আঁচলে-কাঁধে বসতি

আম্মুকে সেদিন রাতে বলেছিলাম, ‘মা, তোমার লাইফ তো ত্যানাময় হয়ে গেছে।’ মা হাসলো, আব্বু তার চেয়েও জোরে হাসলো। মা কড়াই বা হাঁড়ি ধরার কিছু চোখের সামনে রেখেও খোঁজে। সব চাইতে বেশি খোঁজে এবং না পেলে ভীষন পরিমান ক্ষেপে যায় তা হলো আম্মুর ভাষায় ‘লুছুন’! আম্মু ভাতের মাড় পাশানোর পর পাতিলের মুখে এবং মাটির সড়ায় লেগে থাকা শুকিয়ে যাওয়া মাড় না মুছে কোনদিন ভাত বেড়ে দেয় নি আমাদের। শীতের দিনে মা এক টুকরো কাপড়ের উপর পিঁড়ি রেখে বসে রান্না করে, খাওয়ার সময়ও তাই।

আমার মা এমন একটা মানুষ! মাছের পেটি যদি মা’র জন্যে ছেড়ে খাই, তো আম্মু নিজে না খেয়ে ওইটা রেখে দেয়, পরে আমি খাবো বলে। তার চেয়ে আমি ওইটা খেয়ে নিলে, আমি যেটা খেলাম সেটা মা খেতো। মন খারাপ লাগে তখন আরো বেশি।

কোনও কাজ মার ভুল হয় না। এই যে প্রতিদিন রাতে আমার ঘরে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকবে বলে একটুকরা কাপড় বাইরে থেকে দরোজার নিচে গুঁজে দিয়ে যেতে এই মানুষটা একদিনও ভুল করে না। আমার পক্ষে জীবনেও সম্ভব না এত ভালো একজন মা হওয়া।

আমার আম্মুটা না খুব সুন্দর। মাঝে মাঝে চুরি করে তাকিয়ে থাকি আম্মুর দিকে। আম্মু তাকালে চোখ নামিয়ে নেই। এতো সাধারন মানুষ থাকে! খুব প্রয়োজনেও মা আব্বুর কাছ থেকে মুখ ফুটে কিছু চায় না। ছোটবেলায় ঘরে লাইট না দিয়ে ঘুমানে যেতো না আমার জন্যে। ইলেকট্রিসিটি চলে গেলে নিজের চিত্কারে নিজেরই ঘুম ভাঙতো আমার। আমি যখন টেনে তখনও এই বিদঘুটে অভ্যাস ছিলো। ভাবি তো বিয়ের পর প্রথম দিন ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলো! এখন অবশ্য আলোতে ঘুম আসে না। তবে এখনও রাতে আকাশের দিকে তাকালে মা ভাবে আমি ভয় পাবো।

আম্মু দুধপিঠা বানাতে পারে না। মানুষজন নেই বলে একা একা করা হয় না এত কিছু। এবার আমার পরীক্ষার জন্য কোন পিঠাই খাওয়া হয়নি এপর্যন্ত। মা বলে, “আমি আমার জামাইরে টাকা দিয়ে বলবো, ‘বাবা আমি পারি না তো কি করবো। তুমি কিনে খেয়ে নিও’।” আব্বু শুনে হাসে, সাথে আমিও। কিন্তু সে অস্থির হয়ে আছে শ্বাশুড়ির হাতের পিঠা খাবার জন্যে।

আমার মা এখনো আমাকে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়। ভার্সিটিতে যাবার আগে আমি রেডি হই, আম্মু খাইয়ে দেয়। পরীক্ষার সময় তো সকাল দুপুর দুইবেলাতেই খাইয়ে দেয়।তবে মা মাঝে মাঝে একটু রাজনীতিও করে। একদিন আ্যসাইনমেন্ট করতে দেরি হয়ে গিয়েছিলো। আম্মুকে বললাম খাইয়ে দিতে।আমি যেখানে খুব বেশি হলে দুইটা রুটি খাই, আম্মু আমাকে তিনটা খাইয়ে দিয়েছিলো। পেট যতক্ষণে সিগনাল দিলো ততক্ষনে বেশ খানিক দেরি হয়ে গিয়েছিলো। আর ওইদিকে আম্মু হেসেই যাচ্ছে।

আর আব্বু! পারলে আব্বু নিজের গায়ে কষ্ট দিবে, তবু নিজের ব্যবহার্য জিনিসগুলোকে না। আব্বুর কাছে কিছু চাইতে ভয় লাগে, কিন্তু আব্বু চাইলেই দেয়। বছরখানেক আগে একটা ওষুধ খেয়ে পাকস্থলির অর্ন্তভাগ ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার পর থেকে আব্বু এখনো অফিসে যাবার আগে আমার গোসলের পানি তুলে রেখে যায়।

আম্মু আমাদের বমি দেখলে নিজেই বমি করে দেয়। অথচ জন্মের পর থেকে এই বস্তুটা আমার বাবা পরিস্কার করে। জ্বর আসলে তো আমি নাই। একশ দুই মিনিমাম আর চার ম্যাক্সিমাম। কলেজে সেকেণ্ড ইয়ারে থাকতে নাকি একশ পাঁচও উঠেছিল। জ্বর থাকেও মাশাল্লাহ টানা এক সপ্তাহ। মা ছাড়া কেউ নামাতে পারে না আমার জ্বর। অজ্ঞান হয়ে যাই আমি। জ্ঞান ফিরলেই দায়িত্ব পালন করতে হয় আব্বুকে।

ছোটবেলায় একদিন আম্মু দাদিবাড়ি গিয়েছিলো। আব্বু রেখে আসতে গিয়েছিলো। ভাইয়া গিয়েছে প্রাইভেট পড়তে। আমি মনের সুখে লাল রঙের মোমবাতি দেখে জ্বালাচ্ছিলাম আর নিভাচ্ছিলাম।আব্বু সেই দৃশ্য ফিরে এসে জানালা দিয়ে দেখে ফেলে।  তার থেকে এখনো পর্যন্ত আব্বু আমার ঘরে দিয়াশলাই রাখতে দেয় না!

প্যারাপ্লিজিয়া আছে আমার। পাঁচ বছর বয়সে হঠাত্‍ করেই এক সকালে হাঁটতে পেরেছিলাম না। বিছানা থেকে পরে গিয়েছিলাম। তারপর অনেক জ্বর। ছয়মাস রাজশাহী মেডিকেলে কোমর আর হাঁটুতে হিট দেয়ার পর হাঁটতে পারতাম। পায়ের পেশী শক্ত হয়ে গেলে মা এখনও পায়ে সেক দেয়, তেল দেয়, বড় হয়ে গেছি বলে আব্বু এখন আর দেয় না।

আমার খুব ঠাণ্ডা লাগে, আব্বুরও। মা রেগে যায়, ‘আমার পেটে এই পঁচা মেয়ে কিভাবে হইছে! যেমন বাপ, তেমনি বেটি। একটা কিচ্ছু বাদ নাই। বাপের এক্কেবারে অষ্ট অলংকার!’ আব্বুর সাথে যেদিন ব্লাডগ্রুপ টেস্ট করতে যাচ্ছিলাম তখন মা বললো, ‘বি পজেটিভ না হলে যদি কিছু কইছি!’ ব্লাড ব্যাংকের আঙ্কেল টেস্ট করে আব্বুর ব্লাডগ্রুপ জানতে চেয়েছিলো। আঙ্কেল হাসার সাথে সাথে আব্বু বলে উঠলো, ‘আপনার ভাবিও তাইই বল পাঠাইছে।’ বাসায় এসে সে কি হাসি!

আমার ঘরে না ঢুকলে আব্বুর ভালোই লাগে না। ওষুধগুলো গুনতেও ভুল হয় না। ভীষন রকম হিসাবী, ধীর স্থির, কিন্তু রাগী। আব্বুর অবশ্য রাগ দেখাতে হয় না, তাকালেই ফুসসস! আব্বু আর আম্মু যা কিছু করে, যত আদর দেয়, জানি না কিভাবে এটা সম্ভব। এই দুইটা মানুষকে আসলে কিছু ভাষা দিয়ে প্রকাশ করা যাবে না। না শুধু আমার নয়, পৃথিবীর সব মাবাবা-ই এমন।

আব্বু আম্মুকে একটা কথাই বলতে চাই,  ”মা, আব্বু, তোমাদের খুব ভালোবাসি।”

কিন্তু কথাটা কখনোই বলতে পারি নি আজও…

 

পৃথিবীর সব বাবা মা’র জন্য অনেক অনেক শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।

 

অবন্তিকা সম্পর্কে

প্রচণ্ড আলসে আমিটা স্বপ্ন দেখতে খুব ভালবাসি। পড়াশুনার বিষ্যয়বস্তু তড়িৎ প্রকৌশল, কিন্তু রক্তের মাঝে ইলেক্ট্রনের বদলে যে প্রবাহটা পাই সেটা হল স্বপ্ন আর ভালবাসার। ঘরকূণো, চুপচাপ এই আমি বৃষ্টি নামাতেও খুব ভালবাসি। আমার চার প্রকোষ্ঠের ১৩/৯ সেন্টিমিটার জায়গাতেও তার প্রভাব পরে বেশ দারুনভাবে। এতকিছুর পরও কিভাবে কিভাবে যেন মাঝে মাঝে শিমুল তুলা অথবা আকন্দের বীজের মত ভাসতে থাকি কারো এক চাহনির উষ্ণতায়, অথবা অবহেলার উল্টোপিঠের মত অবচেতনে নির্গত গাঢ় নিঃশ্বাসের তোড়ের আভাসে। ...
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে স্মৃতিচারণ-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

26 Responses to আঁচলে-কাঁধে বসতি

  1. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    বাবা মা’দের কথা বলে শেষ করাই যাবে না!

    দারুণ লেখারে!

  2. সামিরা বলেছেনঃ

    লাইক দিলুম। 🙂
    “না শুধু আমার নয়, পৃথিবীর সব মাবাবা-ই এমন।”

  3. অবন্তিকা বলেছেনঃ

    থেঙ্কু ফর লাইক আপ্পি। 😀

  4. স্বপ্ন বিলাস বলেছেনঃ

    “পৃথিবীর সব বাবা মা’র জন্য অনেক অনেক শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।”
    :clappinghands:

  5. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    বাবা-মায়ের কথা কি বলে শেষ করা যায়?
    আমার বাবা-মাও এতো পাগল। মাঝে মাঝে ভাবি, পৃথিবীতে আমার মত এইরকম সৌভাগ্য ক’জনেরই বা আছে? ক’জনের বাবা-মা তাদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু হতে পারে?

    পৃথিবীর সব বাবা-মায়ের জন্য ভালোবাসা। 🙂

  6. রাইয়্যান বলেছেনঃ

    লাইক 🙂

  7. অনাবিল বলেছেনঃ

    প্রিয় বাবা-মা!

    খাইয়ে দেবার প্যারাটা হুবুহু মিলে গেলো…:)

  8. শাহরিয়ার বলেছেনঃ

    আমার বাবা-মা উভয়েই দীর্ঘদিন যাবত অসুস্থতায় ভুগছেন। দু’জনেরই বেশ বয়স হয়েছে। ক’দিন আগে আম্মার একটা মেজর অপারেশন হয়। কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠছিলেন, কিন্তু হঠাতই আবার নতুন কিছু উটকো শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে শুরু করেছে। অপারেশনের পর থেকে প্রায় ২ মাস যাবত উনি আমার বোনের বাসায় আছেন। তাই লেখাটা লেখাটা পড়ছিলাম, চোখ ছলছল করে উঠছিল। 🙁

    লেখাটা ভাল লেগেছে। 🙂

    *** আব্বু আম্মুকে একটা কথাই বলতে চাই, “মা, আব্বু, তোমাদের খুব ভালোবাসি।”
    কিন্তু কথাটা কখনোই বলতে পারি নি আজও…
    পৃথিবীর সব বাবা মা’র জন্য অনেক অনেক শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। *** :love:

  9. হৃদয় বলেছেনঃ

    বাবা মার আদরগুলো খুব আদর করে গল্প আকারে অল্প পরিসরে প্রকাশ করার চেষ্টাটা অনেক ভালো লেগেছে 🙂

    কিছু মানুষের ভালবাসা ছাড়া পৃথিবীতে নিজের অস্তিত্ব চিন্তা করা আদৌ সম্ভব না।এই মানুষগুলোর মধ্যে আব্বু আম্মু আব্বু আম্মুর অবস্থান সবার উপরে।তাই আব্বু আম্মুর আদর প্রসঙ্গে কিছু বলার নেই।

    তবে কিছু কিছু লাইন পড়ে মনে হলো আপনি ‘অসুখকুমারী’ genus এর মধ্যে পড়েন 😛

    tc ছাড়া তো আর কিছু বলার দেখি না,
    tc 🙂

  10. শুকপাখি বলেছেনঃ

    আপু,বলতে পারেন-মায়েরা এত ভালো হয় কেন?
    আমার নিজের মাকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম,তোমরা গর্ভকালীন সময় থেকে প্রসব পর্যন্ত সময় কিভাবে এত কষ্ট সহ্য করো?
    মা শুনে হেসে বলেছিল,বেবিকে কোলে নেওয়ার পরে মায়ের আর কোন কষ্ট থাকে না।সব ভুলে যায় মা।
    খুব ভালো লিখেছেন আপু।

    • অবন্তিকা বলেছেনঃ

      সেজন্যই তিনি “মা”, ভাইয়া!
      “গর্ভকালীন সময় থেকে প্রসব পর্যন্ত সময় কিভাবে এত কষ্ট সহ্য করো?” -এই প্রশ্নটা আমারও আছে, তবে কখনো কাউকে জিজ্ঞেস করা হয় নি।
      আপনার দৃষ্টিভঙ্গি ভাল লেগেছে অনেক! ধন্যবাদ আপনাকে! 🙂 🙂

  11. শুকপাখি বলেছেনঃ

    আপু,আপনি আমাকে তুই বা তুমি করেই বলতে পারেন।আপনি শুনতে কেমন জানি লাগে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।