কখনো বিজয়ের মাসে স্মৃতিসৌধে যায় নি অমি। খুব অবাক করা কথাই বটে! কারণ একুশে ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, ১৪ই ডিসেম্বর কোন দিবসেই ঘরে বসে থাকে না সে। কাউকে না পেলে একাই চলে যায় প্রভাতফেরী কিংবা মিরপুর বধ্যভূমিতে, শহীদদের ফুলেল শ্রদ্ধা জানাতে।
বৃদ্ধ, দরিদ্র মানুষের শীত নিবারণ, তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসা, পথশিশুদের স্কুলে পড়ানো, মানুষকে এসব কাজে উদ্বুদ্ধ করা যেন তার নিত্যনৈমিত্তিক কাজের অংশ। ভার্সিটির পড়াশুনার তুমুল চাপের মাঝেও বন্ধুদের নিয়ে এসব স্বেচ্ছাসেবী কাজ সে করে চলে অবলীলায়।
দেশের প্রতি ওর গভীর আবেগ কাজ করার পেছনের ইতিহাসটা করুণ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ওর পরিবারের ওপর চলে নৃশংস অত্যাচার। মা মারা যান যুদ্ধের সময়। বোনটা লাঞ্ছিত হয় হানাদারদের হাতে। ওর বাবা আর একমাত্র চাচা গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। বাবা ফিরে আসেন নি, চাচা ফিরে এসেছিলেন, পঙ্গু হয়ে।
এত আত্মত্যাগের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা, সেই স্বাধীনতার পূর্ণাঙ্গ রূপটাই অমি খুঁজে ফেরে প্রতিক্ষণ। দেশের মানুষগুলোর ওপর তাই হয়তো এত টান ওর। নিজের আপনজনদের খুঁজে ফেরে স্বাধীন দেশের ছায়ায় পড়ে থাকা নিঃস্ব-অসহায় ওই মুখগুলোর মাঝে। ওদের দুঃখ লাঘবের চেষ্টায় কোন কার্পণ্য নেই ওর।
একটাই বড়বোন আছে অমির। যুদ্ধের সময়কার পাশবিক অত্যাচারের শিকার হয়ে একসময় উদ্ধার হয়ে আসেন নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে। সেখানে একটা মৃত বাচ্চা প্রসব করেন তিনি। তারপর অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পাড়ি দিয়ে একাকী এক জীবন খুঁজে পান, বেঁচে আছেন সমাজের আর দশটা মানুষের মাঝেই, অনেকটা নিঃসঙ্গতার শেকল পরে। তবু পত্রপত্রিকার হেডলাইন হতে সময় লাগে না বছরের একটা সময়ে, ডিসেম্বর মাসে বীরাঙ্গনাদের যে অন্যরকম সম্মানের চোখে দেখা হয়! পেপারে ছবি আর সাক্ষাৎকার ছাপা হয়, দেয়া হয় ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাব। তারপর তাঁরা সময়ের স্রোতে হারিয়ে যায় মানুষের স্মৃতি থেকে। ব্যস্ত জীবনের চাকা মানুষের মৌলিক অনুভূতিতে যেন ফাটল ধরিয়ে দেয়, চেনা মুখগুলোও খুব অচেনা মনে হয়।
অমির চাচা যুদ্ধ শেষে অমিকে কোলে নিয়ে বলেছিলেন,”একটা লাল পতাকা এনেছি বাবা! তোর জন্য এই মাটির অধিকার নিয়ে এলাম! যত্ন করে রেখে দিস, এটা বিজয় নিশান। যতদিন উঁচু করে ধরে রাখতে পারবি, এই মাটির অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারবে না!” সেই লাল নিশানটা খুব যত্ন করে রেখে দিয়েছে অমি। বিজয় নিশান মানে কী তা বোঝার বয়স তখনো হয় নি ওর। চাচা বলেছিলেন ওটা উঁচু করে ধরে রাখতে। তার মানে কী কিছুই বোঝে নি সে। তবে নিশানটাকে বাঁশের আগায় লাগিয়ে মাঠময় দৌড়ে বেড়াতো অমি, ওর গাঢ় সবুজের ভেতরে টকটকে লাল রঙের বৃত্তটা যেন চুম্বকের মত টানতো ওকে।
স্বাধীনতার তিন বছর পর অমির চাচা মারা যান। যুদ্ধে মারাত্মক আঘাত পেয়েছিলেন মাথার বাম পাশটায়, একটা হাত পুরোপুরি অকেজো হয়ে যাওয়ায় কেটে ফেলা হয়। তারপরও কোন রকমে বেঁচে ছিলেন বছর তিনেক, মারা যাবার পর অমিরা ওর খালার কাছে চলে আসে, সেখানেই বড় হয় অমি।
আজকে অমি অনেক বড়, ভার্সিটি স্টুডেন্ট। দেশটা কীভাবে স্বাধীন হয়েছে তার রক্তাক্ত অনুভূতিটা নিজের জীবন দিয়েই অনুভব করতে পারে সে। তবে চাচার রেখে যাওয়া সেই ‘মাটির অধিকার’ কতটুকু ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে……তাই নিয়ে নিত্য প্রশ্ন জাগে অমির মনে। দেশের শাসকেরা আজকে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত, অল্প একটু স্বার্থের জন্য দেশটাকে বিকিয়ে দিতেও কোন কার্পণ্য নেই ওদের। গদি দখলের লড়াইয়ে কে কাকে হারাতে পারে এই প্রতিযোগিতায় মত্ত হয়ে দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর কথা ভুলেই গেছে তারা। যুদ্ধের পর শহীদদের রেখে যাওয়া এই ভাঙাচোরা দেশটাকে শক্ত হাতে গড়ে তোলার মত বলিষ্ঠ কোন হাত এগিয়ে আসেনি, আসলেও টিকে থাকে নি বেশিদিন। ক্ষমতালোভী দালালদের ভীড়ে দেশপ্রেমিক নেতারা হারিয়ে গেছে অতলান্তে। যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আজকের স্বাধীনতা, তাদেরই জীবনের ভগ্নদশা আজকের এই স্বাধীন দেশের বুকে অমির হৃদয়ে নিয়ে আসে গভীর বেদনার ঝড়। ওর বাবার মাটিতে মিশে যাওয়া, মায়ের রক্তে ভেজা এই দেশের বুকে এখনো রাজাকারদের মুক্ত পদচারণা ওকে বিস্মিত করে! কিসের মাটির অধিকার? যেই অধিকার কতগুলো বিদেশী পরাশক্তির হাতে কুক্ষিগত…! যেই অধিকার এখনো দেশের বুক থেকে জারজ মীরজাফরগুলোকে উৎখাত করতে পারে নি! ওরা তো এখনো দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজেদের তকমা ওড়ায়! ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নিয়ে ভোল পাল্টে দেশের মানুষকে আবারো চূড়ান্ত প্রহসনে করছে প্রতারিত!
কোথায় সেই বিজয় নিশান যাতে মাটির অধিকার হবে সুনিশ্চিত? যাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে বাংলার মানুষ গাইবে বিজয়ের গান! আজকে অমির মনে হয়, ওর মত পোড়-খাওয়া কিছু মানুষই কেবল পতাকাটা রক্তের মত লাল করে রেখেছে হৃদয়ে, আর ওই পতাকাটা ঊর্ধ্বে তুলে ধরার মত শক্তিও যেন আবার খুঁজে বের করতে হবে অমিদের। এই মাটির অধিকার আরো দৃঢ় আর শক্তিশালী করে তবেই অমি ঊর্ধ্বে তুলে ধরবে বিজয় নিশান, তার আগ পর্যন্ত যুদ্ধের আগুনটা হৃদয়ে জ্বলতে থাকুক অবিরাম।
-সরল
এই মাটির অধিকার আরো দৃঢ় আর শক্তিশালী করে তবেই অমি ঊর্ধ্বে তুলে ধরবে বিজয় নিশান, তার আগ পর্যন্ত যুদ্ধের আগুনটা হৃদয়ে জ্বলতে থাকুক অবিরাম।
ভালো লেগেছে।
তবে এইটা কোন সময়ের কথা বলছেন? যুদ্ধের সময় মা মারা গেলে এই গল্প তো বেশ আগের। কারণ এখন অমির বয়স ৪১ হবার কথা
এই মাটির অধিকার আরো দৃঢ় আর শক্তিশালী করে তবেই অমি ঊর্ধ্বে তুলে ধরবে বিজয় নিশান, তার আগ পর্যন্ত যুদ্ধের আগুনটা হৃদয়ে জ্বলতে থাকুক অবিরাম।
বিজয় নিশানের মর্যাদা ধরে রাখার জন্য আমরা সবাই লড়ে যাবো। আমাদের যুদ্ধ এখনও শেষ হয়ে যায় নি।
অমির বয়সের ক্ষেত্রে প্রশ্নবোধক চিহ্ন বাদ দিলে পুরো লেখাটা খুব ভালো হয়েছে।
“এই মাটির অধিকার আরো দৃঢ় আর শক্তিশালী করে তবেই অমি ঊর্ধ্বে তুলে ধরবে বিজয় নিশান, তার আগ পর্যন্ত যুদ্ধের আগুনটা হৃদয়ে জ্বলতে থাকুক অবিরাম।”
গল্পটা খুব ভালো লেগেছে। তবে, অমি-র বয়স নিয়ে প্রশ্নটা আমারও।
আসলে লেখাটা লেখার সময় অমির বয়সের কথাটা মাথায় আসেনি 🙁
তবে আজকে থেকে বিশ বছর আগেও দেশের ওই অবস্থা গুলো সত্য ছিল,এখনো আছে!!! খুব একটা উন্নতি হয়নি,বরং কিছু ক্ষেত্রে অবনতিই হয়েছে বেশি । 🙁
এই জায়গাটাতে মনে হয় দুঃখ টা বেশি কাটা দেয় ।