তাতে তোমার কি? আমার চোখে বেয়ে জল নামুক আর আগুন ঝরুক তাতে তোমার কি? তোমার কি তাতে কিছু আসে যায়? তুমি জানো টা কি পৃথিবীর? কেউ আমার চোখ উপড়ে ফেলুক বা সেখানে আঙুলের খোঁচা দিয়ে রক্ত ঝরাক তাতে তোমার আকাশজুড়ে কি আগুনের শিখা জ্বলবে? নাকি তুমি পৃথিবীর সব পাপ মুছে দিতে যুদ্ধে নামবে? কোন প্রমিথিউওস হবে? হু! বিরক্ত করো না। ভাগো এখান থেকে!
আমি খুব চুপচাপ। এতগুলো কথা শোনার পর আর কি সেখানে বসে থাকা চলে? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করি- আমি এমন কেন? আরেকটু ভালো কি হতে পারতাম না? আমি কি পারতাম না তোমার কথা শোনার জন্য রাত বিরাতে জ্যোৎস্নার আলো মেখে ঘুরে বেড়াতে? আমি কত দিন মাউথ অরগান টা নিয়ে একটা সুর তোলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তুমি তো জানি আমার গলাটা যেরকম হেঁড়ে কোন কিছু বাজাতে গেলে সেটাও তারস্বরে চিৎকার করে ওঠে। তাই আমার সে সুর ওঠেনি আর কোন দিনে শোনাতেও পারিনি তোমাকে।
এক রাতে গল্প বলি। আমি ঘর থেকে বের হয়ে এসেছি। কোথাও যাবো এমন কোন উদ্দেশ্য নেই। শুধু বের হতে মন চাইল। ব্যস ! বের হয়ে এলাম। জানোই তো এই নগরীতে রাত মানে অন্য এক জীবনের নাম। ঘট ঘট আওয়াজ করে চলা বিরামহীন শব্দের রাতের বাহন, তীব্র চিৎকারের মত বীভৎস ট্রাকের দম ধরা গতি। শেষ রাতের পাইকারি বাজারের হাক ডাক। যেন রাত্রিও ভুলে গেছে তার বিশ্রাম প্রয়োজন। যেন জীবন কখনও থামেনা, থামবেও না।
আমার দু চাকার মোটরযান। গতি যদি খুব বেশি বাড়ে তবে মনে করো এই ৭০ বা ৮০ কিলোমিটার হোল। কিন্তু তুমি তো জানি আমি কোন কিছুর সাথেই জোরে ছুটে চলতে পারিনা। যখন পৃথিবীর সবাই গভীর ঘুমের ঘরে জীবনের উৎসব করে তখন আমি অপেক্ষা করি নিশব্দ ভোরের পাখি ডাকার জন্য। যদি কখনও শীতল হই তার পর আস্তে আস্তে আমি নিদ্রাদেবির কোলে আশ্রয় খুঁজি।
সেই আমিটা মোটরযানে মধ্য রাতের আওয়াজ ভেঙে ব্যস্ত পাইকারি কাঁচা বাজার থেকে বেরিয়েছি। কিছু দুর যেতে না যেতেই একটা মজার কাণ্ড দেখলাম। একটা মালবাহী ট্রাক। বেশ জোর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। তার উপর দুটো অল্প বয়সের ছেলে। দেখলেই বোঝা যায় রাস্তার টোকাই। ওরা উপর থেকে বেশ কসরত করে মোড়ানো পলিথিন কাটার চেষ্টা করছে। যদি পলিথিন কাটতে পারে তবে ভিতর থেকে কিছু চুরি করে নিতে পারবে। ট্রাকের গতির সাথে পাল্লা দেব এমন কল্পনাও কখনও করিনি। এমনকি ঘুমের মধ্যেও না। কিন্তু ছেলে দুটোর কাণ্ড দেখে কি করে টা দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। পিক আপ বাড়িয়ে দিলাম।
ইতোমধ্যে ট্রাকের লোকজন বুঝতে পেরেছে কিছু একটা হচ্ছে। ওরা দিলো আরো গতি বাড়িয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যে ট্রাক ছাড়িয়ে গেল কাওরান বাজারের ব্যস্ত মোড়। প্রচণ্ড গতিতে ছুটে চলছে। এবার ঐ ছেলে দুটি পড়ল মহা বিপদে। কে জানে এই ট্রাক কোথায় গিয়ে থামবে। পিছনে আসছে আরও একটি ট্রাক। জীবনের সাথে সেও যুদ্ধ করে কিনা তা জানা নেই। কিন্তু গতি দেখলে বোঝা যায় সে বিশ্রাম নেয়নি বহুকাল।
এবার দেখলাম সেই নির্মম সত্য। নিজের দুচোখ কে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ছেলে দুটি কি অসীম সাহসিকতার সাথে ঐ চলন্ত ট্রাক থেকে লাফ দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছে! ট্রাকের পাটাতনের গা ঘেঁষে ছেলে দুটি চলে আসলো ট্রাকের পিছনের দিকে। এখন যদি লাফ দেয় তাহলে রাস্তার উপরে পড়বে। গড়াগড়ি খাবে। মাথা ফাটবে। রক্ত বেরুবে। হয়ত মরেও যেতে পারে। আমার দু’হাত ঠাণ্ডা হয়ে যাবার অনুভুতি টের পেলাম।!
কিন্তু তার চে বড় বিপদ ছিল পেছনের ট্রাকটা। সেও তো পাল্লা দিয়ে চলছিল। আমি ভয়ে হিম হয়ে যাচ্ছি। নিশ্চিত হলাম ছেলে দুটি লাফ দিচ্ছে! তার চে বেশি নিশ্চিত হলাম পেছনের ট্রাকটা গতি না কমালে ছেলে দুটি ট্রাকের চাকার নিচে যাবে। এবার ছেলে দুটি প্রানপনে চিৎকার শুরু করলো পেছনের ট্রাকটাকে উদ্দেশ্য করে। “ এট্টু আস্তে। পড়লে মইরা যাবো’।
জীবন কত কঠিন হতে পারে তার ধারনা আমার কোন কালে ছিল না। আজও নেই। কিন্তু যা দেখলাম। পেছনের ট্রাকটার গতি কমানোর কোনও লক্ষন নেই। আমি নিশ্চিত ছেলে দুটি টোকাই এবং চোর। কিন্তু এভাবে মরতে হবে সে ধারনা ছিল না। কেন জানি মন থেকে একটা প্রার্থনা ছিল ওরা যেন এভাবে না মরে।
দুটো মাত্র পথ খোলা। একদিকে লাফিয়ে রাস্তায় পড়লে ট্রাকের নিচে যাবার সম্ভাবনা। আরেক দিকে ঐ চলন্ত ট্রাকে থেকে পরবর্তী চরম পিটুনি খেয়ে মৃত্যুর কাছাকাছি যাওয়া। কোনটা বেছে নেবে ওরা!? ট্রাক চলে এসেছে শেরাটন হোটেলের কাছে।
এবার ছেলে দুটি একসাথে লাফ দিল ঐ ট্রাক থেকে! ও আল্লাহ। লাফিয়ে পড়েই তাল সামলাতে না পেরে রীতিমত পিং পং বলের মত এদিক ওদিক লাফালাফি গড়াগড়ি খেল। পেছনে ধাবমান ট্রাক। আমার দম বন্ধ হয়ে যাবার মত হল!
ছেলে দুটো রাস্তার উপর। এবার হঠাৎ যন্ত্র দানবের তীব্র চিৎকার। প্রচণ্ড জোরে ব্রেক কষে যখন থামল তখন দুটো ছেলেই ট্রাকটার সামনের দুই চাকার থেকে বড়জোর এক ফুট দূরে। আরেকটা সেকেন্ড সময় গেলে এই দুটো মাথা রাস্তার পিচের সাথে পিশে যেত! আমার শরীরের সব শক্তি তখন শেষ। চিন্তা করার ক্ষমতাও মনে হল কেউ কেড়ে নিয়ে গেছে। রাস্তার বাম পাশে দাঁড়িয়ে গেলাম।
সত্যি যদি ছেলে দুটো মারা যেত! কি আর হত? আমি পরদিন খবরের কাগজের এক কোনায় হয়ত পেতাম-সড়ক দুর্ঘটনায় রাজধানীতে দুই কিশোরের মৃত্যু! একটি চলন্ত ট্রাক কিশোর দুটিকে চাপা দিয়ে যায়!
এমন খবর পড়ে সত্যি কি তোমার দু চোখ ধুয়ে কখনও জল নেমেছে? পবিত্র জল? ভালবাসায় লেখা?
টানটান উত্তেজনা নিয়ে পড়ছিলাম।
হ্যাঁ আমার চোখ দিয়ে জল পড়েছে।
খুবই ভালো লাগল মানুষ ভাই!
কলম চলুক।
টানা পড়লাম, দম আটকে গিয়েছিল…
আমার দম আটকে গিয়েছিল ভাই!
কলমের জন্য আপনার মত বোহেমিয়ান হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। আর মানুষ থাকতে চাই না।
জ্বী, পড়েছে!
ভাল লাগল লেখাটা। 🙂
রুদ্ধশ্বাসে লিখাটা পড়লাম! জীবন মৃত্যুর মাঝে কি ভয়ঙ্কর কম সময়!
দম আটকে আসছিলো। একেবারে শেষ মুহূর্তে বোধহয় দম নেবার একটা সুযোগ পেলাম !
কখনো কি এমন দৃশ্য কল্পনা করতে পারি আমরা কেউ খবরের কাগজে বেরুনো ছোট্ট একটা মৃত্যুসংবাদ পড়ে ?
বাইরে আকাশের বুকে জল আর ঘরের ভেতরে চোখের কোণে জল সব কেমন যেন মিলেমিশে অনুভূতিশূন্য হয়ে যাচ্ছে !
অনেক সুন্দর লেখা। আসলেই জীবন আর মৃত্যুর মাঝে পার্থক্যটা কত অল্প। আর সেই পার্থক্যটা সময়ে সময়ে কত সস্তাতেই পার হয়ে যায়!!
অসাধারণ! জীবন থেকে নেয়া শ্বাসরুদ্ধকর একটা লেখা।
ভয় পেয়ে গেছিলাম!
আমি ভয় পাইনি। কিন্তু হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল!
কত সহজেই না এক একটা জিনিসকে দেখি আমরা, অথচ কত গভীর তীব্রতা লুকিয়ে থাকে তা কারো বোঝা হয় না খবরের শিরোনামকে ভেদ করে…সত্য একটা অনুভূতি!!
অনেকদিন পর পড়লাম লিখাটা। অনেক ভালো লেগেছে পড়তে। কিন্তু চোখে জল আসেনি, একটু বিষন্ন আছি তো। কেমন যেন শূন্য শূন্য লাগলো……