ছায়ার আড়াল, অথবা অভিমানী বৃষ্টির ছেলে

 

সকালের রোদের নিচে হাটতে হাটতে ছেলেটা আনমনেই অনেক কিছু ভাবছিল। চোখেমুখে তন্ময়তা এতটুকুও আড়াল ছিল না। ভাবনাটুকু সঙ্গী করে হাটতে হাটতে পথের শেষ প্রান্তে চলে এল সে। সেখানে তার জন্য ওৎ পেতে ছিল গাঢ় অভিমানী ছায়ার দল। ছায়াগুলো তাকে গ্রাস করতে চাইল। ছেলেটা পিছন ফিরে চেয়েছিল। তার পদচিহ্ন গুলো রোদের আলোয় জ্বল জ্বল করছিল। ছেলেটা হেসে ফেলল আকাশের দিকে তাকিয়ে। এক খন্ড ধুসর মেঘ এসে যেন দাড়িয়েছে তার মাথার উপর। অথচ একটু আগেই তপ্ত রোদে পুড়ছিল সবটা রাস্তা। এইতো, একফোটা বৃষ্টিও কোথা থেকে এসে পড়ল তার গায়ে! বৃষ্টি ফোটার সন্ধানে আকাশের দিকে ফিরে চাইল ছেলেটা। এক খন্ড মেঘটা নেমে এল তার অনেক কাছে। মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাত ই মনে পড়ে গেল সব কথা… যে কথা গুলো প্রায় ভুলিয়ে দিতে চেয়েছে গ্রীষ্মের প্রখর সুর্য্যালোক আর অপসারী রোদের রং। রোদের নিচে হাটতে হাটতে ছেলেটা ভুলেই গিয়েছিল, সে বৃষ্টির ছেলে…

 

– – – – – – – – – –

 

এক

“ছায়াগুলো আমাকে ঘিরে ধরে। ফিসফিসিয়ে কি যেন বলতে চায়। অনেক অভিমান ওদের চোখেমুখে…” ডেস্কের ওপারে চেয়ারে বসে কথা গুলো বলছিল ছেলেটি। লম্বা মুখ, ঝাকড়া চুল, কোকরানো। একহারা গড়ন। শান্ত অথচ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার চোখে। দৃষ্টির ভেতরে কেমন একটা সম্মোহনী ভাব আছে। রুপক নাম ছেলেটার। আমার নতুন পেশেন্ট।

“আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না ডক্টর।” শান্ত অথচ গাঢ় স্বরে বলল রুপক। “করার কথাও না। বিশ্বাস হতে পারে এমন কিছুই বলছিনা আমি। চাইলেও বলতে পারবো না। কারণ আমি বানিয়ে বলছিনা কিছু। কিন্তু আপনাকে সত্যিটা বলা ছাড়া আর কিইবা করার আছে আমার?…” আরও অনেক কিছু বলছিল রুপক, আমি শুনতে পাচ্ছিলাম না। আমি ওর হাত নেড়ে কথা বলাটা দেখতে পাচ্ছিলাম, মানে চোখে ভাসছিল। কিন্তু, ভাবছিলাম অন্য কথা। বয়স বেশি না ছেলেটার। মাত্র ২১। সিজোফ্রেনিয়াক* বলে আপাতত সন্দেহ করছি। কিন্তু ওর কথাবার্তায় কল্পনার লেশমাত্র নেই। চোখের দৃষ্টি বলে দিচ্ছে, যতটুকুই ও বলছে, মিথ্যে নয়। আমার এখানে রুপককে নিয়ে এসেছেন ওর বাবা। খুব বেশি দিন হয়নি সাইকিয়েট্রি তে ঢুকেছি। এরকম কেস আগে দেখিনি।… আমার চিন্তার রাশ টেনে ধরল রুপক। “আজ তাহলে উঠি?” সেই শান্ত অথচ দৃঢ় কন্ঠস্বর। “নিশ্চয়ই। ভাল থাকবেন।” উঠে দাড়াল রুপক। “আমার সমস্যাটা কি, ধরতে পেরেছেন?” মৃদু হাসল সে। আমাকে স্বীকার করতেই হল, দৃশ্যমান কোন অসুস্থতা আমার চোখে পড়েনি। রুপক চলে গেল। অদ্ভুত একটা ছেলে। চলা ফেরা কি আশ্চর্য রকম শান্ত! ওর ব্যপারে যতটুকু জানলাম, তাতে এই আচরণ, অস্বাভাবিক কথাবার্তা বলার কোন কারণ খুজে পাওয়া যায় না। পড়ালেখার পাশাপাশি রুপক গান ভালোবাসে। ছবি আকতে আর টুকটাক লেখালেখির আগ্রহও আছে বলে শুনেছি। ওদের বাড়িতে একদিন যেতে পারলে হত। হয়ত কিছু জানতে পারতাম। এমন কিছু, যেটা আমাকে ওর চিকিৎসা করতে সাহায্য করবে।

 

দুই

সকাল থেকেই আকাশের মন খারাপ, তাই মুখটা কালো করে রেখছে সে। রোদ কে একবারের জন্যও নিজের আড়াল থেকে বেরোবার সুযোগ দেয়নি মেঘের দল। আমি এখন বসে আছি রুপকদের বাসায়, ওর বেডরুমে। সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো ঘর। ঘর লাগোয়া ছোট্ট একটা ঝুলবারান্দা। দোতালা বাসা রুপকদের। রুপকের বয়স যখন ৭ বছর, তখন একটা দুর্ঘটনায় ওর মা মারা যান। তার পর থেকেই বদলে গেছে রুপক। ভয়ঙ্কর রকমের শান্ত হয়ে গেছে। সবার সাথে ঠিকমত মিশতে চায় না। নিজের জগত টাকে আর সবার জগত থেকে আলাদা করে নিয়েছে। রুপকের বাবা বহু চেষ্টা করেছেন সন্তান কে বোঝার, কিন্তু কিছুই করতে পারেন নি।

আমি রুপকের কবিতার খাতা নাড়াচাড়া করছিলাম। রুপক এল বেশ কিছুক্ষন পর। “আপনার লেখার হাত কিন্তু দারূণ। বলিষ্ঠ লেখনী।” বললাম আমি। রুপক একটু লজ্জা পেল যেন। “এই একটু আধটু লেখার অভ্যেস আছে। স্মিতহাস্যে বলল।”

দেয়ালে বড় করে বাধানো রুপকের মা’র ছবি। খেয়াল করে দেখলাম, রুপকের দেখতে ওর মা’র মত। আমাকে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে রুপক কিছু একটা বলতে মুখ খুলছিল, ঠিক তখনি আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামন। রুপকের সাথে আমার চোখাচোখি হল। ওর চোখে আচমকা একটা আনন্দের শিহরণ বয়ে যেতে দেখলাম। আমাকে অবাক করে কিশোর ছেলেদের মত দৌড়ে রুপক বারান্দায় গিয়ে দাড়াল। বৃষ্টির রাজ্যে হারিয়ে গেল যেন সে! অন্য কোন দিকে খেয়াল নেই। বৃষ্টিফোটা গুলো যেন তাকে আড়াল করে ফেলছিল! তার তন্ময়তা ভাঙ্গল বৃষ্টিটা একটু ধরে এলে। পুরোটা সময় আমি বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম, দরজার পাশে। আমারো যে একটু আধটু ভিজতে ইচ্ছা করছিল না তা কিন্তু নয়! কিন্তু আমার তো বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করেনা কখনো। আজ তবে কি হল?

রুপকের লজ্জিত কন্ঠস্বরে ভাবনার জাল ছিড়ে গেল। “এই যা! আপনাকে দাড় করিয়ে রেখেছি!” আমি বাধা দিয়ে বললাম, “না না, ঠিক আছে। আমি নিজেই এসেছি। আপনাকে দেখতে খুব ভাল লাগছিল। বৃষ্টি বুঝি খুব পছন্দ করেন আপনি?” রুপক হাসল। “হ্যা। অনেকে! ছোটবেলা থেকেই। আমার মা খুব ভালবাসতেন বৃষ্টি। আমাকে কখনোই বৃষ্টিতে ভিজতে বারণ করেনি মা। বরং উতসাহ দিয়েছে। এজন্যই বোধহয় ছোটবেলা থেকে আমার কখনো জ্বর হয়নি। অসুখ খুব কম হয় আমার।”

কথা বলতে বলতে আমরা আবার ঘরে ঢুকে পড়েছি টের পাইনি। রুপক আমাকে বলল “বসুন আমি কফি নিয়ে আসছি। দুধ ছাড়া, চিনি বেশি।” আমি চমকে উঠলাম। “আমি ব্ল্যাক কফি খাই, চিনি বেশি। একথা কি আপনাকে আগে কখনো বলেছি?” রুপক হাসল। “না বলেন নি।” “তাহলে আপনি কিভাবে জানলেন?” “মনে হল।” মৃদুহাস্যে বলল রুপক।

আমি রুপকের ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। ঘর বটে একখানা! এত সুন্দর গোছানো পরিপাটি ঘর আমি খুব কমই দেখেছি। দুদিকে দুটো জানালা, একটা ঝুলবারান্দা। প্রতিটি জিনিসে যত্নের ছাপ। স্টাডি টেবিলে একটা আধখোলা বই। খাটের পাশে একটা গীটার, আলো পরেছে ওটায়। বুকশেলফে থরে থরে সাজানো নানারকম বই। আমি দেখছি আর অবাক হচ্ছি। এমন সময় রুপক এল দুটো মগে কফি নিয়ে। “আর কিছু? না না! অত আপ্যায়ন করতে হবে না। চলুন বসি।”

আবার বারান্দায়। গার্ডেন চেয়ারে বসলাম আমরা। রুপক নিজে থেকেই বলতে শুরু করল, “মা মারা যাবার পর থেকে আমি অনেক বদলে গেছি। কারো সাথে সেভাবে মিশি না। ক্লাসের সময়টা বাদে ঘরেই থাকি। এ ঘরটাই আমার জগত। আসলে মাই ছিল আমার একমাত্র বন্ধু। ছোটবেলা থেকে মা খুবই আগলে রাখত। মাকে ছাড়া আমার একমূহুর্তও চলত না। মা যখন চলে গেল, সে শুন্যতাটা আমি আর কোন কিছু দিয়েই পুরণ করতে পারিনি। কখনো পারবোও না জানি।” রুপকের চোখে জল দেখলাম। একটু আগেই বৃষ্টি ধরে গিয়ে রোদ এসেছিল। কিন্তু আবার আকাশে মেঘ ঘনিয়ে এল। আমরা ভেতরে চলে এলাম। “ইয়ং ম্যান, ভেঙ্গে পড়লে চলবেনা। কিছু কিছু ক্ষতি এমনও থাকে যা কখনোই পুরণ করা যায় না। কিন্তু তারপর ও আমাদের বেচে থাকতে হয় সবকিছু মেনে নিয়েই। আপনাকেও পারতে হবে। আমরা আছি আপনার পাশে। আমরা সবাই আপনাকে সাহায্য করবো।”

রুপকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তায় নামলাম। অদ্ভুত ব্যাপার, খানিক আগেই মেঘ ঘনিয়ে এসেছিল আকাশে। এখন কিছুই নেই। আমার রোদ উকি দিয়েছে। রুপক কে তো বলে এলাম সাহয্য করব। কিন্তু কি সাহায্য করব! আমি তো কোন ক্লুই পেলাম না। প্রথমদিন আমার চেম্বারে বসা রুপক আর এই রুপক পুরোপুরি আলাদা দুজন মানুষ মনে হচ্ছে আমার…

 

তিন

খুব ব্যাস্ত দিন যাচ্ছে। একসপ্তাহ মত কেটেছে রুপকদের বাড়ি যাবার পর। গতকাল রুপকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। রুপক আসেনি। ফোনও করেনি। যখন ভাবছিলাম আমিই ফোনটা করবো কিনা, তখনই রুপক এসে দাড়াল চেম্বারের দরজায়।

আসব?

-নিশ্চয়ই! কেমন আছেন বলুন?

ভাল। তবে

-তবে কি?

ছায়া গুলো আমাকে ডাকছে। ওরা আমাকে কোথাও নিয়ে যেতে চায়। আমি ঠিক করেছি যাব।

-দেখুন রুপক আপনাকে এখনো মেডিকেট করিনি আমি। আমার মনে হয় মেডিকেশন পড়লেই আপনি সুস্থ্য হয়ে উঠবেন। এগুলো আপনার ভ্রম ছাড়া আর কিছু নয়।

ডক্টর, আমার কোন রোগ হয়নি। আর সেজন্যই এর কোন চিকিতসা করাও সম্ভব না। আমাকে ওরা ডাকছে। এখনই সময়। আমাকে যেতে হবে। হয়ত আপনার সাথে আর কখনো দেখা হবে না। ভাল থাকবেন, ডক্টর!

কথাগুলো বলল রুপক তার স্বভাবসুলভ দৃঢ়তায়। তারপর আর এক মূহুর্ত দাড়াল না সে। বেরিয়ে গেল। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম…

 

চার

রুপক চলে যাবার পরদিনই আমি ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম। আসলে আমি যেতে চাইনি, কি যেন আমাকে টেনে নিয়ে গেল। মনে হচ্ছিল যেতেই হবে। ভাবতে ভাবতেই ওদের বাড়ির দরজায় পা দিয়ে ফেলেছিলাম। ওর রুমে নিয়ে গিয়েছিলেন ওর বাবা’ই। একদিনেই ভেঙ্গে পড়েছেন অসম্ভব। আমাকে একা রেখে চলে গিয়েছিলেন তিনি। আমি আবারো সেই ঘরের ভেতরে… শুধু রুপক নেই। বাকি সব কিছু যেমন ছিল তেমনি আছে। সাজানো, ছিমছাম, পরিপাটি। কি যেন ভাবতে ভাবতে আমি রুপকের ডায়েরীটা তুলে নিয়েছিলাম। খুলে পড়াও শুরু করেছিলাম।

 

২ জানুয়ারী

আসলেই কি যা দেখছি ওগুলো ঠিক নাকি আমার মস্তিস্কের অতিকল্পনা? বিশ্বাস করাও শক্ত। কাউকে বলতেও পারছিনা।

৫ জানুয়ারী

আমি নিশ্চিত, কিছু একটা ঘটছে আমার সাথে। রোদের ভেতর অত্তগুলো ছায়া আমার চারপাশে কি করছিল? রাস্তা তো ফাকাই ছিল। নাকি পাগল হয়ে যাচ্ছি?

৯ জানুয়ারী

আমি এখন জানি ওই ছায়াগুলো কি! ওরা কেন এসেছে… কিন্তু ওরা যা চায় সেটা তো আমার কাছে নেই!

১০ জানুয়ারী

আজ ছায়াগুলোর সাথে একটুকরো মেঘও ছিল। পুরোটা সময় জুড়েই। বাইরে বের হওয়া বন্ধ করে দেব নাকি?

১২ জানুয়ারী

মা বলেছিল, বৃষ্টির ভেতর নাকি তাকে খুজে পাবো আমি। যখনই বৃষ্টি হবে, মা নাকি আমাকে দেখতে আসবে। ভেবেছিলাম মা বুঝি প্রবোধ দিয়েছে আমাকে। কিন্তু না! মা সত্যি বলেছিল!

১৪ জানুয়ারী

এখন আমি জানি, আমি কি! আমি বৃষ্টির ছেলে, বৃষ্টি আমার মা! তাই যখনই আমার মন খারাপ হয়, তখনই বৃষ্টি নামে। মা আমায় দেখতে আসে। আমি মায়ের হাত ধরে হাটি। মন যখন ভাল থাকে তখন কেন মা আসেনা?

১৭ জানুয়ারী

রিআর সাথে ঝগড়া হল। মা’র পর সারা জীবনে আমার একটাই ভাল বন্ধু ছিল, একজনই ছিল যে আমাকে বুঝত! আসলে আমি ওভাবে বলতে চাইনি। ওই তো আমাকে পাগল বলল। আমার মা’কে অপমান করল। আমি ওকে কখনই ক্ষমা করব না।

২০ জানুয়ারী

ডায়েরী লেখা ছেড়ে দিতে হবে দেখছি। বাবা আজ চুরি করে আমার ডায়েরী পড়ে ফেলেছে। বাবার ধারণা আমার মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে… আমাকে নিয়ে কাল সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাবে বলল। যাব নাকি? ভাবছি যাব। মন বলছে যেতে হবে।

২১ জানুয়ারী

ডক্টর মানুষটা ভালই। আর যাই হোক সবার মত আমাকে পাগল ঠাউরে বসেনি। আমার কথা গুলো মনযোগ দিয়ে শুনেছে। বিশ্বাস করেছে বলে মনে হয়না। অবশ্য বিশ্বাস করা শক্ত। আমার সাথে যা ঘটছে সেটা তো আর সবার সাথে ঘটেনা!

২৫ জানুয়ারী

আজ রিআ ডেকেছিল। গিয়েছিলাম। অনেক কথা বলল ও। ক্ষমা চাইল। কিন্তু আমি তো বাড়াবাড়ি রকম একগুয়ে। এত সহজে তো আমি ক্ষমা করি না। ওকেও করব না। সেদিন বিকেলের স্নিগ্ধতম হাসিটা তাকে উপহার দিয়েছিলাম আমি। তারপর ঘুরে দাড়িয়েছিলাম, ফেরার সময় হয়ে গ্যাছে। আমার শরীর জুড়ে বৃষ্টি খেলা করতে শুরু করেছে ততক্ষণে… আমি নিষ্ঠুর হয়ে গ্যাছি! আশ্চর্য্য লাগছে, ওর সাথে এত নিষ্ঠুর আচরণ আমি কিভাবে করছি!

আমি আর পড়তে পারছিলাম না! রোগটা দেখি ওর মধ্যে বেশ ভালভাবেই শেকড় গেড়েছিল। আমিই বুঝতে পারিনি কিছু। আমার ই ব্যার্থতা… ডায়েরীটা বন্ধ করে বাইরে তাকিয়ে দেখি সন্ধ্যা নেমেছে। চলে এসেছিলাম আমি রুপকদের ওখান থেকে।

 

তারপর কেটে গেল বেশ কিছুদিন। কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। হঠাত একরাতে দেখলাম স্বপ্নটা…

জলে ভেজা কাদা জড়ানো পায়ে সবুজে ছাওয়া পথে ছুটে চলেছে একটা ছেলে। তার চোখের তারায় জোনাকের আলোর মত ঝিকমিক করছে স্বাধীন আকাশের প্রতিচ্ছবি। মাঠ পেরিয়ে, ফসলের ক্ষেত পেরিয়ে পথের আরো গভীরে ছুটে চলছিল সে। শেষ বিকেলের এক মুঠো আলোকে সঙ্গী করে সে ছুটে চলছিল, আশ্চর্য, তার পথচলায় কোন ক্লান্তি ছিলনা! সূর্য্য হেলে পড়েছে। ছুটতে ছুটতে দিগন্তের দিকে ফিরে চাইল ছেলেটা, হঠাত থেমে দাঁড়াল। ঠোটের কোণে ফুটেছে এক টুকরো অপার্থিব হাসি…

ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘড়ি দেখলাম চারটা বত্রিশ। বাকি রাতে আর ভাল ঘুম এলনা।

পরের দিন থেকে প্রতি রাতেই দেখতে থাকলাম স্বপ্নটা। বারে বারে। একই স্বপ্ন, একই সময়ে। কেন? এটা তো কাকতালীয় হতে পারেনা! অনেক ব্যখ্যা দেয়া যেতে পারে, কিন্তু কোন ব্যখ্যাই আমার কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছিল না! তবে এটা কি কোন ধরণের সংকেত? কিসের? কি বুঝব আমি এখান থেকে? রোজ রাতে একই স্বপ্ন দেখছিলাম আমি। ঘুম ভেঙ্গে গেলে আর ঘুমাতে পারছিলাম না অজানা আশঙ্কায়। আচ্ছা এটা কি টেলিপ্যাথি? রুপক কি আমাকে কিছু বলতে চায়? তাই যদি হবে তাহলে সে নিজে বলল না কেন? চলে গেল কেন? উফফ! আমি আর ভাবতেও পারছি না।

আজ সকাল থেকে চেম্বারে বসে আছি। ভাবার চেষ্টা করছি, কিন্তু কিছুই ভাবতে পারছি না। এভাবে আর কতদিন? আর কত রাত আমি এভাবে স্বপ্ন দেখব? নিজের ভেতরেই ভয় দানা বেধে উঠছে। এভাবে আর কিছুদিন চললে আমার নিজেরই সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে হবে।

লাঞ্চ আওয়ার পার হয়ে যাচ্ছে। আজ রোগী নেই তেমন। লাঞ্চ করতে যাবার জন্য চেয়ার ছেড়ে উঠতেই জমে গেলাম। আমার চেম্বারের দরজা দিয়ে শান্ত পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে একজন। রুপক!!!

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। রুপক কাছে এসে চেয়ার টেনে বসল।

-আপনি!

~কেমন আছেন ডক্টর?

-কোথায় চলে গিয়েছিলেন আপনি?

~কোথায় আবার! বৃষ্টির দেশে! আমি এখন বৃষ্টি নামাতে শিখে গ্যাছি!

রুপক হাসছে। ওর হাসিটা স্নিগ্ধতায় ভরা না। অন্যরকম। এটা আমার চেনা সেই রুপক না! অন্য রুপক!

রুপক উঠে এসে আমার পাশে দাড়াল। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল- ডক্টর, বৃষ্টি নামানো শিখবেন? আমি কিন্তু চাইলেই আপনাকে শিখিয়ে দিতে পারি…

নাহ! ওইতো রুপক চেয়ারে বসে আছে। হাসছে। ওর হাসিটা স্নিগ্ধতায় ভরা না। অন্যরকম… আমার মাথার ভেতরটা দুলে উঠল। কেমন যেন বোধ হচ্ছে। চারদিকে অনেক শব্দ… চিৎকার, মানুষের কথা। এখন বোধহয় অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন ও শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু আমার সামনে তো রুপক বসে আছে। আমার সামনে পেছনে, সব জায়গায় রুপক। আস্তে আস্তে তাদের সংখ্যা বাড়ছে… আরে! এত রুপক আসল কোত্থেকে……?

 

 

(শেষ)

ফ্লাইং ডাচম্যান সম্পর্কে

সীমাবদ্ধতা গুলোর কথা ভেবে কষ্ট পাই। আমি নিয়ম ভাঙ্গার দলে। কিন্তু আমাদের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ... যদি তা না হত, তবে মহাসৃষ্টির সব রহস্য থাকত আমাদের নখদর্পণে। নিয়মের বেড়াজাল ভেঙ্গে ছিন্ন করতাম। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা তো হতে দিতে পারেন না। তাই তিনি আমাদের বাধলেন নানারকম অনুভূতির জালে... পথ রুদ্ধ করলেন জরা, শোক, মৃত্যু ইত্যাদি দিয়ে... তবুও আমি নিয়ম ভাঙ্গার দলে...
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে গল্প-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

26 Responses to ছায়ার আড়াল, অথবা অভিমানী বৃষ্টির ছেলে

  1. সরব! ভালই লাগছে। তাই নিজেও সরব হলাম। নিয়মিত হবার নিশ্চয়তা দিতে পারি না। তবে মাঝে মধ্যে অবশ্যই আসা হবে। 🙂

  2. সামিরা বলেছেনঃ

    সরবে স্বাগতম! :welcome:
    আপনার এই লেখাটা সামহোয়্যারেও পড়েছিলাম মনে হয়। 🙂

  3. অরণ্য নীলিন বলেছেনঃ

    স্বাগতম :welcome:

  4. বোকা মানুষ বলেছেনঃ

    মুগ্ধ করা শব্দ গুলো। অসাধারণ!!

  5. বাবুনি সুপ্তি বলেছেনঃ

    বৃষ্টি পরছে এখন। ঠিক তখনই বৃষ্টির গল্প 🙂 দারুন লাগল

  6. ইয়াদ বলেছেনঃ

    :welcome:

  7. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    :welcome: সরবে স্বাগতম!

    চমৎকার লাগল গল্পটি।
    নিয়মিত হবার আহ্বান থাকল।

    • ভাইয়া আপনার মত অনেকেই (যারা আমার সময় ব্লগিং করতেন) সামু পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছেন। অচেনা মুখের ভীড়ে সামু অনেক অপরিচিত লাগে আজকাল। তাই পরিচিত ব্লগারদের খুজে ফেরা!

      নিয়মিত ঢু মারার নিশ্চয়তা দিতে পারি আপাতত। 🙂

  8. শিশিরকণা বলেছেনঃ

    :welcome: সরবে স্বাগতম!
    অনেক অনেক অনেক ভালো লাগলো গল্পটা….
    সুন্দর লিখা পড়ার তৃষ্ণা মিটাতে আপনাকে নিয়মিত হবার আহ্বান নয় , অনুরোধ করছি | আশা করি অনুরোধ রাখবেন….

  9. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    অসাধারণ ! এক নিঃশ্বাসে পড়লাম !

    সরবে স্বাগতম :welcome:

  10. সরবে স্বাগতম ভাইয়া! :welcome:

    লেখাটা পুরোটাই মুগ্ধ হয়ে পড়েছি, অদ্ভুত মনকাড়া……
    নিয়মিত আপনাকে পাবো আশা করি! 😀

  11. প্রজ্ঞা বলেছেনঃ

    সরবে স্বাগতম ভাইয়া!

    এরকম আরও অদ্ভুত সুন্দর গল্প পড়ার সুযোগ পাবো, আশা রাখছি! 🙂

  12. নীল বলেছেনঃ

    অসাধারন লেখা এবং অসাধারন লেখনী! :welcome:

  13. নিলয় বলেছেনঃ

    :welcome:

    দারুণ লাগলো! আরো লেখা চাই :clappinghands:

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।