তোর মামনির জন্য সময়টা খুব কস্টের হয়ে গেল। নতুনের আগমনে নানা পরিবর্তন, নানা নিয়মকানুন আর বাসায় একা একা অলস সময় কাটানো আসলেই কস্টের। আমার অফিস থেকে আসার আগ পর্যন্ত পুরোটা সময় তাকে একা থাকতে হয়, মাঝে মাঝে তোরা দাদী, নানি অথবা মামীর সাথে কথা বলা এই তার কাজ। সবসময় ছুটোছুটি আর নানা কাজে ব্যস্ত থাকা একটা মানুষের জন্য এভাবে সময় কাটানো অনেক কস্টের , তোর জন্য সেটা সে হাসিমুখেই মেনে নিয়েছিল। কিন্তু শারীরিক পরিবর্তনগুলোর সাথের খাপ খাইয়ে নেয়া আসলেই অনেক কস্টের। তার অনেক কস্ট হচ্ছে বুঝতে পারলেও আমার আসলেই কিছু করার ছিলনা। অফিসে আমিও কেমন যেন একটা আনমনা সময় পার করছিলাম। মনে মনে সারাক্ষনই আমি তোর সাথে কথা বলি। কতশত কথা, সব ইস্যুতেই। তোকে নিয়ে কত ভাবনা- খোলা মাঠে কাঁদা দেখলে ভাবি একটু বড় হলেই তোকে এমন কাঁদার মাঝে ছেড়ে দিব গড়াগড়ি খাবার জন্য, তোর মা নিশ্চিত হৈচৈ শুরু করে দিবে, তবুও আমি করব এমনটা , তোকে যে মাটির কাছাকাছি যেতে হবে, মাটির মানুষের কাছাকাছি। জীনবনটাকে শুধু ইট পাথরের জঙ্গলে আবদ্ধ করে রাখলেত চলবেনা।পৃথিবীটাকে জানতে হবে চিনতে হবে , আর তার জন্য মাটির কাছে যাওয়া যে সবচেয়ে জরুরী।
আমার ভয়ও করে, তোর মামনির জন্য, পরিবর্তনটা তার জন্য অনেক কস্টের হয়ে গেছে। তার কস্টটা আমার সহ্য হচ্ছেনা, কেমন শুকিয়ে গেছে সে । আবার আমার সাথে যখন সময় কাটায় তখন তোকে নিয়ে তার নানা উচ্ছাস ঝড়ে পরে। তোর মার ধারনা তুই ছেলে হয়ে জন্ম নিবি, আমার কাছে জানতে চায় আমার কি পছন্দ। আমি হাসি, আর বলি আল্লাহর কাছে আমার চাওয়া একটা সুস্হ সন্তান, যে হবে উত্তম চরিত্রের অধিকারী। তবুও তোর মা জোর করে কিছু একটা বলতে, আমি হাসি। তুই ছেলে বা মেয়ে যাই হসনা কেন সেটা নিয়ে আমার কোন ভাবনা নেই, আমার ভাবনা তোর মাকে নিয়ে সে যেন সুস্হ থাকে সব সময়, তোকে নিয়ে- সুস্হ ভাবে তোকে যেন আমরা আমাদের মাঝে পাই। তোর দাদা দাদী তোর মাকে নিয়মিত প্রর্থনায় করার জন্য অনেকগুলো দোয়া শিখিয়ে দেন ফোনে, তোর মার কথা অনুযায়ী সূরা ইয়াসিন তেলাওয়াত করে আমি তাকে ফু দিয়ে দিই, আর মনে মনে আল্লাহর কাছে তোদের দুজনের সুস্হতা কামনা করি। তোর মামীর সাথে বলতে গিয়ে বলে ফেলি, তোর দাদা দাদীর চরম উচ্ছাসের কথা, বলি ওদের এই অনুভূতি অন্যরকম, পরিবারে, এমনকি আমাদের দিকের আত্মীয় স্বজনের মাঝে তুইই হচ্ছিস তৃতীয় প্রজন্মের প্রথম জন, পরিবারের প্রথম নাতনী। বলেই না আমি নিজে নিজে মনে হেসে উঠি, আরে , একি আমি কি মনে মনে মেয়ের কথা ভাবছি। না পরক্ষনেই নিজের মন জাচাই করে দেখি- আমার যেকোন টাতেই চলবে, আমার সন্তান এটাই হচ্ছে আসল কথা, মনের মত করে গড়ে তুলব তোকে এই ভাবনা নিরন্তর।
তোর মামনির শরীরটা হঠাৎ করে খুব খারাপ হয়ে যায়। বাসায় তাকে এভাবে একা রাখা ঠিক হচ্ছেনা দেখে তোর মামী এসে তকে সাথে করে নিয়ে যায়। সেখানে তোর নানীও আছে, কাজেই তোর মামনির টেক কেয়ারটা ভালভাবেই হবে। তোর মামনী কান্না করে, আমাকে একা রেখে সে যাবেনা, কিন্তু আমাদের আর অন্য কোন উপায়ও যে নেই, তোর দাদা দাদী এসে যে থাকবেন সেটাও সম্ভবনা।
সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে আমার খুব খারাপ লাগে, একা একা লাগে, তোর উপর কিন্তু হালকা রাগও করি, তোর কারনে আজকে তোর মামনি আমার থেকে দূরে, শুধুমাত্র তোর ভালর জন্য । তোর মামনি যখন অফিসে যেত তখন সকালে তাকে বিদায় দিয়ে আমি অফিসে যেতাম, আর সন্ধ্যায় দুজন একসাথে ফিরতাম। জব ছেড়ে দেয়ার পর সে আমাকে বিদায় দিত আর হাসিমুখে সন্ধ্যায় দরজা খুলে দিত। এখন সব বদলে গেল। আমি একা থাকি, নিজেই তালা খুলে ঘরে ঢুকি, আমার ভাল লাগেনা। তোর মা বুঝতে পারি অস্হিরতায় ভুগে, আমাকে একা রেখে যেতে তার ভাল লাগেনি, এখনও লাগছেনা – কিভাবে আছি এই নিয়ে ভীষন টেনশন, ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করছি কিনা এই নিয়ে নানা চিন্তা। এতকিছুর পরও আমি কিছুটা স্বস্তিতে থাকি তোর মাকে নিয়ে, তার পাশে অন্তত দেখাশোনা করার অনেকেই আছে এই ভেবে।
এমন সময় চিটাগং থেকে খবর এল তোর দাদাভাই ভীষন অসুস্হ……….
তোর মাকে রেখে আমি চিটাগং যাবার গাড়িতে উঠলাম। তোর দাদা ভাই কোন কথা বলতে পারছেননা, অচেতন হয়ে গেছেন, তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হল, আত্মীয় স্বজন -আমার বন্ধুরা সবাই হাসপাতালের আইসিউর সামনে অপেক্ষমান । আমার বন্ধু জামিল আসার পর তাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষন কাঁদলাম – নিজেকে এত অসহায় আর কখনো মনে হয়নি, বিশাল একটা ছাতার মত আমার কাছে তোর দাদা ভাই, অনেক ভাল বন্ধুও বটে। সব কিছুতেই তার সাথে আমার আলোচনা হয়, পরামর্শ করা হয়। অচেতন হয়ে তিনি শুয়ে আছেন, আমি আইসিইউর সামনে বাইরে বসে আছি। রাতে সবাইকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে আমি থেকে গেলাম, আমার পৃথিবীটা এত ভঙ্গুর মনে হচ্ছিল সেটা কাউকে বোঝাতে পারবনা, চরম অসহায় আমি একদিকে তোর দাদাভাই আরেকদিকে তুই সহ তোর মামনি । কারো জন্য আমি কিছু করতে পারছিনা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা ছাড়া – হাসপাতালের বারান্দায় বসে একা একা অশ্রু বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছি।
তোর মামনির অবস্হাও ভাল না। তোকে শরীরে স্হান দেয়ার ফলে প্রাথমিক জটিলতাগুলো তাকে বেশ কাবু করে ফেলেছে। পরিবর্তনগুলো শরীরের সাথে এডজাস্ট হতে সময় লাগবে আর ততদিন তাকে বেশ কস্ট ও সহ্য করে যেতে হবে। তদুপরি তোর দাদা ভাইয়ের এমন অবস্হাও তার জন্য বেশ কস্টকর। মেনে নেয়া টাফ !!!
শৈশবে তোর নানাকে হারানোর একটা অপূর্ণতা রয়ে গেছে তোর মামনির জীবনে। পিতৃস্নেহের সে জায়গাটুকু সে খুজে নিয়েছে তোর দাদার কাছে। আর তোর দাদাও কোন কমতি রাখেনি- নিজের মেয়ের মতই স্নেহ করেন তোর মা কে। এছাড়া তোর দাদা ভাই এর এমন খারাপ সময়ে নিজে কাছে থাকতে না পারার একটা কস্টও রয়েছে তোর মামনির।
আমার পৃথিবী এক রকম স্হবির। হাসপাতাল কেন্দ্রিক হয়ে গেছে জীবন। এদিকে তোর দাদাভাইকে নিয়ে উদ্বিগ্নতা একটুও কমছেনা, তার জ্ঞান এখনও ফিরেনি, ডাক্তাররা একেরপর এক পরীক্ষা করেই যাচ্ছেন, কোন স্পেসিফিক ফলাফল কেউ দিতে পারছেননা। তোর দাদীমার চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছেনা- একের পর এক নির্ঘুম রজনী পার করছে সে, তোর ফুফুরও একই দশা আর তোর ছোট চাচাকে আমরা কিছুই জানায়নি, সে খুলনায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। এমনিতে বাসার ছোট বলে তার আদর আল্লাদের কমতি নেই-কিন্তু এ খবর পেলে সে সহ্য করতে পারবেনা, লেখাপড়াও করতে পারবেনা, তাই তাকে কিছুই জানালামনা।
এক একটা দিন যে কত বড় হতে পারে তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি, তোর মার থেকে প্রায় তিনশ কিলোমিটার দূরে আমি। মোবাইলে কথা বলে সময় কাটে আমার, তার অস্হিরতা টের পায়, কিন্তু কিছুই করার নেই- না পারছি আমি তার কাছে ছুটে যেতে না পারছি তাকে আমার কাছে নিয়ে আসতে। তোর নিরাপত্তা আর সুস্হতা আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পরষ্পর থেকে দূরে থাকার এ কস্ট আমরা সহজেই মেনে নিতে পারছি শুধুমাত্র তোর কথা চিন্তা করে।
প্রায় এগারদিন পর তোর দাদার একটু সম্বিৎ ফিরে এল। ধীরে ধীরে সেন্স পুরোপুরি ফিরে আসছে। অবস্হা আরেকটু ভাল হলে আমি ঢাকায় চলে আসলাম। দুসপ্তাহ পর তোর মামনির সাথে আমার দেখা হল, তাকে তোর নানুর কাছে রেখে আমি অফিসে চলে আসলাম, সেখান থেকে আমাদের বাসায় যাব। বিকেলে বাসায় ফিরে দেখি তোর মা হাজির, সে নাকি আমাকে ছেড়ে একা থাকতে পারবেনা, তোকেও নাকি এভাবে আমার থেকে দূরে রাখা ঠিক হচ্ছেনা !!!!
তোর দাদাভাই এর অবস্হা ধীরে ধীরে ভাল হচ্ছে- পরের সপ্তাহে তোর মামনিকে নিয়ে আমি আবার চিটাগং গেলাম, তোর মামনিকে দেখে তোর দাদুভাই কি যে খুশি হল সেটা বলে বোঝাতে পারবোনা।
তোর মামনির এত ফ্রিকোয়েন্ট জার্নি করা ঠিক হবেনা তাই তাকে সেখানে রেখে আমি ঢাকা চলে আসলাম। এইবার তোর মা চিটাগাং এ আমি ঢাকায় ।এরপর ঢাকায় আসার পরে প্রচন্ড গরমে তোর মামনির শরীর খুব খারাপ হয়ে গেল- পানি শূণ্যতায় সে একেবারে কাবু হয়ে গেছে। তোর ডাঃ মামীর সাথে কথা বলে আমরাও কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়লাম। আল্লাহ না করুক তোর যাতে কোন সমস্যা না হয়, তাই আমরা কোন রিস্ক নিতে চাইলামনা। তোর মামনি বেশ খারাপ বোধ করায় মাঝ রাতে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করালাম। তার পরদিন রোজা শুরু আর আমরা তখন হাসপাতালে। ভোর রাতের দিকে আমি একাএকা বাসায় চলে আসলাম সেখানে থাকতে দিবেনা তাই। পবিত্র রমযানের প্রথম রোজা শুরু করলাম কোনমতে। পরম করুণাময় আল্লাহর অসীম রহমতের মাস এই রমযান মাস , নিত্য তার রহমতের মুখাপেক্ষী আমরা। আল্লার অশেষ রহমতে তোর মামনি সুস্হ হয়ে পরদিন বাসায় ফিরে আসল।
প্রথম পর্ব :
পড়ছি! 😀
“ও” যখন বড় হবে এই গুলা পড়বে কী করবে ভাবছিলাম! 😀
চলুক ভাইয়া 😀
:):)
গভীর আগ্রহ নিয়ে পড়লাম।
পরের পর্বের জন্য অপেক্ষা করে আছি।
আর ভাইয়া, লেখার শিরোনামে ‘আমাদের তুই-২’ লিখে দেবেন? নাহলে মনে হয় একই লেখা। শেয়ার দিলেও বুঝবে না অনেকে। 🙂
ধন্যবাদ….এডিট করে দিলাম 🙂
অপেক্ষা পরবর্তী অনুভূতিগুলোর, শুভকামনা প্রতি মুহূর্তের। 🙂 🙂
শুভকামনা
অনেক অনেক শুভকামনা………
অপেক্ষায় আছি পরের পর্বের…………
thanks a lot.
অনেক শুভকামনা রইল আপনাদের দু’জনের জন্য।
সবাই ভাল থাকুন।
ভাইয়া, টেনশনগুলো যেন ছুঁয়ে যাচ্ছে আমাকেও……
একটা কথা: বানানগুলোর দিকে একটু খেয়াল রাখবেন।
কস্ট-কষ্ট
কাঁদা-কাদা (চন্দ্রবিন্দু থাকলে কান্না বোঝায়)