ছোট বোন বাড়ি যাবে। চট্টগ্রাম। একা বাড়ি যাবে,তাই ট্রেন-ই ভাল সমাধান। নিরাপত্তা ও ক্রমবর্ধমান বাসভাড়ার কথা চিন্তা করলে…। কিন্তু ট্রেনের টিকেট সোনার হরিণের চেয়ে এক ডিগ্রি বেশি দুষ্প্রাপ্য বস্তু। দশদিন আগে যে টিকেট দেয়া শুরু হয় সকাল ৯টা’র সময়, তা ৯:০৫ টা’র মাথায় সব টিকেট হাওয়া। মোবাইলে টিকেট কাটতে গিয়ে এই হলো আমার সাম্প্রতিকতম অভিজ্ঞতা।
এত অনিশ্চয়তার পরও সেলফোনে টিকেট কাটার জন্য ঠিক করে সকালে মতিঝিলে বাংলালিঙ্কের কাস্টমার কেয়ারে ধর্না দিলাম। ওয়ালেটে টাকা ক্যাশ-ইন করাতে হবে। ১৩নম্বর বাসে ঝুলে মতিঝিলে কাস্টমার কেয়ারে শুরুতেই ভাল অভ্যর্থনা পেলাম। একজন টোকেন ধরিয়ে দিল। যেহেতু আমি একমাত্র ক্রেতা, তাই টোকেনে কল পেলাম সাথে সাথে।
এক সুন্দরী আপু’র সামনে গিয়ে বললাম, ট্রেনের টিকেট কাটবো, তাই ক্যাশ ইন করতে চাই। উনি টোকেনে নম্বরটা ক্রস চেক করে নিলেন। এবং টাকার অংক বললাম। প্রায় মিনিট পাঁচেক সময় নিয়ে উনি ফোন টেপাটিপি করলেন। তারপর হঠাৎ মুখ তুলে টাকা দিতে বললেন, এবং ভাঙতি চাইলেন।
আমি ভাঙতি টাকার বিষয় প্রায় ইগনোর করলাম, কারণ পকেটে একটাই নোট, সেটা পাঁচশ টাকার। উনি আরো মিনিট খানেক ফোন টেপাটিপির পর টাকা চাইলেন। দিলাম। বললো, ”আপনাকে না ভাঙতি দিতে বললাম”।
”আমার কাছে তো ভাঙতি নাই। দেখেন না, আশে পাশের কারো কাছে আছে কি না?”
”আমরা তো ভাঙতি রাখি না স্যার। আপনি প্লিজ পাশের কোন দোকান থেকে ভাঙতি করে আনুন।”
এই সকাল বেলা মতিঝিলে কোন আল্লাহ’র বান্দা আমাকে টাকা ভাঙিয়ে দিবে? মাসের মাঝামাঝি এসে হাতে টাকাও থাকে না, নাহয় হীরাঝিলে-ই নাস্তাটা সেরে টাকা ভাঙানোর চেষ্টা করতাম। এসব ভাবনায় আমার মাথা তখন মোটামুটি ঘুরতেছে। কারণ নয়টা বেজে গেছে, টিকেট পাবার সম্ভাবনা প্রতি সেকেন্ডেই কমছে। এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমার মুখ মনের প্রতিচ্ছবি।
কিছুক্ষন চিন্তা করার চেষ্টা করলাম, তারপর উপায়ন্তর না দেখে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। কাস্টমার কেয়ার থেকে বের হয়ে কিছুক্ষন সেই আপুকে ও বাংলালিংককে মনে মনে গালি দেয়ার চেষ্টা দিলাম। একটা কথাই মাথায় ঘুরছিল, ”সেবা দেয়ার যদি এত ইচ্ছা থাকে, তবে রঙচঙ্গে বিজ্ঞাপন বানানোই আসল কথা না, গালভরা প্রমিজ-ই যথেষ্ট না। বরং সেবার সব উপাদানকে এক ছাদের তলায় হাজির করা, এবং কার্যকর সার্ভিস রিকভারি’র ব্যবস্থা করা, এসবও গুরুত্বপূর্ন। অন্যথায় সকল প্রমিজ ক্রেতার কাছে অশ্বডিম্ব ছাড়া আর কিছু মনে হবে না।”
এরপর মেগাসিটিতে চড়ে গুলিস্তান হয়ে অফিসে চলে আসলাম। আমাকে চমকে দিয়ে খুব সম্ভবত সেই আপুই কল করলো। বললো, ”স্যার আপনি সকালে আমাদের সেন্টারে এসছিলেন ক্যাশ ইন করার জন্য, কিন্তু ভাঙতি নিয়ে তো আসলেন না?”
আমার মাথা গরম হবার জন্য যথেষ্ঠ। বেশ ভদ্র গলায় বললাম, ”দেখেন এই সকাল বেলা মতিঝিলে আমাকে ভাঙতি দেয়ার জন্য কি কেউ বসে থাকে?”
উনার চটপটে জবাব, ”কিন্তু স্যার আমাদের তো ভাঙতি দেবার কোন ব্যবস্থা থাকে না”।
”এটা কি কোন ভাল জবাব হলো? আপনারা ফোনে ক্যাশ ইন করার জন্য বসেছেন, অথচ ভাঙতি টাকা রাখবেন না??”
”এটা তো আমাদের এক্তিয়ারে নেই স্যার”
”সেক্ষেত্রে আপনাদের উপরওয়ালাদের বলবেন যেন এরকম কিছু চিন্তা করে দেখেন”।
এরপর থ্যাঙকু দিয়ে ফোন রেখে দিলেন।
একটু অপ্রাসঙ্গিক: বাংলাদেশের সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে আমার কয়েকটা পর্যবেক্ষণ এখানে নোট করে রাখতে চাই, আমার নিজের রেফারেন্সের প্রয়োজন মেটাবে হয়তো ভবিষ্যতে।
১. আমি নিজেও একটা আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠানে কাজ করি। ফলে, আমি জানি, টাইমলিনেস বা সময়ের যথার্থতা সেবার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ন। এটা মোটামুটি সব সেবা প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ন। যেমন আমি চেষ্টা করি ক্লায়েন্টের সই গুলো নিয়ে তাকে অপেক্ষায় না রেখে ছেড়ে দেয়া। পরে ফর্ম পূরণ বা এপ্লিকেশ লেখা সব আমিই সেরে নেই।
২. যারা সেবা নিতে আসেন তারাও সেবার মান কেমন হবে তাতে ভাল ভূমিকা রাখেন। তাই তাদের সেবা সর্ম্পকে শিক্ষিত করা জরুরী। যারা সেবা নিতে আসেন, তাদের ’দুনিয়া ধংস হয়ে গেল’ টাইপ একধরনের এটিচুড থাকে। একে মাথায় রেখেই সেবা প্রদানের প্রক্রিয়া বানানো উচিত।
৩. কাস্টমার কেয়ারে, হোক সে ব্যক্তিক বা ফোনে, সমস্যার সমাধান জরুরী। হয়তো সুন্দর মুখ বা কণ্ঠ সাময়িকভাবে সেবা গ্রহীতাকে মানসিক রিলিফ দিতে পারে, কিন্তু সমস্যার সমাধার ক্রেতার কাছে সবচে জরুরী বলেই তিনি সেবা কেন্দ্রের দারস্থ হন।
৪. আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষন, পুরুষ কর্মীরা নারী কর্মীদের চেয়ে বেশি তড়িতগতিতে ও কার্যকরভাবে সমস্যার সমাধান করতে পারেন। আমি নিজেও কিউবি’তে বেশ কয়েকবার ফোন করেছিলাম। পাঁচ মিনিট ব্যাপি ওয়েটিং টাইম বাদ দিলে তাদের সেবায় আমি বেশ খুশি। এবং প্রত্যেকবার আমার কথা হয়েছিল পুরুষ সেবাকর্মীর সাথে।
শেষ করতে চাই, আমাদের ম্যানেজার টিপু স্যারের কথা বলে। যেহেতু ব্যবসায়ী ক্লায়েন্টদের তাৎক্ষনিক টাকা দরকার হয়, টিপু স্যার নিজে একটা লোন একাউন্ট চালান, যেখানে তিনি টাকা রেখে দেন। পরিচিত ও বিশ্বস্থ ক্লায়েন্টদের শুধু মুখের কথা/ফোন কলেই উনি টাকা দেয়ার ব্যবস্থা করেন। কারণ, উনি জানেন ক্রেতাকে সেবা দেয়া জন্য কতটুকু যেতে হবে।
শুধু চকচকে কেয়ার সেন্টার বা পরিপাটি সেবা কর্মী-ই যথেষ্ট না..এই বিষয়টা বাংলাদেশের সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রির পলিসি মেকারদের বুঝতে হবে। সরকারী সেবার মানের সন্তুষ্ট হবার প্রতিক্রিয়ায় আমরা বেসরকারী খাতের উপর নির্ভর করেছি। এখন সেই বেসকারী খাত যদি মান রক্ষা করতে না পারে, সেক্ষেত্রে তারা নিশ্চিতভাবেই এই প্রতিযোগিতায় হেরে যেতে যাচ্ছে।
ফেইসবুকে একটা গ্রুপ আছে।
https://www.facebook.com/groups/consumersvoice/
ভোক্তার কণ্ঠস্বর।
বেসরকারি খাতে কিন্তু আমাদের হাতে ক্ষমতা আছে। আমরা একটাকে ছেড়ে অন্যটায় যেতে পারি।
যেমন আমি বাংলালায়ন এর সার্ভিস পছন্দ করি নি, তাই কিউবিতে গেছি।
এইভাবে প্রাইভেট কোম্পানিগুলাকে “শিক্ষা” দিতে পারি।
আপনার মেয়েদের বিষয়ে যেই পর্যবেক্ষণ সেটা সবার সাথে নাও মিলতে পারে। আর অনেকে সেক্সিস্ট হিসেবে দেখতে পারে।
মেয়েরা *কেন* তড়িৎগতিতে পারে না বলে মনে করেন? আমি অনেক অহংকারীও পেয়েছি আবার অনেক (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভালো সার্ভিস পেয়েছি)
সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলায় চাইলেই তো একদিনে উন্নতি হবে না। এটার জন্য সময় লাগবে। প্রেশার প্রয়োগ করতে হবে
বেসরকারী খাত কেন এত ভাল করছে তা নিয়ে একটা আর্টিকেল পড়েছিলাম ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেসে। সেখানে বলা হয়েছে, সরকারের সেবার প্রতি প্রতিবাদ হিসেবেই বেসরকারী খাত ভাল করছে।
আর মেয়েদের ব্যাপারে আমার পর্যবেক্ষণ ভুল হতেই পারে। কারণ বেশিরভাগ সব কাস্টমার কেয়ারে মেয়েরা কর্মী হিসেবে সংখ্যায় বেশি। আর এই মুহুর্তে আমার মনে পড়ছে কিউবি’র কাস্টমার কেয়ারের এক মেয়ে কর্মীর কথা, যিনি ফোনে আমাকে হেল্প করেছিলেন বেশ। এবং এটাই আমার একমাত্র গুড এক্সপেরিয়েন্স।
যারা সেবা নিতে আসেন তারাও সেবার মান কেমন হবে তাতে ভাল ভূমিকা রাখেন। তাই তাদের সেবা সর্ম্পকে শিক্ষিত করা জরুরী। যারা সেবা নিতে আসেন, তাদের ’দুনিয়া ধংস হয়ে গেল’ টাইপ একধরনের এটিচুড থাকে। একে মাথায় রেখেই সেবা প্রদানের প্রক্রিয়া বানানো উচিত।
এই ধরনের সেবা নিতে খুব ভয় লাগে, একবার সিটিসেলে কল দিয়ে মেজাজ গরম হয়েছিলো……
তবে, ভোক্তা এবং সেবাদাতা, দুইয়ের-ই সচেতনতার প্রয়োজন আছে……
হুমম। বুঝা যাচ্ছে আপনি আমার মতোই। বাজে অভিজ্ঞতা বেশি হয়েছে।
এরকম সেবা নেয়ার অভিজ্ঞতা খুব বেশি নেই, অল্প যা আছে তাতে খুব নেতিবাচক কিছুও নেই।
আর হ্যাঁ, ছেলে-মেয়ে কর্মী বিষয়ক মন্তব্যটা সেক্সিস্ট লাগলো। আশা করি এই ধারণা দ্রুতই দূর হবে আর কথাটা মুছে দেবেন। 🙂
আমিও চাই, আমার বর্তমান ধারণা বদলে যাক। আফটার অল, যেটা আমার কাছে জরুরী সেটা হলো, আমার সমস্যার সমাধান পাওয়া। 😀
ভোক্তা সেবা বিষয়ক সুবিধাগুলো বাংলাদেশে এখনো খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থা পৌছাতে পারে নি। আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে, উপযুক্ত ট্রেনিংটা হয়তো খুব একটা ভালোভাবে পাচ্ছেন না তারা। আর, উপযুক্ত ট্রেনিং পেলে এবং ঠিকমতো বাছাই করে নিয়োগ দেয়া হলে, সম্ভবত ভালো সেবা পাওয়ার আশা করতে পারবো আমরা। সেটা পুরুষ বা নারী সেবাকর্মীর উপর নির্ভর করবে না বলেই আমার বিশ্বাস।
সহমত।
এরকম সেবা নেয়ার অভিজ্ঞতা কম তবে ওয়েটিং টাইমটা অনেক সময় বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তার মাঝে কিছু অনভিজ্ঞ সেবাদাতার পরিচয়ও পেয়েছি। দুঃখজনক।