সর্প হইয়া দংশন কর …ওঝা হইয়া ঝাড়ো

ছোটবেলায় স্বরবর্ণ পরিচিতি বইয়ে “ও” তে ওঝা পড়েছিলাম। আমি জানি অনেকেই পড়েছেন। তারপর এই এতোগুলো বছর “ওঝা” শব্দটির সাথে দূরদূরান্তের সম্পর্কও আমার নেই। কিছুদিন আগে এব্যাপারে তথ্য ঘাঁটাঘাঁটি করলাম| নতুন কিছু শিখলেই কেন যেন চিৎকার করে সবাইকে জানাতে ইচ্ছে করে! অবশ্যই হাতে মাইক নেই, তাই চিন্তিত হবেন না| কিন্তু স্বলব্ধ এই জ্ঞান বিতরণ করার লোভ সামলাতে পারছিনা!

আসুন প্রথমে দেখি ওঝা কি বা কারা?

১। মন্ত্রতন্ত্রের দ্বারা যে সাপের বিষ নামায়।

২। মন্ত্রতন্ত্রের দ্বারা যে ভূত তাড়ায়।

৩। ব্রাহ্মনদের উপাধিবিশেষ।

খ্রিস্টধর্ম প্রবর্তনেরও আগে পাশ্চাত্যে বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে নির্দিষ্ট কোনো ধর্মের প্রচলন ছিল না। তবে তাদের মধ্যে অদ্ভুত কিছু বিশ্বাস ও কর্মকাণ্ডের চর্চা ছিল। এক একটি গোত্র বিভিন্ন কাল্পনিক ভূত-প্রেত বা অশুভ আত্মার আরাধনা করত। মূলত আত্মাসংক্রান্ত সেই ধ্যান-ধারণা থেকেই ব্ল্যাক ম্যাজিক বা কালো জাদুর বিবর্তন। এর ২ টি শাখা হিসেবে ভুডু আর শামানিজম এর উল্লেখ রয়েছে। আমাদের দেশের ওঝারা এই শামানদেরই পরিবর্তিত রূপ।

 

নতুন করে কিছু বলার নেই এদেশের পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠীর ব্যাপারে।  এদের কাছে মানুষের কিছু অস্বাভাবিক আচরণের মূল ব্যাখ্যা  “ভূতের আসর” /  “জ্বিনের আসর”। অবস্থা এমনই, যে মনে হয় পাশ্চাত্যে বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতির কারনে ভূতগুলো বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশের মত অনগ্রসর দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে!  :thinking:  মানসিক (ও শারীরিক) রোগ সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং এক ধরনের ভয়ার্ত দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই এসবের প্রসার ঘটেছে।  বাণ মারলে মানুষ মারা যায়, ঝাড়ফুঁক, তাবিজ নিলেই ভূত-প্রেত দূর হয়, সংসারের অশান্তি কাটাতে ভোগ দিতে হয় এমন বিশ্বাস যুগ যুগ ধরে রয়ে গেছে মানুষের মনে। তেমনিভাবে বিষাক্ত সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসায় ওঝার গুরুত্ব গ্রামবাসীর কাছে অনেক। চিকিৎসা বিজ্ঞানে সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা বের হলেও গ্রামের নিরীহ মানুষ এখনো ওঝাকেই খুঁজে ফেরে। ওঝারাও পদ্ধতির পরিবর্তন করেছে।  আগে ঝাড়ফুঁক হতো, এখন দল বেঁধে ঢোল-তবলা নিয়ে গীত গায় সাপে কাটা রোগীকে সামনে রেখে। উৎসুক জনতা ভিড় জমায় সেই দৃশ্য দেখতে। অন্যদিকে বাঁচা-মরার চিন্তা নিয়েই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আহত রোগী। প্রায়ই এরকম চিকিৎসায় রোগী মারা যায়।

 

সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার লক্ষ্মীকোলা গ্রাম থেকে ছবিটি তোলা

 

তবে সবসময় কি অশিক্ষা আর অদ্ভুত বিশ্বাসই ওঝাদের দ্বারস্থ করছে এসব মানুষকে? দুটো ঘটনা উল্লেখ করছি এ প্রশ্নের জবাবে-

*তিস্তাপারের চরগুলোর মানুষদের প্রধান ভরসা ওঝা- কবিরাজ।  নীলফামারীর তিস্তা নদীবেষ্টিত চরগুলোতে কোন স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই।  প্রতিটি চর উপজেলা থেকে অনেক দূরে, যোগাযোগের বাবস্থ্যা অত্যন্ত খারাপ, এখানকার অধিবাসীরা তাই স্বাস্থ্যসেবার নাগালের বাইরে।

* সরকারিভাবে দেশের প্রতিটি উপজেলা হাসপাতালসহ সকল হাসপাতালে সর্পদংশনের ইঞ্জেকশন অ্যান্টিভেনম সিরাম বিনামূল্যে সরবরাহ করার কথা থাকলেও বরিশালসহ সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলে গত তিন বছর ধরে এ ইঞ্জেকশনের শূন্যতা দেখা যাচ্ছে। বরিশালের সিভিল সার্জন ডঃ অনীল দত্তের কাছ থেকে জানা যায়, বছর তিনেক পূর্বে সরকারিভাবে ইঞ্জেকশন সরবরাহ করা হলেও পরবর্তিতে আর এধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ফলে এসব উপজেলার বিভিন্ন এলাকার মানুষকে বাধ্য হয়ে ওঝাদের শরনাপন্ন হতে হচ্ছে আর মৃত্যুই শেষ পরিনতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মাত্র ২টি নয়, এমন অনেক উদাহরণ বিদ্যমান।

 

চিকিৎসাসেবা এমনই এক ক্ষেত্র যেখানে বিফলতা মানেই জীবনের  ঝুঁকি। এটি মানুষের মৌলিক অধিকার এবং শুধুমাত্র কোন পুঞ্জিভূত জনগোষ্ঠীর জন্য নয়। দেশের প্রতিটি কোনায় এর যথাযথ প্রয়োগের জন্য সরকারের পাশাপাশি এগিয়ে আসতে হবে চিকিৎসার সাথে জড়িত সকলকে। পাশাপাশি আশা করছি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার অগ্রগতি, যাতে ভবিষ্যতে ওঝা শব্দটি স্বরবর্ণ পরিচিতি বইয়ের পাতাতেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়,বাস্তবে উদাহরণ না মেলে!

 

স্কয়ার হাসপাতালের জন্য অমিতাভ রেজার তৈরি বিজ্ঞাপনটির কথা মনে আছে? আমার খুব প্রিয় ছিল! –

 

“তোমার ওই চির সুন্দর সৃষ্টি -কেন অসময়ে ঝাপসা হয়ে আসে?

                         তোমার দেয়া অফুরান ভালোবাসার স্পন্দন- হঠাৎ থেমে আসে কেন?

                         তোমার দেখানো সোনালী স্বপ্ন- এখনই কেন ভেঙে যেতে চায়?

 

                         তোমার অসীমের সামনে দাঁড়িয়ে, ক্ষুদ্র আমরা খুঁজে পাই একটাই উত্তর-

                         তুমি সর্প হইয়া দংশন করো,ওঝা হইয়া ঝাড়ো!

 

                         এই আমাদের বিশ্বাস

                         যখন দিয়েছ সীমাবদ্ধতা, তখনই দিয়েছ অতিক্রমের শক্তি।

 

                        তাই হে স্রষ্টা,                        

                        আমাদের হাতকে করো দক্ষ

                         দৃষ্টিকে করো প্রখর

                         মনকে করো একগ্র

                         যাতে আঁধারে ছড়িয়ে দিতে পারি-তোমার করুনার আলো!”

 

কথাগুলো আমাদেরকে অনুপ্রানিত করার জন্য যথেষ্ট নয় কি?  🙂

এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে বিবিধ, সচেতনতা-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

26 Responses to সর্প হইয়া দংশন কর …ওঝা হইয়া ঝাড়ো

  1. ইয়াদ বলেছেনঃ

    :welcome:

    এই ধরনের আরো অনেক ব্যাপার আছে যে গুলো নিয়ে তেমন একটা আলোচনা হয় না, কিন্তু জানা দরকার!

    ধন্যবাদ লিখার জন্য!

  2. সামিরা বলেছেনঃ

    :welcome:
    দারুণ হয়েছে তন্বী। নিয়মিত লিখতে থাকো। 😀

  3. বোকা মানুষ বলেছেনঃ

    বেশ লাগলো লেখাটা!

  4. দারূণ! এসব মানুষের কথা খুব বেশি উঠে আসে না আমাদের গল্পে, লিখায় কিংবা ভাবনায়! ভালো লাগলো এখনো এদের নিয়ে ভাবার মতো মানুষ আছে দেখে!

    সরবে স্বাগতম! আরো লিখার অপেক্ষায় থাকলাম!

    :welcome:

    • কানিজ আফরোজ তন্বী বলেছেনঃ

      ভেবেছিলাম বিষয়টা তুলে ধরা দরকার, সমাধান তেমন কিছু দিতে না পারায় পোস্ট টা সম্পূর্ণও মনে হচ্ছিলনা!
      ধন্যবাদ শৈশব ভাইয়া 🙂

  5. রাইয়্যান বলেছেনঃ

    :welcome: :happy:

  6. অক্ষর বলেছেনঃ

    লেখাটা সময় উপযোগী একটা লেখা আপি, শুধু গ্রামেই না, শহরেও এমন অনেক কুসংস্কার এখন ও আছে কিন্তু দেখার বা বলার কেউ নেই, ওমুক কবিরাজ অমুক সমস্যা সমাধান করেন, স্বপ্নযোগে পাওয়া ঔষধ, আরও কত কি!!

    সামনে এমন আরও লেখা আশা করছি, আপি।

    :welcome:

  7. মুবিন বলেছেনঃ

    ভিন্ন স্বাদের একটা লেখা।
    ভালো লাগলো
    :welcome:

  8. স্বপ্ন বিলাস বলেছেনঃ

    অন্ধকারের ঠিকানা উঠে আসুক লেখায়। আলোতে দূর করতে চাই অন্ধকার……

    সরবে স্বাগতম :welcome:

  9. অবন্তিকা বলেছেনঃ

    দারুন লেখা। :clappinghands:
    অশিক্ষা দূর হোক, আলোকিত হোক প্রতিটি জনপদ!

    :welcome:

  10. অনাবিল বলেছেনঃ

    স্বাগতম!
    অনেক গুরুত্বপুর্ণ একটা জিনিস তুলে ধরেছেন, ধন্যবাদ…

    সচেতন হই আমরা সবাই, সরব হই সচেতনতার আহবানে….

  11. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    :welcome:

    দারুণ তন্বী। আরও লেখা চাই। 🙂

  12. নোঙ্গর ছেঁড়া বলেছেনঃ

    একদম ভিন্ন রকম একটা লেখা। অনেক ভালো লাগলো

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।