কবিতার প্রিয় যত চরণে, কে যেন আসে আজ স্মরণে…

আজকে সারাটা দিন জুড়ে বৃষ্টি হল। কোনই থামাথামি নেই। কখনো কখনো একটু ঝিরঝিরিয়ে ওঠে, তারপরই আবার দ্বিগুণ বেগে, পূর্ণোদ্যমে ফিরে আসে।

মাঝে মাঝে বৃষ্টির ছাঁট এসে পড়ে সামনের আলোভরা স্ক্রিনটায়। তখন যদি ইচ্ছে হয়, তাহলে আমি রাতজাগা ক্লান্ত চোখ দুটো মেলে জানালার বাইরের কাঁঠাল গাছটাকে দেখে নিই এক পলক। এতদিনে ধুলো জমে ধূসর হয়ে ওঠা পাতাগুলো থেকে টুপটাপ করে বৃষ্টির পানি ঝরে পড়ার সাথে সাথে ওদের সবুজ হয়ে উঠতে দেখি ক্রমান্বয়ে।

আলস্য আরেকটু জয় করতে পারলে চেয়ার ছেড়ে উঠে গ্রিল ছুঁয়ে বাইরে তাকাই। কাকভেজা কংক্রিটের জঙ্গল দেখতে ভাল লাগে না। বাসার পেছনের ছোট্ট জায়গাটা দেখি। ওটাও জঙ্গল, তবে গাছের। মেহগনি গাছগুলো কবে যে এত বড় হয়ে গেছে খেয়ালই করি নি। উপরের দিকেই বাড়ছে কেবল ধাই ধাই করে। কাণ্ড মোটা হয় নি একরত্তি। কেমন বোকা বোকা লাগে দেখতে।

জায়গাটা অনেকদিন খালি পড়ে ছিল দেখে অনেকগুলো মেহগনির চারা এনে লাগানো হল একবার। কাজটা ঠিক হয় নি বোধহয়। এটা সম্ভবত বিদেশি গাছ, কোন পাখি বসে না ডালে। অথচ ছোট্ট বরই গাছটা একলাই হয়েছে টুনটুনিদের আড্ডাখানা!

আগে কত পাখি যে আসত এখানে! মাছরাঙা, দোয়েল, বুলবুলি…আর হরেক রঙের অদ্ভুত সুন্দর প্রজাপতির দল। এখন সব কোথায় হারিয়ে গেছে, কেন কে জানে! ওদের ওড়াউড়ি দেখার জন্য পুরনো মানুষগুলো নেই আর, এটা একটা কারণ হতে পারে।

সেই মানুষেরা আজ বড্ড ব্যস্ত! মজারু বাক্স থেকে চোখ তোলার ফুরসত মেলে না তাদের। সারাদিনের একটানা ঝমঝমানি বৃষ্টির শব্দে-গন্ধে-বর্ণে তাদের চিত্ত চঞ্চল হয় না একটুও। জানালার গ্রিল আঁকড়ে দাঁড়িয়ে অনেক অনেক দিন আগের মত মুগ্ধ ঘোরলাগা চোখে আর বৃষ্টি দেখা হয় না। কাদাপানিতে ছোট ছোট বাচ্চাদের উচ্ছ্বসিত লাফঝাঁপ দেখে আর আনন্দ জাগে না মনে। বৃষ্টিতে ভেজা হয় না যদিও, কিন্তু সেটা আগেও হত যে তেমন না, ফোঁটাকয়েক মাথায় পড়লেই জ্বর এসে যেত যে! তবু দুর্দমনীয় যে ইচ্ছেটা জাগত বৃষ্টিবিলাসিতার, তা আজ আর জাগে না। অজানা আকুলতায় কাতর হওয়াও আর হয় না এখন…

প্রবল শিলাবৃষ্টিতে শিল কুড়িয়ে সমস্ত পৃথিবী হাতের মুঠোয় বন্দী করার মত গর্ব হয় না বহুদিন। বারান্দা আর জানালার শিক দিয়ে হাত গলিয়ে, মুখ বাড়িয়ে বৃষ্টির চুম্বনে সিক্ত হওয়ার অবর্ণনীয় আনন্দ পাওয়া হয় না আজ। প্রিয়তম ঘ্রাণ, ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ ছোট্ট দু’হাত বাড়িয়ে বুক ভরে টেনে নিতে নিতে আশা জাগে না, “ইস! শ্বাসটা যদি শুধু নিতেই পারতাম, ফেলতে আর না হত কখনো! তবে তো অর্ধেক গন্ধ হারিয়ে যেত না এভাবে!” বৃষ্টি এলে অকারণ অপরাধে আবেগী হয়ে চোখ ভিজিয়ে ফেলা হয় না। জীবনের স-অ-ব প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিরা দল বেঁধে এসে বৃষ্টিধারার মত বুকের দু’কূল ছাপিয়ে উপচে পড়ে না। মুষলধার বর্ষণে ঝাপসা হয়ে ওঠা চারপাশ, ঝাপসা হয়ে আসা দৃষ্টি আর ঝাপসা হওয়া অন্তর-প্রান্তরের সাথে একাত্ম হয়ে হারিয়ে যাওয়া হয় না কতদিন…কতদিন…আর কতদিন?

এরপরের বার বৃষ্টি এলে, এমনটা আর হবে না দেখো!

সামিরা সম্পর্কে

পীচ-গলা তরলে আটকে পা, দুঃস্বপ্ন অন্ধ দুই চোখে/ অসতর্ক হৃদয় পোষ মানে মিথ্যে বলার আফসোসে.../// প্রকাশিত লেখার কপিরাইট সংশ্লিষ্ট লেখক সংরক্ষণ করেন এবং লেখকের অনুমতি ছাড়া লেখা আংশিক বা পূর্ণভাবে কোন মিডিয়ায় পুন:প্রকাশ করা যাবে না।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে বিবিধ, হাবিজাবি-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

37 Responses to কবিতার প্রিয় যত চরণে, কে যেন আসে আজ স্মরণে…

  1. অপেক্ষা বলেছেনঃ

    অদ্ভূত সুন্দর লেখা! এখনো বাইরে বৃষ্টি ঝরছে এই মাঝরাতে। একগাদা বৃষ্টির লেখা পড়লাম এক নিঃশ্বাসে। ভালো লাগলো খুব।

    সরবে আজই সাইনআপ করলাম। এটাই প্রথম কমেন্ট। 🙂

  2. বোকা মানুষ বলেছেনঃ

    বৃষ্টির সাথে মনে হয় অনেক ক্ষণ গল্প করলাম! মুগ্ধ।

  3. কি আর বলব! বৃষ্টি দারুণ একটা প্রিয় বিষয় আমার কাছে। লেখাটা পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল দৃশ্যপট গুলো দেখতে পাচ্ছি। মুগ্ধপাঠ!

    পোস্টটা প্রিয় তে নেবার লোভ তাই সামলানো গেল না।

  4. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    মুগ্ধ!

    পুরাই মুগ্ধ!

    প্রিয়তে নিলাম 😀

  5. বাবুনি সুপ্তি বলেছেনঃ

    এমন একটা লেখা দিলে টিচার কেমন নুম্বার দিত জানিনা। কিন্তু এভাবে মন খুলে কখন পরীক্ষার খাতায় লিখতে পারিনি। অনেক ভালো লাগল আপু। মন ভালো করে দেয়া কষ্ট যেন।

  6. ইয়াদ বলেছেনঃ

    লেখক যা বলতে চাইছেন সেটা visualize করতে পারলে অনেক ভালো লাগে!

    উপরে একজন বললো, “লেখাটা পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল দৃশ্যপট গুলো দেখতে পাচ্ছি”
    এই জিনিসটা আমারও হয়েছে!

    দারুণ লেখা!

  7. স্বপ্ন বিলাস বলেছেনঃ

    সেই মানুষেরা আজ বড্ড ব্যস্ত! মজারু বাক্স থেকে চোখ তোলার ফুরসত মেলে না তাদের। সারাদিনের একটানা ঝমঝমানি বৃষ্টির শব্দে-গন্ধে-বর্ণে তাদের চিত্ত চঞ্চল হয় না একটুও। :huzur:

    চমৎকার লেখা সামিরা। অসাধারণ। মনের পর্দায় দৃশ্যগুলো ভাসছিলো। মনে হচ্ছিল বোকা বোকা মেহগনী গাছগুলোর নিচে দাঁড়িয়ে একটু ভিজে নেই্‌………

  8. সবসময় একটি বৃষ্টিস্নাত সকাল/সন্ধ্যা, একটি বৃষ্টিভেজা বিকেল রচনাগুলো টানতো আমাকে! এই একটা ঋতুর জন্য আমি হা করে (আসলে পুরা হা না!) করে বসে থাকি! কেন জানিনা, বৃষ্টির সাথে বিশাল ফাটাফাটি ধরণের একটা “ইয়ে” আছে আমার! 😐
    অসাধারণ একটা লিখা পড়লাম সামিরা!! মনে হলো বৃষ্টির সাথে গল্প হলো বহুদিন পর! এরপর বৃষ্টি হলে আমিও দৌড়াবো ছাদে! নিজের এক পৃথিবীতে…… :huzur:

  9. প্রজ্ঞা বলেছেনঃ

    এরপরের বার বৃষ্টি এলেও যেন এমনটাই হয়! তাহলে এত্ত এত্ত এত্ত সুন্দর আবেগময় লেখা পড়ার সুযোগ পাবো আরো!

  10. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    অসাধারণ হয়েছে সামিরা।
    আমি বৃষ্টি চাই, আমি বৃষ্টি চাই বারবার
    সুখে যন্ত্রণা এই ঠিকানা বাঁচবার। :beshikhushi:

  11. সাথী বলেছেনঃ

    সত্যিই মনেহয় তাই “ওদের ওড়াউড়ি দেখার জন্য পুরনো মানুষগুলো নেই …” 🙁
    গল্পটা পড়ে অনেক ভালো লাগল……

  12. কৃষ্ণচূড়া বলেছেনঃ

    চোখে সত্যি সত্যি পানি চলে এল। এই মেয়ে,তুমি কি আমার ছায়া??
    :beshikhushi:
    বর্ণনা চমৎকার সামিরা!
    আমার আর বেশি কিছু বলার নেই। উফ! উফ! কে যেন একটা ভীষণ স্মৃতির ধাক্কা দিয়ে গেল…

  13. অনাবিল বলেছেনঃ

    🙂

  14. অহনিশ বলেছেনঃ

    অনন্য, বৃষ্টি নিয়ে শাব্দিক অলংকরণে এত মাধুর্যতা আগে কখনো চোখে পড়েনি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।