তোর জন্য মন পোড়ে রে সাগর কন্যা ————-

সুখন ফোন করলো- “ঐ তুই যাবি না?”

‘দোস্ত আজকের মধ্যেই তোকে টাকা পাঠাচ্ছি। যেভাবেই হোক’। আধা ঘুমের মধ্যেই বলে দিলাম টাকা দেবার কথা।

 

চার দিন পর যখন মনে পড়ল তখন লজ্জায় আর সুখন কে কিছু না বললে শিহাবের কাছে টাকা দিলাম। ‘ মামা দেইখো আমার জন্য যেন বাসের শেষ সিট টা থাকে”।

 

২০ জানুয়ারি ২০১২।

 

সন্ধ্যে গড়িয়ে মাঝ রাতের কাছাকাছি। কলা ভবনের সামনে আমরা কিছু চেনা অচেনা মানুষ। আরাফাতকে দেখে নিজেকে আর বহিরাগত মনে হল না। কারণ আরাফাতও এরই মধ্যে ডিপার্টমেন্টকে তালাক দিয়ে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ এ ভর্তি হয়েছে, আর আমি ইহ জনমের মত বিদ্যা অর্জনের চিন্তা বিদায় করেছি।

 

কিন্তু যাদের সাথে যাবো বলে এসেছি  ওরা সবাই এম এ পড়ে। ছোট বেলায় স্কুলে যখন পড়তাম তখন উপর ক্লাসের ভাইয়াদের কে দেখে মনে হত ওরা না জানি কত বড়। আমার ছোট মাথায় ঢুকত ওরে বাবা ক্লাস টেনে পড়ে! কলেজে যখন ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি তখন যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে তাদের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতাম। একবার একজন এম এ পড়ুয়া কে জিজ্ঞেস করেছিলাম- আপনি সবচে উপর ক্লাসে পড়েন তাই না!

 

 

সাত পাঁচ ভাবছি। সানিমের সাথে দেখা হল। সায়মার সাথে এনগেজমেন্ট হয়েছে অল্প কদিন হল। হবু বউকে বিদায় দিতে এসেছে। সায়মা জীবনে প্রথম বারের মত সমুদ্র দেখতে যাবে। তাই সানিমের অনেক ভয়। আমাকে এক পাশে ডেকে নিয়ে বলল ‘ আমার ক্রেডিট কার্ড দিয়ে দিলাম ওর কাছে, যখন যা লাগে একটু হেল্প কর’। সায়মা একটু রাগের ভান করে -আমি কি বাচ্চা নাকি?

ওদের আগামীর সংসারের জন্য সুখ প্রার্থনা করতে ভালো লাগে।

 

ঘণ্টা খানেক পর বাস এল। সবার জন্য সিট বরাদ্দ করা আছে। মাহিম সারা রাত জেগে সিট প্লান করেছে। কিন্তু বাসে উঠে দেখে ঘটনা উল্টো। খানিকটা অনুযোগের সাথে বলল- “আমি কি সুন্দর একটা প্লান করেছিলাম। এখন! ধুর!” ব্যস্ত ব্যবস্থাপক। তাকে তালপাতার সেপাই বললে আমার দিকে হয়ত তেড়ে আসবে না, কিন্তু ওর চশমাটা ঠিক জায়গায় থাকবে না। এই ট্যুর এর জন্য কিনা করেছে ছেলেটা।

 

শেষ যাত্রী হিসেবে সুখন যখন আমাকে উঠতে বলল তখন বাসের ভিতরে সে উচ্ছল প্রানের উচ্ছলতা। সুখনের সেই হাসি মাখা মুখ। মামা! হেই মামা। ট্যুর এর সবচে বেশি ঝামেলা গেছে এই ছেলেটির উপরে। যাকে বলে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডী পাঠ। কি না করতে হয়েছে ওকে। এমনিতেই ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের পোলাপান। পোস্ট মডানির্জম বুঝুক বুঝুক আর না বুঝুক ক্রিটিসিজম খুব ভালো বুঝে। এই সব পণ্ডিত এবং পণ্ডিতিদের (পণ্ডিতের স্ত্রী লিঙ্গ  পড়তে হবে, কেউ ফেমিনিস্ট থাকলে দূরে গিয়া মর) এক সাথে করে কোন কাজ করা কত বড় আনন্দের (!) সেটা ভুক্তভোগী মাত্রই জানে। কিন্তু সুখনরা শেষ পর্যন্ত সেই লঙ্কাও জয় করলো। সাধু সাধু! বসার জায়গাটা বেশ!

 

সবার সামনে  বিএসএস ম্যম, ওনার ছেলে আদিব এবং কন্যা নওশীন। প্রতীতি ম্যম আর ওনার হাজব্যন্ড ইমিডিইয়েট টু বিএসএস ম্যম। প্রটোকলের পর লেডিস ফার্স্ট। অর্থাৎ ক্লাসে যারা হুদাই সামনে বসার জায়গা পায়- মানে রোকেয়া হল, শামসুন্নাহার হল আরও কত কত হল জানি আছে- ওদের বাহিনী বসলো। মাঝখানে শিহাব গিয়ে আশ্রয় পেল শামসুন্নাহার এর আঁচলে। সব গুলো ছেলে বসলো পিছনে। সমানাধিকারের এই যুগেও! কলিকাল। গুনে দেখা গেল ২২ টা মেয়ে আর ১৫ টা ছেলে। আরাফাত গেল না। তাই  আমি একমাত্র বৈধ বহিরাগত। সব মিলে ১৬ টা।

 

বোচকা বুচকি সমেত আমাদের বাস মল চত্তর ছাড়ার আগেই বাঁধ ভাঙার আওয়াজ। প্রযুক্তির কল্যাণে বাসের সামনের স্ক্রিনে ভেসে উঠল ডন-২ এর মাফিয়া একশন। এর পর চিকনি চামেলি। নাচের তোড়ে বাসের ফ্লোর ত্রাহি ত্রাহি করে। আমি আর মামুন পেছনে বসা। মামুনের আরেক পরিচয় ফিল্ম মেকার আর আঁতেল। হিন্দির সাথে ফ্রাস্ট্রাটেড ইংরেজির পোলাপানের ঢিলা ছাম্মাক ছাল্লো দেখে বলল ‘দোস্ত ভালোই লাগতেসে’।

 

কংক্রিটের জঙ্গল পার হই। যাত্রাবাড়ী সায়েদাবাদ ফেলে আমাদেরকে নিয়ে পদ্মা এক্সক্লুসিভ পার হয়ে যায় মেঘনার সেতু। কখন সময় গেছে কেউ খেয়াল করে নি। সাগরের ঢেউ এর টানে খেয়াল করা হয়নি বাসের হেড লাইট নষ্ট। যখন সবাই টের পেল তখন আমরা কুমিল্লাও  পৌঁছুতে পারিনি। একটা অজানা ভয় আর শঙ্কা টের পাই। বন্ধু মিজান-[অচিরেই ও বিয়ে করবে বলে শুনেছি] বরিশালের আঞ্চলিক টান দিয়ে বলল – মোর দ্বারে ঘটনা ডা বালো মনে হইতে আছে না!

 

এর পর অন্ধকারের বুকে। মিস্ত্রি আসবে, ঠিক করবে। ডায়নামো আনবে না কি আনবে জানি শুনলাম। অনেকেই বাস থেকে নেমে গেলো। যাত্রার শুরুতে  এমন কিছু কেউ আশা করে নি। রাতের আকাশে অল্প কটা তারা। মাঝে মাঝে যন্ত্র দানবদের অবিরাম চিৎকার করে পাশ ফেলে ছুটে যাওয়া। প্রচণ্ড ধুলোর ঝড়।

 

সেই অন্ধকারে হেড লাইট ঠিক হল না। কিছু করতে হলে কুমিল্লা না গিয়ে আর হবে না। এই অন্ধকারে হয় সেখানে বসে থাকতে হবে না হয় আস্তে আস্তে কুমিল্লার দিকে যেতে হবে। সবাই বাসে উঠলাম। দুরু দুরু মনে অনেকেই তখন ভাবছে কি হবে যদি ড্রাইভার হটাত রাস্তা মনে করে কোন খানা খন্দে ফেলে দেয়। আল্লাহ গো আর যাই কর ‘মেধাবী’ বানাইও না ।

 

গিফারি বুকে হাত দেয়। মামুন বলে ধুর। মাহিম বলে এতগুলো টাকা দিলাম! ইরানি যুবক আমির কিছু না বুঝে বসে থাকে।

 

হটাত গিফারি দেখল ইয়াসমিনুন নেই। মানে ইয়াসিন কবির। বাসের সামনে খুঁজে পিছনে খুঁজে। কোথাও নেই। আল নুর হুদা কই? আরে ওরা দু’জন তো বাসে নেই। ফোন দে ফোন দে!

 

গিফারি- ঐ তুই কই?

ইয়াসিন- আরে আমি আর নুর তো প্রকৃতির কর্ম সেরে একটু হাঁটাহাটি করি।

গিফারি- শালা ——-সামনে দৌড়া!

 

বাস ঘুরে আবার উল্টো দিকে দৌড়াতে শুরু করে। আলো নেই। অন্য গাড়ির আলোর ভরসা। শুরু হল নুর আর ইয়াছিনের বিচার পর্ব। সামনে থেকে কে যেন বলে বসলো এবার কেউ এরকম করলে তার শাস্তি জরিমানা। আরেক জনের মত- নানা সেটাকে ফেলে রেখেই চলে যেতে হবে। অস্থির শিপলু  বলে – ঐ দুইটাকে এমন চটকানা দিতে হবে!

 

আমরা রাস্তার ডান দিকে তাকিয়ে খেয়াল করি ওরা আসছে কিনা। শুধু ধুলো আর ট্রাক বাস দেখি। কিছুদুর যাবার পর পাওয়া যায় সেই ‘ দুই’ গুনধর কে। ড্রাইভার বাস ঘুরায়। ওরা বাসে উঠে। উঠেই সামনের রোকেয়া, শামসুন্নহার, ফযিলাতুন্নেসাদের কবলে। এমনিতেই তিনটা মেয়ে এক সাথে থাকলে কে কার আগে কথা বলবে সেই ঝগড়ায় কিছু বোঝা যায় না। এইবার পড়েছে ২২ জন নারীর সামনে। অনেক গুলো গলার সম্মিলিত আওয়াজ। চোঁ, চ্যাঁ-কাউ মাউ। ভাইরে ভাই। ক্ষমা দে! সামনের ময়দান ছেড়ে ওরা দু’জন যখন পেছন পর্যন্ত জান নিয়ে এসেছে তখন আমাদের সমব্যথী হওয়া ছাড়া আর কিছু বলার বাকি নেই।

 

অন্ধকারের বুক চিরে আমাদের বাস আবার কুমিল্লার দিকে ছোটে। মনে হয় কোন এক বন্য শিয়াল যেন চোখ বন্ধ করে শিকারের পেছনে ধাওয়া করছে। মাঝে মাঝে কড়া ব্রেক। ঝুঁকে পড়ি সামনের দিকে।  আমাদের ভয়ার্ত চোখ জোড়া আলোর রশ্মি খুঁজে ফেরে। গিফারি দোয়া পড়ে। অরিন আল্লাহ আল্লাহ করে। বিএসএস ম্যাম ছেলের হাত ধরে বসে থাকে। সুখনের চোখে টেনশন। মুকিব সামনে বসে বলে কোন ভয় নেই ইনশাল্লাহ। শিহাব লোপার হাত ধরে থাকে দেখে কে যেন বলে ওঠে মরলে-বাঁচলে সব একসাথে! শ্যামলী বিরক্ত। শফিক চোখ বন্ধ করে থাকে। ভাবটা এমন যে পড়ে গেছি কেউ যেন দেখতে না পায়।

 

ঘণ্টা দেড়েক অন্ধকার ভেদ করে কুমিল্লা পার হয়ে আমাদের আশ্রয় হয় হাইওয়ে রেস্টুরেন্টে। গিফারি বলে- সেকেন্ড লাইফ পাইলাম। সবাই নেমে আসি। রেস্টুরেন্টে বসি আদিবের সাথে। আমার কানে কানে জিজ্ঞেস করে ‘ আমার আম্মু কি আপনাদের ক্লাস নেয়ার সময় পড়া না পারলে বকা দেয়? আমাকে কিন্তু বকা দেয়”।

‘তোমার আম্মু হেব্বি বকা দেয়। মোটেও ভালো না’।

 

আদিব আমার উত্তর শুনে খুশি হয়। বিএসএস ম্যম আমার দিকে তাকিয়ে হাসেন। আদিব নাকি ক্রিকেট খেলতে গিয়ে হাজারটা ঝামেলা বাড়ায়। আমি আদিবের পক্ষ নেই। চা কাপে চুমুক দেই। সায়ফা কে দেখে বলি –‘আয় এক চেয়ারে বসি’। এমন ভাবে তাকায় যেন পারলে আমাকে—-।

 

দু-একজন ক্যামেরা বের করে ছবি তোলে। আমি সায়ফার পাশে বসে ওর মাথায় চা ঢালতেসি এমন একটা পোজ দেবার ভাব নেই। সায়ফা  চা না খেয়ে আমার মাথায় ঢালে। মুকিব এক পাশে বসে ভাত আর গরু খায়। শফিক সঙ্গ দেয়। জ্যোতি সায়মা হাত ধরাধরি করে পাশাপাশি বসে। অরিন সিফাতরা এক কোনার টেবিলে। মামুন বিড়ি ধরায়। গিফারি ইয়াছিন ঘুর ঘুর করে। শিহাব বাসে ওঠে লোপার কি জানি লাগবে তাই!  মাহিম ব্যস্ত। নুর মাসল বের করার কোশেশ করে। সুখনের টেনশন। প্রতীতি ম্যম আর স্যার রাতের খাবার সারেন। আমরা অপেক্ষা করি।

 

ঢাকা থেকে মিস্ত্রি আর সেই ডায়নামো আসে। হেড লাইট ঠিক হয় তো হয় না। মুকিব ফোন করে বাস মালিক কে ফাপড় দেয়। মিস্ত্রি বলে- এখনই ঠিক করে দিচ্ছি স্যার। এক ঘণ্টা যায়, দু ঘণ্টা যায়। বাস ঠিক হয় না। অন্ধকার বাড়ে। ঝগড়া হয়। শালা!  বাস ক্যাম্পাসে নিলে চুরমার করে দেব। মাহিম ঝাড়ি মারে। সায়ফা ড্রাইভার কে বলে – “জানেন আমরা সবাই ঢাকা ভার্সিটির। আমাদের কিছু হলে আপনাদেরকে সারা জীবন জেলের ভাত খেতে হবে”। সুপারভাইজার ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে।  

ভোর পাঁচটার দিকে আবার বাস ছাড়ে। হেড লাইট ছাড়া। এইবার কুয়াশা। ভারি। সামনে যেন কিছু দেখা যায় না।  গিফারি আবার দোয়া পড়ে। ড্রাইভার ঝিমায়। মিস্ত্রি ঘুমায়। রুকু না কে জানি চেঁচায় ‘আস্তে আস্তে চালান’ বলে।

 

 

২১ জানুয়ারি, ২০১২

 

সকালবেলা। চট্টগ্রামের জিইসি মোড়। আমরা সহি সালামতে সেই ঘন কুয়াশা ভেদ করে জীবন পাড়ি দিয়ে এসেছি। আল্লাহ সবই তোমার দয়া। নিরিবিলি রেস্তোরাঁতে নাশ্তার জন্য ঢুকি। ওয়াশ রুমের সামনে লাইন পড়ে। বেসিনের সামনে ছেলেরা চুল ঠিক করে, মেয়েরা আয়না দেখে। এদিক ওদিক ঘোরে।

 

শক্ত রুটি, পোড়া মুগডাল আর আধাভাজা অমলেট। নাস্তা শেষ। বিল নিয়ে ক্যাচাল লাগে। আমরা বলি কম খেয়েছি। হোটেল মালিক বলে আপনারা বেশি খাইছেন! শেষ মেশ রফা হয়।  বাসে উঠি। গুনে দেখ সবাই আছে কিনা। সবাই চোখ কপালে তুলে তাকায় নুর আর ইয়াছিনের দিকে!

 

রোলার কোস্টার যাত্রা শুরু। গন্তব্য কক্সবাজার। কয়েকজন ঝিমায়। হটাত লাফ দিয়ে ওঠে। সিফাত গান গায়। নুর নজরুল সঙ্গিত ধরে। অরিন চেঁচায় না গান গায় ঠিক বুঝতে পারিনা। রোমানারা গলা মেলায়। দিপু আন্তরিক ছবি তোলে। ইতি [আসল নাম ভুলে গেছি।  ইতিহাস নয় কিন্তু] হাসে। বাঁধন চুপ করে দেখে। রুকু জোরে জোরে গান গায়।

 

শুরু হয় বয়েজ ভারসাস গার্লস। কে বেশি গান জানে। সবাই জেতে সবাই হারে। একবার মেয়েগুলো হারে তো আরেকবার ছেলেরা। কত গান যে জানে ওরা। ধিঙ্কা চিকা -উলালা উলালা, রাজাকো রানিকো—, পোলা তো নয়, গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ, লালন ফকির, মিলা। কেউ বাদ পড়ে না। আমরা কজন নাচার চেষ্টা করি। রুকু, মৌ লাফায়। ক’ জন হাসে। সারা রাত না ঘুমানো লাল চোখ ক্লান্ত হয়ে আসে।

 

সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়। দুপাশে মাঝে মাঝে গাছের সারি। কথাও টিলা। দুপুর গড়ায়। বাস কক্সবাজার পৌঁছে। রোদেলা’র সামনে থামে। ক্লান্ত দেহ, উতফুল্ল মন। সবাই নেমে পড়ে দুপুরের খাবারের জন্য। কোরাল, ডাল আর সবজি দিয়ে শক্ত ভাত চিবিয়ে শেষ হয় দুপুরের ‘লাঞ্চ’ পর্ব। আবার বাসে ওঠা।  গন্তব্য প্রবাল মোটেল।

 

এইবার বাস উল্টো দিকে যায়। পথ না চেনার ফল এটা। বাসের মধ্যে গুঞ্জন। পথ চিনিস না তো এই পথে আসলি ক্যান? রুকু, সায়ফা, মাহিম, সুখনের গলা শোনা যায় পেছন থেকে। মুকিব বাদ যায় না। আমাদের ভয় হয়- যদি নিজেরা নিজেরা ঝগড়া করে বসি। খুঁজে পাওয়া যায় প্রবাল মোটেল। লনে বসে রুম ঠিক করা। দৌড় ঝাঁপ শুরু হয়। কোন রকম ফ্রেশ হয়ে সোজা সৈকতে।

 

 

লাবনী পয়েন্টে অসংখ্য মানুষ। সাগরের ঢেউয়ের টানে আসা মানুষের ভিড়। জীবনের ঢেউ। বালুকা বেলা পার হয়ে সামনেই সেই সাগর। পৃথিবীর দীর্ঘতম সৈকতে আমরা। অনেকের চোখে প্রথম বারের মত দেখা সাগর। এইতো। চোখের সামনেই। এক নিমিষেই আমরা মিশে যাব ঢেউয়ের সাথে। উচ্ছল রোদ ভাসে চোখে চোখে। কোন এক অপার্থিব আনন্দ।

 

কেউ ছবি তোলে। কেউ একটু একটু করে ভেজে। কেউ না ভেজার চেষ্টা করে একটু ছুঁয়ে আসার চেষ্টা করে। সাগরের বোকা ঢেউ কি আর  ওসব জানে? সোজা এক ঝাঁপটা দেয়। পানি আছড়ে পড়ে। ভিজিয়ে  যায়।

 

আবার অনেক দিন পর দেখি ঢেউ। ঢেউয়ের বুকে মিলিয়ে যাওয়া সময়ের পাল। কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে থাকি। খানিকটা নীরব। আরেকটু পর বেলা ডুবে যাবে।

 

পানিতে নেমে এক অসীম নীরবতার ছোঁয়া খুঁজে পাই। আশপাশের মানুষের কোলাহল বড় অচেনা মনে হয়। অনেক মানুষের ভিড়ে এখানে শুধু আমি। এক অন্তহীন শূন্যতার মাঝখানে ভুল করে ঢেউ গুনি। আছড়ে পড়া আর্তনাদ কানে ভাসে। বুকের ভেতর জমে থাকা কান্না ভিজে যায় সীমাহীন জলরাশির তরঙ্গে। হাজারো বালুকণার মাঝে হারিয়ে যায় সেই ছোট সে ঝিনুক মন। সামনে যাই। জলের তোড় অনুভব করি। অদ্ভুত এক আলোর প্রতিফলন দেখি সাগরের মাঝ দিকে। সামনের জলরাশি দেখে মনে হয় এর বুঝিবা আর কোন শেষ নেই। চোখের কোনায় আটকে থাকা বিন্দুর বেরিয়ে পড়বার প্রার্থনা শুনতে পাই।

 

এরপর সবাই মিলে দাপাদাপি। ইরানি বন্ধু আমির এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে। হাতে ব্যাথা পাই। কানে পানি ঢোকে। ঘাড়ের ব্যথা কচকে ওঠে। এত শত ঢেউয়ের মাঝে আবার শুরু করি দুরন্তপনা। হই চই। সবাই ছবি তোলে। স্মৃতি ধরে রাখবার ব্যকুলতা দেখি। বন্ধু আয় গলাগলি করি রাখি সুখের বাঁধন। নানা ভঙ্গিমায়, পথ হারানো পথে, এই বালুকা বেলা আর পড়ন্ত বিকেলের লালিমা সঙ্গী করে। শুনতে পাই  সে সুর  -আমি কখনও যাইনি জলে, কখনও রাখিনি চোখ ডানা মেলা গাঙচিলে———

 

সন্ধ্যে নেমে আসে সাগরের ঢেউ ছুঁয়ে। আমরা মোটেলে ফিরে আসি। সবাই ফ্রেশ হয়ে ঘুরতে বের হয় কক্সবাজার শহর দেখতে। সাগরের তল খুঁজে আনা ঝিনুক শামুক আর প্রবালের যত রুপ দেখছি তা কেন জানি মনে হয় হাজার বছর ধরে দেখলও দেখার আকুলতা মিটবে না। নানা রঙে গাঁথা সব যেন –আমি ফেলে এসেছি সুদুর কল্পলোকে।

 

রাতের খাবার খেয়ে আবার সাগর পাড়ে আসি। ঠাণ্ডা বালু। পানিতে নামি। একটু একটু সামনে যাই। ঢেউ আসলে পিছিয়ে আসি। সেই দস্যি বেলার খেলার মত- তোমায় আমি ছুঁতে দেব না। বোকা ঢেউ শুধু গর্জন করে। আছড়ে পড়ে মিলিয়ে যায়। মহাকালের পাতা থেকে হারিয়ে যায়। ভুলে যায় সেই তারা ভরা রাত্রির নীরবতা। অনন্ত শ্রদ্ধায় নত হয় বিনম্র মন তার প্রতি- এই সমস্ত সৃষ্টি যার। দু চোখ ভরে দেখি তবু তৃষ্ণা মেটে না।

 

 

২২ জানুয়ারী ২০১২

 

খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে যাই। প্রবাল মোটেলের রুম গুলোতে  তখনও আলো জ্বলবার কথা নয়। দরজা খুলে বাইরে তাকাই। কুয়াশা ভেদ করে সাগর দেখা যায় না। শুধু ভোর বেলার একাকী বাতি গুলো জানিয়ে দেয় আরেকটু পরেই সাগর বেলাভুমি থেকে লালিমা মেখে ও উঠবে। আর সাগর পাড়ে শুরু হবে জীবনের কোলাহল। ঢেউয়ের সঙ্গে গড়া মিতালি। এই নীরব সময়টা বড় বেশি ভালো লাগে। বড় আপন মনে হয়। মানুষের মন আনত হয় সে অসীম সত্তার প্রতি। সারা দিনমান কোলাহল ছেড়ে এই নিঃসীম নীরবতা সাগর পাড়ের মুহূর্ত ব্যকুল হয়ে ওঠে। সেই বেলা থেকে এই বেলা। সেই থেকে এই। এই আমি, তুমি, আমরা, ওরা- সবাই। কোন এক অন্তহীন দিকে জানি আমাদের পথ চলা। এখানে হাসি আর গান, বেদনার পাথর ছুঁয়ে যাওয়া সরল রেখা। এর নাম জীবন।  

 

 

এবার সবাইকে ডাক দেই। সকাল বেলার সাগর দেখব বলে। কেউ ওঠে, কেউ ওঠে না। আমি বেরিয়ে আসি। একটানা বাতাস। একটা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা অনুভুতি। ছোট ছোট ঢেউ। তীর ধরে হাঁটতে ভালো লাগে। অদ্ভুত সে ভালো লাগার চাদর গায়ে অপেক্ষা করি তার ওঠার অপেক্ষায়। ঐ বিশাল ঢেউয়ের ওপারের দেশে তিনি উঠবেন। এক আকাশ রঙ নিয়ে। হেঁটে হেঁটে আরো কিছুদুর যাই। আবার উল্টো দিকে হাঁটি। মানুষের আনাগোনা বেড়ে গেছে।

 

বন্ধুদের অনেককেই দেখি সেই ক্যামেরা হাতে। নানা ভঙ্গিমায়। “দোস্ত একটা ছবি তুলে দে না। এখানে, এই ভাবে। দেখিস একটা ঢেউ যেন ব্যকগ্রাউন্ডে থাকে”। প্রতীতি ম্যডামদের সাথে দেখা হয়। একটা বেগুনী রঙের ঝিনুক দেখি। বড় বেশি সুন্দর সে। বালুর মাঝে মুখ লুকানো। সৈকতে এখন আর আগের মত সে রঙ বেরঙের ঝিনুক শামুকের বাহার দেখা যায় না। দেখায় যায় না বালু মাঝে হাজার রঙের নুড়ি পাথরের দল। আমাদের মত লোভী মানুষ কেড়ে নিয়েছে সে অনিন্দ্য সৌন্দর্য। এখন সৈকত কে মনে হয় নোলক ছাড়া গাঁয়ের বধু।

 

সৈকত থেকে ফিরে প্রবাল মোটেলে নাস্তা করি। অনেকেই তখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। দ্যাখেনি সকাল বেলার সাগর। এইবার আমিও আরেকটু ঘুমিয়ে নিই।

 

ঘুম ভাঙে ইরানি বন্ধু আমিরের অত্যাচারে। হটাত দেখি কে যে আমার উপর চেপে বসেছে। এক ঝটকায় দূরে ঠেলে দেই। আমির হাসে। আমি ঘাড়ের ব্যথা টের পাই।

 

সবাই রেডি হয়ে নিচে নামে। আজ আমাদের গন্তব্য ইনানি বিচ এবং হিমছড়ি। কক্সবাজার শহর থেকে ইনানি বিচ পর্যন্ত যে মেরিন ড্রাইভ তা এক কথায় অনন্য।  এক পাশে উঁচু টিলা, কারো কারো ভাষায় পাহাড় আর পাশে সাগরের নীল জল রাশি। পাহাড় আর সাগর যেখানে গড়েছে মিতালি।

 

মোটেল থেকে বের হয়ে নাস্তা সেরে এবং দুপুরের খাবার নিয়ে আমরা বের হই ইনানির দিকে। দরিয়াপাড়ের গুহা দেখে যাবার প্রস্তাব দেন স্যার। সাগর পাড়ে পাহাড় টিলা আবার তার মাঝে প্রকৃতির অপার দান। দরিয়াপাড় পার্কে ঢোকার সময় হাঙরের মুখের ভিতর দিয়ে ঢুকতে হয়। বানানো হাঙর। ওর পেটের ভেতরে গিয়ে আওয়াজ করলে সে শব্দ কয়েকগুণ বাড়ে। আর আমাদের বাঁদরদের দল তা নিয়ে যে কেচামেচি করে তাতে এক বিরল দৃশ্য হয় বটে। সব ছেলেমেয়ে এক সাথে চেঁচালে সেকি শব্দ রে বাবা!

 

আমরা উঠে যাই। প্রথমে টিলায় উঠে গুহায় নামার পথ। সবাই আস্তে আস্তে সে অন্ধকার পিচ্ছিল পথে পা বাড়াই। ক্যামেরার একটানা ফ্ল্যাশ আলোকিত করে। গুঞ্জন ওঠে যদি ভেঙে পড়ে ঘাড়ের উপর। কোথাও কোথাও মাটির দেয়াল চুয়ে পানি পড়ছে। আমরা একে একে একেবারে গুহার শেষ মাথায় চলে যাই। যতই ভেতরে যাই ততই পথ সরু হয়ে আসে। একা আসলে যে কারো ভয়ে গা ছম ছম করবে। মাথার উপরে আলো দেখা যায়। এক চিলতে নীল আকাশ উঁকি মারে যেন। অন্তত শ’ খানেক ছবি তুলে সবাই ওখান থেকে বেরিয়ে আসে।

 

গুহা থেকে বের হয়ে এক গ্রপ যায় ওয়াচ টাওয়ারে। সোজা পথ বেয়ে অনেক উঁচুতে ওয়াচ টাওয়ার। ওখান থেকে দেখা যায় পাহাড় আর সাগরের কত মিল। যেন অনন্তকাল ওরা আছে বড় কাছাকাছি।

 

আমরা ক’জন ওয়াচ টাওয়ার এর দিকে না গিয়ে তার চেয়ে উঁচু পাশের টিলায় উঠে পড়ি। আমির, শিহাব, লোপা,  মৌ, রুকু, জ্যোতি, সায়মা আরও কয়েকজন। আমাদের দেখা দেখি টিলায় উঠে আদিব এবং নওশিন। প্রতীতি ম্যম আর স্যার চলে যান সামনে। ওদের কয়েকজন ব্যপক কসরত করে টিলায় ওঠার চেষ্টা করে। অনেকটা দুর  ওঠার পর একে সবাই নামতে শুরু করে। পাহাড়ে ওঠার চেয়ে নামা কষ্টকর, সবার নামার কায়দা দেখে আমি সেটা আরো দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে নেই। নওশিন নামতে গিয়ে স্লিপ খেয়ে পড়ে। শেষে ওকে ধরে নামাতে হয়। শিপলু ব্যথা পায়। লোপাকে ধরে শিহাব নামে।  আমরা সবাই নেমে আসি। আবার বাস। এবার গন্তব্য সোজা ইনানি ।

 

হিমছড়ি পার হয়ে ইনানিতে যখন বাস পৌঁছে তখন মাথার উপর বেশ রোদ। সবাই দ্রুত নেমে যায় সাগর পাড়ে। ইনানি অন্য সব সৈকত থেকে আলাদা শুধু স্বচ্ছ পানির কারণে। একদম একহারা গড়নের। বিপুল জলরাশি যখন সৈকতে আছড়ে পড়ে তখন ইনানি যেন এক অনন্য রুপ ধারন করে। এক পাশে খানিকটা প্রবাল আর বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সৈকত।

 

লাবণি পয়েন্টে সাগর দেখে কারো পুরোপুরি মুগ্ধ হবার কথা নয়। কিন্তু ইনানি সে আশা পূর্ণ করে দেয়। নীল ঊর্মিমালা পায়ের কাছে এসে যেন লুটিয়ে পড়ে। যতদূর দু চোখ যায় শুধু সে নীল জল, আকাশ আর সৈকতের বন্ধন। ইচ্ছে করে দু হাত মেলে বুকে ধরে রাখি এই সৌরভ।

 

অনেকের-ই ইনানিতে ভেজার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু সে বিস্তীর্ণ জলরাশি এতই মুগ্ধ করে যে সবাই নামতে বাধ্য হয়। ঢেউয়ের টানে সাগরের মাঝ বরাবর চলে জেতে ইচ্ছে করে। সবাইকে দেখলাম পারলে সাগর বাড়ি নিয়ে ফিরবে।  যা দেখেছি দু চোখ ভরে তার সবটুকু কোনদিন বলা সম্ভব নয়। মনের ভাষার যে প্রকাশ তা শুধু ঐ জলরাশির সামনে নত, ডায়েরির পাতার জন্য নয়।

 

ইনানিতে সবাই লাঞ্চ করলো। আর আমি খেলাম চারটে ডাব। ভালোই লাগে। শুধু একটু প্রেসার বেশি থাকে।

 

ইনানি থেকে আবার আমাদের বাস ছাড়ল। গন্তব্য হিমছড়ি। এখানে একটা ঝরনা রয়েছে। যদিও এটাকে আমার ঝর্না বলতে খুব বাঁধে! মনে হয় এক নাগাড়ে একটা কলের পানি পড়ছে। কারো এবার এটাই ভালো লাগে।

 

হিমছড়ি ঝর্নার দিকে না গিয়ে আমরা ক’জন টিলা পথ ধরে নিচে নামতে থাকি পাশের বড় চুড়ায় উঠবো তাই। মাহিম, রুহুল, সুখন, আমির, নাহিদ এবং আমি। সরু পথ বেয়ে নেমে আসি অনেকদুর। তারপর ওঠা শুরু করি ওপরে। এক পর্যায়ে ট্রেইল হারায়ে আবার ফিরে আসি। এর মধ্যে অন্যরা সবাই উঠে গেছে হিমছড়ির মুল টিলায়। বানানো পথ। শীতের মৌসুমে হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন এখানে আসে। পাহাড়ের চুড়া আর সাগরের ঢেউ-মিতালি যেন পাগলপারা করে।   

 

এখানে এসে সবাই অনেকক্ষণ সময় কাটাই। অনেকের ক্যমেরার চার্জ ফুরিয়ে গেছে ছবি তোলার প্রতিযোগিতায়। সব মুহূর্তগুলো বন্দি করে রাখবার আমাদের কি প্রয়াস। গিফারি, ইয়াছিন আর রুহুল চলে যায় পাশের চুড়ায়। আদিব কে নিয়ে আমিও নামতে যাই। সবুজ পাহাড় আর নীল সাগরের  মাঝে ঝাউবন। আর এরই মাঝে আমাদের সময় দ্রুত ফুরিয়ে যেতে থাকে। আকাশের রঙ লাল হতে থাকে। উনি এবার চলে যাবেন। সে রশ্মি ছড়িয়ে পড়ে জল তরঙ্গের বুকে। আমরা টিলা থেকে দ্রুত নেমে এসে চলে যাই সৈকতে।

 

 

শেষ বিকেলের সময়টা ফুরিয়ে যায় বড় তাড়াতাড়ি। ঢেউগুলোকে দেখলে মনে হয় ওরা যেন এখনি বাড়ি ফিরে যাবে। এক মোহনীয় ভঙ্গিমায় সূর্যি মামা নামতে থাকেন সাগর বুকে। চুপ চুপ করে ভিজিয়ে দেয়া ঢেউগুলোকেও উনি যেন ক্লান্ত করে দিতে চান। সমস্ত সাগর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে লালিমা। এক অপরূপ মুগ্ধতায় নিশ্চল তাকিয়ে থাকি বেলা শেষের বেলাতে। কয়েকটা ছবি তুলি।

 

শেষ হয়ে এসেছে সময়। সাগরের সব ঢেউ ফেলে সূর্যটা চলে গেল কোন হারিয়ে যাবার দেশে। কিন্তু রেখে যায় নিশানা। চলে যাবার পথ। বেলাভুমে আছড়ে পড়া ঢেউ বিরহে কাতর হয়। পা ভিজিয়ে দিয়ে এক চুপে চুপে আদর নিয়ে আবার মিশে যায় অনন্ত তরঙ্গ রাশির মাঝখানে।

 

 

সন্ধের বেলা পার হয়। আমরা আবার বাসে উঠি। গন্তব্য প্রবাল মোটেল। আমাদের থাকবার ঠিকানা। বাসের মধ্যে চিপস, বনফুল কেক আর কমলা দিয়ে সন্ধ্যের নাশতা। এই ট্যুর আয়োজক বন্ধুদের প্রতি আরেকবার কৃতজ্ঞ না হয়ে পারি না।

 

ফেরার সময় আবার সেই প্রানখোলা আড্ডা। গিফারির জন্য অরিন কান্নাকাটি করে। গিফারি শান্তনা দেয়। সায়ফা, নিপুনরা গিফারির দিকে তেড়ে আসে। নুর মন্তব্য করে একমাত্র গিফারি হচ্ছে  হারমলেস বয় টু দ্য গার্লস। গিফারি আর অরিনের নাচ ছিল পুরো ট্যুরের সবচে বড় আকর্ষণ!

 

কিছুটা মন খারাপ ছিল সবার।  কারন এই দিনটি ছিল কক্সবাজারের শেষ দিন। মোটেলে ফিরে ঘণ্টা খানেকের জন্য অনেকেই শপিং এ বের হল। কেউ আমার মত চুপ করে সাগর পাড়ে চলে এল। রাতের খাবার শেষে যে যার রুমে চলে গেল। নির্দেশনা থাকলো কাল ৬ টায় বাস ছাড়া হবে। কারন যেতে হবে সমুদ্র কন্যা নারিকেল জিঞ্জিরা দেখতে। সেন্ট মাটৃন আইল্যান্ড এর আরেক নাম। 

 

কথা ছিল আমাদের একটা আড্ডা হবে। কিন্তু সেই আড্ডাটার সময় আর হয়ে উঠছিল না। রাতের খাবার পর যে যার ব্যাগ গোছানোর কাজ শেষ করলো। এর মধ্যে জানা গেল মেয়েরা ওদের মত করে একটা পার্টি দিবে। সেটা শুধু ওদের মধ্যেই। শেষমেশ একটা কমন আড্ডা। মোটেলের লবিতে বসে জমে উঠলো সেই সে রাতের আড্ডা।

 

আড্ডাতে সবাইকে অংশ নিতে হয়। আমি যেহেতু কিছুই পারিনা তাই গলাবাজির দায়িত্বটা স্বেচ্ছায় নিয়ে নিলাম। কথা হল যাকে যেটা বলা হবে তাকে সেটা করতে হবে। রুকুর গান দিয়ে শুরু হল আমাদের আড্ডা। বন্ধুরা অনেকেই তখন চলে গেছে নিদ্রাদেবির কোলে। যারা জেগে ছিল তারাও ঝিমাচ্ছিল। তার উপর ছিল পরদিন ভোরের বাস ছাড়ার সময় নিয়ে টেনশন।

 

তবুও আড্ডা জমে উঠলো। রুকুর গানের পর জানা গেল শিপলু এই ট্যুরে এসে এক ষোড়শীর প্রেমে পড়েছে। সবার সামনে ঘটনা প্রকাশ হওয়ায় লজ্জায় লাল হয়ে গেল।  নুর জানালো ওর টব শুদ্ধ ফুল তোলার পরিকল্পনা। সিলেটের এক ফ্যামিলির সাথে ঘটনা ক্রমে নুরের পরিচয় হয়েছে। তাদের কন্যাকে দেখে নুর সরাসরি ঐ মেয়ের বাপকে পটানোর প্লান নিয়েছে। মামুন এসে কার মাথায় পানি ঢেলেছে তাও জানা গেল। চার চোখের নাদুস নুদুস গিফারি কখনও আড্ডা দিতে পারে আমার বিশ্বাসই হয় না। অথচ সে যে অভিনয় করলো মনে রাখারা মত। সিফাত ( মেয়ে) নিজের নাম পরিবরতন করার ঘোষণা দিল যেহেতু ঐ নামে আরেকটা ছেলে ছিল। ছেলে সিফাত গান গাইল। আমাদের মামা মুকিব তার স্বভাব সুলভ চটুল বাক্য আর মন্তব্য দিয়ে সবাইকে মাতিয়ে রাখল। এর মধ্যে সুখন বলল ওর বল হারিয়ে গিয়েছে। এমা! আর যাবে কোথায়! সবাই সুখনের বল বিষয়ক প্রসঙ্গে হাসতে হাসতে কিছুক্ষণ গড়াগড়ি খেল।

 

রাত সাড়ে বারটায় যখন আড্ডা ভাংল তখন সিদ্ধান্ত হল আগামি দিন শিহাব নাচবে এবং লোপা গান গাইবে।

 

 

২৩ জানুয়ারি, ২০১২

 

খুব সকালে উঠেই রেডি হয়ে নিলাম। আজ তাড়াতাড়ি না বেরুতে পারলে টেকনাফ থেকে জাহাজ মিস করবো। আর এটা করলে সব গোল্লায় যাবে। নারিকেল জিঞ্জিরা আর যাওয়া হবে না। তাই সবাই খুব সকালেই লবিতে এসে হাজির। ছেড়ে যাচ্ছি প্রবাল মোটেল, ছেড়ে যাচ্ছি কক্সবাজার।

 

সবাই বাসে উঠে গেছে। বাস ছাড়বে। এমন সময় ঘটল সেই মহা বিপত্তি। প্রবাল এর পারকিং প্লেস একটাই আর তার গেটও একটা। এই গেটের সামনে আগের রাতে বালু ফেলে রেখেছে নির্মাণ কাজের জন্য। এক ট্রাক বালু।  এই বালু না সরালে আমাদের বাস বেরোতে পারবে না। না বেরোতে পারলে আমাদের জাহাজের টিকেট মিস হয়ে যাবে। আমাদের আর নারিকেল জিঞ্জিরা যাওয়া হবে না।

 

বাস ড্রাইভার অনেক চেষ্টা করেও অন্য কোন উপায় বের করতে পারলো না। এখন কি করা যায়। একটা সরু কোদাল আছে মাত্র। সেই বালির স্তুপ সরানোর কোন সহজ উপায় পাওয়া গেল না।

 

 

পুরো ট্রিপে এই মুহূর্তটার কথা কেউ ভুলবে না। প্রথমে ছেলেদের কয়েকজন হাতে বালি সরাবার চেষ্টা করলো। কিন্তু এত বিশাল পরিমান বালি কিভাবে সরানো সম্ভব? বাসে আমরা যারা ছিলাম তারা প্রথমে বিষয়টাকে এত গুরুত্ত দেই নি। এর মধ্যে অরিন এর অত্যাচারে বাস থেকে নেমে দেখতে গেলাম আসলে বিষয়টা কি। অবস্থা দেখে মাথায় হাত।

 

একে একে সব গুলো ছেলে মেয়ে নেমে আসলো। সায়ফা আর শিপলুর বুদ্ধিতে শুরু হল ঐ বালির উপর ইট দিয়ে রাস্তা বানানো। বালির পাশে নির্মাণের ইট পড়েছিল। তাই দিয়েই ইয়াসিন, গিফারি, মাহিম, শিপলু, সুখন, রুহুল, সায়ফা, অরিন সহ সব ছেলেমেয়েরা মিলে সেই ইটের রাস্তা বানানো হল বালির উপর।

 

এইবার ড্রাইভার যখন বাস নিয়ে ঐ রাস্তার উপর উঠল তখন নিচে বালি আটকে গেল। আবার পিছিয়ে যেতে হল। তার মানে আমরা বেরোতে পারছিনা। এদিকে সময় দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছে।

 

আবার সবাই মিলে শুরু হল সেই চেষ্টা। এবার বালু সরানোর কাজ। কিছুটা পথ তৈরি হতেই ড্রাইভার আবার চেষ্টা করলেন ওর উপর দিয়ে বেরুবার। কিন্তু এবার ও হল না।

 

আমরা আবার সবাই হাত দিলাম। এবার আবার বের হবার মত একটা পথ করা হল। ড্রাইভার বেশ পেছন থেকে স্পিড উঠিয়ে আসলেন। এবং এই বারে আমরা সফল হলাম।

সবাই জোরে চিৎকার করে বিজয়ের আনন্দ প্রকাশ করলো। কিন্তু এর মধ্যে প্রায় এক ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। অভ্যাস না থাকায় ইটের টুকরায় হাত পা ছিলেছে কারো কারো।

তবু সেই আনন্দ দেখে কে!

 

হোটেল থেকে নাশতা নিয়ে এইবার আমাদের বাস ছুটে চলল টেকনাফের উদ্দেশ্যে। কিন্ত রাস্তার যে বেহাল অবস্থা তাতে আরে স্থির বসে থাকবার মত উপায় ছিল না। না চাইলেও সবাই নাচছিল। কি আর করা। এইবার সুখন শুরু করলো তার হেই মা হে! আর যায় কোথায়? গিফারি আর অরিন শুরু করল পুরো ধিঙ্কা চিকা। ওদের সাথে অন্যরাও যোগ দিল। আমরা যারা নাচতে পারিনা তারাও এদিক অদিক হাত পা ছোড়া ছুড়ি করলাম।

 

বাস যখন টেকনাফ পৌঁছল তখন জাহাজ ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। শেষ কিস্তির যাত্রী হিসাবে আমরা এগিয়ে গেলাম জাহাজে উঠতে।

 

জাহাজে ওঠার পর অনেকের একটু মন খারাপ হল। কারন তখন পর্যন্ত সব সার্ভিস ছিল বেশ ভালো। কিন্তু জাহাজে আমাদের সিট যেখানে পড়েছে তাতে সবাই খুশি হতে পারলো না।   

 

কিন্তু কি আর করা। আমাদের পিছনে একটা ফাকা জায়গা ছিল। আমাদের ব্যাগ বোচকা ঠিকঠাক রেখে ওখানে জড় হলাম। কারন আর কিছু নয়। তখন জাহাজে বাজছে চিকনি চামেলি।

এর মধ্যে কোত্থেকে জানি আরেকটা গ্রুপ এসে জড় হল। যাইহোক আমরা আমাদের ফ্রেন্ডদের মধ্যে থাকলাম। নুর শুরু করল তার মাসল ডান্স। শিপলু উত্তেজনায় বার ড্যান্স দিতে গেল। নাহিদ এবং মুকিব খানিকক্ষণ লাফালো। মাহিম তো পুরা জ্যাকেট খুলে অস্থির অবস্থা। অরিন, রুকু এবং মৌ পুরা উলালা উলালা নেচে ধুমধাম কাণ্ড করে বসলো। আমিসহ অন্যদের অবস্থা তথৈবচ। হাত পা ছোড়ার কোশেশ।

 

নাফ নদী ছেড়ে আমাদের জাহাজ চলল সমুদ্রের নীল জল কেটে কেটে। বিশাল সাগর মাঝে ঈগলের ঐ জাহাজটিকে আসলে কলার মোচার মত মনে হয়। ঢেউয়ের তোড়ে এদিক ওদিক দোলে। একদল গাঙচিল আমাদের সঙ্গী হল। সারাটা পথ ওরা জাহাজের পিছনে পিছনে উড়ে উড়ে আসল।

 

সাগরের নীল জল তখন আমাদের আপন করেছে। বন্ধুরা সবাই গল্প করছি। ছবি তোলার বাতিক যাদের একটু বেশি ওরা সমানে চালিয়ে যাচ্ছে, আর আমি আমার জায়গা বেছে নিলাম দোতলার পেছনের দিকটাতে। রেলিং এ ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে চুপ চাপ সাগর দেখার অনুভূতিটাই অন্য রকম।

 

অথৈ জলরাশি কেটে কেটে জাহাজ একসময় এসে ভিড়ল সেন্ট মাটির্ন ঘাটে। এই সেই নারিকেল জিঞ্জিরা দ্বীপ। বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। এই দ্বীপের প্রবালের বিশেষত্ব হচ্ছে এখানে জীবন্ত প্রবাল পাওয়া যায়। নীল জলের নিচেই দেখা যায় প্রবাল। প্রকৃতির এই ওপার বিস্ময় দক্ষিণ এশিয়াতেও বিরল।

 

জাহাজ থেকে নেমে সেই বাহারি ভ্যান। আমরা চলে এলাম নীল দিগন্ত রিসোর্টে। সাগরের একেবারে পার ঘেঁষে তৈরি এই রিসোর্ট। দুপুরের খাবারের পর অনেকেই নামলো সমুদ্রে। ক্লান্তি লাগায় একটা ঘুম দিলাম। তারপর চলে আসলাম সমুদ্রের নীল পানিতে।

 

প্রবালের উপর দীর্ঘ সময় বসে থাকতে বড় বেশি ভালো লাগে। এক একটা প্রবাল সৃষ্টির যে বিপুল বিস্ময় তাতে মুগ্ধ না হয়ে পারে না কোন প্রান। কোথায় কোন সাগরের মাঝখানে ছোট্ট একটা পাথর এসে জমা হল। ঢেউয়ের তোড়ে ভাসতে ভাসতে প্রবাল কীটেরা এসে জমা হল। এরপর শত বছর ধরে একে একে জমা হল হাজারও প্রবাল। মানুষ খুঁজে পেল নীল সাগরের মাঝে এক অদ্ভুত আশ্রয় স্থান। দূর থেকে এল বসতি। জীবনের কোলাহলে মুখরিত হল ঢেউয়ের বুক। সৃষ্টি তুমি এত বিস্ময় হলে কি করে! অব্যক্ত জিজ্ঞাসা উত্তর খুঁজে ফেরে সৃষ্টির মাঝে।

 

 

সন্ধ্যে বেলা এই প্রবাল সৈকতে সবাই সূর্যাস্ত দেখল। কোন এক অজানা অনুভুতি যেন এখানে নাড়া দেয়। কোথায় যেন চিন চিন করে ওঠে অব্যক্ত অনুভূতিগুলো। কি এক ভালো লাগায় মন প্রান ভরে ওঠে। আমি যেন দেখেছি সেই সে সাগর বুননের গল্প। মানুষের মনের সাথে সাগরের কি এক অদ্ভুত যোগাযোগ। সাগরের বুকে ঢেউ, সে যেন আছড়ে পড়ে মানুষের বুকেও।

 

সন্ধ্যের আগেই কেউ কেউ ছুটল সমুদ্র বিলাস দেখতে। হুমায়ুন আহমদের বাড়ি। কথাশিল্পী হুমায়ুন আহমদ।

 

সন্ধ্যের পর আমরা ক’জন বন্ধু মিলে বের হলাম সৈকতে হাঁটতে। আমি, নুর, জ্যোতি, সায়মা,  শিপলু, সেতু, তিথি এবং প্রিয়াঙ্কা। অন্য বন্ধুরাও তখন দলবেঁধে ঘুরছে। ইয়াসিন, গিফারি, রুহুল ওরা গেছে পুরো দ্বীপ ঘুরতে। সুখন, শিহাব, মাহিম ওরাও আড্ডা দিচ্ছিল সৈকতে। রুকু,  মৌ , বাঁধন, শফিক, মামুন, শ্যামলী, মন্টি, অরিন, সিফাত, রুবা, দিনা- সবাই ছিল সমুদ্র বিলাসের শুভ্রতা দেখতে।

 

সন্ধ্যের পর ছিল মুল আড্ডাটা। বার বি কিউ। এই নারিকেল জিঞ্জিরা দ্বীপে বেড়াতে আসলে সবাই মাছ, লোবস্টার এবং কাঁকড়া খেতে চায়। নানা জাতের সামুদ্রিক মাছ। আমরা ক’জন বন্ধু মিলে চাঁদা তুলে বরসড় একটা চাঁদা মাছ নিলাম। বেশ লেগেছিল ওটা খেতে।

 

রাতের খাবার ছিল চিকেন এবং পরোটা। সবাই রিসোর্টের সামনে লনে বসে এক সাথে খাওয়া। খাবার পর ফরমাল পার্ট। ট্যুর আয়োজন করায় সবাই পুরা  টীম কে ধন্যবাদ জানালো বিশেষ করে সুখন এবং মাহিমকে।

 

ট্যুর চীফ গেস্ট বিএসএস ম্যম আয়োজনে মারকিং করলেন ১০০ তে ৯৯। মাহিম জিজ্ঞেস করল এই পরিমাণ নাম্বার ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের পরীক্ষায় পাওয়া যাবে কিনা। লটারি ড্র হল। ছেলে এবং মেয়ে আলাদা আলাদা। ছেলেদের তালিকায় প্রথম হওয়া ইয়াছিন কি কারণে জানি বাইরে গেল। আর তাতেই মিস করলো্ পুরষ্কার। ভাগ্যে চক্রে সেই প্রথম পুরস্কার গেল গিফারির হাতে। অরিনের আনন্দ তখন কে দ্যাখে! মেয়েদের মধ্যে নিপা জয় করে নিল ভাগ্যের হাত!

 

এরপর সবাই মিলে আবার বিচে যাওয়া। জোয়ারের পানি তখন অনেক বেড়েছে। সেই মধ্য রাতে বিচের সৌন্দর্যটাই আলাদা। এ এমন এক সময় যখন খুব বেশি মিশে জেতে ইচ্ছে করে সাগরজলের সাথে। মাথার উপর নীল চাঁদোয়ার মত আকাশ। তারা ভরা। চেনা যায় সপ্তর্ষি আর আদম সুরাত। পায়ের কাছে ঢেউ। মাঝে মাঝে অশান্ত হয়ে উঠছে সে জলধারা। বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দ। মনটাও এখানে এসে নীরব হয়ে যায়। কোন চাওয়া নেই, কোন পাওয়া নেই, গুমরে ওঠা কান্না মিশে যায় ঢেউয়ের মাঝে। সাগরের অতল জল তাকে নিয়ে যাবে কোন এক দূর দেশে।

 

সবাই  ঘোরা ঘুরি শেষ করে আসলো মুল আড্ডায়। তখন শুধু আমরাই। সবার কাছে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ ট্যুর এটা। ইয়াছিন নারিকেল জিঞ্জিরার স্থানীয়  আর গিফারি সোমালিয়ান সেজে যে কাহিনি দেখালো তাতে হাসতে হাসতে সবার পেটে খিল ধরার উপক্রম হল।

 

এই আড্ডাটা সঞ্চালনার দায়িত্ব ছিল আমার উপর। কিন্তু গলার অবস্থা খারাপ হওয়ায় খুব সুবিধা করতে পারলাম না। শিহাব লোপা গান গাইল। অরিন আর গিফারি নাচল। দ্বৈত নাচ। মামুন মন্টিকে ডেডিকেট করে গান গাইল। মামুনের গানের কন্যা নাকি সূর্যের  কাছাকাছি থাকে। শিপলু ফোড়ন কাটল- এত হট! নুর বাংলা সিনেমার ডায়লগ দিল। ওরে সে কি সেই রকম! নাহিদ এসে সেই পুরনো ব্যথা, আর না পাবার শোকে কিছুই বলতে পারলো না। এদিক ওদিক ঘুরে সায়ফা মাহিমের পাশে গিয়ে বসল। সায়মা ওর এনগেজমেন্টের অনুভুতি জানালো একবারে সাদা মাটা ভাষায়। লজ্জাবতী জ্যোতি বসে থাকলো। নিপুণ, মৌ, রুকু আর সেতু ছিল অন্য রকম আনন্দে। রুহুল, মুকিব, সুখন, নাহিদ, গিফারি, ইয়াসিন-সবাই বেলি ড্যান্স দিতে চেয়েও দিতে পারলো না। সায়ফাকে কবে ফোন করেছিলাম রাতে আর ওকে বলেছিলাম ‘ কিছু একটা বল, আচ্ছা কি খেয়েছিস রাতে সেইটা বল’ সেই ঘটনা ফাঁস করে দিল। সবাই বলল- নে তোর হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিল। সে রাতের মত সবাই সেখানেই ক্ষান্ত হল। রুমে এসে শিপলু বলল- ‘মামা তুমি সবচে বর ধরাটা খাইলা!”

 

 

২৪ জানুয়ারি, ২০১২

 

সকালে দেরি করে উঠলাম। অনেকেই সূর্য ওঠা দেখতে গেছে। আমি যাইনি। বেশ লম্বা ঘুমের পর শরীরটা ঝরঝরে লাগছিল। ফ্রেশ হলাম। ব্যাগ গুছিয়ে ফেললাম। ছেঁড়া দ্বীপ যাবো। ফেরার পালা চলে এসেছে। গতরাতে অবশ্য কয়েকজনের অসুস্থ হবার খবর পেলাম। আবার ট্রলারে ভয়ের কারণে দুই তিন জন ছেঁড়া দ্বীপ যাবে না।

 

ক্যামেরা  নিয়ে বের হলাম। ইচ্ছে ছিল বেশ কিছু ছবি তুলবো। এগুলো একান্তই নিজের। ছবি গুলো শুধুই প্রবালের। ডিঙি নৌকা করে ট্রলারে যেয়ে উঠতে হবে। নিজে উঠে গেলাম। আর অন্যদের ভয় দেখে মনে মনে মজা পাচ্ছিলাম। কিন্তু মুখে তো আর কিছু বলা যায় না!

 

 

ট্রলার ছাড়ল ছেঁড়া দ্বীপের দিকে। নীল জলের তীব্র সে ঢেউ ভেঙে আমাদের সে যান্ত্রিক তরী চলল। প্রচণ্ড ঢেউয়ে ট্রলার এদিক ওদিক দুলছে। বন্ধু শফিক বলল দোস্ত আমারে একটু ধর। ভয় লাগতেছে। বললাম- “এই সাগরের মাঝাখানে কারেও ডাইকা লাভ নাই। আল্লাহ্‌রে ডাক”। শিহাব ভয় পেয়েছিল সবচে বেশি।

 

ছেঁড়া দ্বীপের কাছে গিয়ে আবার নৌকায় উঠে দ্বীপে যেয়ে নামলাম। আমাদের বন্ধুরা সবাই নামলো। এবার সবার থেকে আলাদা হয়ে গেলাম।

 

 

ক্যামেরাটা নিয়ে যতদূর সম্ভব প্রবালের ছবি তুললাম। নানা রঙের, নানা আকারের প্রবাল। এখানে সবচে ভালো লাগে নুড়ি পাথরের সারি। কেয়া বনের পাশে প্রবাল গুলো দেখে মনে হয় কে যেন খুব যত্ন করে এগুলো সাজিয়ে রেখেছে।

 

এক একটা প্রবাল দেখি আর মুগ্ধ হই। ছেঁড়া দ্বীপের একবারে পূর্ব পাশে চলে এলাম। এখানে কিছু সাদা প্রবাল দেখা যায়। মুগ্ধ হয়ে ওগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। অনেকক্ষণ ধরে প্রবাল দেখলাম।

 

সময় পার হয়ে যেতে  লাগলো। এইবার বন্ধুদের দিকে আসলাম। ওরা সবাই ছিল পশ্চিম পাশে। নেমে গেলাম সাগরে। পুরোপুরি ভিজে গেলাম। কয়েকটা ছবি তুললাম। একটু হইচই করলাম। সবাই মিলে গ্রুপ ছবি তুললাম।

 

এবার ফেরার পালা। আবার সেই ছেঁড়া দ্বীপ ছেড়ে যাচ্ছি যেখানে আমার জীবনের সবচে গভীরতম স্মৃতি ফেলে এসেছি। যখনই একা থাকবো কিংবা আসবো এই প্রবালের কাছে তখন খুঁজে ফিরবো সেই মুহূর্ত। সেই উৎকণ্ঠা আর বিহ্বলতা।

 

ফেরার সময় উঠলাম ছোট ট্রলারে। সাগরের পানি কেটে কেটে যখন খুদে এই জলযানটি চলছিল তখন বেশ আনন্দ লাগছিল। যেভাবে ঢেউয়ের সাথে ও দুলছিল তাতে মনে হচ্ছিল একটা পাখি আকাশে উড়ছে। একবার উপরে উঠছে আরেকবার নামছে। আমি দু হাত মেলে ধরে পাখিটার মত ওড়ার ভান করছিলাম। তাই পানির ঝাঁপটাও খেতে হচ্ছিল মাঝে মাঝে।

 

 

সময় দ্রুত ফুরিয়ে যায়। ফিরে আসি রিসোর্টে। আসার পথে প্রতীতি ম্যম এবং ওনার হাজব্যান্ড নৌকা থেক পড়ে যান। ম্যম প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলেন বলে শুনেছিলাম। ওনাদের ক্যামেরাটা বোধহয় পানিতে পড়ে কি একটা সমস্যা হয়েছিল।

 

এইবার কাপর চোপড় ধুয়ে রেডি হয়ে লাঞ্চ করি। হাতে সময় খুব কম। বাহারি ভ্যানে করে চলে আসি ঘাটে। জাহাজে উঠে যাই। ফেলে আসি নারিকেল জিঞ্জিরা।

 

জাহাজ আমাদের নিয়ে টেকনাফের দিকে রওনা হয়। পথিমধ্যে টের পাই রোলিং হচ্ছে। একটু বাতাস উঠেছে। রোলিং আস্তে আস্তে বাড়ছিল। যারা সমুদ্রে থাকেন তারা জানেন রোলিং কি। যদিও আবহাওয়া ভালো ছিল তারপরও কখন কি হয় তাতো বলা যায় না। জাহাজেরও যে কচকচ আওয়াজ শুনছিলাম তাতে একটা অজানা আশঙ্কা কাজ করছিল। ক’ জন কে দেখলাম দোয়া পড়ছে।

 

একটা মেসেজ ড্রাফট করলাম। বড় ভাইকে পাঠাতে হবে। আমার নিজের কিছু ঋণ আছে। ওগুলোর বন্দোবস্ত করতে। এইবার চুপচাপ অপেক্ষা করলাম পরবর্তী সময়ের জন্য।

দেখলাম  আস্তে আস্তে জাহাজের দুলুনি বন্ধ হয়েছে। দিনা অনেক বেশি ভয় পেয়েছিলো। এই মেয়ে নাকি যে কোন কিছুতেই অনেক ভয় পায়।

 

আসার পথে আবার মুকিব, সেতু, সায়মা, শিপলু, সায়ফা, নুর, সুখন মিলে আড্ডা দিলাম। ব্যাক পেইন ও টের পাচ্ছিলাম। বাসে পিছনে বসতে হবে এটা মনে করে আর রাস্তার কথা চিন্তা করে বোঝার চেষ্টা করছিলাম কি হবে।

 

জাহাজ থেকে নামলাম। বাস ছিল আরেক ঘাটে। ঐ ঘাটে বাস আশার পর সবাই বাসে উঠছে। সামনে বসার জন্য তখনি মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেললাম।

 

বাসে উঠে দেখি সায়ফার পাশে সিট খালি। ওকে জিজ্ঞেস করলাম আমি ওর পাশে বসলে ওর কোন আপত্তি আছে কিনা। ও জানালো ওর আপত্তি নেই। ব্যাগ নিয়ে বসে পড়লাম। সায়ফা এইবার বললো –‘দোস্ত তুই অন্য কোথাও গিয়ে বস’।  কিন্তু আমার পিঠের যা অবস্থা তাতে আপত্তি জানালেও আমার কিছুই করার ছিল না। ওকে বললাম ব্যক পেইনের কথা। আর কথা বাড়াল না।

 

বাস প্রথমে টেকনাফ গেল। ওখানে সবাই একটু কেনাকাটা করলো। মায়ের জন্য একটা শাল কিনলাম। রাত সাড়ে আটটায় বাস ছাড়ল টেকনাফ বাজার থেকে। গন্তব্য- ফিরে চলো যেখান থেকে এসেছিলে সেখানে।

 

যেখানে বাঘের ভয় সেখানে রাত হয়। কক্সবাজার থেকে প্রায় এক ঘণ্টার দুরত্তে আবার হেড লাইট নষ্ট হল। গাড় অন্ধকার। এই রাস্তা এমনিতেই ভালো না। কারণ সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে এই এলাকার একটা নাম আছে। তারপর আমাদের এই বেহাল অবস্থা। এতোগুলো ছেলে মেয়ে একসাথে।  সেই সাথে রাস্তার যে ‘আবুল’ হাল। সুপারভাইজার মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে রাখল আর ড্রাইভার আস্তে আস্তে চালাতে লাগলো। সবার মনে আবার সেই উৎকণ্ঠা।

 

প্রায় দুই  ঘণ্টা পর অনেক ঝাঁকুনি খেয়ে আর ভয়ের মাঝখানে কক্সবাজার পৌঁছলাম। সবাই বাসের উপর প্রচণ্ড ক্ষ্যাপা। বাসের মালিক কে ফোন,  সুপারভাইজার কে ধমক, হুমকি ধামকি কোনটাই বাকি থাকলো না। সাত-পাঁচ করে সিদ্ধান্ত হল বাস ঠিক হবার পর এই বাসেই আবার ঢাকায় যাবো। রাতের খাবার খেয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন বাস ঠিক হয়।

 

ঘণ্টা দেড়েক পর বাস ঠিক হল। কক্সবাজার পার হবার পর বুঝলাম হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা কাকে বলে। এই কয়দিনে ঠাণ্ডা লাগে নাই বললেই চলে। কিন্তু এই সময় বুঝলাম। মাগো। কি ঠাণ্ডা! পুরো বাসের মধ্যে সবাই শীতে কাবু হয়ে গেছে। সায়ফা কে দেখলাম ঠাণ্ডায় একদম গুটিসুটি মেরে কাঁপতে।  

 

আমার গায়ে চাদর ছিল। বললাম –“চাদর নিবি”? আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর বলল না! আমি প্রথমে বুঝে উঠিনি। বুঝতে পেরে বললাম – “আমার টা না। আম্মার জন্য যে চাদরটা কিনছি, ঐটা ব্যাগে আছে”। এইবার আর আপত্তি করলো না। চাদরটা গায়ে দিয়ে গুটিসুটি মেরে পড়ে থাকলো।   

 

পিছনে একবার শুনলাম নাহিদ রুকু কে ডাকছে করুন সুরে “ রুকু রুকু রে,—-

 

কুমিল্লায় নাশতা করার সময় দেখলাম ঐ ডাক পুরো হিট- রুকু, রুকু রে!

 

বেলা পৌনে বারটায় আমাদের বাস থামল ক্যাম্পাসে। একটা  গ্রুপ ছবি তুলে সবাই বিদায় নিল। স্মৃতি ধরে রাখল অনাগত দিনের জন্য।

 

আমি এক বন্ধুকে বলেছিলাম ওকে সাগর দেখাতে নিয়ে যাবো। এই পুরো ট্যুরে ওকে সবচে বেশি মিস করেছি, পুরোটা সময়। কিন্তু ও আর কোন দিন জানতেও পারবে না আমি আজো ওকে সাগর দেখাতে নিয়ে যেতে চাই!

ইতি

২৫ জানুয়ারি, ২০১২

এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে ভ্রমণ-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

9 Responses to তোর জন্য মন পোড়ে রে সাগর কন্যা ————-

  1. মুবিন বলেছেনঃ

    চমৎকার অভিজ্ঞতা।
    দারুণ বর্ণনা। :clappinghands:

    শেষবার সমুদ্র দেখতে গিয়েছিলাম ২০০৫ সালে। এরপর আর যাওয়া হয়নি। আপনার লেখা পড়ে আবার যেতে মন চাইছে। :love:

  2. Tajwar Akram Sukhon বলেছেনঃ

    মামা জোস হইসে..হেই মামা হেই…:D

  3. বোকা মানুষ বলেছেনঃ

    ধন্যবাদ!
    আবার ঘুরে আসুন। এখন অনেক বদলে গেছে সাগরপাড়।

  4. সামিরা বলেছেনঃ

    ওরে ভাইয়া! এত্ত বড় পোস্ট একসাথে দিলেন!
    পড়ছি আস্তে-ধীরে। 😀

  5. একবারেই পড়লাম, দুর্দান্ত লাগলো, নিজের স্মৃতির সাথে ঝালিয়ে নিলাম অনেকটাই! আর আপনার লিখার মধ্যে একটা অন্যরকম ভাব আছে, অল্প অল্প করে লিখা, ছোট ছোট বাক্য, আমার খুব প্রিয় একজন লেখিকার সাথে অনেক মিল আছে! ভালো লাগলো! দারুণ! 😀

  6. নিলয় বলেছেনঃ

    দারুণ লাগলো! 🙂
    লেখায় একটা আকর্ষণ আছে- ভালো লাগে 🙂

  7. কিনাদি বলেছেনঃ

    এত্ত বড় ক্যান? 😯 😯

  8. অবন্তিকা বলেছেনঃ

    অনেক বড় পোস্ট। পুরোটাই পড়লাম। 🙂 সহজ ভাষায়। ভালো লাগছে অনেক। :clappinghands: শেষ কথাটায় মন খারাপ হয়ে গেলো। 🙁

  9. অনাবিল বলেছেনঃ

    আস্তে আস্তে পুরোটা পড়ে ফেললাম, অনেক মায়া জড়ানো একটা লেখা……
    সাগর পাড়ে যেতে ইচ্ছে করছে খুব লেখাটা পড়ে…..
    শেষ লাইনটা পড়ে মন খুব খারাপ হয়ে গেল, চোখটা একটু ভিজে উঠল কিন ঠিক বলতে পারি না…..

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।