ক’ফোঁটা চোখের জল…

মনে আছে বিভা?

সেই যে আমরা একবার রেললাইনের ওপর দিয়ে হাঁটছিলাম, তারপর হঠাৎ একটা ট্রেন এলো আর আমরা হুড়মুড়িয়ে পাশের ঢালে নেমে পড়লাম। আর ট্রেন যাওয়ার সময় এত্ত জোরে বাতাস বইছিল, আমাদের মনে হল যেন এক্ষুণি গড়িয়ে ধানক্ষেতে হুমড়ি খেয়ে পড়বো।

তারপর…উমম্‌, সে বারের কথা মনে পড়ে? আমরা খুব আচারপাগল ছিলাম আর লুকিয়ে লুকিয়ে তেঁতুল কিনে এনে কোথায় বসে খেলে কেউ খুঁজে পাবে না আমাদের, সেটা ভেবে সদ্য তোলা দেয়ালটার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেলাম? হঠাৎ কী দেখেছিলাম মনে আছে, যে আমাদের পাশেই ছোট্ট তেঁতুলের চারা একটা? দেখে বড্ড ভয় পেয়েছিলাম, তেঁতুল গাছে ভূত থাকে যে!

মনে আছে তুই কেমন সুন্দরী ছিলি? সবাই তোর প্রশংসা করতো, কিন্তু তুই কখনো বিশ্বাসই করতি না কারোর কথা। টীচাররাও তোর প্রেমে পড়ে যেতো! হাহাহ্‌। পরে অবশ্য ভুল ভেঙেছিল তোর, কীভাবে সেটা আজ আর না মনে করি। তবে একটা জিনিস শিখেছি তখন, স্রষ্টাপ্রদত্ত ভাল সব জিনিসের একটা ভয়াবহ দিকও থাকে। খ্যাতির বিড়ম্বনার মত রূপের বিড়ম্বনাও আছে।

আমি একটা গল্প লিখতে চেয়েছিলাম। গল্পের প্রথম লাইন হবে এরকম কিছু, “আর কবে ঋ-কার লিখতে শিখবি তুই…?” না না, ঠিক এটা না, এরকম কিছুই। এটা তো আমাদের প্রিয় সেই বইটার প্রথম লাইন। মনে আছে না তোর?

আমি খুব বাংলা পারতাম। আর একটু একটু ইংরেজিও পারতাম। ওহ্‌ হো, “ইংরেজি” লিখতে গিয়ে মনে পড়ে গেলো, আমরা না আগে রাগ করতাম, যে বিদেশিরা কেন আমাদের নামগুলো ভুল উচ্চারণ করে, ভুল বানানে লেখে, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এখন তো দেখি, আমরাও বাইরের দেশের অনেক শব্দ নিজেদের মত পালটে নিয়েছি, আমরা ইংলিশকে লিখি ইংরেজি, ফ্রঁসেকে লিখি ফরাসি না হয় ফ্রেঞ্চ…ওহ্‌ যা বলছিলাম, আমি ছিলাম বাংলাপ্রিয় ছাত্রী – আর বাংলা টীচারদের প্রিয়পাত্রী! মনে হত, যাক একটা কিছু তো পারি! অল্প হলেও পারি তো! কিন্তু এখন চর্চার অভাবে ভুলভাল করে ফেলি…ইস্‌ আমি বাংলা নিয়ে পড়লে কত্ত ভাল হত, তাই না রে? কিন্তু বিদ্রোহ করতে চেয়েছিলাম যে! কেন যে চেয়েছি নিজেও কি আর জানি! পুরনো কথাগুলো মনে পড়লে এখন সবই প্রায় ছেলেমানুষি মনে হয়। অনেক বড় হয়ে গেছি এখন আমরা, কী বলিস?

মাঝে মাঝে খুব গল্প লিখতে ইচ্ছে হয় জানিস? মানুষ কী সুন্দর ঝটপট গল্প লিখে ফেলে, আর আমি? গল্প লিখতে একটু পরিশ্রম লাগে বোধহয়, একটু কল্পনা-টল্পনা করা লাগে, আমার তো অত ধৈর্য হয় না! তবু একদিন লিখে ফেলবো দেখিস। হয়তো লিখবো, আবার না-ও লিখতে পারি।

সেদিন দারুণ একটা গান শুনলাম। তোকে খুব শোনাতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আমি তো গাইতে পারি না! তার চেয়ে লিরিকটাই দিয়ে দিই বরং –

“ক’ফোঁটা চোখের জল ফেলেছো যে তুমি ভালবাসবে?

পথের কাঁটায় পায়ে রক্ত না ঝরালে কী করে এখানে তুমি আসবে?

কটা রাত কাটিয়েছো জেগে? স্বপ্নের মিথ্যে আবেগে?

কী এমন দুঃখকে সয়েছো, যে তুমি এত সহজেই হাসবে?

হাজার কাজের ভিড়ে সময় তো হয় নি তোমার

শোনো নি তো কান পেতে অস্ফুট কোন কথা তার।

আজ কেন হাহাকার করো? সে কথায় ইতিহাস গড়ো?

কী সুখ জলাঞ্জলি দিয়েছো, যে তুমি সুখের সাগরে ভাসবে?”

অস্কার ওয়াইল্ডের লেখায় পড়েছিলাম, শিল্পমাত্রই অর্থহীন। কথাটাকে মাঝে মাঝে সত্যিই মনে হয়। এসব গান-টান শুনে, আর কবিতা-টবিতা দিয়ে কী আর হবে বল্‌? এগুলো আমরা ভাল লাগে তাই করি, কিন্তু প্রয়োজন বোধহয় নেই খুব একটা। এই গানটার কথাই ধর, কত রকম অর্থই না করা যায়, আবার চাইলে কোন অর্থও খুঁজে না পেতে পারি, তাই না?

কখনো কখনো কিচ্ছু ভাল লাগে না। জানি ভাল না লাগার মতন কিছু নেই আমার, তবুও। তখন কী ইচ্ছে করে জানিস? সেই অনেক আগের মত, কাউকে না জানিয়ে ছুটে গিয়ে নদীর ধারের সেই যে গোরস্থানটা, সেখানকার লজ্জাবতীর পাতাগুলোকে ছুঁয়ে দিতে। ওরা এখনো আছে তো ওখানে?

যে মানুষ শৈশব পার করেছে, তার লেখার রসদ নাকি কখনো ফুরোবার কথা নয় – সেদিন একটা বইয়ে পড়ছিলাম। আমারও কি তাহলে ফুরোবে না কখনো?

সামিরা সম্পর্কে

পীচ-গলা তরলে আটকে পা, দুঃস্বপ্ন অন্ধ দুই চোখে/ অসতর্ক হৃদয় পোষ মানে মিথ্যে বলার আফসোসে.../// প্রকাশিত লেখার কপিরাইট সংশ্লিষ্ট লেখক সংরক্ষণ করেন এবং লেখকের অনুমতি ছাড়া লেখা আংশিক বা পূর্ণভাবে কোন মিডিয়ায় পুন:প্রকাশ করা যাবে না।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে গল্প, পাগলামি, হাবিজাবি-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

20 Responses to ক’ফোঁটা চোখের জল…

  1. অক্ষর বলেছেনঃ

    সরলতম সুন্দর হইসে আপি , নিজের জীবন থেকে নেওয়া ?? :guiter:

  2. বোকা মানুষ বলেছেনঃ

    এক ফোঁটা জলও ফেলিনি…
    কারন যদি কেউ দেখে ফেলে
    জলের ফোঁটায় খুঁজেছো আবেগের ঘাম
    তুমি তো ওখানে আমাকে দেখতে পাওনি।

    মানুষের শৈশব এক বড় জ্বালাতন!

  3. স্বপ্ন বিলাস বলেছেনঃ

    খুবই সুন্দর লেগেছে। পড়ে কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম মনে হলো……

  4. রাইয়্যান বলেছেনঃ

    ফ্রঁসে??? :thinking: 😯

    “আমি বাংলা নিয়ে পড়লে কত্ত ভাল হত, তাই না রে?” পুরোপুরি সহমত!!!! :happy: 😛 :happy: :huzur:

  5. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    আমি জানি না এই টাইপের লেখাগুলা এত চমৎকার হয়! ঠিক যেন লজ্জাবতীর গায়ে পরশ বুলানোর মত!

  6. আপনার এই লিখাগুলোর মাঝখানে একটা অন্যরকম আবেগ থাকে, কিছু লেখা যেটা পড়লেই মনে হয় অসাধারণ একটা মায়া নিয়ে লেখা হয়েছে, অসাধারণ একটা আবেগ টান দিয়ে নিয়ে চলে যায় অন্য কোথাও, একসময় ইচ্ছে ছিলো, যদি এমন লিখতে পারতাম, কিন্তু এখন টের পাই, আমাকে দিয়ে হবে না, তাই অপেক্ষায় থাকি, কবে আপনার লিখা আসবে, আরেকবার পড়বো……

    • সামিরা বলেছেনঃ

      অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া! 😀
      সবারই আলাদা স্টাইল থাকে মনে হয়, অনেকের লেখা দেখলে আমারও ইচ্ছে করে ওভাবে যদি লিখতে পারতাম; কিন্তু লিখতে বসলে আর হয় না।

  7. অনাবিল বলেছেনঃ

    মনে আছে!

    স্মৃতি গুলো সবসময় বড্ড জ্বালায়…………

  8. অবন্তিকা বলেছেনঃ

    ইশ! এতো অদ্ভূত সুন্দর করে লিখো কিভাবে আপ্পি! দারুন হইছে। :clappinghands:

  9. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    সামনে পেলে তোকে একটা মাইর দিবো। ওয়েট খাইতে থাক। 😛

  10. গাঙচিল বলেছেনঃ

    লেখাগুলো কী করে এত্ত সুন্দর হয় আপু???
    কেমন যেন অন্য জগতে চলে গিয়েছিলাম কিছু সময়ের জন্য!!!
    (দেয়ার মত কোন ইমো পেলাম না 😛 )

    আর………অস্কার ওয়াইল্ডের মতে, শিল্পমাত্রই অর্থহীন ?!?!?
    বিস্ময়কর! 😯

    • সামিরা বলেছেনঃ

      ধন্যবাদ গাঙচিল, আমার নিজের অবশ্য অত পছন্দ হয় নি এই লেখা। দেওয়ার পরে প্রচণ্ড লজ্জা পাচ্ছিলাম। 😛
      আর হুম, সরবে ইমোর কিঞ্চিৎ অভাব। 😀 যেগুলি আছে সেগুলি দারুণ, তবে আরো দরকার। 😀
      হ্যাঁ, অবাক হয়েছো তুমি? অস্কার ওয়াইল্ডের কথা শুনে? আমার কেন যেন অত অবাক লাগে নি, অনেক ক্ষেত্রেই সত্যি হয়তো। কি জানি!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।