১.
কাঠখোট্টা গণিত ক্লাস শেষে ল্যাবে ফিরছিলাম। গণিত ক্লাসটির বাংলা নাম করলে দাঁড়ায় ফলিত গণিত পদ্ধতি-১। সাধারণত এই গণিত ক্লাস শেষে মন বেশ ভাল থাকে। নাম শুনেই বোঝা যায় বেশ খটমটে বিষয়। তারপরও মন ভাল কেন? কারণ শিক্ষক। গ্র্যাড জীবনে কোন কোর্স নেবার আগে অবশ্য অবশ্যই www.ratemyprofessor.com এ কোর্সের শিক্ষক সম্পর্কে ধারনা নিয়ে ক্লাসে যাই। এই কোর্সের শিক্ষকের রেটিং-এ লিখা ছিল হট! জীবনে (HOT) অনেক কিছুই দেখেছি কিন্তু একজন পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই প্রায় বৃদ্ধ শিক্ষক কী করে হট হতে পারে সে ধারনা ছিল না। ক্লাসে গিয়ে বুঝতে পারলাম অন্তরীকরণ সমীকরণের জটিল জটিল বিষয়ের সহজবোধ্য ব্যাখ্যার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি ঠাট্টায় মেতে ওঠাই তার তপ্ত(!) হবার প্রধান কারণ। যা হোক ক্লাস শেষে ল্যাবে হেঁটে ফিরে আসতে ৫~৭ মিনিট লাগে। ফিরে আসার পথে ক্লাসের হাসি-ঠাট্টাগুলো মনে করতে থাকি সে কারণেই মন ভাল থাকে। ফিরে আসার পথে স্কুল ক্যাম্পাসে মাঝে মাঝে একজনকে দেখতে পাই বিশেষ ট্রলির সাহায্য নিয়ে বেশ কষ্ট করে হেঁটে হেঁটে ক্লাসে যেতে। আমাদের বয়সী একটা মেয়ে। যার হাঁটার গতি ও প্রকৃতি স্বাভাবিক নয়। পায়ের কোন ধরনের অস্বাভাবিকতার জন্যে হাঁটার জন্যে ক্রাচ টাইপের সহায়ক কিছু দরকার । ইচ্ছা করলেই সে হয়ত হুইল চেয়ার নিয়ে আসতে পারত। কিন্তু কেন এত কষ্ট করে ট্রলি নিয়ে প্রতিদিন ক্লাসে যায় কে বলতে পারে। গণিত ক্লাস শেষে ভাললাগার আবেশ নিয়ে ফিরে আসতে আসতে এই মেয়েটার কষ্ট দেখে মন কিছুটা খারাপ হয়ে যায়। পরক্ষণেই আবার মনে হয় এত প্রতিবন্ধকতার পরও জ্ঞানার্জনের অদমনীয় স্পৃহা তাকে আটকে রাখতে পারেনি। পৃথিবীর কত জন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের এতটা প্রবল আগ্রহ ও দৃঢ় মানসিকতা আছে? এর সাথে প্রতিবন্ধীদের জন্যে বাড়তি সুবিধা তার জীবন কিছুটা সহজ করে দিয়েছে। বাসে ওঠা থেকে শুরু করে গাড়ি পার্কিং, সিঁড়ির পাশে বিশেষ ধরনের ঢাল, ব্রেইল পদ্ধতিতে খোদাই করা কক্ষের নাম, প্রয়োজনে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের ব্যবস্থা এসব দেখে মনে হয় এদেশ কোন ধরনের সম্ভাবনাময় বেথোভেন, ভ্যান গগ, জন ন্যাশ বা হকিন্সকে হারিয়ে যেতে দিতে রাজি নয়। মনে পড়ে যায় পরিচিত এক অন্ধ স্কুল শিক্ষকের কথা যিনি বাংলাদেশের শত প্রতিকূলতার মাঝেও সফলভাবে পড়াশুনা শেষ করে চাকরি করতে পেরেছিলেন।
২.
এই সেমিস্টারে শিক্ষক সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পরেছে আন্ডারগ্র্যাডের ব্যবহারিক ক্লাসের। ব্যবহারিক ক্লাসের দায়িত্ব নেয়া বেশ ঝামেলার। প্রায় ২~৩ ঘণ্টা শিক্ষার্থীদের তত্ত্বাবধানে থাকতে হয়। গ্রুপের পোলাপাইন যদি তার উপরে হয় মহা আঁতেল গোছের তাহলেই হয়েছে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সতর্কতা তাদের। রিপোর্টের ব্যাপারে মহাজ্ঞানী ধরনের প্রশ্ন। মাঝে মাঝে তাই ইচ্ছা করেই আঁতেল গ্রুপকে বেশি কাজ দিয়ে দিই। সেদিনের ল্যাব গ্রুপ তেমন আঁতেল ধরনের ছিল না। বেশ মজা করছিলাম তাদের সাথে। একটা সমস্যা নিজেরাই সমাধান করে ফেলায় “জিনিয়াস” বলে সম্বোধন করে পরিবেশ হালকা করে দিলাম। তারাও বেশ মজা পেল এবং ব্যবহারিক ক্লাস উপভোগ করতে শুরু করল। তাদের মধ্যে একজনের কানে অদ্ভুত ধরনের একটা হিয়ারিং এইড লাগানো দেখেছিলাম শুরুতেই। স্বাভাবিক হিয়ারিং এইডের মত কানের সাথে লাগানো অংশটা থেকে একটা তার বেরিয়ে এসেছে। সেটা তার মাথায় আরেকটা অংশের সাথে লাগানো। প্রথম দেখায় বেশ ভীতিকর মনে হতে পারে। হিয়ারিং এইড দেখলেও এ ধরনের কিছু আগে কখনো চোখে পড়েনি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবার পর তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “তোমার ব্রেইনের সাথে কি হিয়ারিং এইডের যোগাযোগ আছে?” সাধারণত বধির লোকজনের কথা ঠিক মত বিকশিত হয় না। কারণ তারা তাদের সীমিত শ্রবণশক্তিতে শব্দগুলোকে যেভাবে শুনতে পায় ঠিক সেভাবেই উচ্চারণ করতে থাকে। তাই ছেলেটা অনেক কিছু বললেও আমি খুব কমই বুঝতে পারলাম। এবার দেখলাম গ্রুপের অন্যরা তাকে সাহায্য করছে তার কথা পরিষ্কার করার জন্যে। ছোটবেলার শিখে আসা “কালাকে কালা বলিও না” নীতি কথার অদ্ভুত বাস্তব প্রয়োগ দেখে থমকে যাই। প্রতিবন্ধী শিশু বা মানুষের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের আচরণের সাথে মেলাতে চেষ্টা করি। কোনভাবেই যেন মেলাতে পারি না। এজন্যই কি হকিন্সদের জন্ম শুধু উন্নত দেশে? হয়ত। যা হোক ছেলেটা ব্যাখ্যা করে, তার মাথার সাথে লাগানো যন্ত্রটা একটা চুম্বক যেটা হিয়ারিং এইডের সাথে লাগানো। শব্দ তরঙ্গের অনুরণনে চুম্বকটা তার মাথার অডিটরী কর্টেক্সে হিয়ারিং এইডের মাধ্যমে আলাদা কম্পন তৈরি করে যার মাধ্যমে সে শুনতে পায়। চুম্বকটা খুলে ফেললে সে আর শুনতে পায় না। স্বাভাবিক মানুষ হয়ে ওঠার সংগ্রামের জন্যে তাকে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে ধন্যবাদ জানাই। অবাক হয়ে সে জিজ্ঞাসা করে আমি সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ কীভাবে জানি। আমি তাকে ব্যাখ্যা করি আমি সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ-এ অল্প কিছু শব্দ বলতে পারি, “ধন্যবাদ” সেই অল্প কিছু শব্দের অন্তর্গত। সে বেশ উপভোগ করে। এরপর গ্রুপের অন্যদের সাথে হাসি ঠাট্টায় মেতে ওঠে। একসময় সফলভাবে ব্যবহারিক শেষ করে আমার কাছে রিপোর্ট করে সবাই গল্প করতে করতে চলে যায়। দূর থেকে তাদের আচরণ দেখে কে বলতে পারবে তাদের মধ্যে একজনের শ্রবনেন্দ্রিয় বিকল?
প্রতিবন্ধীদের এত এত সুযোগ সুবিধার পাশাপাশি এখানকার সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা দেখে সত্যিই অন্যরকম অনুভূতি হয় আর মনের গহীনে আশা জাগে আমরাও শীঘ্রই প্রতিবন্ধীদের আমাদের একজন হিসেবে গ্রহণ করতে শিখব।
– অপরিচিতা
খুবই ভালো লেগেছে এই পোস্ট।
নিয়মিত লিখুন প্লিজ
দারুণ লেখা।
“আমরাও শীঘ্রই প্রতিবন্ধীদের আমাদের একজন হিসেবে গ্রহণ করতে শিখব।” – ইনশাআল্লাহ্। 🙂
অনেক অনেক ভালো লাগলো পড়ে… আমরা সবাই এক, এই বোধটা জাগুক সবার মাঝে…
আরো লেখার অপেক্ষায়…।
দারুন পোস্ট! আমাদের দেশটাও এমন হয়ে উঠুক।
আমরাও শীঘ্রই প্রতিবন্ধীদের আমাদের একজন হিসেবে গ্রহণ করতে শিখব>> এই আশাই করছি।
ভালো লেগেছে পোস্টটি।