নদীটাকে আমার অনেক ভালো লাগতো। ধানখেতের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া। একটা কুলুকুলু শব্দে বয়ে গিয়ে ঘাটে এসে আছড়ে পড়া। আমিও যেন সাথে সাথেই বয়ে যেতাম। স্মৃতিটা কোথা থেকে শুরু মনে নেই। আমার আজো স্নিগ্ধ সকালগুলো মনে পড়ে। মিষ্টি রোদ্দুরে নানীজানের সাথে একদিন সকালে ধনেপাতা আনতে গিয়েছিলাম বাড়ির পেছনের খেতে। দৌড়াতে দৌড়াতে সেদিন আমি অনেকদূর চলে গিয়েছিলাম। একদম দূরের সেই খালপাড়ের কাছাকাছি। রুনি আপু পেছন থেকে চিতকার করে ডেকেছিলেন যেন আর না আগাই। ওই একটা-দু’টা স্মৃতিই। তারপর আবার আগের মতন শহুরে জীবন। দমবন্ধ লাগেনি তখন। সকালে উঠেই স্কুলে যাওয়া, ফিরে গল্পের বইতে ডুব দেয়া, বিকেলে আসরের পরে কাশেম ভাইদের সাথে রাস্তায় ক্রিকেট খেলা, মসজিদে মাগরিব পড়ে বাসায় ফিরেই পড়তে বসা।
এই আমার স্মৃতিগুলো। আমার অসহায় স্মৃতি। বয়ে চলে নদীর মতই। পাগলা নদীর কথা আমার প্রায়ই মনে হয়। সেতুটা অনেক সংকীর্ণ ছিলো। পাশে অনেকে পড়ে গিয়ে মরে গিয়েছিলো। সে পাগলা নদীর ঘূর্ণিতে অনেকেই হারিয়ে গেছে জীবনের ঘূর্ণিপাকে — চলে গেছে পরপারে। আমি সেই ঘূর্ণি দেখিনি, আব্বুর কাছে গল্প শুনেছি। এইটাও আমার স্মৃতির অংশ। এটাও বয়ে চলে কলকল শব্দে।
অথচ আমার বেঁচে থাকার ৯৯ ভাগেই এই শহর। আমার শ্বাস-প্রশ্বাসের পুরোভাগেই এই নদী আর গ্রামের কথা। শহরে আমার প্রাণ নেই, আমার স্মৃতি কেবল আলোড়িত হয় যখন গাছের ছায়া আসে, যখন নদী আর সমুদ্রের স্পর্শ পায়। এই আমার বুকের ভিতরটা তো ইমারত। চারপাশে বসে বসে দেয়াল তুলেছি। কত কী যে চেয়েছিল মন, কত-শত অজস্র আর্তি ছিলো। সবাইকে এই ইমারতের ভিতরের চারদেয়ালে বন্দী করে দমবন্ধ করে হত্যা করেছি। উপায় ছিলো না — জানতাম আমি “বাস্তববাদী” হবার আকাঙ্ক্ষায় এগিয়ে চলেছি, এই আর্তি আর চাওয়াদের শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ করেই মেরে ফেলতে হবে।
একটা দ্যোতনাহীন জীবন তো এইই। আমার ভিতরে আর নাড়া দেয়না সেই কৈশোরের ভালোবাসা। আমার তো আসলে কোন ভালোবাসা নেই। আমি নিরুদ্বিগ্ন অপদার্থের মতন কাটিয়ে দিতে পারি দিন-রাত। অফিসে আসি, যাই, ঘুমাই, খাই। জোর করে নিয়মের ভিতরে বেঁধে রাখার একটা চেষ্টা। আমি জানি, আমার আত্মা মৃতপ্রায়। মাঝে মাঝে গুমরে উঠে চিৎকার দিয়ে — কেউ শুনতে পায় কি? পাবেনা। পায়না। এই চিতকার শব্দোত্তর। কোন প্রাণীরা জীবিত আত্মা এই রোদন শোনেনা। মৃত আত্মারা টের পায় — তাদের কাছাকাছি কেউ চলে এসেছে, এই আরেকটু, আরেকটু হলেই তাদের দলে চলে আসবে।
নদী বয়ে চলে প্রবাহমান। পাড়ের দিকে তাকিয়ে অনেক দৃশ্য দেখা যায়। কত রঙ্গিন আবেগঘন মানুষ। বয়ে চলা জলকণারা কি কখনো সে আবেগকে স্পর্শ করতে পারে? নদীর পাড়ে দুই কিশোরীর উদ্বেলা হাসি কি কখনো স্পর্শ করে সেই ক্ষুদ্র জলকণাকে? সে কেবল দেখে চলে, তার কাজ হলো বয়ে চলা — এই আবেগে বাঁধাপড়া না। কেন সে এই প্রবাহের অংশ হলো? কেন সে হলোনা এই পাড়ের কোন প্রাণ? তার উত্তর কেইবা দিতে পারে? নিরন্তর বয়ে চলা অস্ফূট অস্তিত্ব…
ঘোর কাটিয়ে ফিরি এই ঘরে। আমার পুরোনো ছোট্ট বিছানায়। মা আছেন বলেই আমার বেঁচে থাকা হয়। ঘরে ফিরে মায়ের মুখ দেখি বলেই মনে হয় — এই একটা জিনিসের জন্য আমার আজো টান আছে। বেঁচে থাকতেও আমার ভালো লাগে। মরে যাবার কথা এসেছিলো মাথায়, সেদিন বুঝেছি আমি বেঁচে থাকতে ভালোবাসি। সে কেবলই এভাবে বেঁচে থাকা? একটা কারাগারে দমবন্ধ করে সমস্ত আবেগ-অনুভূতিদের চিপে চিপে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া?
সবাই কত লাল-নীল স্বপ্নের কথা বলে। সবাই আজো অনেক কিছু করবে বলে। আমি জানি এই বুকের ভিতরের নির্মিত ইমারত আর বাস্তবে বানাতে ইচ্ছে হয়না। কেন এই রোদনভরা পৌষ, কেন রোদনভরা নির্লিপ্ত ফাগুনের প্রতিটি প্রহর? আমি কবে এসেছি এই নীলদীঘির পাড়ে? আমি পরিষ্কার জানি, কোন ভার্সিটিতে পড়বো সিদ্ধান্তে বেছে নিয়েছিলাম সেই বিশাল পুকুরটার জন্য। আমি তো ঘুরে ফিরে গিয়েছি সেই গাছের তলায়, পুকুরের পাড়ে, রাতের আকাশের নিচে অন্ধকারে বিশাল মাঠের ঘাসে। আজ আবার ফিরে এসেছি এই ইমারত সভ্যতায়। আমি জানি আমি এখানকার জন্য না। এই সাদারঙ সিলিং, এই কাঁচের দরজা, এই কৃত্রিম সাদা আলো — এগুলো আমার না। পারদকে যেমন কাঁচের মাঝে ধরে রাখলেও অস্থির হয়ে ছুটতে চায় — এই ইমারত সভ্যতায় আমার আত্মাও অমন করেই বয়ে যায়। নদীর স্রোতের সাথে মিল কোথায় এই নিরন্তর বয়ে যাওয়ার?
আমি হাল ছেড়ে দিতে চাই। আমি এই নিউরন সিনাপ্সের অবিন্যস্ত অভিক্ষেপে আর তাল দিতে পারিনা। আমার সবকিছু থেকে মুক্তি পেতে ইচ্ছে করে। এই নীলাকাশ আর রাতের নক্ষত্রালোকে আমি অস্থিরতা ছাড়া আর কিছু পাইনা। পঁচিশ বছর পেরিয়ে যাওয়া জীবনটাকে আজ খুব অসম্পূর্ণ লাগে। কোথায় যেন অনির্ণেয় ক্ষয়। এই ক্ষয় দেখা যায়না — অনুভব করা যায়। ক্ষয়ে ক্ষয়ে পঁচন ধরে যাওয়া আত্মাটাকেও আমি আর ফিরিয়ে আনার উপায় দেখিনা। ক্যান্সার হয়ে গেলে যেমনি উপায় থাকেনা বিষণ্ণ মনের ফিরিয়ে আনার। আজকাল আর হারানোর ভয় হয়না। কতজন কত কিছু চায় আমার কাছে, আমার যোগ্যতাও ছিলো হয়ত। আগে হলে সাহায্য করতাম। এখন আর ভিতরে টানেনা। আমি চুপচাপ থাকি। কেউ খারাপ ভাবলে ভাবুক — সে তো আর জানেনা আমার বুকের ভিতরের এই যন্ত্রটা কার্যত বন্ধ। আমার আর হারিয়ে যাবার নেই মানা, মনে মনে… রবীদার গানটা কানে ভাসতে থাকে, আমারো মনে হতে থাকে যা কিছু হয় আমার, সব তো ওই মনে মনেই… ((http://tagoreweb.in/Render/ShowContent.aspx?ct=Verses&bi=FF66344F-BF40-408F-285B-407E73D94158&ti=FF66344F-BF40-49AF-B85B-407E73D94158&ch=c))
কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানামনে মনে।
মেলে দিলেম গানের সুরের এই ডানামনে মনে।
তেপান্তরের পাথার পেরোই রূপকথার,
পথ ভুলে যাই দূর পারে সেই চুপকথার,
পারুলবনের চম্পারে মোর হয় জানা… মনে মনে।
স্মৃতির সাদা ধবধবে শাড়ির শ্বেতশুভ্র নানীজানের মুখটা এখনো জাগরূক। তার হাসিটা আজো মনে ভাসে। এই মানুষটাকে আমি মনে হয় সবচাইতে ভালোবাসতাম আমার দেখা জীবিত মানুষদের মধ্যে। অথচ কী অদ্ভূত! তার সান্নিধ্য আমার স্মৃতির মাঝে অল্প কিছু মূহুর্তই! আমি তো আরো অনেক মানুষের কাছে কৃতজ্ঞ। ক্যাম্পাসে মোমিন ভাই তো চা-ই শুধু বানিয়ে দেননি, তার আলাদা চোখে আমাকে দেখে রাখা, বিষণ্ণতা দেখলে খোঁজ নিয়ে আদা-চা আর লেবু চায়ের অদ্ভূত পরিবেশনা আমাকে কৃতজ্ঞতায় আবিষ্ট করে। অমন ভালোবাসা কোথা ফিরে আসে? মরহুম মোজাহার ভাইয়ের কথাও মনে হয়– হাউস বেয়ারার ছিলেন। ভোর সকালে দেখা হলে ফোঁকলা দাঁতেএকটা মিষ্টি হাসি দিতেন পঞ্চাশোর্ধ এই লোকটা — একটা কিশোরকে ভালোবাসাময় নিষ্কলুষ হাসি উপহার। আমরা কলেজ থেকে চলে আসার বছরেই উনি চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে অনন্তের পথে। উনিও কি আমাকে বেঁধে রেখে যাননি কৃতজ্ঞতায়?
আমার স্মৃতিরা কখনো কখনো আর বয়ে চলতে চায়না যেন। হয়ত চায়, আমি টের পাইনা। সবকিছুতে থেকেও না থাকার একটা ভুতুড়ে আর স্তব্ধ অনুরণন আমি বুঝি। আমি জানি নির্লিপ্ত আত্মার মৃত্যু। আমি জানি এই সভ্যতার কারাগারে অন্তরীণ হয়ে পচে যাওয়া অনুভূতিরা বেঁচে ফেরার হয়ত আর উপায় দেখেনা। এ আমার নিরন্তর বয়ে চলা, এ আমার নিরন্তর অনুভূতি, এ আমার নিরন্তর ক্ষয়। আমার প্রতিদিনের নিরন্তর অশ্রুভেজা চোখ, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কষ্ট আর না-পাওয়া সবই তো নিরন্তর ক্ষয়ে চলা। একদিন এভাবেই অন্য অনেকের মতন নিস্পন্দ হয়ে যাবো — সে আমি বেশ টের পাই।
দারুণ লাগল!! :clappinghands:
আরও চাই
আচ্ছা ফ্লিকার এর বদলে সরবে আপলোড করলে মন্দ হয় না। কেন যেন আসে নাই
সরবে আপলোড করিনি বরং ধুমধাম ছবিগুলোর লিঙ্ক শেয়ার করে দিয়েছি 🙂
লেখা পড়ার জন্য ধন্যবাদ। হাজার হলেও এই হিজিবিজি লেখাটা সরবে আমার প্রথম লেখা 🙂
লিখলেন অবশেষে! অনেক সুন্দর লাগলো।
:welcome:
জ্বি ধন্যবাদ।
আমার প্রথম পোস্ট। অন্যরকম ভালোলাগা 🙂
নিয়মিত পাবার আশায়
:welcome:
আশা পূরণের আকাঙ্ক্ষায় 🙂
এই যে নদী যায় সাগরে… এত জানে তবু নদী কথা বলেনা…
সরবে স্বাগতম। :welcome:
সেটাই রে ভাই… তবু কথা বলেনা, পারেনা আসলে …
অনেক ধন্যবাদ জনৈক ভাই 🙂
:welcome:
ভাল লাগল 🙂 আরো লিখবেন সামনে। কথার মালা সুন্দর সাজিয়েছেন 🙂
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে
পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল এটা যেন নিজের সাথেই কথা বলা…… অনেক ভালো লাগলো পড়তে, কিন্তু একটু বিষন্নতাও এলো বুঝি………
শুভকামনা সবসময়ের জন্য……
সবরে স্বাগতম, লেখা চলুক…… 🙂
কমেন্টের জন্য অনেক ধন্যবাদ। লেখাটা আসলে অনেক বিষণ্ণতা থেকেই লেখা। সেই ঘ্রাণ পেয়েই মনে হয় কেউ পড়তে আসেনি।