সমাজের যান্ত্রিকতায় যখন আমরা নিত্য পিষ্ট হই লালসা, হতাশা আর ফেলে আসা স্মৃতিকাতরতায়, তখনই খুঁজে ফিরি এক টুকরো নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা। একুশে বইমেলা ঠিক তেমনই এক স্বপ্নদ্রষ্টা শক্তির নাম, যেখানে খুঁজে পাওয়া যায় সেই পুরনো ‘আমি’কে। ফেলে আসা জীবনের কথকতা আর নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাওয়ার সেই বইমেলায় হাজারো বইয়ের ভিড়ে খুঁজে নিতে হয় নিজের কথা বলা বইটিকে। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে ‘সরব’ ব্লগের এই আয়োজন, ‘আয়নায় মুখোমুখি ব্লগার-লেখক’। লেখালেখি জীবনে ব্লগ থেকে বইতে পা রেখেছেন যারা, তাদের ভাবনার জগত পাঠকদের সামনে উপস্থাপনের ছোট্ট প্রয়াস।
অপেক্ষায় থাকুন নতুন বইয়ের, অপেক্ষায় থাকুন নতুন সাহিত্যিকের…
বইমেলা হোক সরব, প্রাণের উৎসবে!
১. নিজের সম্পর্কে কিছু বলবেন?
– আমি সুস্মিতা রেজা খান, ব্লগ লিখি সাদা কালো এবং ধূসর নামে মূলত। লিখতে ভালোবাসি, পড়তে ভালোবাসি। একাডেমিক পড়াশোনা শেষ করেছি অতি কষ্টেসৃষ্টে।অর্থনীতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেছি। জন্মেছি এবং বড় হয়েছি সবুজ সাতক্ষীরায় – তবে শৈশবের বেশ বড় একটা সময় এক মরুভূমির দেশে কেটেছে।বাবার বই পড়ার অভ্যাস আছে, আমাদেরকে দেশবিদেশের অনেক বই পড়তে উৎসাহ দিয়েছেন, পড়ে শুনিয়েছেন দেশি-বিদেশি কবিতা । মায়ের মধ্যে এক রকম সৃষ্টিশীলতা আছে – স্কুলের পরীক্ষায় নিজের মত করে লিখতে আম্মুই শিখিয়েছিলো। আমার ছোটবোনও টুকটাক লেখে। আমার নানা একটা গল্পের বই প্রকাশ করার পর্যায়ে ছিলেন – পরে বিভিন্ন কারনে সেটা ঘটেনি। আমার বন্ধুদের অনেকে এবং আমার জীবনসঙ্গী যিনি তারও টুকটাক লেখার অভ্যাস আছে 🙂 সব মিলিয়ে আমি দেখি আমি সব সময় লেখালিখির আশেপাশেই আছি।
২. লেখালেখির সাথে সম্পর্কের শুরু হলো কী করে?
– পড়তে শেখার আগেই গল্পকার ছিলাম 🙂 আম্মু যেন নিশ্চিন্তে রান্না করতে পারে ছোটবোন যেন বার বার আম্মুর কাছে না যায় সেজন্য গল্প বলা শুরু করলাম একদিন হঠাৎ। এর আগে আম্মু বলতো আমি যেন ওকে নিয়ে খেলি, খেলনাগুলো কিভাবে খেলতে হয় ওকে দেখিয়ে দেই। আমি গল্প বলতে শুরু করেছি দেখে আম্মু বেশ অবাক হয়েছিলো এবং চুপচাপ অ্যাপ্রিশিয়েট করেছিলো। এই সময়ে পড়তে শিখিনি। কিন্তু আব্বু আমাদের গল্প বলে শান্ত করতো সেটা থেকে এই গল্প বলার আইডিয়া এসেছিলো মনে আছে। ছবির বই দেখে দেখে গল্প ভাবতাম যা মাঝে মাঝে ওকে বলতাম আরো আগেই। কিন্তু এগুলো ছিলো আস্ত আস্ত বানোয়াট রুপকথা। এরপর এক রকম হাঁটাহাঁটি করার সময় আমি বলতাম আমি গল্প ভাবছি। দেখতাম এই হাঁটাহাঁটির সময় কেউ আমাকে ডিসটার্ব করে না। কিছু সময় ওকে বলার গল্প ভাবতাম তারপর বাদবাকি সময় আসলে অন্য গল্প ভাবতাম। এই সময়ে পড়তে শিখেছিলাম। রূপকথার বই ইচ্ছামত নিজের মত করে নিয়ে ওকে বলতাম। যা পড়তাম তা নিয়ে ভাবা লাগতো – কারন ওর শোনার ক্ষমতাও শার্প হয়ে উঠছিলো। গল্পের ভুলত্রুটি থাকলে সে প্রশ্ন করতে পারতো। এজন্য আগে ভেবে নেওয়া লাগতো।
প্রায় আট বছর বয়সে ঠিকমত লিখতে শিখেছিলাম। স্কুলের ম্যাগাজিনে লেখার ইচ্ছা হলো, লিখতে বসেছিলাম, লিখেছিলাম। যা লিখেছিলাম নিজের ভালো লেগেছিলো,কিন্তু স্কুলে জমা দেওয়া হয়নি। কারন সেটা কোনো ক্যাটাগরিরমতই ভালোমত হয় নাই। এর আগে লেখার কথা মনে পড়ছে না।
৩. কেন লিখেন? লেখালেখি নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
– লিখতে ভালো লাগে, লিখলে ভালো লাগে। লেখার মধ্যে অনেক রকম আনন্দ পাই, সাথে সাথে আরো অনেক রকম আনন্দের কাছাকাছি সেই আনন্দকে নিতে পারি।লিখে ভাবনা চিন্তাগুলো গুছিয়ে নিতে পারি, লিখে লিখে ভাবতে ভালো লাগে – মজা লাগে।
লেখালিখি নিয়ে কিছু পরিকল্পনা আছে, কিন্তু সেগুলো আসলে খুব বিশেষ কিছু না। পরিকল্পনা করে আমার আসলে তেমন কিছু করা হয় না, পথ চলতে চলতেই পথ নিয়ে ভাবা আমার ভালো লাগে। যখন যেটার সময় হবে, যখন যেটা লেখার জন্য তৈরি হয়েছি বলে মনে হবে তখন সেটা লিখতে চাই – এরকম কিছু।
৪. লেখালেখির ক্ষেত্রে কোন অনুপ্রেরণা আছে কি? কাউকে কি অনুসরণ করেন?
– লেখালিখির ক্ষেত্রে কোনো অনুপ্রেরণা আছে কিনা বলতে পারি না, থাকলেও সে বিষয়ে আমি সুনিশ্চিত কিছু জানি না। হয়তো আমার জন্ম থেকে এ যাবৎ আমি যা কিছু দেখেছি, যা কিছুর ভিতর দিয়ে গিয়েছি, বা যা কিছুর সাথে আমি সচেতন ভাবে পরিচিতও হইনি তার সবই আমার লেখার অনুপ্রেরনা হিসাবে কাজ করেছে।
কাউকে অনুসরন না করার চেষ্টা করি, জীবনে বা লেখালিখিতে সব কিছুতেই আমি আমার নিজের প্রয়োজন বা চাহিদামাফিক সব কিছু পাবার চেষ্টা করি, সেটা যেখানে অন্যের সাথে মেলার মিলবে, যেখানে না মেলার মিলবে না – এই আরকি।
৫. অনেকের ধারনা এখন অধিকাংশ লেখকের লেখা একই প্যাটার্নের হয়ে থাকে, নতুনত্ব খুব কম পাওয়া যায় – আপনি কি এর সাথে একমত?
– প্রত্যেক সময়ের লেখকেরা নিজের সময়ের প্রতিষ্ঠিত লেখকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এসেছেন। নতুনত্ব তো বেশি লেখক দেন নাই কখনোই। কিন্তু কিছু নতুনত্ব যারা দিয়ে এসেছেন তাদের অনেকেই জীবিত অবস্থায় তেমন স্বীকৃতি দেখে যেতে পারেননি যেটা হয়তোবা সেই যুগের পাঠকদের বিষয়ে কিছু আলোকপাত করতে পারে।
৬. নতুন লেখকদের বিষয়ে পাঠকদের মনোভাব কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন?
– ভালো পাঠকসুলভ মনোভাব হওয়া উচিত। সেরকম মনোভাব ধরে রাখতে হলে ভালো পাঠক হওয়া উচিত। ভালো পাঠক হতে হলে দেশবিদেশের প্রচুর বই পড়া থাকা ভালো। তবে সেটাই আবার সব না। প্রচুর লেখাপড়া করা থাকলে আসলে ঠকে যাওয়ার স্কোপ কম।
৭. একজন ব্লগারের কি তার প্রতি কোন দায়বদ্ধতা আছে? থাকলে কতটুকু? বাংলা ব্লগে দায়বদ্ধতার কী রকম ছাপ দেখতে পান?
– খুব বেশি কোনো দায়বদ্ধতার কিছু আছে বলে মনে করি না, দায়বদ্ধতা খুব বেশি কিছু দেখতে পাই না, এবং সেটাতে অখুশি হই না। ব্লগ থেকে যদি একটা কিছু শেখার থাকে তা হলো স্বতঃস্ফূর্ততা। আপনার যে পোস্ট আরেকজন ব্লগ ব্যবহারকারীর মধ্যে যতটুকু প্রতিক্রিয়া জাগাবে সে ততটা প্রকাশ করবে -যেভাবে সেখানকার existingকালচার এবং নর্মস এলাউ করবে। একথা ঠিক লেখক যেমন পাঠক সৃষ্টি করেন তেমনি পাঠকও লেখক সৃষ্টি করেন। কিন্তু ব্যাপারটা দায়বদ্ধতার মত কঠিন কিছু থেকে না এসে বরং স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে যতটা ঘটে ততটা সুন্দর। আমার লেখার এক লাইন পড়ার পর যদি আপনি আরেক লাইন পড়তে আগ্রহী হন তাহলে সেটা না জানানোর কোনো কারন না ঘটলে আপনি সেটা জানাবেনই এবং আপনার ক্ষেত্রেও আমি তেমনটা করবো। এখানে অনেকে পারস্পারিক তেল ঢালাঢালির মত ব্যাপারে জড়িত হয়ে যেতে পারেন – এবং তখন তারা হয়তো সৃষ্টিশীলতায় মন দেবার সময় কম পাবেন। সৃষ্টিশীল মানুষেরা নিজেদের পথ নিয়ে সচেতন থাকবেন এটাই স্বাভাবিক।
৮. ব্লগের ফিডব্যাক নিয়ে আপনার মন্তব্য কী? সবসময় কি ঠিক মনে হয়?
– ব্লগের ফিডব্যাক ব্লগের ইউজারদের উপর নির্ভর করে – যে মুহুর্তে একটি ব্লগ পোস্ট আসছে সেই মুহুর্তে কারা পাঠক, এবং চব্বিশ ঘন্টায় মূলত কারা পাঠক থাকেন।এই ব্যাপারটি আসলে অনেক কিছু নির্ধারন করে দেয়। এখন অনেক ব্লগ সাইট, এবং সবাই নিজের নিজের পছন্দের সাইট খুজে নিচ্ছেন, যেখানকার পাঠকদের সাথে মতে-রূচিতে বনছে সেখানে থিতু হচ্ছেন অথবা হচ্ছেন না, অথবা ব্লগ ছেড়ে দিচ্ছেন। পৃথিবীতে কিছুই পারফেক্ট না, যে কোনো একজন ব্যক্তির কোনোখানেই আসলে কিছু একটা নিজের জন্য পারফেক্ট রূপে পাবেন সেটা প্রায় অসম্ভব। সব সময় কোনো কিছুকেই সঠিক মনে করে নেবার মত মানসিকতা একজন সৃষ্টিশীল মানুষের না থাকা উচিত – তার হওয়া উচিত সাবধানি ও খুঁতখুঁতে।
৯. ব্লগ আসার পর মানুষ খুব বেশি ওয়েব-নির্ভর হয়ে গেছে, আগের মত বই কিনে পড়ে না – এ নিয়ে আপনার কী মতামত?
– ব্লগে-ওয়েবে (ইন্টারনেট) আসার পর আমার যেটা হয়েছে সেটা হলো আগের চাইতে বৈচিত্র্যময় পড়াশুনা বেড়েছে, আমার তো মনে হয় অনেকেরই সেটা ঘটে। ব্লগে আসার পর আমার আসলে বই কেনা বেড়েছে। আমি এখন আরও বেশি বই এর কনটেন্ট বিষয়ে জানি।
১০. আপনার নতুন প্রকাশিত বই সম্পর্কে পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন?
– আমার নতুন প্রকাশিত বইটি আমার প্রথম বই। এটি কবিতার বই। এর সবগুলি কবিতাই ইন্টারনেটে পূর্বে প্রকাশিত। সূতরাং একজন পাঠক বিনামূল্যে আমার বই এর সব কটি কবিতা পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন। প্রায় সব কবিতা একাধিক ওয়েবসাইট যথা চতুর্মাত্রিক, সামহোয়্যারইন ব্লগ এবং মুক্তমঞ্চে প্রকাশিত। ইচ্ছা আছে সরবে সবগুলি কবিতা একত্রে উপস্থাপন করার তবে তার আগে জানতে ইচ্ছা হয় সরবে কবিতা খুজে পাচ্ছি না কেন 😉
বই – পেজগি
প্রকাশক – Chariot
প্রকাশকাল – একুশে বইমেলা ২০১২
মূল্য – ৪৩ টাকা
পূর্বে প্রকাশিত সাহিত্যস্বর:
আয়নায় মুখোমুখি ব্লগার-লেখক(৬): নুরুন্নবী হাছিব
আয়নায় মুখোমুখি ব্লগার-লেখক(৫): নির্ঝর নৈঃশব্দ্য
আয়নায় মুখোমুখি ব্লগার-লেখক(৪): মাইনুল এইচ সিরাজী
আয়নায় মুখোমুখি ব্লগার-লেখক(৩): আবদুল্লাহ আল মাহমুদ
সাক্ষাৎকারটা ভাল লাগলো।
আপনার ব্লগের একটা পোস্ট দেখেছিলাম সেদিন, চতুর্মাত্রিকে। 🙂
কবিতাগুলো খুঁজে খুঁজে পড়ে ফেলতে হবে তো।
আর সরবে কবিতা নেই দেখে আমরা কবি ব্লগারদের হারাচ্ছি! 🙁 হায় হায়! নিজেকেই তাড়াতাড়ি কবিতা লিখতে বসে যেতে হবে দেখি। 😛
হে হে কেন নয় অবশ্যই লিখবেন 😀
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাদের সকলকে 🙂
আমারও একই প্রশ্ন সরবে কবিতা কই 😛 😛
কিছু মনে হয় আছে স্বপ্ন বিলাস ভাইয়ার , তবে আরও চাই।
সুস্মিতা আপির কবিতা পড়ার জন্য অপেক্ষায় রইলাম যদিও আমি কবিতার পাঠক হিসেবে অনেক নিম্ন মানের 🙁
হে হে খুব শিগগিরিই কবিতা দিব (আশা করছি 🙂 ) হি হি 😀 😀
সরব এ কবিতা ট্যাগের আন্ডারে আছে এই সব
http://shorob.com/category/%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%B9%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AF/%E0%A6%95%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A6%BE/
আমি নিজে কবিতার একজন মনোযোগী পাঠক যদি একটি রাজনৈতিক হয় আর কি! কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধের প্রতি আগ্রহ অনেক বেশি।
আপনি শুরু করে দিন সরব এ কবিতা লেখা।
দায়বদ্ধতা নিয়ে আপনার চিন্তাটা ভালো লাগল।
আপনার উত্তরগুলো আমার দারুণ লেগেছে।
বই এর জন্য শুভকামনা। আমার লিস্টে থাকল 😀
সে তো আমি জানি 🙂 🙂 তাই তো ভাবছিলাম তুমি কই! এখানে তুমি এই নামেই আছো কিনা!
থ্যাংকু 🙂
থ্যাংকু 🙂
হে হে অনেক অনেক ধন্যবাদ 🙂
অনেকক্ষণ ধরে ভাবতেছিলাম কি মন্তব্য করা যায়।
একটা কথাই মাথায় আসতেছে……..
তুমি মুখ শক্ত করে কথা বলো নাই।
ওয়েল ডান।