আমলারা নিজেরাই একটা পার্টি- আহমদ ছফা

আহমদ ছফা খুবই প্রিয় একজন লেখক। নিম্নের লেখাটি ১৯৯৬ সালে লেখা হয়। কিছু অংশ তুলে দিলাম। এই প্রবন্ধটি নিয়ে ভবিষ্যতে আলোচনার ইচ্ছে আছে। তখন লেখাটি পড়ে নিলে সহজ হবে। 

আমলাতন্ত্র রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা স্তম্ভ। ইংরেজী গ্রামার সম্পর্কে যে কথাটি চালু আছে ‘A good servant but a bad master’ – আমলাতন্ত্র সম্পর্কেও এ কথাটি বলা যেতে পারে। গুনার মিরডাল ‘এশিয়ান ড্রামা’ গ্রন্থে তৃতীয় বিশ্বের যে রাষ্ট্রগুলোকে Soft States বলে চিহ্নিত করেছেন, সেগুলোতে আমলাতন্ত্র দোর্দণ্ড প্রতাপের অধিকারী। এই নড়বড়ে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সাধারণত কোনো সরকার স্থায়ী হয় না। হয়তো গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে এক সরকার এল, সেই সরকারের ব্যর্থতাকে পুঁজি করে সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করে বসে। সামরিক সরকারের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে জনগণ অভ্যুত্থানে ফেটে পড়ল। এই যে বারবার সরকার পরিবর্তনটি হয়, আমলারা এই সকল পরিবর্তনের মধ্যেই রাষ্ট্রের হালটি ধরে থাকে। যেহেতু গোটা প্রশাসন ব্যবস্থাটা আমলাদের হাতে থাকে যে কোনো ধরনের সরকার আসুক না কেন আমলাতন্ত্রের কাছে সারেণ্ডার করতে হয়। আমলাতন্ত্রের স্বার্থে যে সরকারই আঘাত করুক না কেন তাকে খেসারত দিতে হয়।

সরকারের দফতরগুলো যে সকল ব্যক্তি চালিয়ে থাকেন তাঁরা রক্তমাংসের মানুষ হলেও তাদের মানুষী চেহারাটা দফতরের আড়ালে গোপন থেকে যায়। তাই অনেক সময় আমলারা গর্ব করে নিজেদের Faceless Bureaucrat বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। আমলারা অনেক সময় বলে থাকেন, ‘সরকার আসবে, সরকার যাবে কিন্তু আমরা চিরস্থায়ী। আমাদের অবস্থানের কোনো হেরফের নেই।’ কাবাবে যেমন হাড্ডি, মাছে যেমন কাঁটা তেমনি রাষ্ট্রযন্ত্রে আমলার অবস্থান একটি তর্কাতীত সত্য। অস্থিতিশীল রাষ্ট্রসমূহে আমলাতন্ত্রই সর্বাধিক ক্ষমতার মালিক হয়ে থাকেযাঁর হাতে অধিক ক্ষমতা দুর্নীতি করার প্রবণতাও তার ততোধিক। সাধারণ অর্থে আমলাদের দুর্নীতিপরায়ণ বলেই মনে হয়। সরকারের কোর্ট-কাচারী, অফিস-আদালত, দফতরসমূহের চেয়ার-টেবিল, দরজা-জানালা পর্যন্ত ঘুষ দাবী করে থাকে। এ জিনিসটা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। এ কারণে আমলাদের প্রতি সাধারণ জনগণ একটি ঘৃণাব্যঞ্জক মনোভাব পোষণ করে থাকেন। তারপরও একথা সত্য যে আমলাতন্ত্র ছাড়া কোনো রাষ্ট্র চলতে পারে না। আমলাদের লোভ-লালসা-দুর্নীতি যদি কোনো সরকার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বন্ধ করতে পারে তাহলে সে সরকারকে অবশ্যই ভালো সরকার বলতে হবে।

বাংলাদেশের বর্তমান আমলাতন্ত্র সম্পর্কে কিছু বলার আগে আমি আমার দুজন বন্ধুর কথা উল্লেখ করব। একবার আমি আমার বন্ধু তপন চক্রবর্তীর কাছে গিয়েছিলাম। সে চাকরী করত বাংলা একাডেমীতে। তপন এবং মোতাহার সাহেব একজন হতাশ আমলা ও তার চামচার ভূমিকা অভিনয় করে দেখিয়েছিলেন। চামচা বলছে, ‘স্যার, আপনি তো খুব সুখে আছেন, ভালো আছেন। রিটায়ার করেছেন। ছেলেমেয়েরা বিদেশে। বিবি সাহেব রিটায়ার করবেন। তিনটা বাড়ী, দুটো গাড়ী।’ আমলা ভদ্রলোক জবাব দিচ্ছেন – ‘মোতাহার, আমাকে কেউ বুঝল না। আমার অন্তরে কি দুঃখ কেউ খবর নিল না।’ ‘আপনার কেন দুঃখ হবে স্যার? তিনটি বাড়ী দুটো গাড়ী সব মিলিয়ে জমজমাট অবস্থা।’ আমলা ভদ্রলোকের জবাব, ‘মোতাহার, তুমি বাইরেরটা দেখলে, ভেতরটা দেখলে না। আসল খবর আমি তোমাকে জানাই – তোমাদের রাজনৈতিক পরিভাষায় আমি সর্বহারা মানুষ। যে তিনটে বাড়ীর কথা বলছ তার একটাও আমার নয়। ধানমণ্ডির বাড়ীর মালিক তোমার ভাবী, উত্তরার বাড়ী বড় মেয়ের, লালমাটিয়ার বাড়ীটি ছোট ছেলের। দেখতে পাচ্ছ আমার মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। তোমার ভাবী এবং ছেলেমেয়েরা বের করে দিলে আমাকে রাস্তায় দাঁড়াতে হবে। এখন গাড়ীর কথায় আসি। পাজেরোটার মালিক তোমার ভাবীর বড় ভাই। আমাকে শুধু চালাতে দিয়েছে। টয়োটা মেজো ছেলের। এখন বুঝতে পারছ আক্ষরিক অর্থেই আমি সর্বহারা। মনে দুঃখ থেকে গেল মোতাহার, এই জিনিসটি আমি কাউকে বোঝাতে পারলাম না। মাঝে মাঝে আমার বুক চাপড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কাঁদবার অভ্যাস নেই বলেই পারি না।’

আমার বন্ধু ফরহাদ মজহার আনসারদের নির্যাতনের ওপর লেখা ছেপে একমাস জেলে গিয়েছিল। জেল থেকে ফিরে এসে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে ‘আজকের কাগজ’-এ একটা লেখা লিখেছিল। সে লিখেছিল – জেলখানায় ব্যবসায়ী দেখেছে, রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী দেখেছে, দু’চারজন মৌলানা সাহেব দেখেছে, এমনকি সামরিক বাহিনীর কিছু লোককে জেল খাটতে দেখেছে। জেলখানাতে কোনো সরকারি আমলার সঙ্গে ফরহাদের দেখা হয়নি। অর্থাৎ আমলারা এমন এক জাত যতই অপরাধ করুক তাদের জেলে যেতে হয় না। জবাবদিহি করতে হয় না।

এমনও দেখা গেছে, নতুন সরকার এলে পুরনো সরকারের লোকদের জেলে পাঠায়। তাদের নামে নানারকম অভিযোগ হাজির করে। আইয়ুব খানের সরকার, মুজিবের সরকার; জিয়া, এরশাদ, খালেদা সবগুলো সরকারের আমলে আমলাদের নামে কেউ টুঁ শব্দটি উচ্চারণ করেনি। আমলাতন্ত্র এমন জিনিস – দুর্নীতি তারা করে কিন্তু প্রমাণ রাখে না। সব দোষ সরকারের লোকদের উপর গিয়ে বর্তায়। কিন্তু আমি একথাও বলব সমস্ত আমলা খারাপ এবং দুর্নীতিপরায়ণ নন। অনেক সৎ এবং দেশপ্রেমিক আমলাও আমি দেখেছি। আমার একজন উচ্চপদস্থ সচিব-স্তরের আমলা বন্ধু আছেন। যিনি ধার করে কোরবানীর গরু কিনেছিলেন।

(বোল্ড ইটালিকরণ বর্তমান পোস্টকারক এর!)

পৌনঃপুনিক সম্পর্কে

আব্দুর রাজ্জাক, আহমদ ছফা - এদের না পড়লে বাংলাদেশের জন্মের অনেক কিছুই বোঝা যাবে না।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে চিন্তাভাবনা-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

5 Responses to আমলারা নিজেরাই একটা পার্টি- আহমদ ছফা

  1. পৌণঃপুনিক বলেছেনঃ

    সরব এ প্রথম পোস্ট। অনেক চেষ্টা করেও সাফারি থেকে ছবি আপলোড করতে পারলাম না।

  2. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    আহমদ ছফা খুবই খুবই প্রিয় একজন লেখক।
    চিন্তাও অন্যরকম।
    আমলাদের ব্যাপারে এই রকম একটা আইডিয়া ছিলো।
    অনেকবার শুনেছি দেশ চালায় সচিবরা! আমাদের অর্ধশিক্ষিত প্রায় অশিক্ষিত মন্ত্রীরা তো আসলেই সচিবদের পুতুল!

    ইদানিং একটা কথা মাথায় বার বার আসছে! who will guard the guards? পুলিশ ঠিক নাই, আমলারা কোন কালেও ঠিক ছিলো না [১৯৯৬ সালে লেখা! অথচ এখনও কতটা প্রাসঙ্গিক! ]

    আপনার চিন্তাভাবনা গুলা শেয়ার করুন প্লিজ 🙂

  3. বোকা মানুষ বলেছেনঃ

    আসলেই আমলারা মহা শক্তিশালী প্রাণী।
    কালে ভদ্রে এদেরকে আমরা দেখি। চাকুরি জীবন শেষে তারা বড় সমাজের মানুষ হয়ে যান!
    একবার আমাকে একজন বলেছিলেন- যে রিকশাওালার ঘামের টাকায় আমার বেতন হয় সে একদিন না খেয়ে থাকলেও রাষ্ট্র তার দায়িত্ব নেবে না। কিন্তু আমার বেতন কখনও বন্ধ হবে না!

    আরেক জন মানুষ সম্পর্কে জানি। এই রোজার ক’টা দিন মাত্র আগে মারা গেলেন। সচিব ছিলেন এমন এক মন্ত্রনালয়ের যেখান থেকে কোটি টাকা বাঁ হাতের কাজ করা কোন ব্যপার-ই না।
    কিন্তু তিনি করেন নি। তাই অবসর নেয়ার কয়েক মাসের মাথায় মারা গেলেন। কারন যে চিকিৎসা তার লাগবে তার জন্য তার পরিবারকে খরচ করতে হবে প্রায় ৫ লাখ টাকা! ভদ্র লোক কারো কাছে কিছু বলেন নি প্রচণ্ড আত্মসম্মান বোধের কারণে।

    খুব চুপে চুপে চলে গেলেন। ইচ্ছে আছে সরব’ এর বন্ধুদের সাথে তার কথা শেয়ার করবো।

  4. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    হায় এই আমলাদের বেড়াজাল ! আহমেদ ছফা কত আগেই কত প্রাসঙ্গিক কথা বলে গেছেন ! ধন্যবাদ শেয়ার করার জন্য ।
    সরবে স্বাগতম। :welcome:

  5. awakenbd বলেছেনঃ

    আমলাগণের পলিটিশিয়ান-পায়রামী কালচার

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।