১।
ম্যাক্রোইকনমিক্স ক্লাস করে এসে ক্যান্টিনে খাচ্ছিলাম, এক বন্ধু কথা প্রসঙ্গে বলল, হুমায়ুন ফরীদি মারা গেছেন…শুনার পরে একটু স্থির হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি বললি তুই? ও বলল খাবরটাতো সকালের, জানিস না তুই?
তখন ক্লাস থ্রি বা ফোরে পরতাম…আব্বু একদিন টিভি কিনে নিয়ে আসলেন…হুমায়ুন ফরীদির কোনো একটি নাটক দেখেই ওঁনার ভক্ত হয়ে যাই…এরপর থেকে ওঁনার কোনো নাটক বা সিনেমা দেখার সুযোগ থাকলে আমি মিস করতাম না…
অনেক কাজ জমে আছে, ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছি, হাত চলছে না…
এই লোকটাতো কি আমার কাছের কেউ? না।
আত্নীয় হয়? না।
কোন দিন দেখা হয়েছে? না।
তাইলে আমার চোখে পানি আসলো কেন??!!
২।
এইখানে আমাদের আড্ডার একটা কমন টপিক—পড়াশুনার পরে দেশে ফিরে যাওয়া উচিৎ কিনা। দেশকে ভালোবাসার কোনো কমতি দেখি না কারো মাঝে…দেশের জন্য কিছু করতে সবার প্রবল আগ্রহ, কিন্তু ফিরে যাবার ব্যাপারে অনেকেই সন্দিহান। কারন কি?
দেশ নিয়ে সবার মধ্যে এক ধরনের হতাশা অনিশ্চয়তা। একটার পর একটা খারাপ খবর…ক্যাম্পাসে ছাত্র হত্যা, প্রশাসনে দুর্নীতি-স্থবিরতা, জাতীয় স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রশ্নবোধক ভুমিকা, আরো কত কি…হতাশার লিষ্ট যেনো শেষ হতে চায় না!
হুমায়ুন ফরীদি তাঁর শেষ লেখায় বলেছিলেন
”… আমার এক বন্ধু চলে গেছে বিদেশে। আমি তাকে বললাম, মুক্তিযোদ্ধা হয়ে তুই দেশ ছেড়ে চলে গেলি! ও আমাকে অদ্ভুদ একটা কথা বলেছিলো। ও বললো, এই দেশটার জন্য যুদ্ধ করি নাই, বন্ধু। যেই দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলাম সেটা এই দেশ না। এই দেশটা কুৎসিত হয়ে গেছে, এই দেশটা বেঁচে থাকার জন্য অমানবিক এবং বিশ্রী। এরকম অসভ্য একটা পরিবেশে আমি কেন থাকবো? আমি তো সভ্য মানুষ।
আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাসে আছে যে আমরা হচ্ছি সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ। কিন্তু কোথায়, কোথায় আমরা শ্রেষ্ঠ? আমরাতো শ্রেষ্ঠত্ব দাবী করতে পারি না। আমাদের দেশের যিনি নোবেল পুরস্কার পেলেন তাকে আমরা অপমান করি। কল্পনা করা যায়? ”
তিনি আরো লিখেন
“…শুধু ভোট পাওয়ার জন্য রাজনীতি আর দেশের উন্নয়নের জন্য রাজনীতি এক কথা নয়। আমাদের দেশটাকে রাজনীতিবিদরা যখন যথার্থভাবে ভালোবাসবেন, যখন যথার্থভাবে তাদের মধ্যে দেশপ্রেম জেগে উঠবে, তখনই এই সংস্কারগুলো করা সম্ভব। দেশটা ক্রমশঃ বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে। সেটা শুধু একা আমার জন্যে না– আমার একার কথা আমি ভাবছিনা–একটা সম্প্রদায় হিসেবে আমি ভীত হয়ে পড়েছি। দেশটা চলছে কীভাবে?”
তিনি লেখাটা শেষ করেন এইভাবে
“…সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো সঠিক জায়গায় সঠিক মানুষটি নাই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সব অযোগ্য মানুষ ক্ষমতা নিয়ে বসে আছে। একটা মুর্খলোক কী দেবে মানুষকে? সে মানুষকে কোন পথ দেখাবে? সে তো নিজেই অন্ধ। তার তো জ্ঞান নাই। এই অবস্থায়–আমার প্রশ্ন– আমরা এখন কী করবো? ”
৩।
প্রিয় অভিনেতা উইল স্মিথের Pursuit of Happyness সিনেমায় জবলেস ক্রিশ গার্ডনারকে এক সময় তাঁর স্ত্রী ছেড়ে চলে যান, নিজের বাসা থেকে বিতাড়িত হয়ে চার্চের আশ্রয় কেন্দ্রে রাত যাপনে বাধ্য হন…এমনকি একদিন জায়গা না পেয়ে সাবওয়ের টয়লেটে সন্তান সহ থাকতে বাধ্য হন। নানান ঘটনার মধ্য দিয়ে শেষে ক্রিশ গার্ডনারের জব পারমানেন্ট হয়…সেদিন ডে-কেয়ার সেন্টারে গিয়ে পিচ্চি ছেলেকে জড়িয়ে ধরার আবেগঘন দৃশ্যটা দেখে অনেকক্ষণ কেঁদেছিলাম…পরে গার্ডনার নিজেই একটি ব্রোকারেজ ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেন…হয়ে যান মাল্টি মিলিওনিয়ার।
এই সিনেমাটা আমাকে স্বপ্ন দেখতে আর স্বপ্ন নিয়ে Struggle করতে শিখিয়েছিল…কিন্তু এখন “স্বপ্ন” শব্দটা শুনলে কেমন যেন প্রতারনা প্রতারনা মনে হয়…
দুঃস্বপ্নগুলোই প্রতিদিনের স্বপ্ন হয়ে গেছে…
যে কথা গুলো বলেছে আমরা সবাই সেটা বুঝি জানি। তাও চুপ করে সহ্য করি। এটাই বুঝি আমাদের নিয়তি।
নিয়তি কি মেনে নিতেই হয়???
আসলেই তো আমাদের চোখ কেন ভিজে যায়?
কিন্তু আমাদের স্বপ্ন দেখা তো বন্ধ করা চলবে না!
হুম, স্বপ্ন দেখা বন্ধ করা চলবে না!
”… আমার এক বন্ধু চলে গেছে বিদেশে। আমি তাকে বললাম, মুক্তিযোদ্ধা হয়ে তুই দেশ ছেড়ে চলে গেলি! ও আমাকে অদ্ভুদ একটা কথা বলেছিলো। ও বললো, এই দেশটার জন্য যুদ্ধ করি নাই, বন্ধু। যেই দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলাম সেটা এই দেশ না। এই দেশটা কুৎসিত হয়ে গেছে, এই দেশটা বেঁচে থাকার জন্য অমানবিক এবং বিশ্রী। এরকম অসভ্য একটা পরিবেশে আমি কেন থাকবো? আমি তো সভ্য মানুষ।”
ঠিক কখন একজন মুক্তিযোদ্ধা এমন কথা বলেন ? যেই দেশের জন্য এত ত্যাগ সেই দেশটাকে এমন দেখতে কার ভালো লাগে??
হুমায়ুন ফরীদি নেই, ভাবতেই জানি কেমন লাগে, এভাবে করে দেশের এত ভালো ভালো মানুষগুলো মারা যাচ্ছেন! আমদের জাতিটা না আবার ভালো মানুষ শূন্য হয়ে পড়ে 🙁 ভালো মানুষের বড়ই অভাব ।
সব কিছু এখন অসভ্যদের দখলে :@
ইদানিং শুধু মৃত্যুসংবাদ শুনি।
আর সব ভালো মানুষগুলি এই কথা ভেবে ভেবেই বিদেশ চলে যায়।
…আর আমাদের সমস্যা আরো প্রকট হয়, অসভ্যরা আরো শক্তিশালী হয়
যারা পলায়নপর মনোবৃত্তির, দেশকে দেওয়ার আর বদলে দেওয়ার ব্যাপারে আত্নবিশ্বাস নাই, তারা যাবেই। এদের জন্য মন খারাপ করার কিছু নাই। আর ভাল মানুষ আমাদের তেমন দরকার নাই, আমাদের দরকার আত্ন বিশ্বাসী আর দক্ষ মানুষ, বিশেষ করে পিপুল স্কিলে স্কিল্ড মানুষ।
agreed 🙂
“দুঃস্বপ্নগুলোই প্রতিদিনের স্বপ্ন হয়ে গেছে…”
সহমত।
তবুও স্বপ্ন দেখতে হবে ভালো কিছুর। আমরা না দেখলে কারা দেখবে?
সহমত 🙂
কত আশা নিয়ে এখনও স্বপ্ন দেখে যাচ্ছি! পোড়া মন যে বাধা মানে না।
আপনার কথাটা খুব ভাল লাগলো 🙂
হুমায়ুন ফরিদী আমারও খুব প্রিয় অভিনেতা ছিলেন। কোন একটা চরিত্রের কথা বলতে পারবো না, যেটায় তিনি মিশে যেতে পারেন নি।
দেশ নিয়ে ভাবনাটা আমাদের সবার আছে। কিন্তু, সমস্যা হলো, যে যেখানে থাকলে সমস্যা সমাধান হবে, সে সেখানে নেই। 🙁
হুমায়ুন ফরিদী একই কথা বলেছিলেন…কিন্তু আমাদের শুরু করতে হবে, কিছু একটা করতে হবে…
… আমার এক বন্ধু চলে গেছে বিদেশে। আমি তাকে বললাম, মুক্তিযোদ্ধা হয়ে তুই দেশ ছেড়ে চলে গেলি! ও আমাকে অদ্ভুদ একটা কথা বলেছিলো। ও বললো, এই দেশটার জন্য যুদ্ধ করি নাই, বন্ধু। যেই দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলাম সেটা এই দেশ না। এই দেশটা কুৎসিত হয়ে গেছে, এই দেশটা বেঁচে থাকার জন্য অমানবিক এবং বিশ্রী। এরকম অসভ্য একটা পরিবেশে আমি কেন থাকবো? আমি তো সভ্য মানুষ। …
এই অংশটুকু পড়ে মনটা অনেক খারাপ হইছে 🙁