আজকে গুগল ডুডল দেখে কেউ কেউ হয়তো অবাকই হবেন। কারণ, আজকের ডুডলটিতে ‘গুগল’ লেখাটি দেখা যায় না। কেবল আঁকাবাঁকা কিছু ঢেউ খেলানো রেখা। (ভেতরকার কোন উপায়ে এটা প্রদর্শন করা হয়েছে কি না আমার জানা নেই।)। তবে, অসম্ভব ভালো লাগল, ইলেক্ট্রোমেগনেটিজমের প্রাণপুরুষ, হেনরীখ রুডলফ হার্জের ১৫৫তম জন্মদিনকে উৎযাপন করতেই এই অদ্ভুত ডুডলটি। এই দিনের খুশিতে পাঠকদের কিছু কষ্ট দিতে ইচ্ছা তো করবেই। তাই ফটাফট কিছু লিখে ফেললাম।
জন্ম থেকেই মেধাবী ছাত্র:
একসময়কার স্বাধীন জার্মান কনফেডারেশনের হামবুর্গে, বেশ বনিয়াদী পরিবারে তার জন্ম হয় ১৮৫৭ এর ফেব্রুয়ারীর ২২ তারিখ। পিতা গুস্তাভ হার্জ ছিলেন লেখক ও আইনসভার সদস্য। আর মাতা এ্যানা এলিজাবেথ ফেফার্কন ছিলেন পেশায় ডাক্তার। ছয় বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি হবার পর থেকে একের পর এক মেধার সাক্ষর দিতে দিতে উত্তির্ণ হয়েছেন ছোট্ট হার্জ। খুটিনাটি ছোটখাটো গবেষণার জন্য পরীক্ষণ তৈরী করা ছিল তার সখের মতো। আর ভাষাশিক্ষণের জন্য ছিল আশ্চর্য ঝোঁক। হাতের কাজ, বিশেষ করে কাঠের কাজে তার আগ্রহ ছিল অসাধারণ। তার উপর, স্বাভাবিক পড়ার বিষয়ের বাইরে আরো অনেক বিষয়ে পড়তে পড়তেই ছাত্রজীবন শেষ করেন তিনি।
তাঁর অসাধারণ ব্যবহারিক জ্ঞানের প্রতি আস্থা রেখে, আর সকলের পরামর্শে তিনি প্রকৌশলী হবার সিদ্ধান্ত নিলেন। (আজকাল আমাদের দেশে মেধাবী ছাত্ররা যেই সিদ্ধান্ত স্বভাবতঃ নিয়ে থাকে।)
ইঞ্জিনিয়ারিং জীবন:
সেকন্ডারী ধাপের পড়াশোনা শেষে হাতে কলমে প্রকৌশলী হতে তিনি গেলেন ফ্রাংকফুটে। ১৮৭৫এ। ওখানে গিয়ে লেগে গেলেন বিল্ডিং এর কাজে (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং আর কী)। কিন্তু বেরসিক ঘর বানানোর কাজে কি এই সৃষ্টিশীল মানুষটির মন ভরে? তিনি কেন জানি আনন্দ পেলেন না এই কাজে। তারপরও সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না করে চালাতে লাগলেন কাজ আর পড়াশুনা। কিন্তু, দিনের পর দিন তার কাজে আগ্রহ হারাতে থাকেন। সাধারণ প্রকৌশলের কাজ তার কাছে ঠেকত ‘বই বাঁধা’ বা ‘কাঠ কাটার’ মতো নিরস। আবার সাথে সাথে ‘ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যাথমেটিকস’এর নানান মজার বিষয়ে তিনি পেতে লাগলেন প্রচন্ড আনন্দ। ধীরে ধীরে তার নিজের স্বাপ্নিক-কাজকে বুঝে নিলেন তিনি।
এখন পড়লেন নতুন ঝামেলায়। হতে চান গবেষক। এজন্য দরকার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া । আর এজন্য প্রয়োজন বাবার সম্মতি ও আর্থিক সহায়তা। এখন, বাবা নিশ্চয়ই ছেলের নিশ্চিত ইনজিনিয়ারিং ভবিষ্যৎ ফেলে আবার পড়াশুনায় ফিরে আসাটা সমর্থন করবেন না। কিন্তু, সৌভাগ্যের ব্যাপার, হার্জ যখন তার নিজের একেবারে ভেতরকার ইচ্ছা, উপযুক্ত যুক্তি আর আবেগ দিয়ে পিতাকে বুঝিয়ে বললেন, তার পিতা সম্মত হলেন তার পড়াশোনার টাকার যোগান দিতে। জাত গবেষক হার্জ ১৮৭৭ সালে ছুটে গেলেন মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে।
চৌম্বকতড়িৎবিদ্যার সেই যুগ:
সেই সময়ে তড়িৎচৌম্বকবিদ্যার নতুন দিক উন্নয়ন চলছে। ফারাডে (১৮৩১), লেন্জের (১৮৩৩) সূত্রের প্রয়োগে তড়িৎ বিদ্যা আর চৌম্বক বিদ্যার যুগপৎ পথচলা তখন প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু, হাজার বছর পুরনো আলোক বিদ্যার সমৃদ্ধ গবেষণার কোন কুল কিনারা সম্ভব হচ্ছিল না। এদিকে ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল গাণিতিকভাবে প্রমাণ করে রেখেছেন, ‘আলো হলো আরেক তড়িৎচৌম্বকীয় ঘটনা’ (১৮৭৩)। আলোকে তড়িৎচৌম্বক বিকিরণ ধরে নিলে, আলোকবিদ্যা আর চৌম্বকবিদ্যার নানান অজানা সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন বিজ্ঞানীরা। ঠিক এই সময়েই হার্জ এলেন বিজ্ঞানের মহান মাঠে খেলোয়াড় হয়ে।
দুই বছর গণিতের মূল বিষয়গুলো আর পদার্থবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা আর জ্যোতির্বিদ্যার উপর কোর্স করলেন মিউনিখে। তারপর, বার্লিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবর্তিত ছাত্র হিসাবে গেলেন। পেলেন তখনকার তড়িৎবিদ্যার দুই মহারথী অধ্যাপক হেলমন্টজ আর কার্শফকে। হ্যালমন্টজ এর সহায়তায় ‘তড়িৎ জড়তার’ উপর একটা গবেষণা পুরস্কার হাতিয়ে নিলেন এই উদীয়মান বিজ্ঞানী।(১৮৭৯)
হ্যালমন্টজের তড়িৎবিদ্যার গবেষণায় এই প্রমাণিত বিজ্ঞানীকে আরো নানান কাজে লাগাতে চাইলেন। কিন্তু, গণিতের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হার্জ লেগে থাকলেন ম্যাথমেটিকাল ফিজিক্সের গবেষণায়। ১৮৮২-৮৫ সাল পর্যন্ত নানান থিওরীর উপর চালাতে লাগলেন কলম। বের হলো বেশ কিছু পেপার। এর মধ্যে ম্যাক্সওয়েলের তরংগসূত্রের উপর পেপারে (১৮৮৪) তিনি ধারনা দিলেন ‘বায়ু-মাধ্যমে-তড়িৎচৌম্বক-তরংগ’ সংক্ষেপে ‘বায়ু-তরংগ’এর। যেটা কিনা আসলে, পরবর্তী রেডিও তরংগের মূল সার।
১৮৮৬ সালে বিয়ে করেন তিনি। গবেষণা থেকেও কেন জানি একটু দূরে সরে গেলেন। আসলে বুঝতে পারছিলেন না কি নিয়ে কাজ করবেন। ওদিকে হাল ছাড়েননি হ্যালমন্টজ। তাকে কিছু গবেষণায় কাজ করতে ডেকে পাঠালেন। সাড়া দিলেন হার্জ। যদিও হার্জ তখনো বুঝতে পারেন নি, তার বায়ু-তরংগের ধারনাটিতে কত বিশাল সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে।
যাই হোক, ১৯৮৮তে অপর এক বিজ্ঞানীর পরামর্শে হার্জ আবার ম্যাক্সওয়েলের তরংগ সূত্রের উপর কাজ আরম্ভ করলেন। তার নিজের দেওয়া ‘বায়ু-তরংগের’ ধারনা নিয়ে চিন্তা করলেন। গানিতিক প্রমাণ হয়ে গ্যাছে। কিন্তু, বাস্তব প্রমাণ চাই। আর এজন্য চাই বাস্তব পরীক্ষণ যন্ত্রের। ছোট বেলা থেকে ব্যবহারিক জ্ঞানে অগ্রগামী, একসময়ের প্রকৌশলী এবং তড়িৎবিদ্যায় বিদগ্ধ এই বিজ্ঞানী, নিজের মেধার সাক্ষর রাখলেন আবার।
আবেশক আর ধারকের সাহায্য নিয়ে উচ্চবিভবের একটি কম্পক তৈরী করলেন তিনি। (আজকের ইঞ্জিনিয়াররা যেটাকে এলসি-অসিলেটর বলে চিনে থাকে।) সেটা দিয়ে রেডিয়েটরের মত কাজ করিয়ে তিনি ১২ মিটার দুরের এক প্রতিফলক দিয়ে তৈরী করলেন স্থির তড়িৎচৌম্বক তরংগ। আর একটি রিং ডিটেকটর দিয়ে নিশ্চিত করলেন এই তরংগের অস্তিত্ব। প্রথিবীর বুকে প্রথম প্রমাণিত হলো, শুধু দৃশ্যমান আলো নয়, যে কোন তরংগ আলোর বেগে ছুটে যেতে পারে বহুদূর। প্রমাণিত হলো, বহু বছর আগের ম্যাক্সওয়েলের দেয়া সূত্র। গাণিতিক পদার্থবিদ্যা এগিয়ে গেল বিশাল ধাপ। বাস্তবিক আবিষ্কৃত হলো রেডিও তরংগ (হার্জ রেডিয়েশন)।
প্রকৃতির অমোঘ পরিহাস:
রেডিও বা বেতার তরংগের সুবিশাল সম্ভাবনার কিছুই দেখে যেতে পারেন নি এই বিজ্ঞানী। মাত্র ক’বছর পরই, একটি ইনফেকশনের কারণে এ বিজ্ঞানী পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। বয়স মাত্র ৩৬।
তখনও তিনি জানতেন না, তিনি আমাদের জন্য, ভবিষ্যৎ মানুষদের জন্য কত বিশাল আবিষ্কার রেখে গেলেন। পৃথিবীর মানুষ তাই তাকে সম্মান জানাতে, তড়িৎচৌম্বক তরংগ মৌলিক ধর্ম, কম্পাংক পরিমাপের একক হিসেবে হার্জ কে মনোনীত করল।
আজ বহু বছর পর আমরা রেডিওর টিওনার ঘুরাই। কত কিলোহার্জে কতো ম্যাগাহার্জে খুঁজতে থাকি। সঠিক কম্পাংকে চলতে থাকে অনুষ্ঠান। মোবাইল যোগাযোগ পুরো পৃথিবীকে কতই না সহজ করে দেয়। সবকিছুর পেছনে, যে রেডিও তরংগের আবিষ্কার, যা না হলে বিজ্ঞানীরাই বিশ্বাস করতেন না রেডিও তরংগের অস্তিত্ব, সেই আবিষ্কার করে দিয়ে আমাদের চিরঋণী করে রেখেছেন এই মহান বিজ্ঞানী।
হে মহান বিজ্ঞানী হার্জ, আপনার জন্মদিনে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলী।
শুভ জন্মদিন।
:happybirthday:
মহান উক্তি:
The rigour of science requires that we distinguish well the undraped figure of Nature itself from the gay-coloured vesture with which we clothe her at our pleasure.
দারুন লেখা। :clappinghands:
হে মহান বিজ্ঞানী হার্জ, আপনার জন্মদিনে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলী। “শুভ জন্মদিন”
:happybirthday:
এই ধরনের জীবনী গুলো পড়তে ভালো লাগে, উৎসাহব্যঞ্জক। চালিয়ে যান। :clappinghands:
আমার কাছেই ছবিটা খুব মজার লেগেছে। এমনি কিছু ভেবেছিলাম জানি তো গুগুল কি মজার সব কান্ড করে 🙂
ভাইয়া আপনার এই নিয়ে লেখাটা ভাল হয়েছে তো। 🙂 জানাও হয়ে গেল এই নিয়ে।
লেখাটা দারুণ। গুগুল ডুডলে তাদের রং কিন্তু ঠিক রেখেছে।
:happybirthday:
হার্জের সাথে আমার বেশি মিল আছে দেখি! 😛 আমার “সৃষ্টিশীল”(!) মনও বেরসিক ঘর বানানোর কাজে ভরে না। 🙁
উনি এত অল্প বয়সে মারা গেছেন, জানতাম না এটা। কী দামি অথচ কী ছোট্ট জীবন!
আর লেখাটা বেশ ভাল হয়েছে। গতানুগতিক জীবনী টাইপ লেখাগুলির মত অত বোরিং হয় নি। ভাল লেগেছে পড়ে। 🙂
#শব্দের শেষে বিসর্গ হয় না, “স্বভাবতঃ” না, স্বভাবত। 🙂
দারুণ একটা লেখা! ফটাফট এত চমৎকার লিখেন?! তাইলে আরও বেশি লিখেন না কেনো?
প্রিয় স্বরে নিয়েছি
কম্পক যেটাকে বললেন, ইংরেজি ব্রাকেটে না লিখলে বুঝতাম ই না!
এত অল্প বয়সে মারা গেছেন ভাবতেই খারাপ লাগছে 🙁
ভালো লাগল পড়ে।
ডুডল টা দেখে খুব মজা লেগেছে, লেখা পড়ে অনেক ভালো লাগলো…।
ইন্সপায়ারিং!
🙂
ইন্সপায়ার্ড!
চমৎকার লেখা 😀
এই মহান বিজ্ঞানীর জন্য শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।
ভালো লেগেছে 😀
:love:
আরও এমন লেখা আশা করি