পিলখানায় যখন বিদ্রোহ হয় সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে ছাড়া পাই।
কাজ করতাম একটা শব্দ মাধ্যমে। কাজ ছিল বিভিন্ন ঘটনা মানুষকে জানানো।
আমার রেকর্ডার অন করা ছিল। রেকর্ড করে যাচ্ছিলাম। আশপাশের সব শব্দ একসাথে। ইচ্ছে ছিল একটা প্রতিবেদন তৈরি করবো। কেমন আছে ওরা যারা সবচে কাছের মানুষকে হারিয়েছে, ওদের অনুভুতি নিয়ে।
খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম চোখ গুলো কি বলে, মা কেমন করে সন্তানের জন্য আফসোস করে, সন্তানরা বাবার জন্য কিভাবে কাঁদে দেখার জন্য। তারপর দেখে শুনে, সবার সাথে কিছু কথাবার্তা বলে পরিস্থিতি মানুষকে জানানো।
কিন্তু এমন ক’টা কথা শুনেছিলাম যা আমার সারা জীবনে ভুলবো না। কেন জানি আমার সমস্ত হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায় ঐ কথাগুলো আর সময়টার কথা মনে উঠলে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গ। ওখানে রাখা আছে সারি সারি মৃত দেহ। সূর্য সন্তানদের। খবর পেয়ে সদরঘাট মিটফোর্ড মেডিকেল থেকে ঢাকা মেডিকেলের মর্গের সামনে আসি।
মর্গের দিকে ঢুকতে যাবো।
একজন জলপাই রঙের পোশাক পরা মানুষ, হাতে স্টেন। সামনে দাঁড়ান। প্রশ্ন- কোথায় যাবো, কেন যাবো। পরিচয় পত্র তুলে ধরে বলি আমি গনমাধ্যমে কাজ করি।
একটা গালি শুনি। তারপর সামনে যাবার অনুমতি পাই।
সামনে আরও কিছু মানুষ, সেনা বাহিনীর, মেডিকেলের, গনমাধ্যমের। বেশ কিছু নারী পুরুষ। ওরা এসেছে স্বজনের মৃতদেহ খুঁজতে।
একসাথে প্রায় ২০ টার মত মৃত দেহ এসেছে মর্গে। হয়ত বেশি হবে। চাটাই দিয়ে পেঁচানো। একে একে সবগুলো মর্গের ভিতরে নিয়ে রাখা হল।
কারো মুখে কোন কথা নেই। মনে হয় এখানে মানুষেরা কথা বলে না।
একজন বৃদ্ধাকে দেখলাম –জায়নামাজে বসে আছে। দেয়ালের পাশে ধুলোর উপর রাখা জায়নামাজ।
মর্গের দরজার কাছে কান্নার শব্দ। এক মধ্যবয়সী নারীকে ক’জন আত্মীয় নির্বৃত্ত করার চেষ্টা করছেন মর্গের ঐ দৃশ্য দেখতে না যাবার জন্য।
‘সারা জীবন ওকে দেখেছি। আর আজকে যাবো না?’
– আমি স্তব্ধ হয়ে যাই।
তিনি সামনে যান। আমি কিছুটা পেছনে। প্রচণ্ড দুর্গন্ধ। মহিলা এবার পিছিয়ে যান। মর্গের দরজার কাছে আসার আগেই বমি করে ফেলেন।
আমার গলায় ঝোলানো রেকর্ডার। নাকে রুমাল ধরে সামনে যাই।
ভীষণ গন্ধ। আবার ফিরে আসি।
অপেক্ষা করি মৃত দেহগুলো দেখতে যাবো কিনা।
দেখা হয় ডেইলি স্টারের মেডিকেল রিপোর্টার এর সাথে। এবার দুজন এক সাথে যাই।
মেঝেতে শোয়ানো মৃত দেহের সারি। সেই সামরিক পোশাক পরা। সারা দেহ ফুলে আছে। মৃত মানব দেহ কি এরকম হয়? মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের দেহ এক পাশে। মুখ বিকৃত। ভয়ে তাকাতে পারি না।
দম বন্ধ হয়ে আসে। কোন রকম বেরিয়ে আসি।
বাইরে এসে একজন মানুষকে দেখি। চোখে বিশাল শুন্যতা। কোন শব্দ নেই। বুঝতে পারি না উনি কিছু অনুভব করছেন কিনা। আরেকজন কিছুটা বয়স্ক মহিলা এসে তাকে মর্গের থেকে দুরে নিয়ে আসেন। আস্তে আস্তে।
আমিও একটু একটু করে সামনে এগোই। দেয়ালের বাঁক ঘুরে মেয়েটি একবার ডুকরে কেঁদে উঠে বলে মনে হয়। মানুষ ডুকরে কাঁদলে যেভাবে একটু নড়ে ওঠে।
সাহস করে পাশে আসি। উনি কাঁদছেন না। কারন চোখে পানি নেই। তাহলে এমন করলেন কেন?
এত উদাস চোখ হতে পারে আমার কোনদিন ধারনা ছিল না।
সঙ্গে থাকা বয়সী নারীকে কে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করি “ যারা শহীদ হয়েছেন ওনাদের মধ্যে কি ওনার কেউ আছেন?”
“ ওর হাজব্যন্ড। মাস ছয়েক হল ওদের বিয়ে হয়েছে”।
দ্বিতীয় কোন প্রশ্ন না করে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি। ঐ উদাস চোখের দিকে তাকাতে আর সাহস হয়নি।
অনেকক্ষণ পর দেখলাম সেই মানুষটি খুব নিচু গলায় বলছেন –
“মা! আমি কি আর কোনদিন ওকে দেখতে পাবো না । মা! ও ঘুমাচ্ছে কেন?”
“মা! আমাকে শুধু ঐ মানুষটাকে এনে দাও। আমি ওর পাশে সব সময় থাকতে চেয়েছি, আজ কেন ওর পাশে যেতে পারছি না”।
-শেষ কথাটা আমার জীবনে শোনা সবচে কঠিন কথা, কঠিন প্রশ্ন।
আবেগ শব্দ দিয়ে বেঁধে রাখা যায় না। আমিও চেষ্টা করি না। চোখের জলে সব কিছু ঝরে পড়ে না। আমিও সেদিন তা দেখতে চেষ্টা করিনি।
পুনশ্চঃ “আমাদের সকল ভুল ক্ষমা করো প্রভু”।
খুব কষ্ট লাগে ঐদিনটার কথা মনে হলে, প্রথমে আমি আর আম্মু ভেবেছিলাম হয়ত সামান্য জিম্মি করেছে তাই বলেছিলাম হয়ত অত্যাচারের মাত্রাটা একটু বেশিই হয়ে গেছে জওয়ানদের উপর তাই এটার দরকার ছিল, কিন্তু আস্তে আস্তে সব ঘটনা যখন বের হয়ে এল, যখন দেখলাম কতটা অমানুষের মত ঐ জানোয়ারগুলা এতগুলো মানুষ্কে হত্যা করেছে তখন খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল নিজেকে এদেরকে প্রথমে ভালো ভাবছিলাম !! !
:wallbash:
🙁
প্রথমে আমরাও তাই ভেবেছিলাম। আশা করেছিলাম সব ঠিক হয়ে যাবে। হয়েও গেছে। বনানীর কবরস্থানে ফুল ফুটেছে, নেতা নেত্রীরা রাজনীতি করছে, আসল হোতারা পরিকল্পনা সফল করেছে। শুধু ঐ মেয়েটির খবর জানি না যে আকাশ সমান মেঘ জমিয়ে রেখেছিল ছোট সে দু চোখে।
কান্না পেয়ে গেলো ভাইয়া, আপনার লেখাটা পড়ে।
নিজেকে ওদের জায়গায় কল্পনা করার চেষ্টা করলাম। ভাবতেই পারি না কেমন লাগতো নিজের সাথে এরকম হলে।
আমাদের ডিপার্টমেন্টের এক ছেলের বাবাও ছিল ঐ হতভাগা মানুষগুলির মধ্যে। মরতে না হয় সবাইকেই হবে, কিন্তু একটু স্বাভাবিক মৃত্যু চাওয়াটাও এখন কঠিন হয়ে গেছে মনে হয়। স্বাভাবিক মৃত্যু মানে আশীর্বাদ!
আমার পরিচিত একজন মানুষ ছিলেন এদের মধ্যে। তিনি কর্নেল মুজিবুল হক। বিডিআরের পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। গণমাধ্যমে কাজ করার কারণে তাকে চিনতাম। এক টেবিলে বসে খেয়েছি একাধিকবার। বেশ প্রাণখোলা টাইপের মানুষ। ওনার মৃতদেহ পাওয়া যায় বুড়িগঙ্গায়। ভীষণ খারাপ লাগে। একদিন একসাথে ছিলাম। এখন কত কত দূরে। জীবনের মানে বুঝি খুব কঠিন।
মনটার ভার হয়ে গেলো লেখাটা পড়ে। কী ভয়ংকর একটা দিন ছিলো! দেশের সূর্য সন্তানদের এভাবে হত্যা করলো কারা……তারও বিচার হলো না।
এই দেশে বিচার হয় না।
এই দেশে শুধু আশার মৃত্যু হয়!
কেমন অসম্ভব বোবা একটা কান্না ডুকরে উঠলো ভেতর থেকে।
আমাদের সকল ভুল ক্ষমা করো প্রভু।
আমাদের স্বাভাবিক মৃত্যু দিও।
:'(