মাধ্যাকর্ষণ: স্হান-সময়ের গাঁথুনিতে দোলন

শিশুমনের সরলতা কোন বাঁধন মানে না। যখন তখন আকাশের মেঘেদের মাঝে উড়ে উড়ে পরীদের দেশে চলে যাবার ইচ্ছা থাকেই। কিন্তু এসে ফ্যাকড়া বাঁধায় বিজ্ঞান।
আকাশ থেকে সবকিছুই কেন জানি পরীরা নীচেই ফেলে দেয়। টেনে তুলে নেয় না। (পরীরাও বিজ্ঞান মানে)
বিজ্ঞান অবশ্য কোন আজগুবি ধারনা না। ভারি বস্তু আকাশ থেকে মাটিতে পড়বেই। সে আকাশের গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিই হোক। কিংবা  নিউটনের বাড়ির আপেল।
আমি আপেল গাছ দেখিনি। তাই ঝম ঝম বৃষ্টির দিনে ওটাকেই মাধ্যাকর্ষণের প্রমাণ মনে করে নিই। কিন্তু বয়সের স্রোতে বিজ্ঞানের জ্ঞানে আর বৃষ্টির আর্দ্রতায় নাকাল হয়ে আমার আইন্সটাইনের সাথে পরিচয় হয়।
বেচারা মাটির টানকে তুচ্ছ করতে চেয়েছিলেন নিশ্চয়ই। তাই বছরের পর বছর গবেষণা করে থিওরী দিলেন। কিন্তু কঠিন কঠিন থিওরী অফ আপেক্ষিকতা কি আমার ছোট্ট মাথায় ধরে? তাই নিউটনের জায়গায় আমি হইলে কি করতাম-

অভিকর্ষ :
নিউটনেরও অনেক আগে থেকেই (এমনকি যখন পৃথিবীকে মনে করা হতো সমস্ত জগতের কেন্দ্রবিন্দু) বিজ্ঞানীদের জানা ছিল অভিকর্ষের ব্যাপারে। ‘অভিকর্ষ'(Earth’s Gravity) হলো মাটির টান, মানে পৃথিবী (গোলাকার ধারনা করুন আর নাই করুন) তার নিজের দিনে সকল দৃশ্যমান অদৃশ্য বস্তুকে টেনে নামায়। এই টানকে,বিজ্ঞানীর ভাষায় আমরা বলি ‘বল’ (Force)। ‘বল’ প্রত্যেক বস্তুকেই দেয় ‘ত্বরণ’(Accelaration) ।
কোন গোল বস্তুকে পাহাড়ের ঢাল থেকে গড়িয়ে দিন,দেখবেন যত নীচে নামছে ততই দানবীয় দ্রুততায় তার গতি বাড়ছে। এই গতি বাড়ার প্রক্রিয়াটাকেই আলাদাভাবে বিজ্ঞান বলছে ‘ত্বরণ’।
মজার ব্যপার হলো, প্রত্যেক বলই ত্বরণের জন্ম দেয়। অথবা উল্টোভাবে বললে, প্রত্যেক ত্বরণের পেছনে একটা বল কাজ করে। পড়ন্ত বস্তুর ত্বরণের ক্ষেত্রে যে বল কাজ করে সেটাই “অভিকর্ষজ বল” (Earth’s Gravitational Force)।

আন্তঃমহাকাশীয় বল :
কিছুক্ষণের জন্য দেখি চাঁদের দিকে। পূর্ণিমা আর অমাবস্যার মোহনীয় আবর্তনের  মাঝেও এই চাঁদ প্রায় একদিনে পৃথিবীকে ঘুরে আসে। আপনার শিশুটি যদি বাহিরে আইমক্রিম বা সন-পাঁপড়ির ডাক শুনে আপনার আশেপাশে ঘুরঘুর করে, তাহলে আপনার প্রতি তার এই হঠাৎ এক্সট্রা খাতিরের কারণ আর কষ্ট করে খতিয়ে দেখতে হয় না।কিন্তু অতিকায় চাঁদ (প্রায় ৭৩৬০ লক্ষ কোটি কোটি কেজি ((7.36 × 1022 kilograms)) ভরের) পৃথিবীর চারপাশে ঘুরঘুর করার কারণ  মোটেও সহজাত সমাধানের নয়।

একটু পেছন থেকে চিন্তা করি,  কোন বস্তুর উপর যদি কোন বাইরের শক্তি কাজ না করে, বস্তুটি যেমন গতিতে চলছিল তেমন গতিতেই চলবে। মানে হল, যদি বস্তুটা জটায়ু বৃদ্ধের মত স্থির হয়ে বসে থাকে, বাইরের মদদ না পেলে সে নড়বেনা। আরো মজার হলো,  যদি বস্তুটি একটা পাগলা বেগে  কোন একটা দিকে চলতে থাকে তাহলে তার বেগে কোন ধরনের পরিবর্তন আনতে চাইলে দিতে হবে বল। আপনি আপনার বাসার সামনের রাস্তাটিতে প্রতিদিন জগিং করেন। জোরে একটা দৌড় দিয়ে , হঠাত থামতে চাইলে আপনার অতিরিক্ত বাধা (বিপরীত বল) দিতে হয়। আর  যদি একই ভাবে জোরে দৌড় দিয়ে হঠাৎ বাঁক ঘুরতে চান, সেক্ষেত্রেও দিতে হয় অতিরিক্ত মোচড়।

এখন আসেন নীচের অংশটা পড়ি-
পথ আজ হঠাৎ এ কী পাগলামি করলে। দুজনকে দু জায়গা থেকে ছিঁড়ে এনে আজ থেকে হয়তো এক রাস্তায় চালান করে দিলে। অ্যাস্ট্রনমার ভুল বলেছে। অজানা আকাশ থেকে চাঁদ এসে পড়েছিল পৃথিবীর কক্ষপথে– লাগল তাদের মোটরে মোটরে ধাক্কা, সেই মরণের তাড়নার পর থেকে যুগে যুগে দুজনে একসঙ্গেই চলেছে; এর আলো ওর মুখে পড়ে, ওর আলো এর মুখে। চলার বাঁধন আর ছেঁড়ে না। ” ((শেষের কবিতা- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর  http://www.rabindra-rachanabali.nltr.org/node/128))

বলছিলাম, চাঁদ  পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে। আরো ভালভাবে বললে প্রতিনিয়ত পৃথিবীর দিকেই মোড় নিচ্ছে। এর পেছনে অবশ্যই একটা বল কাজ করছে (যেদিকে মোড় নিচ্ছে ঠিক সেইদিকে, মানে পৃথিবীর দিকে) । কিন্তু, চাঁদের গতিটা এমন যে, ঠিক যে হারে সে মোড় নিচ্ছে, আবার সেই হারে সে ‘সোজা পথে’ পৃথিবী থেকে দুরে সরছে  (বিজ্ঞানের মতে, সোজা যাইতে পয়সা লাগে না)। ফলাফল হলো, চাঁদ কখনোই পৃথিবীকে ছুঁতে পারছেনা। বারবারই মিস হয়ে যাচ্ছে। কার্যতঃ    পৃথিবীতে থেকে একটা দুরত্বে পৃথিবীকে ঘিরেই ঘুরছে।

এই যে প্রতিনিয়ত মোড় নেওয়া পৃথিবীর দিকে, যে বল কাজ করছে সেটাও তাই পৃথিবীর দিকে। নিউটন বুঝতে পারলেন, এই যে পৃথিবীর দিকে বল, এটা সেই অভিকর্ষ বলের মতই। দুটো বল ভিন্ন কিছু নয়। তিনি আরও বুঝতে পারলেন, এই বল শুধুমাত্র পৃথিবীজাত নয়, সার্বজনীন(Universal)। বরং যে কোন বস্তুই (যার ভর আছে) তার আশেপাশের বস্তুর উপর এই বল প্রয়োগ করে।
আকাশের পরীরা কেবল পৃথিবীতেই পুষ্প বর্ষন করে না। অন্য সব কিছুতেই করে। (আমার হতাশ হবার কারণ নাই :))
নিজের দিকে আকর্ষন করার ইচ্ছা কেবল মানুষেরই না। সবকিছুর।
অভিকর্ষবলের সাথে এই মহাকাশীয় বল মিলিয়ে তিনি নতুন বলের নাম দেন “মহাকর্ষীয় বল” আর এই ঘটনার নাম হয় মহাকর্ষ।
পুরো ইতিহাস শুনতে চাইলে এই লিংকটা কাজের-

http://www.youtube.com/watch?v=_q6CXni6yTE

নিউটনের এই আবিষ্কার একটা বড় ধরনের ব্যপকতা এনে দিল বিজ্ঞান গবেষনায়। এখন আর পৃথিবীর বস্তু আর আকাশের বস্তু আলাদা ভাবে চিন্তা করতে হবে না। ধুলিকণা থেকে শুরু করে অতি-অতিকায় সূর্য (প্রায় ২০০ কোটি কোটি কোটি কোটি কেজি ((1.98892 × 1030 kilograms))) পর্যন্ত সবকিছুর চলাচল হিসাব করা যাবে নিখুঁতভাবে।

এতটুকুতে থেমে গেলে তো ভালই ছিল। কিন্তু কে জানত আকাশ থেকে বৃষ্টি না পড়ে আপেল পড়া শুরু করবে? প্রায় একই ধরনের ঘটনায় ঘটল বিজ্ঞানের মেঘমুক্ত আকাশে। শুরু হলো সহজসরল বিজ্ঞানের মোড় ফেরা।…
(কথা চলবে)

জ্ঞানচোর সম্পর্কে

সেই কবে জেগেছিলাম, বিলিয়ন বর্ষী নক্ষত্রের আলোয়, ডিরাকের সমুদ্রের পাড়ে। অবাক কৌতুহল নিয়ে গেলাম বহুদুর। তারপরও সহসা বুঝি, নিজে আমি,নিছক পড়ে থাকা ঝিনুকের খোলসে সোনালী অনুপাত খুঁজে বেড়াই। পড়ে থাকো তুমি, মহা সমুদ্র।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

9 Responses to মাধ্যাকর্ষণ: স্হান-সময়ের গাঁথুনিতে দোলন

  1. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    ব্লগে স্বাগতম। :welcome:
    নতুনভাবে সহজবোধ্য করে বিজ্ঞান তুলে ধরলে পড়তে বিরক্তি আসে না। বরং তা মজার হয়। আমার ধারণা আপনার লেখা কম বয়সীদের কাছেও সমান জনপ্রিয় হবে। সবচেয়ে বড় কথা, এটা ওদের দারুণ কাজে আসবে।

    তবে একটা ছোট্ট কথা। বানান শুদ্ধ হলে লেখা অন্যরকম একটা মাত্রা পায়। যেমন-
    ‘না’ বোধক শব্দ পৃথক লেখা উচিত। ‘মানেনা, নেয়না, হয়না’ না হয়ে ‘মানে না, নেয় না, হয় না’ এরকম হবে।
    আবার ‘কিছুক্ষনের’, ‘পুর্ণিমা আর অমাবশ্যার’, ‘ত্বরনের’ এইরকম বানানগুলো শুদ্ধ হলে পড়তে আরো ভালো লাগবে।

    পরবর্তী লেখা পড়বার অপেক্ষায় রইলাম। 🙂

  2. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    সরবে স্বাগতম! :welcome:

    জট্টিলস! অনেক ভালো লাগল। আপনার লেখার সহজ ধরন দারুণ লাগল।

    সিরিজ চলুক :dhisya:

  3. লেখার মধ্যে মজাটা নজর কেড়েছে! পুরানো করে আবারও মনে হলো নিউটন না হয়ে ওখানে শৈশব হলেই বা কি ক্ষতি হতো! (আপেলটা নিয়ে কচকচ করে খেয়ে নিতো!)
    স্বাগতম সরবে!! :welcome:
    লিখাটা সিরিজ হিসেবে পাবার ইচ্ছা রইলো! 😀

  4. প্রজ্ঞা বলেছেনঃ

    সরবে :welcome: !

    ছোটবেলায় বিজ্ঞান পড়ার সময় ভাবতাম নিউটনের মাথায় আপেল না পড়ে নারকেল পড়লো না কেন?! :wallbash:
    তবে, লেখাটা পড়ে মজা পেলাম! 😀
    কথা চলুক। 🙂

  5. সাদামাটা বলেছেনঃ

    প্রথমেই স্বাগতম :welcome:

    মহাজাগতিক এই ‘টানাটানি’-র বিষয়ে কোথাও কিছু পেলেই অনেক আগ্রহ নিয়ে পড়ি। সহজপাঠ্য লেখা, পড়ে অনেক ভালো লাগলো 🙂

  6. শিশিরকণা বলেছেনঃ

    :welcome:
    লেখার সহজ ধরন অনেক ভালো লাগল। লেখাটা পড়ে মজা পেলাম! :guiter: :clappinghands:

  7. ইয়াদ বলেছেনঃ

    ব্লগে বিজ্ঞান নিয়ে লেখা অনেক কম চোখে পড়ে!

    ভালো লাগলো লেখাটা। লিখতে থাকুন!
    :welcome:

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।