বুড়ি চাঁদ এবং একলা যুবক

 

 এক

কাওসান নামের আধুনিক সংস্করণ কায়সার, এবং অতঃপর শ্রুতি মাধুর্যতা বৃদ্ধি করণ কিম্বা আরো খানিকটা স্মার্ট আকার ধারণ করার ‘নিমিত্তে’ কায়সার নামটি ‘কায়েস’-এ পরিণত হয়ে গেলে, এ নামের সত্ত্বাধিকারী যুবকটি যখন তার ২৪ বছর বয়সে পারিপার্শ্বিক জীবন সম্পর্কে যথেষ্ট পরিপক্কতা অর্জনে সক্ষম হয়, সেই সময়ে জোছনা ধোয়া এক রাতে চাঁদের বুড়ির শত শত শতাব্দির পুরনো কোটরগত চক্ষুতে যুবকের চোখ পড়লে, আচানক এক তথ্য হৃদয়ঙ্গম করতে যুবক সমর্থ হয় । অনেক বছর আগে সুবহে সাদেকের মলিন অথচ নির্মল প্রকৃতির অন্ধকার কেটে কেটে শিশু সন্তান বুকে চেপে, ত্রস্ত পায়ে পড়ি-মরি করে জীর্ণ-শীর্ণ দেহের যে নারীটি স্বামীর ঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন, যে নারীটি তার মা, মায়ের সে ঘটনাটি যতোখানি না পলায়ন, তারচে’ বেশী ছিল আসলে বাবা কর্তৃক মাকে পরিত্যক্তকরণ এবং বিতারণ !

দুই

সুবহে সাদেকের আবছা আলোর মতো, যুবক কায়েসের আবছা স্মৃতির দুয়ার খুলে চিকচিক সোনারাঙ্গা আলোর স্ফুরণ ঢুকে পড়লে, যুবক তার পাঁচ বছর পাঁচ মাস বয়সে ফিরে যায় । সেখানে একটি বাঁশঝাড় দেখতে পায় । তাদের বাড়ির দক্ষিণের বাঁশঝাড় । যেখানে তাকে বুকে চেপে ধরে পালাতে গিয়ে, হোঁচট খেয়ে হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়েছিলেন মা । পরক্ষণেই একটু একটু করে মা উঠে দাঁড়িয়েছিলেন । পরক্ষণেই মা ছুট লাগিয়েছিলেন । মায়ের পেছন -পেছন পোষা কুকুর বুলু ছুটে এসেছিল । পাহারাদার হয়ে বুলু মাকে সঙ্গ দিয়েছিল । সুপারি বাগানের নৈঃশব্দ্যকে আলগোছে ভেঙ্গে, সারি সারি খেজুর গাছেদের পাশ কাটিয়ে, সাদা সাদা, ঝাঁকে-ঝাঁক বকেদের ঝিলের রাজ্যকে পেছনে ফেলে মা যখন খালের পাড়ে এসে পৌঁছলেন, বুলু কুকুরটি তখন থমকে দাঁড়িয়েছিল ক্ষণিক । তারপরই পানির স্রোত অগ্রাহ্য করে সাহসী বুলু ঝাঁপিয়ে পড়েছিল । স্রোতের বিপরীতে সাতার কেটে বুলু খাল পাড়ি দিয়েছিল । পারাপারের নৌকা অবর্তমান ছিল । অগভীর জলে কোমর ডুবিয়ে জলের নীচের বালুকারাশীদের পদস্পর্শের সাক্ষী রেখে মাও খালের এপারে এসেছিলেন, যেখানে শিমুল চূড়ায় রক্তের মতো রঙ আঁকা হয়ে ছিল ! যেখানে শিমুল তলে ঝরে পড়েছিল থোকা থোকা অজস্র নিহত শিমুল !

কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে কুয়াশার চাদর ফুঁড়ে নিস্তব্ধতার শরীরে হুঁইসেল বাজিয়ে কুঁউইই..ঝিকঝিক ঝিকঝিক শব্দ সমেত ভোরের ট্রেন এসে থামলে, ভয় পাওয়া চেহারায় মায়ের একটা হাত শক্ত করে ধরে কায়েস । ট্রেনের কামরার এক কোণে জুবুথুবু হয়ে মা ওঠে বসলে, মার চোখের দু’ফোঁটা দুঃখ গড়িয়ে কোলে থাকা কায়েসের কপোল ছুঁয়ে দেয় । কায়েসের অবাক দৃষ্টি মায়ের কান্নার কারণ নির্ণয়ে ব্যর্থ হয় । সে বলে,- কাঁদছো কেন, মা ?

কায়েসের মাথাটা আরো গভীর করে বুকের সঙ্গে চেপে নিলেও, নিরুত্তর থাকেন মা ! কায়েস বলে, – মা; বাবা তোমাকে মারছে ?

এবার বুকের ভেতরে কি এক হু হু ব্যথার ভারে ডুকরে কেঁদে ওঠেন মা ! কায়েসের দু’ গালে হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে আদর আর আদর লেপটে দেন । তখন মৃদু কম্পন তুলে রেলগাড়ির ঝিকঝিক ঝিকঝিক শব্দের সঙ্গীত ক্রমশ বেগবান হয় । তখন মায়ের পোষা বুলু কুকুরটি যান্ত্রিক রেলগাড়ির সঙ্গে দৌড় পাল্লা লাগিয়ে পেছন – পেছন ছুটতে থাকে, ছুটতেই থাকে। তারও আগে, মা যখন কায়েসকে নিয়ে রেলগাড়িতে ওঠে বসলেন, বুলু কুকুরটি জানালা দিয়ে কুঁইকুঁই শব্দ তুলে জানাচ্ছিল বেদনার বোবা প্রকাশ । তখন বাইরের সবুজ বনানী আর ঢেউ খেলানো সবুজ সবুজ ধানক্ষেতগুলোকে দ্রুত পেছনে ছুঁড়ে ফেলে ফেলে রেলগাড়ি এগিয়ে যেতে থাকলে, এক সময় বুলু কুকুরটির অকৃত্রিম ভালোবাসার নিদর্শন রেলগাড়ির ধাতব ইঞ্জিনের কাছে পরাস্ত হয় । তখন বুলু কুকুরটিকে আর দৃষ্টি সীমানায় ছুটে ছুটে আসতে দেখা না গেলে, ধীরে ধীরে মুখ খোলে কায়েস ।

-মা ! আমরা কোথায় যাই ?
-তোমার মামাবাড়ি !
– বাবা যাবে না ?
– না !
– আমরা কি বেড়াতে যাচ্ছি, মা ?
– হুঁম !
– মামাবাড়িতে আমরা কতোদিন থাকবো ?
-অনেকদিন !
– তাহলে আমার টুনটুনি পাখিটাকে কে খাবার দেবে, মা ?
এ প্রশ্নের জবাবেও মা চুপচাপ থাকলে, নিরুত্তর থাকলে, টুনটুনি পাখিটার জন্য কায়েসের মনের ভেতর কেমন কেমন করতে থাকে ! পাখিটা রোজ ভোর-বিকেলে কায়েসদের দাওয়াই নেমে আসতো, কায়েস চাল-গম ছিটিয়ে দিলে, টুকটুক করে ছোট্ট ঠোঁটে খাবার খুঁজে খুঁজে খেতো ! তা দেখে আনন্দে হাততালি দিতো কায়েস । পিতলের ছোট্ট ঘটিতে পানি ভরে দিলে টুনটুনি পাখি ঠোঁট ডুবাতো ! পানির কথা ভাবতে গিয়ে পুকুর ঘাটে ফুটে থাকা অজস্র শাপলা ফুলেদের সৌন্দর্য কায়েসের চোখে ভাসে । কায়েস বলে,

-মা ! মামাদের পুকুরে কি শাপলা ফুল আছে ?
– আছে !
– এ-ত্তো-গুলা শাপলা ফুল আছে ?
– আছেতো !
– আমাকে তুলতে দিবে ?
– না, ওই পুকুরে অনেক পানিতো !
– তাহলে তুমি আমাকে তুলে দিবে না, মা ?
– আচ্ছা, দিবো !

তিন

কায়েস দেখে, মামাদের শাপলা পুকুরে ভেজা চুলো মায়ের মাথাটা ভেসে ভেসে ওঠে, আবার টুপটুপ ডুবে যায় । ডুব দিয়ে মা শাপলা তুলে আনেন, কোল ভরে শাপলা তুলে আনেন । কি অদ্ভুত দক্ষতায় শাপলার গায়ে শাপলা লতিয়ে মালা গাঁথেন মা । সে মালা কায়েসের গলায় পড়িয়ে দেন !

মামাদের বাড়ি থেকে কায়েস যেদিন ফিরে আসে, মার সঙ্গে মামাদের বাড়িতে যাবার ঠিক এক মাস পর, বাবা যেদিন শেষবারের মতন গিয়ে কায়েসকে ফিরিয়ে আনেন, সেদিন যখন বাবার হাত ধরে শাপলা পুকুর পাড়ে এসে কায়েস দাঁড়িয়েছিল, ঠাঁই দাঁড়িয়েছিল দুই মিনিট, বাবা বলেছিলেন,

-কী দ্যাখো ?
– শাপলা !
– শাপলা আমাদের পুকুরেও আছে !
– বাবা !
– হুঁ !
– মা আমাদের সঙ্গে যায় না কেন ?
– মা যাবেনা !
-যাবেনা কেন, বাবা ?
– সে আলাপ আমরা পরে করি ?
– এখনই বলোনা !
– এখনতো আমরা দরগাহতে যাবো !
– দরগাহতে কি জন্য , বাবা ?
– দরগাহতে আমরা দোয়া করবো !
– দরগাহতে আমরা কি দোয়া করবো, বাবা ?
– তোমার যা মনে আসে, তাই দোয়া করো !
– মার জন্য দোয়া করবো ?
– কোরো !
বলেই মামাদের সদর দরজার পাশে ফকিরের দরগাহতে কায়েসের হাত ধরে বাবা ঢুকে পড়েছিলেন ।

দরগাহ্ থেকে বেরিয়ে বাবা যখন জানতে চাইলেন, – কি দোয়া করলে ?
কায়েস জবাব করেনা, কায়েস তখন ঘাড় কাৎ করে তাদের পেছনের সমবেত মানুষের দলটিকে দেখে । সেখানে মামাদের মুখ, মামীদের মুখ । যেসব মামাতো ভাই-বোনদের সঙ্গে ঘাসফড়িং ধরে কাঁচের বয়ামে জড়ো করে, বাঘ শিকারের আনন্দ পেয়েছে, যাদের আকাশছোঁয়া ঘুড়িগুলো ঘোঁৎতা খেয়ে খেয়ে কাটাকাটি খেলতে খেলতে হঠাৎ সুতো ছিঁড়ে দিগ্বিদিক ছুটতে থাকলে, ঘুড়ির পেছনে ছোটা দলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হয়ে কায়েসও তাদের সঙ্গে ছুটেছে, সেইসব মামাতো ভাই-বোনেরা কায়েসের প্রস্তানে তখন একেকটি শোকাতুর মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কেবল মার মুখটা কায়েস দেখেনা, আ-র দেখেনা ! কেবল মায়ের অস্পষ্ট আহাজারি তখনও শুনতে পাওয়া যায় !

ঝিকঝিক ঝিকঝিক রেলগাড়ি চলতে শুরু করলে যখন ফেরীওয়ালা চকোলেট ফেরী করে যায়, বাবা তখন কায়েসকে চকোলেট কিনে দেন । চকোলেটের স্বাদের চে’ মামাদের বিশাল উঠোনের প্রান্তে ফোটা ভোরের গন্ধরাজদের সাদা সাদা হাসির কথা ভাবতে কায়েসের অধিক ভালো লাগে । ফেরার আগে গন্ধরাজের এক মুঠো সাদা হাসি ছিঁড়ে মাকে উপাহার দিয়েছিল কায়েস । কায়েসকে বুকে লেপটে নিয়ে চোখের কান্নার সঙ্গে বুকের একটা আর্তনাদই কেবল শুনিয়েছিলেন মা,- বাবারে ! আমারে ভুলিসনারে বাবা….আমারে ভুলিসনা.. !

চার

জোছনা ধোয়া সে রাতে, চাঁদের বুড়ির প্রাচীন চোখের চির নবীন আলোতে দাঁড়িয়ে চিৎকারের মতো করে যুবক,- মা ! তোমাকে ভুলি নাই, মা..! তোমাকে ভুলি নাই.. !

আবদুর রাজ্জাক শিপন সম্পর্কে

জন্ম ৬ মে ১৯৮০ । ২০০০-এ পত্রিকায় লেখার মধ্য দিয়ে শুরু । ২০১১ বইমেলাতে প্রকাশিত হয়েছে প্রথম উপন্যাস 'চন্দ্রাবতীর চোখে কাজল রং' ! দ্বিতীয় উপন্যাস 'সোনামুখী সুঁইয়ে রূপোলী সুতো' ২০১২ 'র বই মেলাতে ইতোমধ্যে পায়ে হেঁটে এসে শুদ্ধস্বরের স্টলে পৌঁছেছে । নির্গুণ বলে গুণীজনকে ভীষণ পছন্দ। মানুষের ভালোবাসার ক্ষমতায় মুগ্ধ। মানুষের প্রতারণায় হই ঋদ্ধ। ঘৃণার উৎসে উৎসুক! বিশ্বাস করি, “মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।”
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে গল্প, সাহিত্য-এ এবং ট্যাগ হয়েছে স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

10 Responses to বুড়ি চাঁদ এবং একলা যুবক

  1. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    দারুণ লাগলো গল্পটা।

  2. সামিরা বলেছেনঃ

    কী সুন্দর একটা গল্প, মুগ্ধ!

  3. শারমিন বলেছেনঃ

    অনেক সুন্দর একটা গল্প।

  4. অক্ষর বলেছেনঃ

    অনেক সুন্দর , মন ছুয়ে যাওয়া ।

  5. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    মন খারাপ হয়ে গেল। তার মাঝেও পুরো গল্পটাকে চোখের সামনে গুঁটি গুঁটি পায়ে হেঁটে যেতে দেখলাম। আপনার লেখনীতে মুগ্ধ হয়েছি! অসাধারণ!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।