সৌর ঝড়ের বিশাল প্রদর্শনী হয়ে গেল গত ৭ মার্চ থেকে ৯ মার্চ। কিন্তু সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে এর তেমন কোন প্রভাব না থাকায় তেমন প্রচার পায় নি এই ঝড়। আমাদের সূর্য মামা তার ১১ বছরের সক্রীয়তা- নিষ্ক্রীয়তার পর্যায় শেষে এবছর একেবারে পুরো মাত্রায় সক্রীয় থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, ১৩০০ মাইল প্রতি সেকেন্ড বেগে সৌর ধুলো পৃথিবীতে আঁচড়ে পড়ে। মহাকাশ আবহাওয়া দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, এই ঝড়ের ভুচৌম্বক মাত্রা ছিল জি-থ্রী (শক্তিশালী), এবং সৌরবিকিরণ মাত্রাও ছিল এস-থ্রী (শক্তিশালী)। (( নাসা’র মহাকাশ আবহাওয়া স্কেল )) এ বছর আরো কিছু বড় রকমের সৌর ঝড়ের আশংকা করছেন বিজ্ঞানীরা।
চিত্র: সূর্য পৃষ্ঠ থেকে বিস্ফোরিত হচ্ছে সৌর ধূলী
হায় হায়! পৃথিবী ধ্বংসের পূর্বাভাস নয় তো?
সমগ্র চেনা পৃথিবীর অলক্ষ্যে গড়ে উঠা, প্রাচীন আমেরিকার মায়ান সভ্যতা। মায়ান ক্যলেন্ডার এ বছর ২১ ডিসেম্বর তার সর্বোচ্চ মান ১৩ বা’কতুন শেষ করবে। ১৩.০.০.০.০ মায়ান তারিখ, এই দিনের পর ৫১২৫ বছর পর্যায়কালের মায়ান ক্যালেন্ডার আবার শুরু হবে, ০.০.০.০.০ দিয়ে। আর এই দিনটিকেই অনেকে ভাবছেন চেনা পৃথিবীর শেষ দিন মানে ‘রোজ কেয়ামত’ হিসেবে।
সেই ভয়ের আগুণে ধোয়া দিয়েছে আবার, এবার শীতকালে সুর্যের দক্ষীণায়নের (উইনটার সল্সটিস) সময় ২৬০০০ বছর পর আবার আকাশগঙ্গার কেন্দ্রের সাথে সমরেখায় চলে আসার ঘটনা। (( মায়ান ক্যালেন্ডার নিয়ে লেখা : http://www.usatoday.com_ ))
এ ভবিষ্যৎবাণী নিয়ে আবার হলিউডে হয়ে গেছে প্রচন্ড ব্যবসা সফল সিনেমাও।
কিন্তু যত যাই হোক, আপাতত আমরা, মানে পৃথিবীর আপামর জনতা, পৃথিবী ধ্বংস নিয়ে তেমন সচেতন নই বলেই মনে হচ্ছে । দিন-রাত হাতের মোবাইলটা নিয়ে কিংবা ইন্টারনেটের মডেমটা নিয়ে মহাসমারোহে যখন দিন কাটানো যাচ্ছে, তখন পৃথিবী সত্যি সত্যি ধ্বংস হয়ে যাবার আগ মুহূর্ত ছাড়া নিশ্বাস ফেলার সময় কোথায়? তো এমন দিনে যদি হঠাৎ দেখা যায়, কোন রকম নেটওয়ার্ক কাজ করছে না। এমন কি বিদ্যুৎ লাইন পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গ্যাছে প্রাকৃতিক কোন অজানা কারণে, তবে ভয় তো কিছু লোক পাবেই। তো তাদের ভয় দেখানোর জন্য্, কে বা কারা (দেশীয় রাজনৈতিক ঢংয়ে বললাম) মজার কিছু সাইটও খুলে বসেছেন। (( এটি এর মধ্যে একটি : সোলার ওয়ার্নিং ডট কম))
সৌর ঝড় বা সৌর ধুলির ব্যাপারে ঠিক অনেকটা এরকম আশংকা প্রকাশ করছিল অনেকেই। তবে এবারের সৌরঝড়, আশংকার তুলনায় তেমন কোন ক্ষতিই সাধন করে নি।
সূর্যেও দেখি সিগন্যাল উঠে! তো, নাম টাম দেয় না?
এত বড় সূর্য। (( সূর্য: বাংলা উইকিপিডিয়া )) তার আছে কয়েকলক্ষ পৃথিবীকে ঢুকিয়ে নেবার মতো বিশাল পেট। অনেক বেশী গরম। প্রায় কোটি ডিগ্রী সেলসিয়াস। তার তুলনায় সৌরপৃষ্ঠের তাপমাত্রা নেই বললেই চলে। তাও কিন্তু প্রায় ৫৮০০ ডিগ্রী সে.।
তো, যে যত যাই বলুক, মামা কিন্তু, কেবল অতি তাপমাত্রার এক গ্যাসের বলয়। সৌর বস্তুর এই গ্যাসের মেঘের আবার রয়েছে চৌম্বকীয় গুণাবলী। তো, সূর্যের পিঠে কোথাও কোথাও এই সৌরবস্তু গুলো দলা পাকিয়ে কম তাপমাত্রার চৌম্বকক্ষেত্র তৈরী করে। তাপমাত্রা কম থাকায়, ঐগুলোকে সূর্যের তুলনায় প্রায় অন্ধকার মনে হয়। আর লোকে দুঃখ করে ডাকে সৌরকলংক বলে।
এত দুঃখ রাখে কোথায়। মাঝে মধ্যে এই অদ্ভুত চৌম্বক ক্ষেত্রে গন্ডগোল ঘটে সূর্যের ভেতরের তপ্ত অগ্নিউদরের সাথে সম্পর্ক করার চেষ্টা করে। তখন, তার সেই ছিদ্র গলো কোটি-তাপমাত্রার অন্তর ধন (সৌর গ্যাস), বেরিয়ে এসে ঘটে বিরাট বিস্ফোরণ। এমন বিস্ফোরণ, যা কোটি পারমাণবিক বোমা দিয়েও করা সম্ভব নয়। বিস্ফোরণের ধমকে, সৌরউদরের বস্তু গুলো ছুটে যায় কোটি কোটি মাইল। যখন, কোন অংশ দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের পৃথিবীর সাথে বন্ধুত্ব করার সুযোগ পায়, বিজ্ঞানীরা আতংকে তার নাম দেন সৌরঝড়।
সূর্যের অংশ আমরাও পাই? পুড়ে তো ছারখার হয়ে যাব!
হ্যাঁ। ভয়ংকর বিস্ফোরেন ছিটে ফোঁটা আমাদের ঘরে, মানে পৃথিবীতে, এসে পড়ে বৈ কী। কিন্তু, তার ঘনত্ব এতই কম, তাপমাত্রায় তেমন কোন পরিবর্তনই আসে না বলতে গেলে। কিন্তু, বিপদ ঘটায় তার উচ্চ-কম্পাংকের বিকিরণ ক্ষমতা। আর চৌম্বকধর্ম।
চিত্র: বিশাল সূর্যের পাশে ছোট্ট পৃথিবী ও তার চৌম্বক বলয়।
বিকিরণে যত ভয়, তত স্বস্তি ঐ চৌম্বকত্বের কারণে। সচল ঐ চৌম্বকীয় কণাগুলো তাদের প্রচন্ড বিকিরণ ক্ষমতা নিয়ে পৃথিবীর বুকে আঁচড়ে পড়তে যখন চায়, তখন মনে পড়ে, পৃথিবী নিজেও তো এক বিশাল দন্ড চুম্বক। তার আছে অতি শক্তিশালী দুই মেরু। আর পৃথিবীকে ঘিরে রেখেছে দুর্গের দেয়ালের মতো এক বিস্তৃত আয়নমন্ডল।
তাই সৌর বস্তু গুলো গোলাকার পৃথিবীর পুরো গায়ে লেপ্টে না গিয়ে, বেশির ভাগকেই প্রাণ হারাতে হয় আয়ন মন্ডলে শোষিত হয়ে যায়। পৃথিবীর বুকে এসে পৌছানোর আগেই। যেটুকু থেকে যায়, সেই বাকিদের সুড়সুড় করে চলে যেতে হয় চৌম্বক বলরেখার পথ ধরে, উত্তর আর দক্ষিণ মেরুতে বন্দীশালায়।
কিন্তু, পুড়ে যাবার ভয় না থাকলেও আধুনিক পৃথিবীর বেশ অনেক কিছু কিন্তু আয়নমন্ডলের উপর নির্ভর করে। তাছাড়া অনেক স্যাটেলাইট আছে আয়ন মন্ডলেরও অনেক উপরে। তাই সেগুলোতে মোটামুটি ধ্ধংসাত্বক একটা সময় সামলাতে হয়। প্রতিটা সৌর ঝড়ের সময় তাই, স্যাটেলাইট যোগাযোগ, ও উচ্চ-তরংগের রেডিও যোগাযোগ ঝামেলার মুখে পড়ে। কখনো কখনো, ঝড়ের তোড় অনেক বেশী হলে , কোন কোন স্যাটেলাইট নষ্ট হয়ে যেতে পারে। রেডিও যোগাযোগ বন্ধও হয়ে যেতে পারে। এমনকি বিদ্যুত লাইনেও ঝামেলা করতে পারে।১৮৫৯ সালে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় সৌরঝড় হয়েছিল বলে জানা যায়। তখন, টেলিগ্রাফের যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় ভেংগে পড়েছিল। টেলিগ্রাফ যন্ত্রগুরো বিদ্যুতায়িত হয়ে অনেকক্ষেত্রে আগুণ ধরে গিয়েছিল। (( ১৮৫৯ এর সৌরঝড়: ইংরেজী উইকিপিড়িয়া ))
ও কি উত্তরীয় আকাশে আলোর রংগীন খেলা? মেরু আলেয়া সে, অরোরা রহস্যমেলা..
সৌর ঝড়ের সবচেয়ে মোহনীয় দিকটি হলো মেরু আলেয়া। মেরু অঞ্চলে চৌম্বকীয় ঘনত্বের কারণে সৌরধূলী , চৌম্বক মিথস্ত্রীয়ায় গড়ে তোলে এক অশরীরী আলোচ্ছটা। প্রাচীণ উত্তরীয় অধিবাসীরা এর নাম দিয়েছেন, গ্রীক ভোরের দেবীর নামে, অরোরা। (( অরোরা (জ্যোতির্বিদ্যা): ইংরেজী উইকিপিড়িয়া ))
কেউবা একে বলে নর্দার্ন ফ্লেমস।
এই মোহনীয় অরোরার ছবি দেখেই মুগ্ধ হয় সবাই। আর এতেই ভাষা খুঁজে পায় মানুষ। লিখে রাখে কবিতা গান।
চিত্র: ভোরের দেবীর নামে নাম। উত্তরীয় শিখা বা মরু আলেয়া
সুখী হোক ২০১২
হয়তো এ বছর সৌর ঝড়ের বছর। বলা যায়না, হয়তা ১৮৫৯ এর মতো কোন সুপার- সৌরঝড় অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। তখন নাকি আ্মেরিকার মানুষেরা, অরোরার আলোকে ভোরের আলো মনে করে সকালের নাস্তা করা শুরু করে দিয়েছিল। যদি তেমনটা হয়, হয়তো প্রযুক্তির উন্নতির কারণে, তেমন কোন হুমকির মুখে পড়তে হবে না যোগাযোগ ব্যবস্থা কে। কিন্তু, ভাগ্যে জুটলে, সেই অরোরার রহস্যরূপ আবার দেখা হবে নিজ চোখে।
আর মেরুতে তো নিয়মিতই অরোরা দেবীর আগমণ ঘটেই। ইন্টারনেট ঘেঁটে সেগুলো দেখেই দেবী দর্শনের অভাব মিটাই।
প্রকৃতির এই রহস্যগুলো আমাদের পূর্বপুরুষরা কত অবাক দৃষ্টিতে দেখতো। আর ভাবতো কত কি?
এখন জানার মাঝে কি নেই অবাক হবার অনুভূতিটা মিস করছি? হয়তো হ্যাঁ, আবার হয়তো না।
তবে নিশ্চিত উপভোগ করছি সৌর ঝড়।
“Shall I ever be like him
The brave warrior of the night,
Whose name will be written
In the northern lights” (( অরোরার মোহনীয়তা দেখতে দেখতে একটা গান শোনাও হয়ে যাক। মেলোডিক ডেথ মেটাল ব্যন্ড ‘ইটারনার টিয়ারস অফ সরোস’ (চির দুখের অশ্রুমালা) এর অনেক বিখ্যাত একটি গান, অরোরা বরিয়ালিস। ))
গানটির ইউটিউব লিংক: অরোরা বরিয়ালিস- ইটারনাল টিয়ার্স অফ সরো\’স
সূর্যের উপরিভাগ নিয়ে একটা ডকু টাইপ দেখছিলাম মনে হয় পিচ্চিকালে!
পৃথিবীর চারদিকে এই চৌম্বক বলয় এর উৎস এবং এটার উৎপত্তি নিয়ে ভাবার দরকার আছে মনে হয়! (মানে পড়ার।)
স্যাটেলাইট চ্যানেল গুলোও এর প্রভাবের ভয়ে ছিল !!!
আরোরা দেখার ইচ্ছে আমারো। কিন্তু আমি খারাপ কিছু ভাবতে পারি না। টিভি খুললেই খালি দেখি ২০১২ দেখাচ্ছে!
অ্যাস্ট্রোনমিকাল জিনিসপত্র এমনিতেই আমার ভয়ংকর ভালো লাগে। আর এখানে ছবিগুলো দেখে তো আমি আরও মুগ্ধ! অরোরা যে কী অদ্ভুত সুন্দর! ছবি দেখেও আশ মেটে না। 😐
ভালো লেগেছে। অ্যাস্ট্রোনমিকাল বিষয় সবসময়ই দারুণ লাগে। ছবিগুলো দারুণ ।
খুব ভালো লেগেছে পড়ে, এই ব্যাপারগুলোতে সবসময় খুব আগ্রহ আমার। ইচ্ছে হয় নিজ চোখে যদি কোন্দিন আরোরা দেখতে পাই!
ধন্যবাদ এমন একটা পোস্টের জন্য, এমন লেখা আরো চাই…।