রেলের ব্রীজ আর একটি হতাশার গল্প

“ভয় পাবি না তো !”, রাতুলকে জিজ্ঞাসা করে শিশির । কিন্তু ওর নিজেরই কিন্তু ভয়ে আত্মা শুকিয়ে কাঠ ।
“আরে নাহ, আমরা হলাম ৩ মাস্কেটিয়ার , ভয় পাবো কেন ?? দেখ না কিভাবে পার হয়ে যাই”, বলেই এক বিজয়ীর হাসি দিল রাতুল, যদিও জানে তার মত ভীতু মনে হয়  দুনিয়াতে কমই আছে।
“তোরা কথা কম বলবি?? সামনে যা” এতক্ষণে কথা বলে উঠল অয়ন ।

রাতুল,শিশির আর অয়ন তিনজনই এবার ক্লাস টেনে উঠেছে।এক কথায় বলতে গেলে ওদের মত পাগল মনে হয় পৃথিবীতে আর একটা হবে না। হঠাৎ হঠাৎ ওদের মাথায় যে কি সব উদ্ভট চিন্তা আসে শুনলেই রাগ উঠে যায়। এবার তাদের শখ জেগেছে ব্রহ্মপুত্র নদীর উপরে যে রেল ব্রীজটা ঐটা পার হবে। যেই বলা সেই কাজ, একদিন বিকাল বেলা তিন পাগলে চলে গেল ওখানে। রাস্তার মাঝে তো একেক জনের কি বাহাদুরি , ভাবটা এমন যেন “ দেখনা কি করি !! ”।
কিন্তু ব্রীজের সামনে আসতেই মন চুপসে গেল সবার, যে বিশাল বিশাল ফাঁকা মাঝখানে ! ! তার উপর যদি হঠাৎ মাঝ রাস্তায় ট্রেন চলে আসে তাহলে ! ! !

“আরেহ আগা না!” রাতুল বলে শিশিরকে।

“দাঁড়া ব্যাটা, আচ্ছা তুই আগে যা” ।

“হুম সর”, বলে সামনে চলে গেল রাতুল এরপর অয়ন, আর সব শেষে শিশির।

এক পা আগায় আর নিচের দিকে তাকায় অয়ন, “বাপরে ! সাতাঁর তো জানি না, যদি পড়ে যাই ! ! না না আমি যাবো না” ।

“ভীতু কোনখানকার ! আমার মত আয়” শিশির বলে, সে কিন্তু ভয়ে রেলের ট্র্যাকের উপর বসে পরেছে।
ওদিকে মাত্র তারা মনে হয় কিছুদূর ( পুরো ব্রীজের চার ভাগের এক ভাগও না ) গিয়েছে এমন সময় ট্রেনের সাইরেন শুনতে পেল।
“ ওমা গো ! ! ট্রেন !” অয়নের আত্মা কেঁপে উঠে।

“ কি করব এখন?”, রাতুলটাও বেশ ভয় পেয়েছে।

“ তাড়াতাড়ি পিছনে যা”, বলে শিশির নিজেই আগে যাওয়া শুরু করল সাথে সাথে অয়ন আর রাতুলও।

মৃত্যুর ভয়েই কিনা এবার তারা আগের বারের চেয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে আসল ।

“  বড় বাচা বেঁচে গেছি !”, একটু পর যখন ট্রেনটা তাদের সামনে দিয়ে সাই করে ছুটে গেল তখন বলল অয়ন “ আর জীবনে যদি আসছি এখানে ! আমার নাম অয়ন না ! পাগল নাকি ? মরবি তো মর তাঁর মানে এইভাবে ?”

অয়নের অবস্থা দেখে অন্যদুজন তো হেসে গড়াগড়ি।

তিন বছর পর……

অয়ন হাঁটছে ঐ ব্রীজটি ধরে , আজ কেন জানি নিচের দিকে তাকাতে ইচ্ছা করছে না ওর, ভয়ও নেই তেমন কোন, শুধু হেটেই যাচ্ছে ।

“অয়ন সামনে যাবি ? ভয় হচ্ছে না তোর ? আচ্ছা যদি মাঝ রাস্তায় ট্রেন চলে আসে? তুই তো সাঁতার জানিস না ? আচ্ছা তুই মরে গেলে কি ভালো কিছু হবে ? আচ্ছা বাসায় যে তোর আম্মুটা তোর জন্য অপেক্ষা করে আছে তাঁর কি হবে যদি তুই মারা যাস? তোর আব্বুটা কষ্ট পাবে না? তুই যাচ্ছিস কেন ? কি সমস্যা তোর”
প্রশ্ন গুলো নিজেকেই নিজে করল অয়ন। আজ অঙ্কে দিন পর সে এখানে এসে ঠিক সেই ব্রীজটার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে , পুরনো কিছু কথা মনে পড়ে যাচ্ছে , রাতুল, শিশিরের কথা । কোথায় ওরা? অয়ন শুনেছিল রাতুল নাকি পড়াশোনা করতে দেশের বাইরে চলে গেছে, আর শিশির তার ছন্নছাড়া জীবন গোছাতে ব্যস্ত । অয়ন খুব ভালোই ছিল, কোন সমস্যাই ছিলনা তার, ক্লাসের সেরা ছাত্র, বাবা-মার আদরের সন্তান কি ছিল না সে? শুধু ঐ দিনটার জন্য আজ তাকে এখানে চলে আসতে হয়েছে । আর পারছেনা সে । একটা মেয়েকে ভালবেসেছিল সে, তাও আবার পাগলের মত , ঠিক পাগল বললে ভুল হবে এর চেয়ে বেশি হয়ত । মেয়েটি তাকে ভালবাসত কিনা কে জানে ? জানা হয়নি তার , দু একবার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে চেয়েছে , পারেনি ভয়ে । “কিসের ভয় ছিল ? হারানোর , তাতো এমনিতেও হারালাম” মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করে নিজেকে অয়ন। মেয়েটি কখনই বুঝত না অয়ন তাকে ভালবাসে , তার ধারনা ছিল এটা শুধুই পাগলামি , কিন্তু অয়ন যে এটাকেই জীবন ধরে নিয়েছিল কে জানত ? যখন জানতে পারল মেয়েটি কখনই তাকে ভালবাসবে না , খুব অভিমান হয়েছিল ওর, মনে হয়েছিল মরে যাওয়াই ভাল। কিন্তু অয়ন তা করেনি, নিজেকে নতুন ভাবে শুরু করতে চেয়েছিল , কিন্তু নিয়তি অয়নের সাথে ছিল না। আস্তে আস্তে নিজেকে হারিয়ে ফেলে অয়ন, লেখা পড়া, খেলা , গান কিচ্ছু ভাল লাগেনা ওর। যখনই একটু একা থাকে তখনই ওই মেয়েটি এসে হানা দেয় ওর মনে ? সব যখন প্রায় শেষ এমন সময় জীবনের শেষ ধাক্কাটি খেল ও । আর এটা ওর সবচেয়ে প্রিয় মানুষটির কাছ থেকে , ওর মা !!
কাল রাতে অয়নের মা ওকে বলছিল , “ তুমি একটা অপদার্থ । নিজের কি অবস্থা করেছ ! কি কর এখন তুমি ? তোমাকে আর বাসায় রাখা যাবে না , তুমি হোস্টেলে চলে যাবে কাল । তোমার দেখাদেখি তোমার ছোট ভাইটাও তোমার মতই হয়ে যাক এমনটা আমি চাই না”।
আম্মু এই কথা বলতে পারে ভাবতে পারে না অয়ন। “ আম্মু ! ! এইটা কি সেই আম্মু যে কিনা অয়ন যখন ক্লাসে ফার্স্ট হত তখন তাকে কোলে করে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াত ! সেই আম্মু যে বলত আমার অয়নের মত ছেলেই হয় না ! আর আজ সেই আম্মুই কিনা বলে চলেছে অয়নের জন্য তার ছোট ছেলে নষ্ট হয়ে যাবে ?”

শুধু এটা হলে কথা ছিল না, আজকাল বাসার সবাইতো বটেই এমনকি স্কুলের স্যার, ম্যাডাম বা ক্লাসমেটরা পর্যন্ত ওকে নিয়ে হাসাহাসি করে ?? এভাবে আর কত দিন ?? নিজেকে তুচ্ছ মনে হয় অয়নের , যে কি না ক্লাসের সবচেয়ে সেরা ছাত্রটি ছিল তার দিকে মানুষের এমন অবজ্ঞা , এমন অবহেলা তার সহ্য হয় না। জীবনের সাথে একদমই পেরে না উঠে আজ সে চলে এসেছে আবার সেই পুরনো জায়গায়, পুরনো অয়ন হতে ।

ট্রেনের হুইসেল শোনা যাচ্ছে। অয়ন একবারের জন্য থমকে দাঁড়াল , পেছন ফিরে চাইল একবার, তারপর আবার সামনের দিকে হাটা শুরু করল । তার চোখের সামনে ভেসে উঠল তার আম্মুর সেই মায়া ভরা মুখখানি, বাবার আদরের দিনগুলি আর ভাইয়ের সাথে দুষ্টামি করার সময়গুলোর কথা। নিজের অজান্তেই একবার হেসে ফেলল সে । সবশেষে মনে পড়ল তার ঐ মেয়েটির কথা, ছোট্ট মুখখানি , “আচ্ছা ও কি আমাকে কখনই ভালবাসত না ??”, ভাবতে গিয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল ওর চোখ থেকে । আবার সাইরেনের শব্দ, এবার আরও জোরালো ভাবে…….

অক্ষর সম্পর্কে

স্বপ্নবাজ মানুষ একজন। আশাবাদ আর নিরাশার দোলাচালে আশাকেই শেষ পর্যন্ত সঙ্গী করতে চাই। আর স্বপ্ন দেখি একদিন দেশের জন্য কিছু করার, স্বপ্ন দেখি ছোট্ট করে হলেও কিছু একটা করার যা একটা প্রজন্মের গতিপথ পরিবর্তন করবে এবং অবশ্যই সেটা যেন হয় ইতিবাচক কোন পরিবর্তন। এখন পড়াশোনা করছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে। গণনা যন্ত্রের উপর পড়াশোনা করছি ঠিকই কিন্তু যন্ত্র শব্দটাই আমার কাছে বিরক্তিকর। ফেসবুক লিঙ্ক- www.facebook.com/akkhar21
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে গল্প, পাগলামি, বিবিধ, হাবিজাবি-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

14 Responses to রেলের ব্রীজ আর একটি হতাশার গল্প

  1. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    খালি উল্টাপাল্টা মন খারাপের কথা লিখে বাচ্চাগুলো! 🙁

    অফ টপিক-
    বানান! বানান!

  2. সামিরা বলেছেনঃ

    🙁

  3. শারমিন বলেছেনঃ

    মন খারাপ হলো পড়ে।
    🙁

  4. মুবিন বলেছেনঃ

    সাহিত্যমান, কাহিনীর বর্ণনা সবই ঠিক আছে। কিন্তু গল্পের সমাপ্তি নিয়ে আমার খানিকটা আপত্তি আছে।
    একজন পাঠক যখন কোন ভাল মানের গল্প পড়ে তখন সে নিজেকে গল্পের কোন চরিত্রের মধ্যে হারিয়ে ফেলে কিংবা গল্পের মতো করে চারপাশকে সাজিয়ে ফেলে। এটা একজন ভালো লেখকের যোগ্যতা। কিন্তু লেখক যখন গল্পটা নেতিবাচক ভাবে শেষ করে তখন পাঠক মনের অজান্তে নেতিবাচকতার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
    অপরদিকে গল্পের সমাপ্তি যখন ইতিবাচকতা দিয়ে শেষ হয় তখন একজন নেতিবাচক চিন্তার লালনকারী পাঠকও ইতিবাচক চিন্তা করতে শুরু করে। তাই একজন গল্পকার শুধু একজন গল্পকার নন তিনি মনের রোগের একজন ডাক্তারও বটে। তাই এই ডাক্তারিটা আমাদের ভাল মতোই করা উচিৎ।
    শুভকামনা।

    • অনাবিল বলেছেনঃ

      চমৎকার বলেছেন। একমত।
      এবং আমিও মনে করি এটা খুব ভালো করেই করা উচিত……

    • অক্ষর বলেছেনঃ

      ধন্যবাদ বিষয়টি পয়েন্ট আউট করার জন্য ।
      এটা নিয়ে আসলে তর্ক করব না যে একটা গল্পের শেষ সবসময় ইতিবাচকতা দিয়ে করতেই হবে এমন কোন কথা আছে কি না বা মানুষের জীবনে সবসময় যা ঘটে তা ইতিবাচক কি না? আমিও আপনার মতই ভালোটাই করতে চাই, বা ইতিবাচক কিছুই লিখতে চাই, তবে মাঝে মাঝে নির্মম হতেই হয় । সামনে কখনো লিখলে আপনার কথাগুলো মাথায় থাকবে অবশ্যই ।

    • স্বপ্ন বিলাস বলেছেনঃ

      কথার যৌক্তিকতা আছে, কিন্তু, একটা মানুষকে তো শুধু হারিয়ে গেলেই হবে না। নিজেকে খুঁজে ফিরে পাওয়ার মতোও যোগ্য হতে হবে।
      একজন লেখকের গুণ সে কতটা পাঠককে চরিত্রের ভেতর নিয়ে আসতে পারে।
      একজন পাঠকের গুণ সে চরিত্রের ভেতর থেকে কতটা সাহিত্যরস আস্বাদন করে, সেখান থেকে শুধু ভালোটা নিজের করে নিতে পারে……

  5. বাবুনি সুপ্তি বলেছেনঃ

    যত হতাশাই থাকুক এমনটা কখনো মেনে নিতে পারি না আমি।

  6. স্বপ্ন বিলাস বলেছেনঃ

    মন খারাপ হয়ে গেলো গল্প পড়ে। এর মানেই হলো, গল্পটা ভালো হয়েছে…… :clappinghands:

    তবে কেন মানুষের ভালোবাসার মানুষকে না পেলে এমন হারিয়ে যেতে হবে। নতুন করেও তো পৃথিবীটাকে দেখা যায়………

    • অক্ষর বলেছেনঃ

      ভাইয়া ” অয়ন” ছেলেটা খুব বোকা । মায়ের একটু কড়া কথা , ভালবাসার মানুষটিকে না পাওয়া ওকে আসলে আরও বোকা বানিয়ে ফেলসে । আমরা কেউ ই অয়নের মত হব না ।

      ধন্যবাদ ভাইয়া । :love:

  7. সাইব্রিয়ান সৌরভ বলেছেনঃ

    শেষাংসটা কষ্টদায়ক। অন্তত কোনো কিশোর উপন্যাস বা গল্প এমন পরিণতিতে শেষ করাটা অনেকেই ভালো ভাবে নেবে না। :nono:
    তবে তোর লেখার হাত ভালো সেটা স্বীকার না করে উপায় নেই 8)
    চালায়া যা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।