– নাহ্, উঠতে হবে টনি। এর মধ্যে আর আসতে পারব না। একেবারে চাটগাঁ পৌঁছে ফোন করব, ঠিক আছে? এই দেখ, ভাষা কেমন মজার হতে পারে। আজকাল শুনতে পাচ্ছিস তো সবাই কী বলছে। ফোন দিয়ো, ফোন দাও, ফোন দেবে, ফোন দিয়েছিলাম – তাই না? বাপের জন্মে এমন শুনি নি। কার ফোন কে কাকে দিচ্ছে, বল? ফোন কিনতে পয়সা লাগে না? আমার টেলিফোন সেট তোকে দিতে যাবই-বা কোন দুঃখে? আসলে কিন্তু বলতে চাইছে ফোন করো, ফোন কর, ফোন করবে, ফোন করেছিলাম ইত্যাদি। Give me a ring/Give me a call ইংরেজিতে চলে, কারণ এমন বলাটাই ইংরেজদের রীতি। কিন্তু আমরা কখনোই তো ফোনের সঙ্গে ‘দেওয়া’ ক্রিয়াপদ ব্যবহার করি নি, সব সময় ‘করা’ বলেছি। তুই পশ্চিমবঙ্গে যা, ত্রিপুরায় যা, আসামে যা, কোত্থাও কোনো বাঙালিকে ‘ফোন দিও’ বলতে শুনবি না। মানে বুঝলি? মানে একটাই – আমরা মাতৃভাষা ভুলে যাচ্ছি।
– আপু, একুশে ফেব্রুয়ারি কি আমরাই করি নি?
– মনে হয় না, টনি।
পড়ছিলাম হায়াৎ মামুদের ‘শব্দকল্পদ্রুম’। ছোটদের ব্যাকরণ শেখার জন্য খুব ভাল – এ কথা শুনে এবারের বইমেলা থেকে খুঁজে-পেতে কিনে ফেললাম বইটা। সচরাচর ব্যাকরণ বই যেমন হয় তার থেকে পুরোই আলাদা – টনি আর টুপিন নামের দুই ভাইবোনের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে গল্পে গল্পে পুরো বই জুড়ে ব্যাকরণ না জানার সবচেয়ে বড় সমস্যা যেটা – বানান ভুল, তা দূর করার চেষ্টা করা হয়েছে।
বইটা পড়তে একটু কষ্ট হয়েছে, যেহেতু লেখা হয়েছে ছোটদের জন্য। এই বুড়ো বয়সে(মাথার দুটো চুল পেকে গেছে এরই মধ্যে!) কি আর ছোটদের বই পড়তে ভাল লাগে? 🙁 কিন্তু আরো দুঃখের ব্যাপার যেটা, বই যাদের জন্যই লেখা হোক না কেন, যেসব ভুলের কথা তুলে ধরা হয়েছে সেগুলো আমরা ছেলে-বুড়ো (আর মেয়ে-বুড়ি!) সবাই করি!
এতক্ষণে হয়তো প্রায় সবার মনেই সেই প্রশ্নটা জাগছে, বইটা পড়তে শুরু করার সময় যেটা আমার মনে জেগেছিল। ‘শব্দকল্পদ্রুম’ – এই কথার মানেটা কী? লেখকের ভাষাতেই বলি – দ্রুম শব্দের অর্থ বৃক্ষ, গাছ। কল্পদ্রুম মানে এমন একটি গাছ যার কাছে যা চাওয়া যাবে তা-ই মিলবে। তার মানে, শব্দকল্পদ্রুম হল এমন এক শব্দবৃক্ষ যার কাছে কিছু চাইলে নিরাশ হতে হবে না। দেড় শ’ বছর আগে বেরোনো এক অভিধানের নামে নামকরণ এই বইয়ের। অভিধান তো, সব শব্দের অর্থ সেখানে দেওয়া আছে, সেজন্যেই এমন নাম।
“Don’t judge a book by its cover” – কথাটার মধ্যে এতটুকু মিথ্যে নেই, কিন্তু যে বইয়ের কথা বলছি, মলাট দেখলেই সেটা পড়তে ইচ্ছে করবে। বই খুলতে না খুলতে, শুরুতেই আমার ইদানিংকালের একটা দুশ্চিন্তার অবসান হল। ভাবছিলাম, বানান নিয়ে এত্ত যে গণ্ডগোল – আচ্ছা, তাহলে আমরা মুখে যেমন বলি ঠিক তেমন করেই যদি লিখতাম সেটা অনেক ভাল হত না? কিন্তু বইটা পড়ে বুঝলাম যে সেটা করতে গেলে কত ভজঘট অবস্থা হবে, তাছাড়া বলার সাথে লেখার এই ছোটখাটো তফাৎগুলো প্রায় সব ভাষাতেই আছে – সুতরাং নিজেদেরকে দুর্ভাগা ভেবে মন খারাপ করারও কিছু নেই।
আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করছিলাম ইদানিং বড় বড় সাহিত্যিকদের বই পড়তে গিয়ে, তারা সবাই যে লেখার সময় সবখানে একই নিয়মে ভাষার ব্যবহার করেছেন এমনও নয়। যেমন আমরা জানি ‘পারিনি’, ‘পড়িনা’ এই কথাগুলো ভুল; আসলে হবে ‘পারি নি’, ‘পড়ি না’ অর্থাৎ ‘নি’, ‘না’ এসব আলাদাভাবে বসবে। কিন্তু অনেক লেখকই এই নিয়ম মেনে লেখেন নি। আবার ‘দাঁড়াল’, ‘হল’ এগুলো ঠিক; নাকি ‘দাঁড়ালো’, ‘হলো’ সেসব নিয়েও সবাই একমত নন। তার মানে দাঁড়াল কিছু কিছু ক্ষেত্রে বানান নিয়ে আমি আরো কম খুঁতখুঁতে হতে পারি, যেটা একদিক দিয়ে ভাল।
‘কি/কী’, ‘না’, ‘তো’ এই শব্দগুলোর ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে বাক্যের অর্থও যে কতভাবে পালটে যেতে পারে, বইটা পড়তে গিয়ে দেখলাম। আবার, ‘রুগ্ন’ শব্দটার আসল বানান ‘রুগ্ণ’, কারণ ণ-ত্ব বিধান অনুযায়ী এখানে মূর্ধণ্য ণ হবার কথা, অথচ ‘রুগ্ন’ বানানটা লেখা হয়েছে দন্ত্য ন দিয়ে। আমরা কত মানুষ যে এই ভুলটা করি!
আরেকটা মজার জিনিস, ছোট একটা শব্দ থেকে বেশ কিছু শব্দ তৈরি হয় অনেক সময় – এসব ক্ষেত্রে মূল শব্দটা মনে রাখলে অন্যান্য শব্দের বানান ভুল হওয়ার সম্ভাবনাও কম থাকে। যেমন ‘ভূগোল’ শব্দটার বানান মনে রাখতে পারলে ‘ভৌগোলিক’ শব্দটাকে আমরা আর কখনো ভুল করে ‘ভৌগলিক’ লিখব না, কারণ ‘ভূগোলে’ যখন ও-কার, তখন তা থেকে আসা সব শব্দেই ও-কার থাকবে।
কেবল যুক্তবর্ণগুলো কী কী বর্ণ মিলে তৈরি হয়েছে সেটা মনে রাখতে পারলেই আমাদের বানান আর উচ্চারণের ভুল যে কতটা কমে আসবে, বইটা না পড়লে টেরই পেতাম না। কোথায় ‘ঙ’ হবে আর কোথায় ‘ং’, সেটা নিয়েও কি আর ভোগান্তির শেষ আছে! বড় একটা শব্দ কীভাবে দুটো-তিনটে শব্দের সন্ধিতে তৈরি হয়েছে, সেটা জানলেই সেই শব্দের বানান নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকা যায়। ‘মহত্ত্ব’ শব্দের বানান কেন ‘মহত্ত্ব’ হল, ‘বাল্মীকি’র নামের কোথায় ই-কার আর কোথায় ঈ-কার – তাও মনে রাখা জলবৎ তরলং হয়ে যাবে এই বই পড়ে।
কি, মনে হচ্ছে এমন গুবলেট অবস্থা কেবল বাংলা ভাষারই? উঁহু, ইংরেজি-ফরাসি থেকে শুরু করে পৃথিবীর বেশির ভাগ ভাষারই এমন হাজারো নিয়ম আছে, ঠিকমত বুঝতে পারলেই ভাষাটাকে দারুণ মজার একটা ব্যাপার মনে হবে তখন। আর খুশির খবর হচ্ছে, যে ভাষা যত উন্নত তা তত জটিল, সেজন্য বাংলা যদি বা একটু জটিলও মনে হয় আমাদের কাছে, সেটাও আমাদের জন্য আনন্দের।
না জেনেই আমরা যে সাধু-চলিত মিশিয়ে কেমন জগাখিচুরি অবস্থা করি অনেক সময়! ‘শব্দকল্পদ্রুম’ থেকে জানলাম – ইনাকে/উনাকে/ইনার/উনার/এনাকে/ওনাকে/এনার/ওনার লেখা মারাত্মক ভুল; সব সময়ে লিখতে হবে এঁকে/ওঁকে/এঁর/ওঁর (চন্দ্রবিন্দুও যত্ন করে উচ্চারণ করতে হবে তাহলে, কী ভয়াবহ!)। 🙁
বাক্যে কোথায় ফুটে/উঠে/লিখে হবে আর কোথায় ফোটে/ওঠে/লেখে হবে সেসব ভুল আমরা করি সমাপিকা-অসমাপিকা নিয়ে দোটানায় ভুগি বলে। এসবও পরিষ্কার আর মজার করে লেখা আছে বইটাতে।
বইয়ের শেষের দিকের একটা বড় অংশ জুড়ে সন্ধি নিয়ে গল্প জুড়েছিল দুই ভাই-বোন। বানানের বইতে খটমটে সন্ধি কোথা থেকে এলো সেটা ভাবতে পারেন কেউ কেউ। সেটাও বলে দিয়েছেন লেখক, আমাদের শুদ্ধ বানান লিখতে সন্ধি যতটা সাহায্য করে ততটা আর কেউ করে না।
যাই হোক, বই নিয়ে বকর বকর করতে করতে পুরো বইটাই তুলে দিচ্ছি না আশা করি। সংগ্রহে রাখার মত চমৎকার কাজের একটা বই ‘শব্দকল্পদ্রুম’। বইটার আরেকটা ব্যাপার ভাল লেগেছে, বইয়ের শেষের বিষয়-সূচি। এটার সবচেয়ে বড় সুবিধা, কোন বিশেষ বানান নিয়ে সন্দেহ জাগলে পুরো বই উল্টাতে হবে না কাউকে, সূচিতে পৃষ্ঠা নম্বর দেখেই খুঁজে পেতে পারবে সেটা।
সবার শেষে, বইয়ের মলাট থেকে হায়াৎ মামুদের ছোট্ট ভূমিকাটা তুলে দিচ্ছি। আমাদের প্রিয় ভাষাটাকে পুরোপুরি হারিয়ে ফেলার আগেই আমরা যেন এর মর্ম বুঝি, সেই কামনা করি।
“দেড় শ’ বছরের মত আগে ‘শব্দকল্পদ্রুম’ নামে একটি বিখ্যাত অভিধান বেরিয়েছিল। এই ‘শব্দকল্পদ্রুম’ কিন্তু অভিধান নয়। এ-বই হল ব্যাকরণের জুজুর ভয় তাড়ানো বই।
অনেকেরই জানা নেই, পড়তে জানলে ব্যাকরণের অনেক মজা। কোথায় মজা, কেমন মজা সেটুকু ধরিয়ে দেবার জন্যই এই বই। শুধু বাংলাই নয়, আরো দু-চারটি ভাষার হেঁশেলঘরের খবরও এখানে মিলবে। সে-সবও কম মজার নয়।
মাতৃভাষার জন্যে বাঙালি শহীদ হয়েছে। শুধু এখানকার বাঙালিই নয়। ভারতের আসাম রাজ্যের বাঙালিরাও। সারা পৃথিবী তাই বাঙালিকে সম্মান করে, শ্রদ্ধা জানায়। সেই মাতৃভাষা না জানলে কি কম লজ্জা! বিশ্বমাতৃভাষা-দিবসের পিছনেও তো আমরাই।
মজার এ বইটি পড়লে মনে হয় বাংলা নির্ভুলভাবে লেখা যাবে।”
বানান নিয়ে সরবে একটা সিরিজ আছে, বানান বিভ্রাট নামে, কেউ চাইলে দেখতে পারেন। 🙂
‘শব্দকল্পদ্রুম’। ছোটদের ব্যাকরণ শেখার জন্য খুব ভাল –মাথায় রাখলাম 🙂
ভাল বিশ্লেষন, সুন্দর বর্ণনায় । বইটা কোথায় পেতে পারি ??
হাহা। ধন্যবাদ ভাইয়া। 🙂
আমি বইমেলায় ‘চারুলিপি’ প্রকাশনী থেকে কিনেছি।
হায়াৎ মামুদের ভূমিকাটা পড়ে খুব ভালো লাগলো।
বানানের সঠিকতা যেমনি প্রয়োজন, ব্যাকরণের জুজুর ভয় তাড়ানো আমাদের সবারই প্রয়োজন।
আমি হুমায়ূন আজাদের “লাল নীলও দীপাবলী” বইটিকে স্মরণ করছি। খুব অসাধারণ লেগেছিলো। আপনার দেখা না থাকলে দেখে নিতে পারেন, ভালো লাগার কথা।
সুন্দর এই শব্দকল্পীয় লেখাটা ভালো লাগলো
পড়ি নি আমি বইটা, নাম শুনেছি। পড়ে ফেলতে হবে দেখি।
ধন্যবাদ।
পড়তে হবে তো বইটা! দারুণ প্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে………
হ্যাঁ খুবই!
হায়াৎ মামুদের প্রতি আলাদা আগ্রহ আছে। এই বই এর ব্যাপারেও আগ্রহ জন্মাইল। নিতে হবে।
আর শুরুর অংশের সাথে দ্বিমত পোষণের সুযোগ আছে।
ব্যাকরণের প্রতি আগ্রহ তৈরি করা জরুরি। আর সরব এর বানান এর প্রতি আগ্রহ একটা বড় ব্যাপার।
হুম।
আপনার পাঁচ লাইনের মন্তব্য ‘আগ্রহ’ শব্দটা চারবার দেখতে পাচ্ছি। 😀
*মন্তব্যে*
হ! আগ্রহী ছাত্র!
ইশ, কবে যে বইটা হাতে পাব! আর তর সইছে না!
হিংসা লাগছে এত সুন্দর বই আমার আগেই আপনি পড়ে ফেললেন দেখে। 😛
😛 ইয়েস ইয়েস! আমি ফার্স্ট!
এমন একটা পোস্টের জন্য ধন্যবাদ……
বইটা কিনে ফেলতে হবে, নিজের জন্য, আর ছোটদের উপহার দেবার জন্য চমৎকার হতে পারে……
আমার কিছু কিছু ক্ষেত্রে কনফিউশন আছে, যেমন, ‘আরো’ হবে নাকি ‘আরও’ হবে??
জানি না ঠিক আপু, দুটোই ঠিক হওয়ার কথা।
চমৎকার লাগলো ।বই টি খুব তাড়াতাড়ি পড়তে হবে দেখছি! আজকাল আমরা আমাদের ভাষাই তো সঠিক ভাবে বলি না। কত কিছুর মিশেল পাই কথ্য ভাষায়। বোধহয় এটি নিয়ে খুব কম মানুষ ভাবেন। বহু আগে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন “কৃষ্ণনগর” এর ভাষা হলো বাংলা ভাষার স্ট্যান্ডার্ড। কিন্তু মানেন ক’জন? আমিও বোধহয় তাদের মধ্যে একজন। ভাষা বিষয়ে আরও সচেতন হতে হবে। 😀
পড়ে ফেলেন। 😀