
২০০১ সালের ১১ই মার্চ ৯.০ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প এবং এর ফলে সৃষ্ট সুনামি জাপানে আঘাত হানে। জাপানের ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ ভূমিকম্পে প্রায় ১৬,০০০ নিহত এবং ৩ হাজারেরও বেশি নিখোঁজ হয়। গেল ১১ই মার্চ তোহোকু ভূমিকম্প ও সুনামির এক বছরপূর্তি হলো। দেখা যাক ভূমিকম্পের পর দেশটি ক্ষয়ক্ষতি কি পরিমাণ কাটিয়ে উঠলো।

সুনামির পর মহিলাটি তার সন্তানকে খুঁজছিল, এক বছর পরে সেই একই মহিলা তার ৫ বছর বয়সী ছেলেসহ বহাল তবিয়তে

সুনামির সময় ইওয়াতে প্রিফেকচারের রিকুজেন্তাকা এলাকা। পরের ছবিটি এ বছর জানুয়ারীতে তোলা
ইওয়াতে প্রিফেকচারের ওফুনাতো এলাকা। এক বছর আগে ও পরে।
ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত রিকুজেন্তাকা। এ বছর জানুয়ারিতে তোলা রিকুজেন্তাকা এলাকার সর্বশেষ চিত্র।
মিয়াগি প্রিফেকচারের তাগাজোর প্লাবিত রাস্তাঘাট।
চিবা প্রিফেকচারের উরায়াসুর ভূমিকম্পে দেবে যাওয়া রাস্তা (ভূমিকম্পের সময় ও ভূমিকম্পের এক বছর পরে)
আবারো ইওয়াতে প্রিফেকচারের ওফুনাতো
ভূমিকম্প এবং সুনামিতে ১০ মিটার লম্বা অক্ষত পাইন গাছ এবং ক্ষতিগ্রস্ত আশেপাশের এলাকা। এক বছর পরে আবারো সেই পাইন গাছ!
মিয়াগি প্রিফেকচারের তাগাজোর ক্ষতিগ্রস্ত রেললাইন
মিয়াগি প্রিফেকচারের তাগাজোর ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা (ভূমিকম্পের সময় এবং এর এক বছর পর)
মিয়াগি প্রিফেকচারের নাতোরির সেন্দাই বিমানবন্দর ও এর আশেপাশের এলাকা পানিতে ভেসে যায়। সে সময়ের অবস্থা এবং এক বছর পরের অবস্থা
মিয়াগি প্রিফেকচারের সেন্দাই
সুনামির পরে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোতে খাবার কেনার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। স্টোরগুলোর সামনে অপেক্ষারত মানুষের দীর্ঘ লাইন। এক বছর পড়ে সেই একই শপ (মিয়াগি প্রিফেকচারের সেন্দাই এলাকা)
সুনামি আক্রান্ত ফুকুশিমা প্রিফেকচারের মিনামিসোমা এবং এক বছর পর……….
এবার আমার নিজের অভিজ্ঞতা কিছুটা বলি। সাধারণত এ ধরণের দুর্বল মুহুর্তে সবাই সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে- চুরি, ডাকাতি, লুন্ঠন বেড়ে যায়। কিন্তু এই ঘোর বিপদেও জাপানীজরা সবাই একে অপরকে যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, তা সত্যিই অভূতপূর্ব! শিক্ষক, পরিচিত বন্ধুরাও ঝুঁকি নিয়ে শুধু নিজেদের মধ্যেই (জাপানীজদের) নয়, আমাদেরও (বিদেশীদের) সাধ্যমত সাহায্য করেছিল।
এই ভয়াবহ দুর্যোগের মুহুর্তে জাপান সরকার ফোনবুথগুলো থেকে বিনামূল্যে লোকাল ও ইন্টারন্যাশনাল কল করার সুবিধা দেয় যেন সবাই পরিবার পরিজনকে নিজের খবরাখবর জানাতে পারে। ফ্রীতে এই সুবিধা পাওয়ার পর আমার দেখা স্বদেশী ও বিদেশী অনেকেই টুল ও চেয়ার নিয়ে ফোনবুথগুলোতে ঘন্টার পর ঘন্টা আসর পেতেছিলেন যেন এ জীবনের সমস্ত কথা বলে ফেলবেন! অথচ বুথের বাইরে এমন জাপানীসহ অনেকে অপেক্ষারত ছিল যারা তাদের পরিবার পরিজনকে তারা কেমন আছেন এ খবরটি জানানোর জন্য উদগ্রীব ছিলেন।
এবার একজন জাপানীজ বালকের কথা বলব। এই বালক প্রায় ৯ বছর বয়সী একজন স্কুলছাত্র। সে দাঁড়িয়েছিল খাদ্য বিতরণের লাইনের একেবারে শেষের দিকে। খাদ্য বিতরণের লাইন ঠিক রাখার কাজে নিয়োজিত ভিয়েতনামি বংশোদ্ভূত ওই ইমিগ্রান্ট পুলিশ অফিসার হঠাৎ বালকটিকে দেখতে পান। লাইনের শেষভাগে দাঁড়িয়ে বালকটি খাবার পাওয়ার অনিশ্চয়তা জেনেও খাবার বিতরণ পয়েন্টে জড়ো করা খাবারের দিকে তাকিয়ে থাকে। গায়ে শীত নিবারণের জন্য পরিধেয় কাপড় খুবই কম; একটি মাত্র টি-শার্ট এবং পায়ে দুটি মোজা। ক্ষুধা এবং শীত দুটোই তাকে জেঁকে বসেছে।
হঠাৎ পুলিশ অফিসারটি বালকটির কাছে গিয়ে তার সম্পর্কে জানতে চাওয়ায় বালকটি জানাল, সুনামির সময় স্কুল ব্যালকনির তৃতীয় তলায় দাঁড়িয়ে সে দেখতে পেয়েছিল তার বাবা তাকে স্কুল থেকে নেওয়ার জন্য গাড়ি চালিয়ে রাস্তা থেকে স্কুলের দিকে ঢুকছেন। ছেলেটির বাবা ওই স্কুলের কাছেই একটি কারখানায় কাজ করতেন। হঠাৎ সে দেখল, তাদের গাড়িটি অন্যান্য গাড়ির সঙ্গে পানির টানে সাগরের দিকে ভেসে গেল। তারপর তার বাবা আর তাকে নিতে আসেনি। ছেলেটি তার পরিবার সম্পর্কে জানাল যে তারা সমুদ্রপারে বিচ এলাকায় একটি সুন্দর বাড়িতে থাকত। মা, বাবা, সে এবং এক বোন। সুনামির পর বাড়িটি বিধ্বস্ত হয়ে যায়। মা ও বোনেরও কোনো খোঁজ নেই।
ঘটনা শুনে পুলিশ সদস্য প্রায় বাকরুদ্ধ। দুরবস্থা জেনে ওই পুলিশ সদস্য তাঁর নিজের গায়ের জ্যাকেটটি খুলে বালকটিকে পরিয়ে দিলেন। জ্যাকেটটি পরিয়ে দেওয়ার সময় পুলিশ সদস্যের কাছে থাকা তাঁর নিজের খাবারের প্যাকেটটি একপর্যায়ে বালকটির পায়ের কাছে পড়ে যায়। বালকটি তখন খাবারের প্যাকেটটির দিকে তাকিয়ে থাকে। এ অবস্থায় পুলিশ সদস্য প্যাকেটটি হাতে তুলে সেটি বালকটিকে নিতে বলেন।
বালকটি প্যাকেটটি নিয়ে সোজা হেঁটে একেবারে খাবারের লাইনের শেষ প্রান্তে খাবার বণ্টন পয়েন্টে গিয়ে তা সেখানে রেখে আসে এবং পুনরায় লাইনে নিজ অবস্থানে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। পুলিশ সদস্য বালকটির কাছে সে এমনটি করল কেন তা জানতে চাইলেন। জবাবে বালকটি জানায়, ‘আমি দেখেছি, এখানে আমার চেয়ে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা অনেক; যদি আমি খাবারের প্যাকেটটি ওখানে রাখি, তাহলে তারা খাবার সমানভাবে ভাগ করে নেবে।’ বালকটির এই কথা শুনে পুলিশ সদস্য কেঁদে ফেলেন। তাঁর ভাষায়, ‘এ কথা শোনার পর আমি কান্না ঢাকতে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যেতে ঘুরে দাঁড়ালাম।’
এ কাহিনী যখন শুনলাম, আমারও চোখে পানি চলে এসেছিল- শুধু বালকটির প্রতি ভালবাসার কারণে নয়, অনেকটা নিজের প্রতি লজ্জায়ও। ‘মানুষ মানুষের জন্য’ এ কথাটি যেন এই ৯ বছর বালকটি স্বার্থপর আমাদের মনে করিয়ে দিলো।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে
অনুপ্রেরণা,
ইতিবাচক-এ।
স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।
একটা কমেন্ট করলাম উধাও!
সুনামির সময় এপল স্টোরের কর্মিরা বাকিদের সাহায্য করেছিল এটা পড়েছিলাম।
কিছুদিন আগে ব্রিটিনে ঝামেলা হল লোকেরা লুটপাট করল না?!!
একেক দেশের মানুষের মানসিকতা একেক রকম।
আমরা যদি পুশ করি তাহলে হয়ত ৫০/৬০ বছর পর কিংবা ১০০ বছর আমাদের মানসিকতারও পরিবর্তন হবে। আর শাহরিক মানুষের চেয়ে গ্রামীণ মানুষ কিন্তু অনেক আন্তরিক।
সুন্দর একটা লেখার জন্য ধন্যবাদ মাসরুর
বোহেমিয়ান একেবারে মনের কথাটা তুলে আনলো। আমার কেন জানি মনে হয়, সাহায্যের মানসিকতার জন্য যদি কোন ‘জিন’ থাকে, আমরা আর জাপানিরা সেই একই জিন শেয়ার করি। হাসি, কান্না কিংবা আবেগ প্রকাশভঙ্গিতে জাপানিরা, পশ্চিমা কিংবা আরবীয়দের তুলনায় আমাদের অনেক কাছের।
এজন্যই, দেশে সাইক্লোন হলে আমরা নিজেরাই নিজেদের জন্য এগিয়ে যাই সবার আগে।
আমার আসলে ফোনবুথের ঘটনাটা জানার পরে খুব মেজাজ গরম হয়ে গিয়েছিল।
তবে বোহেমিয়ান ভাইয়ার কথার সাথে সহমত পোষণ করছি। পরিস্থিতি মানুষকে বদলিয়ে দেয়।
জ্ঞানচোর ভাইয়ার সাথে সম্পূর্ণ সহমত!! :huzur:
আমার চোখেও পানি চলে এলো।
অনেক ভাল লাগলো লেখাটা পড়ে। 🙂
ধন্যবাদ সামিরা!! 🙂
সুনামির পর জাপানিদের ধৈর্য, সহিষ্ণুতা নিয়ে বেশ কয়েকটি লেখা পড়েছি… আর জাপানিদের সম্পর্কে সবসময় যা শুনি, অনেক শ্রদ্ধা জাগে তাদের প্রতি…
বাচ্চা ছেলেটার কথা পড়ে নিজের চোখ যে ভিজে উঠেছে খেয়াল করিনি…
অনেক চমৎকার পোস্ট… আরিগাতো গুজাইমাস……
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
দোউইতা শিমাশিতে 🙂
অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া এত সুন্দর করে লেখার জন্য! আমরাও একদিন মানুষের মতো মানুষ হবো ইনশাআল্লাহ!
ইনশাআল্লাহ ঈয়াশা আপু 🙂
আমার জানার খুব ইচ্ছে ছিল এত দিন পর কি অবস্থা এখন সুনামি এলাকার। একটা ছবির হেডিং মনে হয় ভুল আছে। লাইনে দাড়িয়ে থাকার কথা বললেন কিন্তু ছবির সাথে মিলছে না মনে হয়। জাপানিদের আমি খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম দেশেই। আমাদের সাথে মিশে যাবার জন্য খুব অন্তরিক দেখেছি। দেখে দেখে যদি কিছু শিখতে পারি আমি!
সুপ্তি আপু, ছবির হেডিংয়ের ব্যাপারটায় কোন জায়গায় ভুল হয়েছে বুঝতে পারি নি…. 🙁
দেশের বাইরে থাকার কারণে মন্তব্যের জবাব দেরিতে হওয়ায় আন্তরিকভাবে দুঃখিত 😳