১.
দৃশ্য ১:
প্রশ্নঃ সৃজনশীল পদ্ধতিতে ভালো নাম্বার পাওয়ার উপায় কি শুধুই বেশি করে লেখা?
উত্তরঃ (হাসিমুখে) শুধু কি নাম্বার পাওয়ার জন্যই পড়ালেখা?
উত্তরদাতা ফেরদৌস আরা বেগম। শিক্ষিকা, রেসিডেনশিয়াল মডেল কলেজ।
দৃশ্য ২:
প্রশ্নঃ বাস্তবজীবনে কারক-বিভক্তি কি আদৌ কোন কাজে লাগে?
উত্তরঃ হ্যাঁ লাগে, পরীক্ষায় এ+ পাওয়ার কাজে!
উত্তরদাতা বিশ্বজিৎ ঘোষ। অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
উপরের দৃশ্যগুলোর মত আরো নানা মজাদার ঘটনায় ভরপুর ছিল অষ্টম ভাষা প্রতিযোগের আঞ্চলিক আসর। নিজের স্কুল-কলেজ জীবনে মাত্র একবার এর সাথে যুক্ত হবার সুযোগ হয়েছিল। নিজের অভাবটা ছোট বোনকে দিয়ে মিটিয়ে নেয়ার প্রয়াসে তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম আজ ঢাকা অঞ্চলের প্রতিযোগে।
২.
সকাল ৯টা থেকে শুরু হবার কথা থাকলেও বাঙ্গালির চিরাচরিত মানসিকতার প্রতিফলন ঘটিয়ে তা শুরু হয় বেলা ১০টায়। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের হাতে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সাথে সাথে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার মধ্য দিয়ে সূচনা ঘটে চমৎকার এ আসরটির। বহু বছর পর আজ জাতীয় সঙ্গীতের লাইনের সাথে গলা মেলানোর অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। শুধু মনে হচ্ছিল, এই গানটার শেকড় মনের অনেক গভীরে প্রোথিত, চাইলেও একে উপড়ে ফেলা যাবে না। “মা তোর বদনখানি মলিন হলে…” গাইতে গিয়ে কি চোখে পানি এসেছিলো? হয়তোবা।
উদ্বোধনের পর যথারীতি পরীক্ষার পালা। বোনের পরীক্ষা দেয়ার ফাঁকে আমি গণিত অলিম্পিয়াডের স্টল ঘুরে দুটো বই কিনে ফেললাম। অবশ্য এজন্য ফ্রী জ্যুস মিস করতে হলেও তাতে দুঃখ নেই।
পরীক্ষার পর শুরু হল ভাষা প্রতিযোগের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশঃ প্রশ্নোত্তর পর্ব। ছেলেমেয়েদের মাইক পাবার প্রাণপণ চেষ্টা দেখে মনে হচ্ছিলঃ এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ দুনিয়াতে থাকতেই পারে না! আর প্রশ্নের তুমুল স্রোতে বাঘা বাঘা অধ্যাপকরা পর্যন্ত নাকানি-চুবানি খাচ্ছিলেন। শব্দের শুরুতে ক্ষ থাকলে উচ্চারণ খ-এর মত এবং অন্যত্র থাকলে উচ্চারণ দ্বিত্ব কেনো হয় – এ প্রশ্নের উত্তরে তো মাহবুবুল হক সরাসরিই বলে বসলেন, “জানি না।” অন্যদের অবস্থাও খুব একটা ভালো ছিলো না। তবে সকলেই চেষ্টা করেছেন যথাসাধ্য উত্তর দেয়ার, একজনের ব্যাখ্যাদানের পর অন্যজন মাইক টেনে নিয়ে সেটার পরিবর্ধন করেছেন অথবা অন্যরকম করে ব্যাখ্যা দিয়েছেন – এরকম অনেকবারই হয়েছে। এরই মাঝে উঠে এসেছে জ্ঞানগর্ভ সব প্রশ্ন এবং তার ততোধিক জ্ঞানগর্ভ উত্তর। আমার কাছে সবচে চমৎকার লেগেছে নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া সায়মা এবং উপস্থাপক অরুণ বসুর বাগযুদ্ধ। টিএন্ডটি স্কুলের এই মেয়েটির প্রশ্নটি ছিল বহুলচর্বিত, “আমরা ৮ই ফাল্গুন না বলে ২১শে ফেব্রুয়ারি কেন বলি?” এর জবাবে অরুন তাকে নানাভাবে জেরা শুরু করলেন; উদ্দেশ্যঃ যেকোনভাবে মেয়েটির মুখ থেকে একটি ইংরেজি শব্দ বের করে আনা। অরুণ ভেবেছিলেন সাফল্য এসে গিয়েছে, যখন তিনি সায়মার জন্ম তারিখ জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু যেন “ওস্তাদের মার শেষ রাতে” প্রবাদটির সত্যতা প্রমাণ করতেই সায়মা তার নিজের জন্মতারিখ বাংলায় বলে দিলো! অপদস্থ হলেন অরুণ নিজেই।
৩.
ধুলোভরা মাঠ আর প্রচণ্ড গরমের কারণে কমবয়সীদের অনেক অসুবিধা ভোগ করতে হয়েছে। আর গোটা অনুষ্ঠান জুড়েই চোখে ধরা পড়েছে পরিকল্পনাহীনতা। পুরো অনুষ্ঠানের উপর একটি নেতিবাচক প্রভাব এনে দিয়েছিল রেসিডেনশিয়ালের কিছু ছাত্রের সাথে উপাধ্যক্ষ ফেরদৌস আরা বেগমের বাজে ব্যবহার, যার কারণে পরবর্তীতে অরুণ বসু সবার সামনে তাদের কাছে ক্ষমা চান। বদমেজাজি এই মহিলাকে কে বুঝাবে যে, ছাত্রদের চেয়ার ছেড়ে উঠায় নয়, বরং তাঁর নিচু মানসিকতার কারণেই তাঁর প্রতিষ্ঠানের বদনাম হচ্ছে?
৪.
শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠানটি স্মরণীয় হয়ে রইল দুটো কারণেঃ একে তো এটা আমার বোনের এধরণের কোন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের প্রথম অভিজ্ঞতা (বেচারি অল্পের জন্য এ বছরের গণিত অলিম্পিয়াডের রেজিস্ট্রেশন মিস করেছে), তার উপর তিন বছর পর আমি এর অংশ হবার সৌভাগ্য লাভ করলাম (আমার প্রথম এবং একমাত্র অভিজ্ঞতা ছিলো কলেজের প্রথম বর্ষে পড়ার সময়)।
আমার কাছে মনে হয় এধরণের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে মূল্যবান অর্জন হল অভিজ্ঞতাঃ নানা ধরণের মানুষের সাথে দেখা হয়, কথা হয়; অভিজ্ঞতার বিনিময় ঘটে। এ কারণেই দিন শেষে আমার নাজীফা তাসনীম নামের বোনটি পুরষ্কার না পেলেও তাতে আমার কোন আক্ষেপ ছিল না, উলটো আমি তাকে নিয়ে গর্বিত ছিলাম ধৈর্য ধরে এতক্ষণ বসে থাকার জন্য।
সংযোজনঃ (উল্লেখযোগ্য প্রশ্ন এবং উত্তরসমূহ)
১। রবীন্দ্রনাথের একটি গান আছে, “ভেঙ্গে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে”। এখানে কবিগুরু তালা ভাঙ্গার কথা না বলে চাবি ভাঙ্গার কথা কেন বলেছেন?
এ প্রশ্নের সবচেয়ে ভালো উত্তর দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক তারিক মনজুর। তিনি বলেন, “রবীন্দ্রনাথ কিছুদিন পাবনায় ছিলেন। পাবনা অঞ্চলে তালাকে চাবি নামে ডাকা হয়ে থাকে।”
২। একটি ছেলে প্রশ্ন করেছিলো, “এ অনুষ্ঠানের নাম শুধু ভাষা প্রতিযোগ কেন? বাংলা ভাষা প্রতিযোগ নয় কেন?” উপস্থাপক অরুণ বসু তাকে পালটা প্রশ্ন করেন, “এই ভাষা প্রতিযোগ বতে তুমি কোন ভাষা বুঝেছ?”
৩। একটি প্রশ্ন হয়েছিল, “বাংলায় বিভক্তিগুলোর নাম প্রথমা, দ্বিতীয়া, … ; কিন্তু প্রথম, দ্বিতীয়, … এরকম নয় কেন?” বিশ্বজিৎ ঘোষ চমৎকারভাবে মূল জায়গাটা দেখিয়ে বললেন, “বিভক্তি শব্দটা নিজেই স্ত্রীবাচক, তাই এর বিশেষণ হিসেবে পুরুষবাচক শব্দ ব্যবহার করা যাবে না।”
৪। অনেকটা অবধারিতভাবেই প্রশ্ন এসেছিল, “উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ইংরেজিই আমাদের একমাত্র পাথেয়। আমরা মাতৃভাষায় কেন উচ্চশিক্ষা লাভ করতে পারি না?” উত্তরে চমকপ্রদ একটা তথ্য বেরিয়ে এলো, “উপমহাদেশের প্রথম মেডিকেল কলেজ, বেঙ্গল মেডিকেল কলেজের প্রতিষ্ঠার পর ১৮৫৩ সাল থেকে ১৮৬৯ সাল পর্যন্ত শিক্ষকেরা বাংলা ভাষায় সেখানে শিক্ষাদান করেছেন।”
একটি অনুরোধঃ ভাষা প্রতিযোগে পুরষ্কারপ্রাপ্ত কেউ যদি আপনার পরিচিত থাকে, তাহলে দয়া করে [email protected] এই ঠিকানায় যোগাযোগ করবেন।
:welcome:
ভাষা প্রতিযোগের কথা এই প্রথম জানলাম, ভাল লাগলো!
😀 অনেক ধন্যবাদ!
ভাষা প্রতিযোগ নিয়মিতভাবেই হচ্ছে স্কুল এবং কলেজের ছাত্রছাত্রীদের জন্য। চতুর্থ থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর যেকোন শিক্ষার্থী এতে অংশ নিতে পারে। সাধারণত আঞ্চলিক আসরগুলো বছরের শুরুর দিকেই হয়ে থাকে। আপনার পরিচিত এই বয়সী কেউ থাকলে অবশ্যই অংশ নিতে উৎসাহ দেবেন।
ভাষা প্রতিযোগে অংশ নেয়ার সৌভাগ্য হয়নি… তবে এই লেখা পড়ার পর মনে হচ্ছে জীবনে বড় একটা কিছু মিস করে ফেললাম। অন্ততপক্ষে মনের জিজ্ঞাস্য কিছু অনুত্তরিত রয়ে গেল। বর্ণনা অসাধারণ হয়েছে। সরবে তোকে চাই!!!
জাঝা :dhisya:
:welcome:
যদি আইডিয়া মাথায় আসে, তাহলে অবশ্যই লিখবো।
তা, তোর প্রোফাইল নাই কেন?! :thinking:
সুন্দর
ধন্যবাদ আপনাকে।
দারুণ!
আয়োজকদের দক্ষতা আস্তে আস্তে বাড়বে আর আমাদের ভাষার প্রতি ছোটদের আগ্রহ আশা করি বাড়তে থাকবে।
সরবে স্বাগতম 😀
আগ্রহের পরিমাণ বর্তমানে আশঙ্কাজনভাবে কম। রাজধানীসহ মোট ছয়টি জেলা নিয়ে এ আয়োজন হলেও অংশগ্রহণকারী ছিলো এক হাজারেরও কম। তবে আপনার মত আমিও আশা করি মানুষের আগ্রহ বাড়বে ধীরে ধীরে।
মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ :happy:
পড়ে খুব ভালো লেগেছে, এই প্রোগ্রাম গুলো অনেক অয়ানন্দের হয়… প্রতিযোগী হিসেবে অংশ নেয়া হয়নি কখনো…
সহমত—-‘আমার কাছে মনে হয় এধরণের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে মূল্যবান অর্জন হল অভিজ্ঞতাঃ নানা ধরণের মানুষের সাথে দেখা হয়, কথা হয়; অভিজ্ঞতার বিনিময় ঘটে। ‘
সরবে স্বাগতম! নিয়মিত সরব থাকবেন আশা করি…
🙂
বন্ধু তুষারের লেখাটি ভালো লাগলো। প্রথাগত পড়াশুনার পাশাপাশি এ ধরণের প্রতিযোগিতায় আমাদের অংশগ্রহণের ব্যাপারে অভিভাবকদের যত্নবান হওয়া উচিত।
চুপি চুপি সবাইকে জানিয়ে রাখি, এই মন্তব্যটা মেহেদী মুখে বলেছে, আর টাইপ করেছি আমি নিজেই! :babymonkey:
সরব থাকতে হলে লেখা প্রকাশিত হতে হবে, লেখা প্রকাশিত হলে নিয়মিত লিখতে হবে, আর নিয়মিত লিখতে হলে আইডিয়া লাগবে; অন্যদিকে নিয়মিত না লিখলে লেখার মান বাড়বে না, আর লেখার মান না বাড়লে লেখাও প্রকাশিত হবে নাঃ একটা vicious cycle তৈরি হলে গেলো দেখছি!
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। 😀
আরে দোস্ত তুই সরবে আইলি কবে?? গুড টু হ্যাভ দোস্তজ অ্যারাউন্ড 😀 :welcome:
:love:
চমৎকার একটি লেখা 🙂
8)
ভাষা প্রতিযোগ, ম্যাথ অলিম্পিয়াড, এই সব দেখে খুবই আফসোস করে কাটাই কেন আমাদের সময় ছিল না 🙁 :'(
আমিও আমার বোনদের নিয়ে গিয়েছিলাম ভাষা প্রতিযোগে। সেটা ৬/৭ বছর আগে।
মন্তব্য করার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
ভাই!! আপ্নে বস!! আপ্নের লেখা চায়!! :clappinghands:
জাতি আপনার কাছ থেকে আরো লেখা চায়!!
এই লেখা এতোদিন পড়িনি বলে আফসোস হচ্ছে। তার চেয়ে বেশি আফসোস হচ্ছে, এমন প্রতিযোগিতায় কখনো অংশগ্রহণ করি নি বলে……
:welcome:
ভাল হইসে লেখা! সুন্দর বর্ণনা! চালায়া যা! (বাই দ্য ওয়ে, তোরা সবাই য্যামনে বাংলায় ব্লগানো শুরু করলি, আমারও তো লিখবার মুঞ্চায়! কিন্তু বাংলায় লিখতে গেলেই কেমন যানি অস্বস্তি লাগে, উপায় কী???)
অনেক মজা পেলাম ভাই। লেখা চালিয়ে যাও। তোমাদের লেখা পড়ে খুব উপভোগ করি।
মাঝে মাঝে নিজের ও খুব লেখতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু আলসেমির জন্য হয়ে উঠে না ।