১)
– একটা কথা বলবো?
– তোমার ইচ্ছা।
– রাগ করবা না তো?
– আমার ইচ্ছা!
– থাক তাহলে
– আরে নারে বাবা, বলো!
– আমার কিন্তু লজ্জা করছে!
– হাত ছেড়ে দিবো?
– তোমার ইচ্ছা।
রফিক হাতটা ছেড়ে দেয়। একটু যে মন খারাপ হয়নি, তা না! কিন্তু, বুঝতে দেয় না সুফিয়াকে। সুফিয়া ওড়নাটা মাথা থেকে আরেকটু টেনে কপাল পর্যন্ত নামিয়ে আনে। আড়চোখে কয়েকবার তাকায় রফিকের দিকে, কিছুটা বিরক্ত ভাব ফুটে উঠে রফিকের চোখে-মুখে। কপাল সামান্য কুঁচকানো, নাকের নীচে ঘাম জমেছে, ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ছে।
– এতো রাগ করছো কেনো?
– আহ! এই আহ্লাদীটা ছাড়তে পারোনা?
– আমার তো আর কেউ নেই আহ্লাদী করার। তোমার সাথে না করলে কার সাথে করবো? কাউকে এনে দাও তাহলে তুমি, তার সাথে করি না হয়!
– কি বললে?
রফিকের রাগ উঠে যাওয়া দেখে সুফিয়ার হাসি আরও বেড়ে যায়। ভালো করে একবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে নেয়। দুপুরের এ সময়টায় পার্কের এদিকে ভিড় একটু কমই থাকে। সুফিয়া আলতো করে রফিকের হাতটা স্পর্শ করে, রফিক ছাড়িয়ে নেয় সাথে সাথে।
– এতো রাগ করেছো? আমি তো একটু আহ্লাদী করছিলাম।
– শুনো, খুব গরম লাগছে, ক্ষিধায় পেটে ছুঁচো দৌড়াচ্ছে। আমি হলে যাবো, তুমি কি এখানে থাকবে নাকি তোমার হলে নামিয়ে দিয়ে আসবো?
– আরেকটু বসি না হয়? প্রতিটা দিনই কারফিউ থাকে, আজ কতোদিন পরে একটু সুযোগ পেলাম দেখা করার, এমন করছো কেনো?
– আমি আবার কি করলাম?
সুফিয়া আবার রফিকের হাত শক্ত করে চেপে ধরে। প্রথমে কয়েকবার ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে, এরপরে রফিক শক্ত করে সুফিয়ার হাতটা ধরে রাখে। সুফিয়া আবার তাকায় রফিকের দিকে, কেমন যেনো মলিন হয়ে আছে মুখটা।
– আচ্ছা, তুমি কি কিছু নিয়ে খুব চিন্তা করছো?
– ওরকম কিছু না।
– যেরকমই হোক, বলো না আমাকে। কি হয়েছে তোমার?
– ঢাকাতে যেভাবে মিলিটারি আসা শুরু হয়েছে, আমার কাছে ব্যাপারটা স্বাভাবিক লাগছেনা।
– হুম, আসলেই। এই তোমার না ক্ষিধে লেগেছে?
– হুম। তোমাকে নামিয়ে আমি হলে যাবো।
রফিক সুফিয়ার হাত ধরে তাকে টেনে তোলে, সুফিয়া খুবই লজ্জা পায়। আবার ওড়নাটা টেনে আরেকটু নামিয়ে দেয় সে। রোকেয়া হলের গেট দিয়ে ঢুকে আরেকটা বার পেছন ফিরে তাকায় সে, রফিক ছেলেটার মুখটাতে এতো মায়া কেনো!
২)
২৩ শে মার্চ ঢাকা এয়ারপোর্টে এসে নামেন জহির। সানগ্লাসটা খুলে চারদিকে ভালো করে তাকান। মেজর বিল্লালকে তিনি দেখতে পান, তার দিকে এগিয়ে আসছেন।
– সো, হোয়াট নাও?
– আপনাকে নিয়ে কর্ণেল এস ডি আহমেদের সাথে দেখা করতে নিয়ে যাবার আদেশ করা হয়েছে আমাকে।
– হুম। তো ফির চালো!
কর্নেলের বাসভবনের উদ্দেশ্যে তারা রওয়ানা দেন। কমান্ডো জহির এর চোখে মুখে একইসাথে ক্রোধ ও বিস্ময় প্রকাশ পেতে দেখা যায়। চারদিকে শুধু বাংলাদেশের পতাকা। একমাত্র মোহাম্মদপুরের বিহারী কলোনিতেই তিনি একটিমাত্র পাকিস্তানের পতাকা দেখতে পান। নাহ, ব্যাপারটা সুবিধার না।
রাও ফরমান আলীর সাথে বাক-বিতণ্ডার পরে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হলো ২৫ শে মার্চ জহিরকে ৩টি ট্রাক সমেত সৈন্য ও বঙ্গবন্ধুর বাড়ির নকশা প্রদান করা হবে। বঙ্গবন্ধুকে জীবিত গ্রেপ্তার করবার নীল নকশা চলতে থাকে জহির, রাও ফরমান আলী ও মেজর জেনারেল মিঠার মাঝে।
দূরে কোথাও একটা রাতের পাখি কেঁদে উঠে, আসছে কোন এক অন্ধকার রাতে, রক্তের ভয়ে সে কেঁদে উঠে। আর মোটে ৩টি রাত।
৩)
সুফিয়া, ২৫/৩/১৯৭১
প্রচণ্ড ক্রোধ আর ক্ষোভ নিয়ে তোমাকে এই চিঠি লিখছি। হয়তো আমারই ত্রুটি আছে, তা না হলে আমাকে ভালবাসার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে আরেকজনের সাথে গোপন অভিলাষে সময় কাটানোর মতো দৃশ্য আমাকে দেখতে হতোনা। কি ভুল করেছিলাম আমি? ভুল করলেও তোমাকে হাজারবার বলেছি, আমাকে বলো আমার ভুল কোথায়, সর্বদাই তুমি মানা করে এসেছো। তাহলে কেনো আমাকে দেখতে হলো এরকম দৃশ্য?
কারফিউ এর কারণে যেখানে তুমি আমার সাথে দিনের পর দিন দেখা করতে পারোনা, ২-৩ দিন হয়ে যায়, একটা চিঠি পাঠাতে পারোনা, সেখানে আমি কিভাবে সহ্য করি এই ঘটনা? ধানমন্ডি থেকে টিউশনি শেষ করে হাজারও ঝক্কি পেড়িয়ে যখন দেখি হলের গেটে তুমি আরেক ছেলের হাতে কান্নারত অবস্থায় চিঠি তুলে দিচ্ছো, কাঁদতে কাঁদতে তার বুকে মাথা গুজে দিচ্ছো। আমার তখনও বিশ্বাস হতে চায়নি, আমি কী দেখছি! আমি প্রচন্ডভাবে বিশ্বাস করতে চেয়েছিলাম, হয়তো তুমি আমাকে পাঠাবার জন্যই কাউকে দিয়ে চিঠি পাঠাতে চেয়েছিলে। একদিন গেলো, দু’দিন গেলো, কই কোনো চিঠি তো পেলাম না! এরপর আমি সেই ছেলে সম্পর্কে খোজ করি, সে তোমার চাচাতো ভাই। বেশ অবস্থা সম্পন্ন, রেলের চাকরী করে। সুফিয়া, একটাবার কি আমাকে বলা যেতো না যে আমাকে তুমি আর সহ্য করতে পারছোনা? আমাকে ছাড়া না বাঁচতে পারবেনা?
আমি জানিনা সুফিয়া, কিছুক্ষণ পরপরই ইচ্ছে করছে কাঁটাচামচ দিয়ে চোখ দুটো উপড়ে ফেলি, কেনো দেখতে গেলাম আমি?
স্রষ্টা তোমায় সুখী করুন।
হয়তো কখনোই তোমার ছিলাম না
– রফিক
সুফিয়ার দম বন্ধ হয়ে আসছে চিঠি পড়ে। হাতে হাতে পাওয়া চিঠিটা একটু আগে বেশ গোপনে দিয়ে গেলো হলে ক্যান্টিনের পিচ্চিটা। ছেলেটা সুফিয়ার আপন চাচাতো ভাই, সুফিয়ার বাবা প্রচণ্ড অসুস্থ, এই খবর নিয়ে এসেছিলেন। সুফিয়া আর কিছু ভেবে পাচ্ছেনা, সন্ধ্যার পর থেকে কারফিউ শুরু হয়ে গেছে। বাইরেও যেতে পারছেনা। রফিকের কিছু একটা হয়ে গেলে সে কোনদিন নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেনা। সুফিয়া কেমন যেনো হাসফাস করতে লাগলো। সে এ জানালা, ও জানালা ছুটে বেড়ায়, পাছে কোথাও দেখা যায় রফিক কিংবা ওর পরিচিত কাউকে হেঁটে যতে। নাহ, শুধু মাঝে মাঝে সবুজ সবুজ কয়েকটা জীপ আলো বন্ধ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
সুফিয়া নিজের মুখ নিজে খামচে ধরে, বাবাকে হারাতে বসেছে সে, রফিককেও। সে কি করবে ! ডুকরে উঠে সুফিয়া, মেঝেতে কুঁকড়ে পরে থাকে সে, শব্দহীন কান্না কেমন যেনো ভারী করে তোলে পরিবেশকে।
“সে রাতের পরিবেশ বর্ণনা করতে গিয়ে সিদ্দিক সালিক বলেন, “আকাশে তারার মেলা। শহর গভীর ঘুমে নিমগ্ন। ঢাকার বসন্তের রাত যেমন চমৎকার হয়, তেমনি ছিল রাতটি। একমাত্র হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ সাধন ছাড়া অন্য সবকিছুর জন্যই পরিবেশটি ছিল চমৎকার”
৩)
মোটামুটি গোলাকার একটা পাথরের উপর অযথাই লাথি মারে রফিক। নিজেকে ঐ পাথরের মতো মনে অতে থাকে তার, বারবার মনে হতে থাকে, জীবনের থেকে সে লাথি ছাড়া আর কীইবা পেয়েছে ! বাবা-মা ছাড়া বড় হয়েছে, অনাথের মতো বোনের সংসারে। পদে পদে নিজের জন্য বোনকে স্বামীর পরিবারে হেনস্থা হতে দেখেছে। লজ্জায় এতোটুকু হয়ে যেতো সে সময়, কিছু করার ছিলোনা তার। সব বুকে মাটি চাপা দিয়ে মসুরের ডাল সাথে ছোটো মাছের তরকারি দিয়ে পেট ভরে ভাত খেয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমানো ছাড়া আর কীইবা করতে পারতো সে! একটা সময় বিধাতা মুখ তুলে তাকালেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো সে। আর সে জীবনের দিকে ফিরে তাকাতে হবেনা, হলে উঠে জীবনটাকে গুছিয়ে নিতে শুরু করেছিলো সুফিয়ার সাথে ধীরে ধীরে।
এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার কান খাড়া হয়ে উঠে, রাস্তা থেকে নেমে সে গাছের পেছনে আশ্রয় নেয়। সে দেখে একটি জীপ আর তার পেছনে ৩টি ট্রাক হেডলাইট অফ করে ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে। রফিক তার হাতের ঘড়ি দেখলো, সময় প্রায় সাড়ে এগারোটা। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সে সাবধানে জগন্নাথ হলের দিকে হাঁটা দেয়।
“দারওয়াজা তোড় দো”, বলেই জহির নীচে নেমে গেলেন মেজর সাঈদ এসেছেন কিনা দেখতে। মেজর বিল্লাল তার আদেশ অনুযায়ী কাজ করতে থাকে। দরজার ওপাশে তখন শেখ মুজিব ওয়ারলেস ট্রান্সমিট করছেন। হঠাৎ গুলি, গ্রেনেড আর সাবমেশিনের শব্দ শুনে জহির দৌড়ে উপরে উঠে এসে দেখেন দরজার সামনে শেখ মুজিব দাঁড়িয়ে। ততোক্ষণে তিনি গোপন ওয়ারলেস বার্তায় ঘোষণা দিয়ে ফেলেছেন, ‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। ছাত্র-জনতা-পুলিশ-ইপিআর শত্রুর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম শুরু হয়েছে। আমি ঘোষণা করছি আজ থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। সর্বস্তরের নাগরিকদের আমি আহ্বান জানাচ্ছি, আপনারা যে যেখানে যে অবস্থাতেই থাকুন, যার যা আছে তাই নিয়ে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ না করা পর্যন্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। সম্মিলিতভাবে শত্রুর মোকাবিলা করুন। এই হয়তো আপনাদের প্রতি আমার শেষ বাণী হতে পারে। আপনারা শেষ শত্রুটি দেশ থেকে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যান।’
জহির মনে মনে বিকট শব্দে ক্রুর হাসি হেঁসে উঠে। সদর দপ্তরে সে রেডিও বার্তা পাঠায় “বিগবার্ড ইন কেইজ”।
৪)
রাত প্রায় দেড়টা। রফিক জগন্নাথ হলের বাইরে ঝোপের ভেতর লুকিয়ে আছে। দরদর করে ঘামছে, ভয়ে হৃদপিণ্ডটা এতো জোরে দাপাচ্ছে যেনো বাকি সবাই তা শুনে ফেলবে। সাবধানে সে আরেকবার চারদিকে চোখ বুলালো। ট্যাংক বিধ্বংসী বিকয়েললস রাইফেল, রকেট লঞ্চার মার্টার ভারি ও হালকা মেশিনগানে সজ্জিত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে ফেলেছে পাকিস্তানি মিলিটারি। ইতোমধ্যেই জগন্নাথ হলের দেব স্যার আর মনিরুজ্জামান স্যারকে হত্যা করেছে বলে শোনা যাচ্ছে। প্রচণ্ড পানির তেষ্টা পেয়েছে তার। যেনো পানি না খেতে পেলে বুকটা ফেটে যাবে। সে বড় বড় করে শ্বাস নিতে থাকে, দূরে মেশিনগানের ঠা ঠা শব্দ শুনতে পায় রফিক, প্রায় সাথে সাথেই এক আর্তচিতকার। চিতকারদাতার কণ্ঠ চেনা চেনা লাগে রফিকের। সে আতংকে চোখ বন্ধ করে ফেলে, কণ্ঠটা তার কলজের বন্ধু হেলালের। রফিক চোখ বন্ধ করে কাঁপতে থাকে, “আল্লাহ, আল্লাহ তুমি সুফিয়াকে বাঁচাও আল্লাহ। আল্লাহ তুমি ওকে বাঁচাও”
৫)
দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে বাইরে, ঘটনার আকস্মিকতায় চিৎকার করতেও ভুলে গেছে মেয়েরা। বাইরে শতশত বুটের ধুপধাপ শব্দ, বুলেট এর এদিক-ওদিক ছুটে বেড়ানো আর গ্যাসোলিন ঢেলে রোকেয়া হল জ্বালিয়ে দেয়ার চেষ্টা দেখে মেয়েরা কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। একটা সময় তারা দৌড়ে গিয়ে একেক কক্ষে অবস্থান নেয়। গগন বিদারী শব্দে দরজা কেঁপে কেঁপে উঠছে। মেয়েগুলা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁপছে ভয়ে। দরজাটা ভেঙ্গে গেলো, প্রায় ২০-২৫ জন সবুজ ইউনিফর্ম পরিহিত আর্মি রুমে ঢুকলো। ভীত মেয়েগুলোর চোখের পানি রাতের আঁধারে ধ্রুবতারার মতো চিকচিক করতে লাগলো।
কিছুক্ষণের মাঝেই আগুনের মাঝেই দেখা গেলো শতশত বহ্নিশিখার ন্যায় তরুণীদের ছুটে আসতে, পাকিস্তানী মিলিটারিরা পজিশন নিলো, এরপর চললো তুমুল গুলিবর্ষন। শ’খানেক ছাত্রী সেখানেই শহীদ হয়। সুফিয়ার মতো বাকি ক’জনের আশ্রয় হয় ক্যান্টনমেন্টে।
আর্চার কে ব্লাডের লেখা গ্রন্থ, “দি ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ” থেকে জানা যায়, সেদিন রাতেই ক্যাম্পাসে প্রায় তিনশো’র অধিক ছাত্র-ছাত্রী নিহত হয়।
৬)
ট্রাক থেকে একে একে ধরে আনা মেয়েদেরকে নামাতে থাকে পাকিস্তানী মিলিটারিরা। চুলের মুঠি ধরে সুফিয়াকে নামানো হয় ট্রাক থেকে, শুধু নামতে দেরী হয় তার, সাথে সাথে চার-পাঁচজন নারীখেকো মিলিটারি এসে তাকে খাবলে ধরে। কেউ গালে, কেউ স্তনে কেউ পেটে কামড়ে, খাঁমচে ধরে। সুফিয়া চিৎকার করে উঠে, রাইফেলের বাট দিয়ে তার মুখে আঘাত করা হয়। সাথে সাথে তার সামনের তিন-চারটি দাঁত ভেঙ্গে পরে যায়। প্রচণ্ড আঘাতে সুফিয়া অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পরে। চোখ বন্ধ করার আগে সে দেখতে পায়, দুইজন অফিসার বেয়োনেট দিয়ে তার ব্লাউজ সমেত তার বুকের মাংস ছিঁড়ছে।
রফিকের জ্ঞান ফিরে বিকালের দিকে। চারিদিকে ধ্বংসস্তূপ যেনো, সে সাবধানে বেড়িয়ে পরে ঢাবি’র রাস্তায়, যেদিকে তাকায় শুধু লাশ আর লাশ। বুলেট এর খোয়া আর পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া বহু লাশ এদিক ওদিকে। রফিকের গা গুলিয়ে আসে, হঠাৎ তার মাথা ঘুরে যায়। “সুফিয়া ! আমার সুফিয়া কই”, রফিক ছুটে যায় রোকেয়া হলের দিকে। তেষ্টায় বুক ফেটে যাওয়া দুর্বল শরীরটা নিয়ে রফিক দৌড়াতে থাকে। পাগলা কুকুরের মতো তার জিহ্বা বের হয়ে যায়, সে তবুও ছুটতে থাকে।
“এ রুক! রুক সালে!”, রফিককে আটকে দেয় কয়েকজন সৈনিক।
“ ভাই, আমাকে যেতে দিন ভাই! প্লীজ! আমাকে একটা মিনিটের জন্য যেতে দিন, আমি কথা দিচ্ছি আবার ফিরে আসবো। প্লীজ যেতে দিন”, রফিক সমানে একই মিনতি করতে থাকে।
– তু মুসলমান হ্যাঁ?
– জ্বী, আমি মুসলমান
– হুম। এ মুকাররাম, ইসকা জারা দ্যাখ তো! কাটা হ্যাঁ ইয়া ……..
বলেই সে বিশ্রীভাবে হাসতে থাকে। মুকাররাম লোকটি এসে রফিকের গালে বেয়োনেট এর খোঁচা দিয়ে বলে, “ সালে, জারা ইধার উধার কিয়া তো, জানসে মার ডালুঙ্গা! পাতলুন খোল!”
রফিককে উলঙ্গ করে বেয়োনেটের মুখে তারা কলেমার পরীক্ষা নিচ্ছে। রফিক মনে মনে আল্লাহকে বলতে লাগলো, “আল্লাহ, তোমার কলেমা পরছি আল্লাহ, আল্লাহ তুমি সুফিয়াকে বাঁচাও আল্লাহ, সুফিয়াকে বাঁচাও………… “
৭)
জ্ঞান ফেরার পরে রফিক নিজেকে একটা কক্ষে আবিষ্কার করলো, দেখে মনে হচ্ছে আর্মিদেরই কক্ষ। ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে হতে পারে।
– বোল, ক কন রাজনীতি কারতা হে ইয়াহা?
– আমি জানিনা।
– নেহি বোলেগা? খুন কার দুংগা সালে ! বোল, ইয়ে পতাকা কিসনে বানায়া? শিবনারায়ণ নে? কাহা পে হে ও ? বোল, নেহি তো দুঙ্গা এক!
– আমি আসলেই জানিনা, বিশ্বাস করেন!
– আব্দুর রব অর সিরাজ কো কাহা মিলেঙ্গা? বোল, ছোড় দুঙ্গা তুঝকো, কাসাম খুদা কি!
– আপনাকে আর কতবার বলবো, আমি কিচ্ছু জানিনা !
প্রশ্নকর্তা, ক্যাপ্টেন শহীদ, একটা সিগারেট ধরালেন। কয়েকজন সৈনিক এসে রফিককে জোর জবরদস্তি করে টর্চার সেলের কাছে নিয়ে গেলো। কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই রফিকের মাথা দেয়ালের সাথে ঠুকে দিলো তারা, এরপর বার বার মাথা ঠুকিয়ে রক্ত বের করে ফেললো। মুঠো পাকানো হাতে সমানে রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করে হাত ছেঁচে দিলো তার। ব্যথায় রফিক গোঙাতে লাগলো। ক্যাপ্টেন শহীদ রফিকের কাছে আসলো, খুব শান্ত ভঙ্গীতে রফিকের ঘাড়ে পা রাখলো। এরপর বেদম ভাবে চড় লাগালো রফিকের গালে, রফিক ঘুরে পরে গেলো। চুল ধরে টেনে তাকে আবার বসানো হলো।
– আব বোল, আব্দুর রব অর সিরাজ কাহা হ্যাঁ?
– আমি কিচ্ছু বলবোনা।
– নেহি বোলেগা? বেহেনচোদ, ইসকা লান্ড পার লাথ মার! সালেকা বহাত তেল বাড়্গায়া হে!
– শুয়োরের বাচ্চা, একবার ছেড়ে দেখ তোকে কি করি!
– হা হা হা, তু ? কেয়া কার লেগা তু? তেরা বাপ শেখ মুজিব কো ইতনা ঠেঙ্গায়া কি উপার পৌছা দেয়া, অর তু, তেরা বাঙ্গাল কি ভুত কেয়া কারেগা? তুম সাব বেহেনচোদ কো মারকার ইয়াপার হোলিয়া খেলেঙ্গা তেরে খুন সে, সামঝা শুয়ার কে বাচ্চে !
– কুত্তার বাচ্চা, কি বললি তুই? তোগো মতোন হাজারটা ভুট্টু, টিক্কা কোটিবার জন্ম নিয়াও শেখ মুজিবের সামনে দাঁড়াইতে সাহস পাবেনা কোনোদিন, তুই খালি ছাড় আমাকে একবার, দেখ তোরে কি করি !
ক্যাপ্টেন শহিদ ইশারা করলো, ঝটপট দুইজন সৈন্য এসে রফিকের হাত চেপে ধরে টেবিলের উপর রাখলো। শহিদ খুব ঠাণ্ডা মাথায় বেয়োনেটের ফলাটা রাইফেল থেকে খুলে শূন্যে ধরলো। রফিক দেখতে লাগলো, ফলাটা দ্রুত গতিতে নীচে নেমে আসছে। বাল্বের হলুদ আলোতে ফলাটা চিকমিক করছে।
৮)
প্রচণ্ড চিৎকারে রফিক সম্বিত ফিরে পায়। খুবি পরিচিত কণ্ঠ মনে হচ্ছে। সে চোখ মেলে তাকায়, কক্ষে সে আর দুইজন সৈনিক আছে। আবার সে চিৎকার শুনে। সুফিয়া? ঐটা সুফিয়ার কন্ঠ না ? রফিক হাতের উপর ভর করে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে, প্রচণ্ড ব্যথায় তার মুখ বিকৃত হয়ে উঠে, হামাগুড়ি দিয়ে সে উঠে দাঁড়ায়। সে এগিয়ে যেতে থাকে, পাশের কক্ষ থেকে চিৎকারের শব্দ আসছে, সামনে সৈন্য দুইজন তাকে বাধা দেয়। হঠাৎ রফিকের গায়ে যেনো অসুরের শক্তি ভর করে, সুফিয়ার চিৎকার শুনে সে ঝটকা মেরে দুইজন সৈন্যকে ফেলে দিয়ে ছুটে যায়, আছড়ে পরে দরজার উপরে। দরজা খুলে সে ভেতরে ছিটকে পরে যায়। চোখ মেলে তাকাবার পরে রফিকের চোখ ফেটে কান্না আসে, গলা দিয়ে কোন শব্দ আসেনা। সে দেখতে পায়, সুফিয়াকে ৩-৪ জন সৈন্য একই সাথে গনধর্ষন করছে, তার সামনের দুই তিনটা দাঁত নেই। স্তনের অধিকাংশই কামড়ে ছিঁড়ে ফেলেছে। পেটে-পিঠে কামড়ে মাংস উপড়ে ফেলা হয়েছে। রফিকের ঠোঁট দুটা কেঁপে উঠে, সে হামাগুড়ি দিয়ে সুফিয়ার কাছে যেতে থাকে। সুফিয়ার যোনিপথ দিয়ে ততোক্ষণে রক্ত মাংস বেড়িয়ে আসছে। রফিক অস্ফুট স্বরে বলে উঠে, “সুফিয়া”
সুফিয়া অসীম কাল পরে যেনো কি শুনতে পেলো, কেউ তাকে ডাকছে। সে চোখ মেলে তাকানোর চেষ্টা করলো, কষ্ট, অনেক কষ্ট। দেখলো, রফিক মেঝেতে পরে আছে। তার হাত থেকে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। মুখ থেঁতলে গেছে, আহারে কি মায়া মুখটায়। আর বোধ হয় বেঁচে থাকতে পারছেনা, শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে সুফিয়া ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠে বলতে লাগলো, “ আমি তোমাকে ধোঁকা দেইনাই রফিক। শুধু তোমাকেই ভালোবাসি …… “
সুফিয়া পুরো বাক্য বলে শেষ করবার আগেই ক্যাপ্টেন শহীদ ও তার সাথের দুই মিলিটারি এসে উপস্থিত হয়। ক্যাপ্টেন শহীদ চিৎকার করে উঠে, “ ইস বেহেনচোদ কো গোলি কারো, ফায়ার ! “
পরপর ছয়টি গুলির শব্দে কেঁপে উঠে বাংলাদেশ। ঘুম ভেঙ্গে যায় ভোরের পাখি, বিদ্রোহী পাখিদের। শুরু হয় ৭১ এর প্রসব বেদনা, জন্মযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার্যেঃ
ব্লগার অমি রহমান পিয়াল, ব্লগার নুরুজ্জামান মানিক, ব্লগার সহজ পৃথিবী ও বাংলা উইকি।
🙁
🙁
তোর হাতে জাদু আছেরে! শুধু লিখে যা। ফেবুতে না লিখে গল্প লিখ, লিখতে থাক।
ছুঁয়ে গেছে আমাকে। যদিও রাজনৈতিক পটভূমির কিছু জায়গা নিয়ে শঙ্কা আছে। তারপরও ধারাবাহিকতা ভালো লাগছে।
এই গল্প সবার সামনে সেই জরুরি ছবি এঁকে দেবে। দারুণ জরুরি
রাজনৈতিক পটভুমি নিয়ে শংকা থাকার কোন কথা না, বেশ অথেন্টিক সোর্স থেকেই নেয়া।
আর যা বললেন, দোয়া রাইখেন 🙂
কষ্ট, খুব কষ্ট……
আর কিছু বলতে পারলাম না রে……
লেখার সময় আমিও বুঝেছি ভাই, কষ্ট, অনেক কষ্ট।
:dhisya: :haturi: :fire: ভাল লাগেনা।
গল্প ভালো হইছে। 😀
😳
পড়তে পড়তে চোখের কোনে হালকা অ্যাকুয়াস হিউমার চলে এসেছিল।পড়া শেষ করে মুছতে গিয়ে দেখলাম লাভ হয়না। দ্বিগুণ গতিতে পড়েই চলেছে।
থামতে দিস না। গড়িয়ে যাক, সিক্ত হোক পবিত্র মাটি, অনুভব করুক, এ দেশের মানুষ তাদের এখনও ভুলে যায়নি, তাদের এখনও ভালোবাসে। চিরকাল বাসবে
কি লিখলি এইটা ? চোখে পানি চলে আসল ।
:crying:
অসাধারন
অসাধারণ হয়েছে , খুব ই অসাধারণ।
🙁
🙁 🙁 🙁
কষ্ট লাগে যখন দেখি এই লিখাগুলো কেউ পড়ে না, পড়তে চায় না, আমরা নাকি অতীত আঁকড়ে ধরে আছি! আমরা নাকি এইসব নিয়ে কথা বললে অন্য দেশের মানহানি হয়……
এই লিখাটা……জানিনা, কিছু বলার ভাষা পাচ্ছি না……
🙁