১)
প্রতি বছর এই দিনটাতে খুব ভোরে খন্দকার সাহেব ঘুম থেকে উঠেন। ফজরের নামাজ পড়ে, কিছুক্ষণ জায়নামাজে বসে থাকেন। তারপর বারান্দায় ইজি চেয়ারে ২টা ঘণ্টা একা একা কাটান। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
– বাবা!
– কিছু বলবে মা?
– মাদ্রাসার হুজুর এসেছে।
– বসতে বলও, নাশতা দাও। আমি আসছি।
খন্দকার সাহেব চাদর গায়ে নীচে নামলেন।
২)
– ১৫০০০ টাকা নিয়ে যান, আমি সরকারী চাকুরীজীবী। সাধ্যের বাইরে কিছু করা আমার জন্য সম্ভব না। আশা করছি, আপনার মাদ্রাসা’র সব ছাত্র একবেলা হলেও ভালো মতো খেতে পারবে।
– খন্দকার সাহেব, আমাকে আর লজ্জা দিবেন না। আপনি যে কেমন মানুষ, আমি জানি। বাদ আসর দোয়া মাহফিল হবে, আপনি কি আসবেন?
– আমি না আসলে যদি কোনো সমস্যা না হয়, তাহলে আসতে চাচ্ছি না।
খন্দকার সাহেব হুজুরকে বিদায় দিয়ে তার বেডরুমে গেলেন। খন্দকার সাহেব পেশায় একজন চাকুরীজীবী, বয়স প্রায় ৪৩। তার একটি মেয়ে আছে, নাম মিলি। মিলি দেখতে ঠিক তার মা’র মতো, তাই মা’র নাম আর মেয়ের নাম একই।
৩)
ষোলো বছর আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ফিরে যাই। শাহীন (খন্দকার সাহেবের ডাকনাম) জাহাঙ্গীরনগরে এপ্লাইড কেমিস্ট্রিতে বি.এস.সি করছে। বেশীরভাগ ক্লাসেই তাকে এবসেন্ট পাওয়া যায়, কেননা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়ুয়া মিলিকে বাসা থেকে নিয়ে ভার্সিটি আবার ভার্সিটি থেকে রমনায় কিছু সময় বাদাম খেতে খেতে গল্প করে আবার বাসায় পৌঁছে দিয়ে এসে আর ক্লাস করার ফুরসত থাকেনা। একজন আদর্শ প্রেমিকের সংজ্ঞা কেউ জিজ্ঞেস করলে শাহীনের নাম বলে দিলে মিথ্যে হবেনা আর কি!
“ ঘুমালেই তোমাকে স্বপ্নে দেখি, আমার হৃদয়ে নিভৃতে শুধু তুমিই তুমি, তুমি ছাড়া আমি যেনো দলহীন গোলাপ” – এই ডায়ালগ গুলো শাহীন কখনোই ব্যবহার করেনা। কারণ, ভালোবাসা এতোটাই সত্য যে তা প্রকাশ করবার দরকার নেই, তা এমনিতেই অনুভব করা যায়। বাতাস দেখা যায়না, কিন্তু বাতাস আছে। এইসব আমার কথা না, শাহীনের দার্শনিকতা! শাহীন পড়াশুনা করছে ব্যবহারিক রসায়ন নিয়ে কিন্তু তার চিন্তা-ভাবনা মনের রসায়ন নিয়ে!
৪)
– কি বললে? বিয়ে করবে? আজকেই?
– দোষ কি? প্রেম করেছি বিয়ে করার জন্য, করতে যখন হবেই, দেরী করবো কেনো?
– তাই বলে এখন? বাবা-মা ঘরে জায়গা দিবেনা, কখনোই না!
– আমি কারো কাছে জায়গা চাইলে তো জায়গা দিবে!
– জীবনটা তোমার পাগলামীতে চলবেনা, ঠিক আছে?
– আমি তোমাকে আজকেই বিয়ে করবো, এখনি করবো।
শাহীনের পাগলামীতে মিলি খুবি বিরক্ত, তবে ভেতরে ভেতরে সে তৃপ্ত। শাহীনকে ভালোবেসে সে ঠকেনি, বাস্তবধর্মী কিন্তু সত্যিকার অর্থে ভালোবাসতে জানে, এমন একজনকেই চেয়েছিলো মিলি, খোদা তাকে তা দিয়েছে। সে কৃতজ্ঞ!
( ঘটনাটি ১৮ই এপ্রিল, ১৯৯৪ সালের)
৫)
২০শে এপ্রিল, ১৯৯৪
বিয়ে হয়নি। একটু পিছিয়েছে। ২৩ তারিখ শুক্রবার, বিয়ে করলে নাকি ভালো, আর মিলিও শুক্রবারে ছাড়া বিয়ে করবেনা। তাছাড়া ওর শরীরটাও একটু খারাপ। আজকে ডাক্তার দেখানো হয়েছে। ২-৩টা টেস্ট দিয়েছে। ডাক্তার তো না যেনো চামার! সব টেস্ট তার প্রাইভেট ক্লিনিক থেকেই করাতে হবে!
৬)
“এখনো সময় আছে, ভেবে দেখো আমাকে বিয়ে করবে কিনা।“ বলতে বলতে মিলি’র কান্না পেয়ে গেলো।
– মিলি, আমি তোমাকে ভালোবাসি, তোমার দেহকে নয়। আমি তোমাকে বিয়ে করবো। আর আমার বাবা-মা পর্যন্ত রাজী।
– কিন্তু তোমার বাবা-মা যখন ব্যাপারটা জানতে পারবে, তখন রাজী থাকবেনা। ঠিক না?
– জানিনা। মিলি, আমি তোমাকে ভালোবাসি। হতে পারে কোনোদিন দুটো রোমান্টিক গান গেয়ে শোনাতে পারিনি, হতে পারে কোনোদিন চোখে চোখ রেখে দু লাইন কবিতা শোনাতে পারিনি। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি মিলি।
– ১ বছর ৩ মাসের জন্য বিয়ে করবে ?
– ১দিনের জন্য হলেও আমি তোমাকে বিয়ে করবো।
মিলি তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম কথাটা শুনলো। জীবনের থেকে আর কিছু চাইবার নেই। একটা মানুষের থেকে এতোটা ভালোবাসা পাবার পর আর কি চাইবার থাকতে পারে?
৭)
২৩শে এপ্রিল খুব ধুমধামের সাথে কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ে হলো। বাবা-মা’র থেকে বিদায় নেবার সময় মিলি বারবার কাঁদতে কাঁদতে ভেঙ্গে পরছিলও। ছেড়ে যাবার দুঃখে নয়, বরং এতোটা ভালোবাসা পাবার কারণে।
– মিলি, একটু বারান্দায় আসবে?
– চা খাবে?
– খাওয়া যায়।
– কিছু ভাবছো?
– হ্যাঁ।
– কি?
– আমার মতো সুখী পৃথিবীতে আজ কেউ নেই মিলি। আমি খোদার কাছে কোনোদিন কিছু চাইনি। তোমাকে চেয়েছিলাম। খোদা আমাকে দিয়েছে। আমি কখনোই সিনেমার নায়কের মতো এতো সুন্দর করে প্রেম নিবেদন করতে পারিনি, পারবোও না। খোদার কাছে আমার আর কিছু চাওয়ার নেই, সবসময় বলেছি, আজ আবার বলি- “মিলি, আমি তোমাকে ভালোবাসি”।
মিলি শাহীনকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে বাচ্চা মানুষের মতো কাঁদতে লাগলো।
৮)
জানুয়ারির ৩১ তারিখে শাহীন আর মিলির ফুটফুটে একটা মেয়ে হলো। মিলির অবস্থা খুব একটা ভালোনা। দিনকে দিন স্বাস্থ্য খারাপ হচ্ছে। তাছাড়া, হাতে আছে আর মাত্র দুই কি তিন মাস! থাক, কিছুটা দিন বাচ্চার জন্য এসব ভুলে থাকা যাবে।
৯)
একের পর এক ক্যামোথেরাপির ফলে মিলিকে এখন কংকালের মতো দেখায়। চোখগুলো যেনো কোটর থেকে বেড়িয়ে আসবে। শাহীন পাগলের মতো শুধু টাকা যোগারের জন্য ছুটছে। প্রতি মাসে একবার ক্যামোথেরাপি দেবার মতো সামর্থ্য তার নেই, সে জানে। কিন্তু হার মানতে শিখেনি সে । মিলিকে সে কোনোভাবেই ক্যান্সারের কাছে হারতে দিবেনা।
১০)
২৩শে এপ্রিল, ১৯৯৫
মিলি বেডে শুয়ে আছে। বাক-শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। খুব কষ্ট করে চোখ মেললো, ফুল হাতে শাহীনকে দেখে চোখ থেকে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পরলো। আজকে তাদের বিবাহ-বার্ষিকী, এতো ঝামেলার মধ্যেও সে ভোলেনি। সে ইশারায় তাকে কাছে ডাকলো। তার চোখে, গালে হাত বুলিয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ডানহাতে শক্ত করে ধরে থাকা চিঠিটা শাহীনকে দিয়ে হাসিমুখে ২৩শে এপ্রিল, ১৯৯৫ তারিখ, সকাল ১০টায় ক্যান্সারে আক্রান্ত মিলি মৃত্যুবরণ করলো।
১১)
দাফন শেষ করে শাহীন ঘরে আসলো। মিলি চুপ করে তার দাদীর কোলে বসে আছে। এখনো বুঝতে পারছেনা আম্মু সাদা শাড়ি পরে কোথায় গেলো। খুব কষ্ট করে নিজেকে চেপে রেখেছে শাহীন, মিলির দেয়া চিঠিটা পকেট থেকে বের করলো।
“বিয়ের এতোটা দিন পরেও জানিনা তোমাকে কি বলে ডাকবো। বেশী লিখতে পারবোনা, হাত ধরে আসছে। শুধু যা বলার ছিলো, তাই বলি। তুমি সবসময় একটা কথা বলতে, “ভালোবাসা এতোটা সত্য যে তা প্রকাশ করবার দরকার পরেনা”। কিন্তু আমি তোমার ভালোবাসাটা প্রতিটি মুহূর্তে অনুভব করেছি। আমার ক্যান্সার জেনেও আমাকে বিয়ে করলে, কিভাবে এতো ভালোবাসো শাহীন? আমিতো পারিনা! বিশ্বাস করো, এতোটা দিন হাসপাতালের বেডে শুয়ে একটিবারের জন্যও মৃত্যুভয় কি বুঝতে পারিনি। জীবনে কোনও অতৃপ্তি নিয়ে পৃথিবী ছাড়িনি। আমি তৃপ্ত শাহীন। অনেক ভালোবাসি তোমাকে। লিখতে খুব কষ্ট হচ্ছে। আমার মেয়েটাকে অনেক বড় করবে, ডাক্তার বানাবে যাতে কোনো শাহীন তার মিলিকে না হারায়।“
চিঠিটা পড়ে আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলোনা, চিৎকার দিয়ে সে কেঁদে উঠলো। “আল্লাহ, জীবনে কোনোদিন কিছু চাইনি। শুধু মিলিকে চেয়েছিলাম, দিয়েও নিয়ে গেলে।“
১২)
বারান্দায় বসে খন্দকার সাহেব বিয়ের এলবাম দেখছেন। এলবামটা কেনো খুলে রেখেছেন, তিনি জানেন না, সব তো তার চোখের সামনেই ভেসে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে তিনি মিলিকে ভাবতে লাগলেন। আজকের ২৩শে এপ্রিল যেনো ১৯৯৪ সালের সেই ২৩শে এপ্রিল, এতোটা বছর পরেও সব যেনো আগের মতোই আছে। মিলি চলে গিয়েও এখনো ফিরে আসে, শাহীনের ভালোবাসার টানে। চোখ বন্ধ করে মিলিকে অপলক দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো শাহীন –
“ সে যেনো আমার পাশে
আজও বসে আছে,
চলে গেছে দিন তবু, আলো রয়ে গেছে,
সে যেনো আমার পাশে
আজও বসে আছে ……”
-(গানের কলিগুলো কিশোর কুমারের সে যেনো আমার পাশে আজও থেকে নেয়া)
( পুর্বে ফেসবুকে আমার প্রোফাইলে ও “ভালোবাসার গল্প” নামক গ্রুপে প্রকাশিত)
একটানে পড়ে ফেললাম। ভালোবাসা ভালোবাসি!
চমৎকার ভালোবাসার গল্প।
[একটু বেশি দ্রুত গেছে, আরেকটু স্লো গেলে ভালো হত মে বি]
😀 😀 😀
আমার গল্পে আমি কখনোই শেষের দিকে ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারিনা 😛
চেষ্টা করবো দাদা 😀
জয়তু ভালোবাসা। :huzur:
আবারো বলি, বানাআআআন ! :nono:
তুমি আছো কি করতে? তুমি ঠিক করে করে দিবা ! হি হি হি
আমারে কত বেতন দিবি ?
চমৎকার গল্প। মনটা ছুঁয়ে গেলো।
:clappinghands:
তাই নাকি ?? 😀 ধন্যবাদ !
গল্পটা পরে সেই কিশোর বয়সের মত করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। ক্যান্সার এর সাথে যুদ্ধ যে কি নির্মম হতে পারে তা যে অনেক কাছ থেকে দেখেছি।
এতো কাদলে হবে? কান্নার যে অনেক বাকি !
‘মন খারাপ করা’ একটা গল্প।
কথা সত্য !
চমৎকার একটা ভালোবাসার গল্প….সাথে মন খারাপও হলো | আরো ভালবাসার গল্প চাই আপনার কাছে….
:brokenheart: :brokenheart: :brokenheart:
ইনশাল্লাহ, পাবেন 😀 :beshikhushi:
তোমাদের সবাই এমন কইরা গল্প লিখলে তো সারাদিনই মনডা খারাপ থাকবো! কেমনে লিখিস?? মনের মইধ্যে কষ্ট না থাকলি নাকি এমুন লিখা যায় না! :huzur:
“আমি কষ্ট দিতে ভালোবাসি!
তাই তোমার কাছে ছুটে আসি !!!”
এটা ছাড়া কমেন্টের সাথে যায়, এমন কোনো গান পাইলাম না 😛
– ১দিনের জন্য হলেও আমি তোমাকে বিয়ে করবো
mone pore gelo kew 1jon ek somoy ei rokom kotha bolechilo…..
bisad makha valo laga rekhe gelam ++