ছোটবেলা

খুব ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। আমরা তখন মণিপুরে থাকতাম। আমার ওই বয়সে (ওয়ানে তখন) খুব ঘনিষ্ঠ একটা বান্ধবী ছিল(!) নাম ছিল মিতু। আমার এখনো মনে পড়ে ও’দের বাসায় যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করতাম আমি। কয়েকদিন কান্নাকাটির পর আম্মু আমাকে নিয়ে যেত ও’দের বাসায়। বাসায় যাওয়ার পর আন্টির আপ্যায়ন, এবং তারপর ও’দের বাসায় আমাদের পিকনিকের আয়োজন! ওর ফাইভ–সিক্স পড়ুয়া কতগুলো ভাই-বোন ছিল, সবাই মিলে পিকনিক করতাম আমরা।

মিতুদের বাসার একটু দূরে একটা বুড়ির ঘর ছিল। সেই ঘরের পাশেই খোলা মাঠের মত ছোট জায়গাটুকুতে আমরা ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতাম। মাঝে মাঝে সেই বুড়ি বের হয়ে আসত রাগী চোখে, তখনই আমরা খেলা ফেলে দিতাম ভোঁ দৌড়! বুড়ি বেশি দূর আসত না, কিন্তু বুড়ির সাদা চুল আর সাদা শাড়ি দেখে ভীষণ ভয় পেতাম আমরা! তাই নাম দিয়েছিলাম ‘ডাইনি বুড়ি’!
মণিপুর ছেড়ে চলে আসার আগে শেষবার মিতুর বাসায় গিয়েছিলাম, এখনো কেন জানি ওই দৃশ্যটা খুব মনে পড়ে। ওর ছলছল করা চাউনি টা গেটের বাইরে থেকেও ঠিক দেখতে পেয়েছিলাম আমি!

ক্লাস টু তে থাকতে মণিপুর থেকে গাজীপুরে শিফট করি আমরা। প্রথম প্রথম দুই-একদিন খুব একা একা ছিলাম, বাইরে বেরোতাম না। তারপর কয়েকদিনের মধ্যেই সমবয়সী কতগুলো বন্ধু জুটে গেল, সারা বিকেল খেলতাম বাইরে। ঢাকার সাথে গাজীপুরের পার্থক্য ছিল এই যে,এর আগে এত বেশি সবুজ দেখিনি। মনে আছে বাসার সামনের নিচু জায়গায় (ধানি জমি) বর্ষায় পানি উঠত, আর শাপলা ফুটে থাকত। পরিষ্কার পানির ভেতর দিয়ে ছোট ছোট মাছ দেখতাম আমরা। বেশ ঝোপঝাড়ের মত কতগুলো জায়গা ছিল, যেখানে প্রচুর লজ্জাবতি গাছ হত। তখনকার খুব আকর্ষণীয় একটা খেলা ছিল লজ্জাবতী গাছকে লজ্জা দেয়া। অসাধারণ সুন্দর হালকা বেগুনী রঙের লজ্জাবতী ফুলগুলো খুব প্রিয় ছিল আমার। আমরা দাতই গুটি জোগাড় করে এক টাইপের গুলতি বানাতাম- জোড়ে শব্দ করত ওটা, আর গায়ে লাগলে বেশ ব্যাথা লাগত!

আমার সবচে কাছের বন্ধু ছিল সাথী, ওর সাথে খুব বেশি মিশতাম। সময়ে অসময়ে পাশের বাসায় চলে যেতাম খেলতে। তারপর আমরা দুজন পুরা তল্লাটে ঢুঁ মারতাম, কোন গাছের লেবুটা একটু বড় হয়েছে, অড়বড়ই গাছে নতুন অড়বড়ই এসেছে কিনা, কিংবা পেয়ারা গাছে পেয়ারার রঙ পেকেছে কিনা,নতুন লিচুগুলো কি এখনো বেশি টক না একটু মিষ্টি হয়েছে……সবকিছু বিপুল আগ্রহ নিয়ে পর্যবেক্ষণ করতাম আমরা।

ক্লাস ফাইভে থাকতে সাথীর বাবা’র পোস্টিং হয় গোপালগঞ্জ। বছরের শুরুর দিকে বাসা ছেড়ে চলে যায় ওরা। বেশ একা হয়ে গিয়েছিলাম তখন। একলা বারান্দায় বসে থাকতাম বিকেল বেলা, এক আন্টি দেখে বলেছিল, “তোমার সাথী চলে গেছে,তাই খুব কষ্ট পেয়েছ না?”

হ্যা, সত্যিই হঠাৎ করে খুব মনমরা হয়ে পড়েছিলাম……সাথীকে খুব মিস করতাম তখন। তারপর হাইস্কুলে উঠে লেখাপড়া নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ি। এর মধ্যে ক্লাস ফাইভে ট্যালেন্টপুলে স্কলারশিপ আর হাইস্কুলে প্লেসে চান্স পেয়ে সবার প্রত্যাশা বাড়িয়ে তুলেছি। তাই বেশ চাপ নিয়ে পড়তাম। ভয়ে থাকতাম প্লেস হারিয়ে ফেলি কিনা। সত্যি বলতে হাইস্কুল আর কলেজ জীবনটা একটু বেরসিক ভাবে বন্ধুবান্ধব ছাড়া কাটিয়েছি আমি……আমার একটাই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। আর ওর সাথে আমার মনের সব সুখ দুঃখের কথা শেয়ার করতাম, এখন পর্যন্ত ওই আমার সবচেয়ে ভাল বন্ধু। কোন কিছু নিয়ে খুব বেশি ভেঙ্গে পড়লে ওর সাথে কথা বলি, ওর আশ্বাসে আবার নতুন করে শুরু করার উদ্যম পাই।

এখন ইউনিভার্সিটি লাইফে অনেক বন্ধু আমার, অনেক রকম মানুষের বৈচিত্র দেখি। বিশেষ করে হলে থাকার সুবাদে দেশের বিভিন্ন জায়গার মানুষের সাথে পরিচিত হবার সুযোগ হয়েছে। বাবা-মা’র প্রত্যাশা শেষ পর্যন্ত আর সেভাবে ধরে রাখতে পারি নি। ভার্সিটি জীবনের সব বন্ধুই কম বেশি ভাল। কোন একটা সমস্যার মূহুর্তে সাধ্যমত সাহায্য করতে কার্পণ্য করে না কেউই। আমার ক্লাসের বন্ধুরাও অনেক হেল্পফুল আর আমি ওদেরকে পেয়ে সত্যি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি।

তবু ছোটবেলার সেই মুক্ত অনাবিল দিনগুলো আর সেই নিষ্পাপ বন্ধুরা আসলে সবসময় সবকিছু থেকে আলাদা……এখনো সেই ছোট ছোট স্মৃতিগুলো ভাবনার জগতে এক চিলতে খোলা আকাশ হয়ে ধরা দেয় কোন এক অলস মূহুর্তে। ছোটবেলা সবার জীবনেই এক অমূল্য সময়, সবকিছুর পরেও সেই সময়ের হাতছানি এক পশলা বৃষ্টি হয়ে বেঁচে থাকে আমাদের ব্যস্ত জীবনের শুকনো মরুতে………

সরল সম্পর্কে

সরল মনের মানুষ
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে বিবিধ-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

14 Responses to ছোটবেলা

  1. অক্ষর বলেছেনঃ

    ” তবু ছোটবেলার সেই মুক্ত অনাবিল দিনগুলো আর সেই নিষ্পাপ বন্ধুরা আসলে সবসময় সবকিছু থেকে আলাদা……এখনো সেই ছোট ছোট স্মৃতিগুলো ভাবনার জগতে এক চিলতে খোলা আকাশ হয়ে ধরা দেয় কোন এক অলস মূহুর্তে। ছোটবেলা সবার জীবনেই এক অমূল্য সময়, সবকিছুর পরেও সেই সময়ের হাতছানি এক পশলা বৃষ্টি হয়ে বেঁচে থাকে আমাদের ব্যস্ত জীবনের শুকনো মরুতে………”

    সবচেয়ে সুন্দর লাগল এই অংশটা , নস্টালজিক হয়ে গেলাম 🙂

    আর ছবিটা আরও সুন্দর।

  2. সামিরা বলেছেনঃ

    ভাল লেগেছে দোস্ত। 😀

    বানান বিভ্রাট:
    ব্যাথা>ব্যথা
    বৈচিত্র>বৈচিত্র্য

    দাতই গুটি কী রে?

    • সরল বলেছেনঃ

      তোকে যদি সেই দাতই গুটি আর কখনো দেখাইতে পারতাম….!!..নিজেই খুশি হইয়া যাইতাম…… জানিস সেই জিনিস খাওয়াও যাইত !! আর এক টাইপের ফুলের ডাটার ভিতরে মিষ্টি রস থাকত……সেই জিনিস তখন মনের সুখে খাইতাম……..:(

  3. তিষা বলেছেনঃ

    “তবু ছোটবেলার সেই মুক্ত অনাবিল দিনগুলো আর সেই নিষ্পাপ বন্ধুরা আসলে সবসময় সবকিছু থেকে আলাদা……”
    একদম সত্যি। আমিও আমার ছোটবেলার খেলার সাথীদের মনে করি। ছোটবেলায় ময়মনসিংহ ছিলাম। ওখানে কিছু বন্ধু-বান্ধব ছিল যাদের কথা মনে পড়ে এখনও। 🙁

  4. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    একমত! পিচ্চিকালের বন্ধুদের মত আর কেউ নয়!

    তোমার সবুজ পিচ্চিকালকে হিংসা হল!

  5. নিবিড় বলেছেনঃ

    লেখাটা পড়ে ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেলো, কি আনন্দেই না পার করতাম দিনগুলি। 🙁

  6. অনাবিল বলেছেনঃ

    লেখাটা ভালো লেগেছে, ছবিটাও…………

    ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল……………

  7. স্বপ্ন বিলাস বলেছেনঃ

    “ছোটবেলা সবার জীবনেই এক অমূল্য সময়, সবকিছুর পরেও সেই সময়ের হাতছানি এক পশলা বৃষ্টি হয়ে বেঁচে থাকে আমাদের ব্যস্ত জীবনের শুকনো মরুতে”
    :clappinghands:

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।