“আজকের রোদটা খুব বেশি, না আব্বু?”
আমার পাঁচ বছরের বুবুন আমার হাত ধরে হাঁটছে, কতো কথা তার, কতো প্রশ্ন, আচ্ছা আব্বু, কাকেরা রাতে কোথায় যায়? বৃষ্টি হলে মেঘগুলো এতো পানি পায় কোথা থেকে, রাস্তার পিচ কালো কেন, আরো কত্তো কিছু……
অনেক প্রশ্নের উত্তর না দিতে পেরে আটকে যাই, কিন্তু প্রশ্ন তাতে কি আর থামে? কিন্তু তবু আজকে কিছুতেই মন বসাতে পারছি না ওর কথাগুলোয়, অনেক হিসেব যে আমারই মিলছে না, সংসারের অনেক হিসেবই এখন মেলে না…
আজ মাসের ২০ তারিখ, অথচ বাজার করতে গিয়ে দেখি, পকেটে সাকুল্যে পাঁচশ টাকা। সন্তর্পণে মাছ মাংসের বাজার থেকে সরে আসলাম, সব্জী বাজারেই ঢুকি। আমরা না হয় তবু শাক-পাতা খেয়ে বেঁচে গেলাম, কিন্তু বুবুনের জন্য তো কিছু কেনা দরকার, নিদেনপক্ষে ডিম, এখনো ১০টা দিন বাকি, কীভাবে চলবে?
রোজ বাসে করে যাওয়া আসা করতে আমার যায় ২০ টাকা মোট, কিন্তু স্কুলে তো আমি তোকে হেঁটে যেতে দিতে পারি না বুবুনসোনা, এই রোদের মধ্যে রিকশা ভাড়াই যাবে ৪০ টাকা, তোর টিফিনের টাকা লাগবে না? এবার যে বলেছিলি তোকে একটা গল্পের বই কিনে দিতে হবে, পক্ষীরাজ ঘোড়ার ছবিসহ, কী করে হিসেব মেলাবো বলতে পারিস??
বুবুন আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “তোমার কি মন খারাপ আব্বু?”
অবাক হয়ে তাকালাম বুবুনের দিকে, হঠাৎ মনে হলো, তুই বুঝি কত্তো বড়ো আমার থেকে রে, তুই তো সব বুঝিস, না? তোর কাছে তোর আব্বু সবচেয়ে দারুণ আব্বু, ‘সুপার’ আব্বু, না?? কিন্তু আমি যে হেরে যাচ্ছি রে বুবুনসোনা……
আনমনে হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন রেল লাইনের পাশে চলে এসেছি। দূরে ট্রেন দেখা যাচ্ছে বুঝি, ছোট্ট কালো বিন্দুর মতো…
আমি হাঁটু গেড়ে আমার বুবুনটার সামনে বসলাম। বললাম,
“আয়, আজকে একটা মজার খেলা খেলি”
উজ্জ্বল চোখে আমার দিকে তাকালো বুবুন।
“কী খেলা বাবা?”
“আমরা আজকে কান ঢেকে রেখে কথা বলবো, ঠিক আছে বাবা?”
“তাহলে তো আমরা কানে শুনতে পাবো না ঠিকমতো!”
“এজন্যই তো, আমরা চিৎকার করে কথা বলবো, ঠিক আছে বুবুন?”
“ঠিক আছে বাবা!”
বুবুন নতুন খেলা পেয়ে মহাখুশি, দু’হাতে কান ঢেকে আমাকে বললো,
“কেমন আছো বাবা?”
ফিসফিস করে বললাম,
“ভালো না বুবুন, একটুও ভালো না…”
“শুনতে পাচ্ছি না বাবা, জোরে বলো…”
দূরে রেল ক্রসিং-এর গেট পড়ে গেছে, আমি দেখতে পাচ্ছি।
বুবুন আমার দিকে ফিরে চিৎকার করে বলছে,
“আজকে বাসায় গিয়ে তুমি আমাকে ফড়িং আঁকা শিখিয়ে দেবে কেমন?”
“কেমন মায়ের মতো চোখ পেয়েছিস রে বুবুন, হঠাৎ করে যখন অবাক হয়ে তাকাস, মনে হয় বুঝি তোর মা তাকিয়েছে, হঠাৎ করে যেন মনে হয়, তোর মধ্যে বুঝি কোথাও তোর মা চুপটি করে লুকিয়ে আছে রে…”
“কী বলো বাবা, একদম শুনতে পাচ্ছি না, এমন করলে আমি কিন্তু খেলবো না!”
ট্রেনটা মাটি কাঁপিয়ে ছুটে আসছে, আশেপাশের মানুষজন কী যেন চিৎকার করে বলছে আমাকে, আমি কিছু শুনতে পাচ্ছি না, কী করে পাবো! ট্রেনটা বড্ড বেশি কাছে চলে এসেছে, আমি ইঞ্জিনে বসে থাকা মানুষটার চেহারা দেখতে পাচ্ছি, অসহায় একটা মানুষ, প্রাণপণে হাত নেড়ে যাচ্ছে, আমাকে সরতে বলছো বুঝি? কোথায় যাবো বল? কোথায় যাবার মতো আছে?
চিৎকার করে বললাম,
“চোখ বন্ধ করবি বুবুন সোনা?”
বুবুন চোখটা বন্ধ করে আমাকে বললো,
“কেন বাবা?? সারপ্রাইজ দেবে?”
ইঞ্জিনটা প্রায় চলে এসেছে, চারপাশ ভয়ঙ্কর রকমের কাঁপছে, বুবুন সোনাটা টের পাচ্ছে না তো??
আর মাত্র কয়েকটা মুহুর্ত।
অদ্ভুত কিছু বিষণ্ণতায় মোড়া একলা কিছু মুহুর্ত,
আর রেললাইনের উপর দু’টো একলা মানুষ……
“আমাকে ক্ষমা করে দিস বুবুন সোনা, আমি পারি নি, তোর ‘সুপার’ বাবা হতে পারি নি রে…”
__________________________________________________________________________________________
এই গল্পের সাথে জীবিত অথবা মৃত কোন মানুষের জীবনকাহিনীর কোন মিল নেই, মিল যদি থেকেই থাকে, তবু হিসেব মিলবে না, কারণ এমন বুবুনের বাবারা হয়তো নিতান্তই অভাগা, যাদের গল্প কেউ জানবে না……
জানতে চাইবে না…
আমি সত্যি তোরে মারবো। সত্যি………
আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে……
কেন এমন করে লিখলাম এটার প্রশ্নের উত্তরও আমার কাছে নেই…
🙁 🙁 🙁 🙁 🙁
😐
কিছু বলার ভাষা সত্যিই নেই……………।
অসম্ভব কষ্টে চোখ ঝাপসা হয়ে গেল………।
লেখনী সার্থক , পাঠক কে কাঁদিয়ে দিতে পেরেছেন সত্যি কিন্তু বিশ্বাস করেন সুইসাইড কোন সমাধান না, সুইসাইড কখনো কোন গল্পের শেষ না। একজন লেখকের কাছে গল্পের এমন শেষ আমি কখনো প্রত্যাশা করি না………
দুঃখিত, কঠিন কথা বলে ফেললে……। কান্না থামাতে পারছি না…………
আমি নিজেও বিশ্বাস করি না এটা কোন সমাধান, শুধুমাত্র মানুষের অনুভূতি নিয়ে খেলা উচিত না, এই কারণেই বহু আগের একটা লিখাকে গলা টিপে খুন করেছিলাম, কেন জানি আজ পারলাম না আর……
দুঃখিত…
আমার এক ফ্রেন্ড …
ও যখন ছোট, তিন ভাই-বোন সবাই স্কুলে পড়ে তখন ওর বাবা মারা যান, ওনার ডেড বডি উদ্ধার করা হয় রেল লাইন এর উপর থেকে… কাটা পড়েছিল! কেউ জানেনা সেটা আত্মহত্যা কী ‘না… হয়তো- হয়তো না!
ওনার চাকরী চলে গিয়েছিল তার কিছুদিন আগে। কিন্তু বাসায় বলেননি সেটা। প্রতিদিনই অফিসের উদ্দেশ্যে বের হতেন… কাউকে বুঝতে দেননি কষ্টটা। বাসায় ছেলে আর ছোট দু’টো মেয়ে… … স্ত্রী … …
—————-
কিছু মানুষ কেন হেরে যেতে চায়? জানেনা আর একটু ধৈর্য ধরলেই অসম্ভব সুন্দর পৃথিবীটা ছেড়ে যেতে কিছুতেই মন চাইতোনা তার?!
————
আমার বন্ধুটির মা একাই মানুষ করেন বাচ্চাগুলোকে…
তাদের প্রত্যেকেই ভালো মানুষ! বড়জন ব্যাঙ্কার, মেঝোজন ডাক্তার… ছোটজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার…
ওদের বাবা বেঁচে থাকলে কী কোনদিন কল্পনা করতেন এমন মৃত্যু?
আমিও তাই বিশ্বাস করি আপু, কিন্তু কেন জানি লিখলাম নিজেই জানি না……
“কিছু মানুষ কেন হেরে যেতে চায়? জানেনা আর একটু ধৈর্য ধরলেই অসম্ভব সুন্দর পৃথিবীটা ছেড়ে যেতে কিছুতেই মন চাইতোনা তার?!”
সোহায়লা আপুর কথার সাথে একমত। :huzur:
🙁 🙁
কান্না না করালে হতো না ?
কি করে বলি? নিজেই তো জানতাম না কি লিখতে যাচ্ছি…
একটু আগেই না বানান শুধরে দিলাম! তবু আবার ভুল? :crying:
কী করে বলি, নিজেই তো জানতাম না কী লিখতে যাচ্ছি……
আবার বলি, আবেগের আতিশয্যে ভুল করেছি…
বুদ্ধিজীবির মতো মাঝে মাঝে বলি যে, কাপুরুষেরাই শুধু আত্মহত্যা করে, তারা জীবনে পরাজয় মেনে নেয়।
কি লিখলেন ভাই? বুদ্ধিজীবির লেবাস পরতে পারলাম না, বুবুনের বাবা ভালোবাসার কাছে পরাজিত, সমাজের কাছে পরাজিত। তার পরাজয়টা খুব অন্যায়রে শৈশব ভাই 🙁 পদে পদে তাকে আমরাই পরাজিত করি, তারপরে তৃপ্তির হাসি হেসে জিভ দিয়ে ঠোটটা চেটে নেই একবার ! তিলে তিলে গলা টিপে একেকটা পরাজিত মানুষদের গল্প রচনা করি, এই আমরাই, আমাদের সমাজ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা উক্তি আছে, “প্রত্যেক লেখকই জানেন, সে কেমন লেখে” , আপনিও জানেন কেমন লিখেছেন।
ক্ষমা কর শৈশব, আমি তোমার লেখার মান নিয়ে কিছু বলব না… কারণ আমি তোমার মত গুনী লেখক নই… তবে নিজের জীবন থেকে বলি… নিম্নবিত্ত নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের অনুভুতিগুলো এত চড়া সুরে বাধা থাকে না… থাকতে চাইলেও পারে না… তাদের অনেক বেশি সইতে হয়… একসময় তারা এতটাই সয়ে যায় যে জীবনে যে রং বলতে কিছু আছে, তা-ই তারা ভুলে যায়…
সেটা মানতে আমার কোনই আপত্তি নেই কিন্তু কখনই কি খবরের কাগজে এমন খবর আসে নি? শুধু একটা বোধ থেকে লিখা…
didnt mean 2 hurt u yaar…
আমি কষ্ট পাই নি, লিখার পর থেকে নিজেই কেন জানি খুব বেশি কষ্টে আছি…
🙁
মন খারাপের ভাবটা এই গল্পে আসলেই কেন জানি তাড়া করে!
:crying: :crying:
:crying: :crying: :crying:
এত অসামান্য গল্প!
কোন ইমো দিব না! এই রকমটা সত্যিরে! অনেক বেশি বাস্তব। শুধু রাস্তায় নামলে শুধু বাস্তবে নামলেই জানা হয়
দেখা মেলে…
আমি কখনো দেখেছি কি না জানি না, মনে নেই, কোথাও পড়েছিলাম কি না, কিন্তু নিতান্ত হঠাৎ করেই শব্দগুলো মাথায় এসে ভিড়ে এক হয়ে গেলো……
খুব বেশীই সুন্দর হইসে,
আমি বলতে চেয়েছিলাম যে আত্ম হত্যাই এক মাত্র পথ না, আরও অনেক পথ আছে, থাকে সব সময় ই শুধু খুজে নিতে হয়।
কেন জানি তর্ক করতে মনে চাইল না,
লেখা অসম্ভব ভালো হয়েছে,
হ্যাটস অফ।
:huzur:
ধন্যবাদ পড়ার জন্য……
তর্কের খাতিরে অনেক কিছুই বলা যায়, কিন্তু গল্প তো সবসময় যুক্তি মেনে চলে না…
প্রুফ দেখতে গিয়ে এমন ধাক্কা খেতে হবে আগে বুঝি নি!
চোখে জল এনে দিতে পারে এমন মানুষ খুব কম-ই আছে, এমন লেখনীশক্তি খুব অল্প লেখকেরই আছে।
সালাম তোমাকে।
ধন্যবাদ আপনাকেও, আপনাদের জ্বালিয়ে এখনো গল্প লিখে যাবার সাহস করি তাই!
বুকের ভেতর শেল বিঁধল…………
আমার যে কী ভীষণ কষ্ট হয়েছে লিখবার সময়, বলে বোঝাতে পারবো না…
অসাধারণ গল্প!
পড়ে কান্না পাইছে 🙁
আমারও ভীষণ খারাপ লেগেছে গল্পটা লিখার পর……জানি না কেন……
“ইতি ছেলেবেলা” লেখাটাকে প্রিয় স্বরে নিতে এসেছিলাম। তারপর এমনিই আপনার ছোটগুলোতে হালকা চোখ বুলিয়ে নিতে নিতে দেখলাম, দু’জন একলা মানুষ এবং… নামের গল্প। গল্প বলেই হয়ত আমি একটু বেশি আগ্রহী হয়ে পড়তে চলে আসি। আর কোন এক অদ্ভুত কারণে “একলা” শব্দটা আমাকে টানে খুব, তাই হয়ত আলাদা একটা টানও কাজ করছিলো।
গল্প পড়ে কী মন্তব্য করবো ভেবে পাচ্ছি না। তবে গল্পটি প্রিয় স্বরে নিয়ে নিলাম। যখনি আমার ভীষণ মন খারাপ হবে তখন পড়বো… অবশ্যই পড়বো।
পোষ্টগুলোতে***
কিছু কিছু সময় থাকে, যখন হিসেব মেলাতে বসে আকাশ কুসুম স্বপ্নেরা বড্ড বেয়াড়া হয়ে যায়, ভীষণ রকম মন খারাপ থেকেই বুঝি এই লিখাটা লিখেছিলাম, ভালো লেগেছে কী না জানি না, তবে যদি কোথাও কষ্ট পেয়ে থাকেন তবে সেখানেই বুঝি সার্থকতা…