যে মেয়েটির সাথে আমার বিয়ে হবে তাকে বলবো- দ্যাখো আমি কিন্তু রাঁধতে পারি। এই ধর আলুর ভর্তা, ডিমভাজি কিংবা ভাত। তরকারিও কেটে কুটে দিতে পারবো! আজ সকালে নিজের জন্য রান্নার আয়োজন করতে গিয়ে আঙুল কেটে ফেলেছি! যদি আমার অনাগত প্রিয় মানুষটা এটা দেখে ফেলে তবে কি আমার হাতের রক্ত দেখে ওর চোখ ফেটে জল আসবে, আর আমার উপর অনেকখানি রাগ করবে? ওর কথা বলতে পারিনে!
আজও সন্ধ্যের আকাশে মেঘ ছিল। কিন্ত প্রথমা থেকে ( আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা) যখন স্টিভ জবস’ এর আত্মজীবনী বইটা নিয়ে বেরুতে পারলাম তখন আমার মন থেকে মেঘ কেটে আলোর ঝিলিক বইছে। মেঘ মাখা সন্ধ্যে বেলায় ওয়াল্টার আইজাক্সন এর কলমে দ্যা পারফেকশনিস্ট ‘স্টিভ জবস’ হাতে নিয়ে নিয়ন আলোয় বার বার মেলে দেখছি। এমনিতেই নতুন বই, কি সুন্দর সব অক্ষর, আর সাদা কালো ক’খান ছবি! চাপা আনন্দ নিয়ে ফিরতে ফিরতে দেখি আকাশের মুখ খুব বেশি গোমড়া হয়ে যাচ্ছে। কি আর করা! একটা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোরের চেয়ে ভালো রাস্তা আমার চেনা নেই। বৃষ্টি-ভালবাসার ফাঁক গলে অপেক্ষায় থাকলাম কখন সব ফোঁটা গুলোও বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ বেশ কষ্টে শিষ্টে স্টিভকে আজ নিতে হয়েছে। যদিও মাসের অনাগত দিনগুলো সামনে আছে! তাই আর যাই হোক স্টিভকে তো ভিজতে দিতে পারি না!
বৃষ্টি শেষে রিকশার জন্য অপেক্ষা। আধা ঘণ্টা পর এক মধ্যবয়সীর ত্রি- চক্রযানের যাত্রী হবার ভাগ্য হল। ন্যায্য ভাড়া থেকে সামান্য কিছু বেশিতেই লোকটা রাজি হয়ে গেল। একদম কাক ভেজা ভিজে আছে। হাত পা মাঝে মাঝে কাঁপছে, স্পষ্টত বুঝতে পারছি। কেমন জানি নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল।
এবার বৈশাখ আসার আগেই কালো বোশেখি শুরু হয়ে গেছে। লোকটার কণ্ঠে কিছুটা অনুযোগের সুর। উত্তর করলাম -বৈশাখ আসতে তো আর বেশি দেরি নেই। ‘ কিন্তু ইলিশের দামের যে অবস্থা, খবর কিছু রাখেন নাকি?’ এবার বেশ কৌতুহলি হয়ে বললাম ‘ কি! ইলিশ- পান্তা দিয়ে কি একটা জমকালো বৈশাখী আয়োজন হয়ে যাবে নাকি!’
লোকটা চুপ করে থাকলো। আমিও কিছু বাড়তি যোগ করলাম না। মনে হল ঠিকমত শুনতে পায় নি। আমিও কথা বাড়ালাম না। কি লাভ জেনে ইলিশ দিয়ে সে কি করবে! তিন চাকা চলতে লাগলো। আমিও ঝির ঝিরে বাতাস-আলিঙ্গন মুগ্ধতায় তন্ময় হয়ে থাকলাম।
বাসার প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছি। এবার লোকটি হঠাত বলল ‘ ইলিশ দিয়ে আমরা আর কি করবো? আমার ছেলেটা সেভেনে পড়ে। খেটে খুটে রিকশা চালিয়ে রোজগার করি দেখে কোন আহ্লাদের কথা বলে না। এমনকি ঈদের সময়ও যদি ওর জন্য কিছু কিনতে না পারি তাতেও বাচ্চাটা মন খারাপ করেনা। কাল বলল এইবার বৈশাখে ও একটু ইলিশ মাছ খেতে চায়। আজ বাজারে গিয়েছিলাম। ছোট ইলিশ ও হাজার টাকা”!
লোকটার চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস শুনতে পাই। আমার সমস্ত অস্তিত্ব কেমন জানি বরফের মত শীতল হয়ে গেল। এই বিশাল নগরী, মানুষের কোলাহল, যান বাহনের অবিরাম ছুটে চলা –সব কেমন জানি স্থির হয়ে এসেছে । যেন কিছুই আর অনুভব করতে পারছি না। উত্তরহীন প্রশ্নেরা চার পাশে জমাট বাঁধে।
ঘরে ফিরে চুপচাপ বসে থাকি। হিসেবের অংক গুনে ভুল করি। গনমাধ্যমে কাজ করা এক বন্ধুর খুব কাছের একটা কথা জানি। যে মহীয়সীকে সে ভেবেছিল ‘বেটার হাফ’; সময়ের অঙ্কে একদিন সেই মহীয়সী ওর সাথে থাকতে পারেনি কারণ- উপার্জনের অংকটা ওর যথেষ্ট ছিল না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়াল লিখন টা এখন খুঁজে ফিরি- যদি স্বপ্নই না থাকে তবে আমরা বাঁচি কেন? নৈশব্দের কবিতারা তাড়া করে ফেরে-
নেই সেই শিক্ষক
যিনি সৌন্দর্যের পক্ষে দাঁড়িয়ে
অন্তত একবার বিদ্রুপে বিদ্ধ হবেন। অথবা বিপরীত –
আমার নিঃশ্বাসে সবুজ হয়ে উঠবে বাংলাদেশের প্রান্তর।
সে সবুজ প্রান্তরের মুগ্ধতায় তোমার জন্য একটা লাল টুকটুকে শাড়ি কিনবো, প্রৌড় রিকশাওয়ালা তার শান্ত কিশোর ছেলেটির জন্য পয়লা বোশেখে একটা ডিমওয়ালা ইলিশ কিনবে পদ্মার জেলের কাছে থেকে। তারপর পূর্ণিমার চাঁদ হতে দেবো বেনোজলে পার……………।।
যদি স্বপ্নই না থাকে তবে আমরা বাঁচি কেন?
এই শহরে কত মানুষ আছে যারা আসলেই জানেন না কেন বেচে আছেন। স্বপ্নহীনহীন ব্লাক-হোয়াইট জীবনকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন শুধু মরতে পারছেন না বলে!
যে জীবন দোয়েলের, যে জীবন ফড়িং এর সে জীবনের কতটুকু খোজ আমাদের কাছে আছে? হাজার টাকার জামা, লাখটাকার আইপ্যাড না হলে আমাদের চলে না। আমাদের চলাচলের জন্যে গাড়ির দরকার হয়, সেই গাড়িতে এসি থাকতে হয়। আর তখন কেউ কেউ ছেলের আবদার মেটানোর জন্যে একটা ইলিশ মাছ কিনতেও ব্যর্থ হয়।
এই অস্বাভাবিকতা এখন এমন হয়ে গেছে যে এটাই এখন স্বাভাবিকের চেয়ে বড় স্বাভাবিক। কারো কোন বিকার নেই, কোন প্রতিবাদ নেই। সবাই মেনে নিয়েছে বলেই এত স্বাভাবিক ভাবে বিশাল সব অস্বাভাবিকতা ক্রমাগত শিকড় গেড়ে এই সমাজের বুকে বিশাল মহীরুহ হয়ে দাড়াচ্ছে।
প্রথমে মনে করেছিলাম সাধারন ডাইরি লেখা। কিন্তু হঠাৎ এতবড় ধাক্কা খাবো ভাবতেও পারিনি।
লেখাটার জন্যে ধন্যবাদ।
অনেক সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
সাদা কালো জীবন, সে তো আমাদের তুলিতেই রঙিন হয়ে ওঠে, আমাদের বেদনায় সুর মেখে হয় অনন্য সে সৃষ্টি!
…. খুব মন খারাপ হয়ে গেল……… পহেলা বৈশাখে একটু ইলিশ মাছের শখ এখন আর বাঙালির অধিকারে নেই……… সেতো সোনার হরিণ হয়ে গেছে……
🙁
এবার মনে হয় পয়লা বৈশাখে ইলিশ খাওয়া হচ্ছেনা!
কার গল্পের রিভিউ যেন পড়েছিলাম গল্পটা শুরুই হয় শেষ লাইনের জন্য!
লেখাটার সূচনা শেষ ভালো হইছে। তবে শেষ লাইনের জন্যই যেটা সেটা সুক্ষ্ম হলে আরও ভালো হত!
হেলাল হাফিজের কবিতাটা এত প্রিয় কেন জানি না
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
পাতা কুড়োনির মেয়ে শীতের সকালে
ওম নেবে জাতীয় সংগীত শুনে পাতার মর্মরে।
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
ভূমিহীন মনুমিয়া গাইবে তৃপ্তির গান জ্যৈষ্ঠে-বোশেখে,
বাঁচবে যুদ্ধের শিশু সসন্মানে সাদা দুতে-ভাতে।
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
আমাদের সব দুঃখ জমা দেবো যৌথ-খামারে,
সম্মিলিত বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে সমান সুখের ভাগ
সকলেই নিয়ে যাবো নিজের সংসারে।
বোহেমিয়ান- আপনি অনেক বড় মাপের বোদ্ধা! একদম ভুল বলছি না।
কিন্তু হেলাল হাফিজের এই কবিতার প্রতি আমার ভালবাসা কম। যদিও বাস্তবতার একটা চিত্র তুলে ধরবার চেষ্টা তবুও আমাদের পতাকা।
আপনার বউ তো ভাগ্যবতী মাশাআল্লাহ্! 🙂
“যে মহীয়সীকে সে ভেবেছিল ‘বেটার হাফ’; সময়ের অঙ্কে একদিন সেই মহীয়সী ওর সাথে থাকতে পারেনি কারণ- উপার্জনের অংকটা ওর যথেষ্ট ছিল না।”
“যদি স্বপ্নই না থাকে তবে আমরা বাঁচি কেন?”
🙁
বানান বিভ্রাট:
প্রৌঢ়
এমন জায়গায় খোঁচা মারলেন!
“যদি স্বপ্নই না থাকে তবে আমরা বাঁচি কেন”?
স্বপ্ন আছে বলেই তো বেঁচে আছি 🙁
দাঁড়াও ক্ষণিক পথিক
যেও না চলে
অরুণ আলো কে যা দেবে
যাও গো বলে।
ফেরো তুমি যাবার বেলা
সাঁঝ আকাশে রঙের মেলা
দেখছ কি কেমন করে
আগুন হয়ে উঠলো জ্বলে।।
পুব গগনের পানে বারেক তাকাও
বিরহেরই ছবি কেন আঁকাও
আঁধার যেন দৈত্য সম আসছে বেগে
শেষ হয়ে যাক তারা তোমার ছোঁয়াচ লেগে
থামো ওগো, যেও না হয়
সময় হলে।।-সুকান্ত ভট্টাচার্য
শুরুটা কারণেই আগ্রহ নিয়ে পড়া । ভালো লেগেছে। 🙂
অনেক ধন্যবাদ। আপনার লেখার খবর!
স্বপ্ন দেখা আর স্বপ্নে বাঁচা, স্বপ্নের ছবি আঁকা……… আশায় বসতি গড়ি…………
সুন্দর একটা লেখা……
শুভকামনা……………
খুবই চমৎকার মন্তব্য।
ভালো লেগেছে।