শুরু হোক তবেঃ
প্রথমেই তবে একটা গল্প বলি। আমার টিউশনির ছাত্রীর গল্প। ভিকারুন্নেসার ছাত্রী। সে এইবার বুয়েটে ভর্তি হয়েছে-তোমাদের সাথে। কথা বলার সময় তাকে এখন আমি ইঞ্জিনিয়ার বলে ডাকি। সে লজ্জা পায়, বলে ভাইয়া আমাকে ইঞ্জিনিয়ার বলছেন কেন? আমার তো লজ্জা লাগে। আমি বলি আরে বুয়েটে ভর্তি হয়েই সবাই অর্ধেক ইঞ্জিনিয়ার হয় আর বাকিটা হয় স্যারদের ধোলাই খেয়ে! তুমি তো এখন হাফ ইঞ্জিনিয়ার -সে হাসে। গতকাল ওর আম্মুকে ফোন দিলাম। কথা বলার এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করলাম- আন্টি ইঞ্জিনিয়ার কোথায়? উনি অবাক, কোন ইঞ্জিনিয়ারের কথা বলছো পলাশ?
এটার সাথে ওটা ফ্রী। সুতরাং ঐ গল্পের সাথে আরেকটা ফ্রী দিতে হয়। তখন আমাদের ১/২ চলে। ২২x রুমে এক সিনিয়র ভাইয়ার সাথে আমাদের খুব খাতির ছিলো। সারাদিন আমরা কয়েকজন তার রুমে আস্তানা গেড়ে থাকতাম, নেট ব্যবহার করতাম। আমাদের কারনে বেচারা ঠিকমতো নিজের কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগই পেতনা। তো আমরা একদিন তার পিসিতে ঘাটতে ঘাটতে এক আপুর সাথে ভাইয়ার ড্যান্সের একটা ফটো পেলাম। ভাইয়া ছিলো খুব লাজুক, অন্তত আমাদের কাছে। হয়তো ঐদিন কি মনে করে একটু নাচতে গিয়েছিলেন কোন বেরসিক সেই সুযোগে ক্লিক চেপে দিয়েছে। আগের দিন ভাইয়া আমাদের কোন কারনে ঝাড়ি দিয়েছিল- এই সুযোগ কাজে লাগালাম আমরা তিনজন। ফটোটা কপি করে নিলাম। তারপরে ভাইয়া আসলে তাকে চেপে ধরলাম। লাজুক ভাইয়া তো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কথাই বলতে পারছে না। অনেক দরাদরি করে শেষে ঠিক হলো স্টারে খাওয়াতে হবে- তাহলে ঐ ফটো ডিলিট করে দেবো, আর কাউকে বলবো না! খেলাম- তারপরে ভুলে গেলাম। কয়েকদিন পরে ভাইয়াকে বললাম ভাইয়া একটা ফটো ডিলিট করতে ভুলে গেছি- আরেকবার খাওয়াতে হবে। এভাবে অনেকবার খেয়েছি। এখন ফটোটা নেই- আসলে কখনো ছিলো না। আমরা কপিই করিনি- একজনের পিসি থেকে ফটো চুরি করবো কেন? ভাইয়া সেটা বুঝে গিয়েছিলেন। তবুও এখন পর্যন্ত আমাদের খাইয়ে চলছেন!
ভাইয়ার পরিচয় সুকৌশলে পুরো লেখার কোন এক জায়গায় দেয়া আছে- দেখি বের করতে পারো কিনা? আমাদের ১১ ব্যাচের ছোট ভাইবোনেরা কত বুদ্ধিমান তার একটা পরীক্ষা হয়ে যাক!
ফর্মাল:
উপকথার এক আশ্চর্য পাখি- আগুন-পাখি-তার নাম ফিনিক্স। পবিত্র জসদ বৃক্ষের পুড়ে যাওয়া ছাই থেকে জন্ম নেয়া হেলিওপোলিশের গর্বের ফিনিক্স। প্রতিবার মৃত্যু তাকে নবজন্ম দেয়! নীড়সহ ভস্মীভূত ফিনিক্সের ছাই থাকে প্রতিবারে আবির্ভূত হয় আরেকটি অগ্নিবর্ণ ফিনিক্স। প্রতিটি ধ্বংস আরেকটি সৃষ্টি। জীবনের পথ ধরে নতুন জীবনের আহবান।
তেমনিভাবে পদ্মা-মেঘনা-যমুনার পলি বিধৌত এই উর্বর বাংলার সন্তান আমরা বাঙ্গালীরা প্রতিবার ধ্বংসের মুখে জেগে উঠি। যুগে যুগে বর্গীরা, মোংগলরা, আর্যরা, মোগল, ইংরেজ এবং পাকিস্তানীরা বার বার আমাদের পদানত করতে চেয়েছে, পরাধীন করেছে। কিন্তু আমরা বীরের মত জেগে উঠেছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেছিলেন আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবেনা। আমরা সেই না দাবিয়ে রাখা বাঙ্গালী। তোমরা সেই না দাবিয়ে রাখা বাঙ্গালী!
প্রজন্মের পরে প্রজন্ম চলে যায়। পুরনোর জায়গায় নতুন প্রতিস্থাপিত হয়। নতুন রক্তে নতুন নতুন অবদান যুক্ত হয়। তোমাদের প্রজন্মের সবচেয়ে মেধাবীদের মধ্যে অন্যতম তোমরা। তোমাদের দ্বারা বুয়েট গর্বিত হোক, দেশ ও জাতি উপকৃত হোক, পূর্ববর্তী প্রজন্মের কাছ থেকে পাওয়া ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের সুনাম তোমরা আরো উপরে তুলে ধরো সে কামনা থাকলো।
ইনফর্মালঃ
আমাদের আছে এফ আর খান, আমাদের আছে রাগিব ভাই, সারা পৃথিবীর বড় বড় কোম্পানি গুলো গুগল মাইক্রোসফট ইন্টেলে ছড়িয়ে আছে আমাদের ভাইয়ারা। নামকরা ইউনিভার্সিটির অগুনতি ফ্যাকাল্টি আছে যারা একদিন এই ক্যাম্পাসে ছিল তোমাদের মত। আমাদের আছে প্রোগ্রামিং টিম, যারা ACM এ বিশ্বের তাবৎ নামকরা সব ভার্সিটি গুলোকে পেছনে ফেলে ১১ তম স্থান অধিকার করতে পারে। আজ আমাদের ফ্যাকাল্টি থেকে সরাসরি এম আই টি তে তিনজন স্কলারশিপ পায়!
এভাবে তালিকা করলে সে তালিকা খুব দীর্ঘ হয়ে যাবে। আমি সেদিকে যাচ্ছি না। আমি খুব তুচ্ছ কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ একটা ঘটনার উল্লেখ করবো।
৩-২ থাকাকালীন আমি আর আমার বন্ধু আরাফের বাইক ছিলো। আমার হাংক আর আরাফের পালসার নিয়ে রাত বারোটার পরে আমরা রেস খেলতাম। একদিন মালিবাগের দিক চেকপোস্টে আমি আটকে যাই। সাথে সামান্য কোন কাগজ ছিলো না, ভুলে সব রুমে রেখে গিয়েছিলাম। নিশ্চিতভাবে বাইকটা সিজ হবার হাত থেকে সেদিন বাঁচিয়েছিল আমার বুয়েট পরিচয়। আমি শুধু বলেছিলাম স্যার আমি বুয়েটের ছাত্র। আর বেশি কিছু দরকার হয় নি। সাথে সাথেই বাইকসহ আমাকে ছেড়ে দিয়েছে।
এই যে সম্মান, এই যে সবার বিশ্বাস- বুয়েটের ছেলেরা মেধাবী, উন্নত রুচির, ভদ্র, সদগুনের অধিকারী এ গুলো কিন্তু ফেলনা নয়। অনেকে অনেক কিছু করে- বিশাল ডিগ্রী কিংবা টাকা কিন্তু এই সম্মান কয়জনে পায়! এলাকায় মুরুব্বীরা বুয়েটে পড়ি শুনে যখন মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দেয় সেই ভালবাসা কয়জনে পায়? লেভেল ২/৩ তেই যখন বাড়িতে একের পর এক বিয়ের প্রস্তাব আসে সেটাও কি কম উপভোগ্য?
এই যে সম্মান, এই যে সুনাম, এই যে বিশ্বাস এখন এগুলোর অংশীদার তোমরাও। ইচ্ছেমত উপভোগ করবে, ধ্বংস নয়। সিনিয়রেরা অনেক সাধনা করে এগুলো অর্জন করেছে সেটাকে বাড়িয়ে দিও-ধ্বংস নয়।
বুয়েটের হল:
হলে ওঠার সময়ে খেয়াল রাখবে হল বাসা নয়। এখানে সবারই অনেক স্যাক্রিফাইস করতে হয়। পছন্দ হবেনা অনেক কিছু তবুও মানিয়ে চলতে হবে। সারাজীবনেই এভাবে এডজাস্ট করার দরকার হবে, সেই শিক্ষা এখনই নাও।
প্রথমে রেন্ডমভাবে সিট পড়বে। একরুমে সিনিয়র জুনিয়র থাকবে। সিনিয়রদের সাথে কোনমতেই বেয়াদবি করা যাবে না। নৈতিকতার দিক থেকে না দেখলেও। সিনিয়রদের সাথে ঝামেলা করলে হল লাইফ খুব কষ্টের হবে। পক্ষান্তরে সিনিয়রদের সাথে সম্পর্ক ভালো থাকলে বুয়েটে জীবনে কি কি যা পাওয়া যায় তার পরিমান অনেক!
পরবর্তী টার্মে ইচ্ছে করলে নিজেরা এরেন্জ করে এক ব্যাচের ছেলেরা-বন্ধুরা এক রুমে এলোটমেন্ট নিতে পারো। সবাই মোটামুটি তাই করে। সে জন্যে আগে থেকেই পছন্দসই রুমমেট সিলেক্ট করে হল অফিসে দরখাস্ত করতে হবে!
হলে থাকলে কিছু জিনিস মানতেই হবে। রুমমেট যখন পড়বে বা ঘুমাবে তখন অবশ্যই হেডফোন ইউজ করবে। হল অফিসে টেবিল ল্যাম্প দেয়। কেউ ঘুমালে তার যাতে ঘুমের ক্ষতি না হয় সেজন্যে টেবিল ল্যাম্প ব্যবহার করবে।
আর অবশ্যই রুমমেটদের সাথে সম্পর্ক ভালো রাখবে- অনেক ত্যাগ করে হলেও!
চুপে চুপে একটা বুদ্ধি শিখিয়ে দেই, হলের মেসবয়, দারোয়ান, মালী, অফিস কর্মচারী সবার সাথে পরিচিত হবে, নাম জানবে তোমার নাম বলবে। কথা বলার সময় মামা মামা না করে অমুক ভাই তমুক চাচা এভাবে ডাকবে দেখবে জাদুকরী ফল পাবে। অনেক সুবিধা, ধরো কেউ একদিন হলে এসে তোমাকে খুঁজল দেখল নাম বলতেই সবাই তোমাকে চেনে, রুম নাম্বার জানে, অনেক খাতির করছে সেটা দেখে তার অনুভূতি কেমন হবে আর তার কাছে তোমার সম্মান কত বাড়বে ভেবে দেখেছ?
সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্ক:
বাংলাদেশের যে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তুলনায় বুয়েটে সিনিয়র-জুনিয়র রিলেশন অনেক ভাল- সাম্প্রতিক কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদেও। আর সব হলের চেয়ে বেশি ভালো নজরুল হলে। যাদের এখানে সিট পড়েছে তারা ভাগ্যবান।
০৩ ব্যাচে আমার একটা সিনিয়র ভাই আছে। আমি তাকে শফি ভাই বলি। তার রুমে কয়েকমাস ছিলাম। চার বছর আগে বুয়েট ছেড়েছেন। এখনো প্রায়ই ভাইয়াকে ফোন দিয়ে বলি ভাইয়া অনেকদিন খাওয়া দাওয়া হয়না ভালো করে। ভাইয়া বলেন চলে আসো। ভাইয়ার সাথে কতবার যে স্টার- কে এফ সি কিংবা বি এফ সি তে খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। মন খারাপ- ভাইয়া আছে, টাকা ধার লাগবে- তাও ভাইয়া আছে।
০৪ এ ছিলেন এনামুল ভাই। এখনো মাঝে মাঝে দেখা করি তার সাথে। ফোনে কথা হয়। ০৫ এ বিজয় ভাই, পাপন ভাই, বাবু ভাই কত নাম আর বলবো।
০৬ এর সব ভাইয়ারাই এত ভাল কাউরে বাদ দিতে ইচ্ছা করছে না। সৌরভ ভাইয়ের কথা বলি- ৩৫০০০ এ চাকুরী পেয়ে খাওয়ালেন বি এফ সি তে, ঐদিন রাতে আরেক কোম্পানি থেকে ৫০০০০ এ অফার পেলেন, এখন তাই আবার খাওয়াবেন। আছেন আমাদের লাভ-গুরু জীবন ভাই আর শেল্টার গুরু শুভ ভাই!
আছেন আইপিই এর ভালো ছাত্র ০৬ এর তানভীর ভাই- তার ব্যাচের ছেলেদের চেয়েও আমার সাথে তার সম্পর্ক ভাল। তারপরে কম্পিউটার এক্সপার্ট মিনহাজ ভাই, নতুন পিসি কিছুই বুঝিনা, সমস্যা দেখা দিলেই মিনহাজ ভাইকে দিলাম ডাক, সেভেন এক্সপির সিডি লাগবে আছে মিনহাজ ভাই, চোথা লাগবে আছেন আরিফ ভাই। আছেন ০৫ এর সাইফুদ্দিন ভাই, আমার সাহিত্য চর্চায় সবসময়ে যিনি উৎসাহ ও পরামর্শ দিয়ে এসেছেন।
০৩ এর রানা ভাই ছিলেন একদিন হাইয়ের চায়ের দোকানে তাদের আড্ডার মাঝে বসে চা খেয়েছিলাম বলে অনেক ধমক দিয়েছেন। কিন্তু পরের দিন আরেকভাবে মন ভাল করে দিয়েছিলেন ঠিকই।
এইভাবে বলে শেষ করে যাবেনা। প্রত্যেক সিনিয়র ভাইয়ের সাথেই এত এত ভাল সম্পর্ক কাকে রেখে কার কথা বলবো! সিনিয়রদের সাথ নিজে পরিচিত হও আগে বাড়িয়ে, নাম জানো- নাম সহ ডাকো!
বুয়েটের সিনিয়র জুনিয়র সম্পর্ক কাজে লাগাও। লাভবান হবে তাতে। হলে আরামে থাকবে, বিভিন্ন উপলক্ষে বুফে নিদেনপক্ষে স্টারে খাওয়া পাবে। বিপদে সাহায্য পাবে। পরবর্তী চাকরি জীবনেও বিশাল উপকার। মনে রেখো বুয়েটের ছাত্ররা বেশিরভাগই কিন্তু বুয়েটের ছাত্রদের আন্ডারেই কাজ করে!
শিক্ষক:
অন্যদের কথা বলতে পারবোনা। আমাদের ইইই ফ্যাকাল্টির শিক্ষকের অসাধারণ। মার্কের কথা আলাদা- পড়ালেখা না করলে কেউ মার্ক দেয় না। কিন্তু মানুষ হিসেবে তারা খুব ভালো।
৪-১ এর এক ক্লাস টেস্টের খাতায় কবিতা লিখে দিয়েছিলাম। প্রশ্ন কমন পরে নি তাই। অনেক দিন পরে স্যার আমাকে বলছেন পলাশ, তোমার কবিতাটা পড়লাম-ভাল লেগেছে। আমি অবাক- স্যার কোন কবিতাটা? ঐ যে ক্লাস টেস্টের খাতায় যেটা লিখে দিয়েছ। ভাবলাম স্যার বোধহয় রেগে গিয়ে মজা করছে- আমি বললাম স্যার ভুল হয়ে গেছে- ফেল করিয়ে দিয়েন না। স্যার অবাক হলেন, বললেন- প্রশ্নই আসে না ওখানে আমি দশ মার্ক দিয়ে দিয়েছি।
এই স্যার আমাদের ৩-১ এ প্রজেক্টের ৭০ ভাগ কাজ নিজে করে দিয়েছেন, আমাদের চেয়েও বেশি খেটেছেন। ইলেকট্রিকালের সবার প্রিয় এই স্যারের নাম আব্দুল্লাহ আরাফাত- স্যারকে ধন্যবাদ!
আমাদের একটা ম্যাডাম আছেন, ল্যাবে- উনি সারাক্ষণ আমার স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবতেন। খারাপ স্বাস্থ্যের কারনে পড়তে পারিনা ঠিকমতো- এই ছিলো তার ধারনা। প্রতিদিন তিনি নিত্য নতুন পরামর্শ দিতেন এই খাও, ঐ করো। ম্যাডাম সব ছাত্রদের নিজের ছেলের মত ভালবাসতেন!
আমার থিসিস সুপারভাইজার ম্যাডাম আরেক অসাধারণ মানুষ। তার ছোট্ট একটা বেবি হয়েছে- তার জন্ম-উপলক্ষে আমি বেবিকে স্বরচিত একটা কবিতা উপহার দিয়েছি।
স্যারদের সাথে ভাল সম্পর্ক রাখবে, তাতেও অনেক সুবিধা পাবে।
বন্ধুত্ব:
স্কুল কলেজের বন্ধুত্বের সাথে ভার্সিটির বন্ধুত্বের পার্থক্য আছে। এই বন্ধুত্ব সারাজীবনেই থাকবে। এরাই ভবিষ্যতে তোমার সহকর্মী হবে। তাই বন্ধুত্বের ব্যাপারে সিরিয়াস থাকবে।
ক্লাসে যত কম গ্রুপিং করা যায় ততই ভালো। যদি অবধারিত ভাবেই লেভেল ২ এর সময় থেকে ক্লাসগুলোতে গ্রুপিং তৈরি হয়- সেটা যাতে রেষারেষিতে না ঠেকে সেই দিকে খেয়াল রাখবে। নিজের সার্কেলের বাইরের অন্যদের সাথেও ভাল সম্পর্ক রাখবে। ভাল নোট পেলে শেয়ার করবে। অন্যে ভাল রেজাল্ট করলে তোমার কোন ক্ষতি নেই।
গ্রাম থেকে যেসব ছেলেগুলো আসে তারা ইংরেজিতে দুর্বল থাকায় ইংরেজি বই পড়তে তাদের সমস্যা হয়- রেজাল্ট খারাপ করে। তার মানে এই নয় তারা ঢাকার ছেলেদের চেয়ে কম মেধাবী। এরা এত চটপটে থাকেনা, স্টাইল করে পোশাক পড়েনা, মাথায় হয়তো তেল চপচপে থাকে, তবুও তাদের অবহেলা করবে না। পড়ালেখায় সাহায্য করবে। এমনিতেই অচেনা ঢাকা শহরে তারা বেশ অসহায় থাকে, তাদের সাহায্য করবে। গ্রামের ছেলেগুলো সহজ সরল হয়, একটু পাশে থাকো-দেখবে তারাই তোমার সবচেয়ে ভাল বন্ধু হয়ে গিয়েছে।
ভার্সিটিতে পড়ার বাইরে অন্যতম একটা কাজ হবে নেটওয়ার্কিং। যত সম্ভব বেশি সংখ্যক মানুষের সাথে পরিচিত হয়, তাদের সাথে সম্পর্ক রাখো- অনেক কাজে লাগবে সেটা, বিশেষ করে যারা ব্যবসা করতে চাও ভবিষ্যতে।
টিউশনি:
যত কম করা যায় তত ভালো। না করতে পারলে আরো ভাল। প্রয়োজনীয় টাকার ব্যবস্থা হলে একাধিক টিউশনি করবেনা।
অল্প বয়সে কাচা টাকা মাথা নষ্ট করে, পড়ালেখায় আগ্রহ কমিয়ে দেয়। ছেলেরা পড়া ফাকি দিয়ে চার-পাচটা টিউশনি করে, সেই টাকা দিয়ে বাইক, ল্যাপি কিনে- কি হাস্যকর!
এবার একটু ইল্লজিকাল কথা বা কর্কশ কথা বলি।
অবশ্য অবশ্য প্রথম কাজ ভাল করে পড়ানো। ভাল পড়াতে না পারলে টিউশনি করো না।
পৃথিবী বড় স্বার্থ-বাজ লোকের আড্ডাখানা। আদায় করে নিতে না পারলে কেউ কিছু দেয় না। আদায় করে নিতে জানতে হবে।
টিউশনি যাদের বাসায়ই করাও তাদের মনে কখনো এই ধারনা জন্মাতে দেবে না যে তারা তোমার ওপর দয়া করছে। সারা ঢাকায় হাজার হাজার ছেলেমেয়ে আছে পড়ানোর মতো- বুয়েটের ছেলে অল্প কয়েকজন। তাদের বুঝিয়ে দাও তুমি সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে তাদের উলটো দয়া করছো, তার ছেলে বা মেয়েকে পড়িয়ে তাদের ধন্য করে দিচ্ছো। অড লাগছে কিন্তু এটার দরকার আছে।
ছাত্রদের ফ্যামিলির সাথে বেশি মাখামাখি না করাই ভাল। আদতে সবাই স্বার্থপর- স্বার্থ আদায় হলে দুম করে ভুলে যাবে। তারা টাকা দেয় তুমি পড়াও এই লেভেলেই সম্পর্ক রাখবে, এর বেশি কিছু দিতে পারো, একদিন বেশি পড়াতে পারো কিন্তু প্রত্যাশা বেশি করো না। পড়ানো শেষে সে যখন ভাল করবে তখন তোমাকে ফোন দিয়ে জানাবেও না!
টাকার ব্যাপারে লজ্জা করবেনা। একাধিক মাসের টাকা বাকি হতে দেবে না, স্পষ্টভাবে চাইবে- তোমার টাকা, তুমি চাইবে- লজ্জার কিছু নেই!
সবার উপরে নিজের সম্মান। টিউশনির অভাব নেই- একটা গেলে আরো আসবে। যে কোন মুহূর্তে বাজে টিউশনি ছেড়ে দেবার প্রস্তুতি রাখবে। ঢাকা শহরে প্রচুর উঠতি বড়লোক আছে, যাদের টাকা ছাড়া আর কিছুই নেই, ভদ্রতা, ভব্যতা নেই, ম্যানার জানে না!- এ ধরনের টিউশনি বর্জন করে চলবে।
বুয়েটিয়ান হিসেবে অলওয়েজ গর্বিত থাকবে! নিজের সম্মান সবার উপরে!
(অনেক ভাল মানুষও এই শহরে আছে, তারা মোটেই এরকম নয়। সব কিছুরই ব্যতিক্রম আছে, আমার অধিকাংশ টিউশনি এই ব্যতিক্রম, কিন্তু অন্য ডিপার্টমেন্টের বন্ধুদের ঘটনা গুলো অধিকাংশ উপরের মত)
পলিটিক্স:
বিদ্যমান পলিটিক্স থেকে একশ হাত দূরে থাকবে। তুমি পড়তে এসেছো এখন পড়ো, দেশ রক্ষার সময় শেষ হয়ে যাচ্ছেনা। সামনে সারা জীবন পরে আছে।
নেতৃত্বের বিকাশ চাও, যে কোন একটা ক্লাবে ঢুকে যাও। কাজ করো, দক্ষতা থাকলে জোর করে তোমাকে নেতা বানানো হবে। মারামারি কাড়াকাড়ি পা চাটাচাটি করতে হবেনা।
আনন্দ:
বুয়েট লাইফটা আসলে অনেক মজার। ক্লাস-টেস্টে বা সেশনালে স্যারের ধোলাই খেয়ে সবাই মিলে স্যারকে মুখের কথায় ধোলাই দিতে দিতেই হঠাৎ কেউ বলে চল নীলক্ষেত, তেহারি খাবো। কেউ বলে আরে না স্টারে চল- লেগ রোস্ট খাবো! মুহূর্তে সবাই ভুলে যায় আজকের সিটিতে কেউ পেয়েছে এক কেউ শূন্য এবং কাল আবার একটা সিটি আছে। স্টার থেকে ফিরে চলে ম্যুভি, টিউশনি। সবাই মিলে গুঁতাগুঁতি করে বসে ফুল ভলিউমে মুভি দেখার মজা আর কোথায় পাবে?
তারপরে টার্মের আগে পি এলে উলটা রূপ। সবাই মিলে আঁতেল হওয়া, ম্যুভি দেখা বন্ধ করে দিনরাত পরা। এভাবেই তো চলে আমাদের জীবন। হলটাই একসময় আমাদের পৃথিবী হয়ে যায়, বাড়িতে যেতে ভাল লাগেনা। কারো জন্মদিন তাকে না জানিয়ে বন্ধুরা কেক নিয়ে এসে সারপ্রাইজ দেয়ার মাঝে কি মজা তা আর কিছুতেই নেই!
তোমরাও মজা করবে, ডিইউ মেডিকেলের মেয়েদের সাথে ভাব মারবে। টি এস সি তে ঢু মারবে। বুয়েটের মেয়েদের ভাবের কাছে পাত্তা না পেয়ে আড়ালে আবডালে অসন্তোষ প্রকাশ করবে- এখন এতো ভাব, বিয়ে তো হবে ডিপ্লোমা টাক্লা অথবা প্রাইভেটের ছাগল কারো সাথে, এই বলে!
হলিক্রস, ভিকারুন্নেসার সুন্দরী ছাত্রী খুঁজবে। চাই কি প্রেম ও করতে পারো। চুপে চুপে সবাই করে, বাইরে বলে না। তুমিও লুকিয়ে লুকিয়ে করবে একটাই কিন্তু, বেশিনা। তবে হ্যাঁ কাউকে বলবে না!
ম্যুভি দেখবে সবাই মিলে।
সারা ঢাকা শহরে সব রেস্টুরেন্ট, ব্যুফেতে খাবে।
আবার নিয়মিত ক্লাস করবে, পিএল এ পড়বে কষ্ট করে।
দেখবে বুয়েট লাইফ কত মজার। এত মজা জীবনে কখনো করোনি আর করতেও পারবেনা। প্রতিটা মুহূর্ত এখানে উপভোগ করার চেষ্টা করো। ডিপার্টমেন্টের পিকনিক, ডে সহ অন্য যে কোন কাজে থাকবে। সবাই মিলে ঘুরতে যাবে। সাথে চলবে পড়ালেখা!
কিন্তু এমন কিছু করবেনা যা বুয়েটের ছাত্রদের মানায় না- যা আসলে কোন ভার্সিটির শিক্ষার্থীদের জন্যই মানানসই নয়।
পলাশীর দোকান থেকে চাঁদাবাজি, ক্যান্টিন থেকে ফাউ খাওয়া।
হলের লোকদের সাথে খারাপ ব্যবহার করা
রিকশাওয়ালাদের চড় মারা
গাড়ি ভাংচুর করা
ইভ-টিজিং করা!
বুয়েট এত কিছু দিচ্ছে, এই দাবি তো তোমাদের কাছে করতেই পারে!
আগামী দিনের ইঞ্জিনিয়াররা তোমাদের অভিনন্দন বুয়েটে ভর্তির সাফল্যের জন্যে। স্বাগতম বুয়েটে।
আমি আবেগপ্রবণ মানুষ। অল্পতেই খুব খুশি হয়ে যাই। নস্টালজিক হয়ে যাই। তোমাদের দেখলে আমার চারবছর আগের কথা মনে পরে যায়। আমিও তোমাদের মতই একসময় নতুন ছিলাম। যা দেখতাম তাতেই অবাক হতাম। হলের লোকেরা স্যার বলে ডাকে এতেই কত মুগ্ধ হতাম। এখন যখন তোমাদের মত ছোট ভাইবোনদের দেখি ক্যাম্পাসে আমি আবার সেই খানে ফিরে যাই তোমাদের ওপর ভর করে। তোমাদের আনন্দ আমাকে ছুঁয়ে যায়। আমি অনুভব করি। আমি চাই তোমরা সুখে থাকো, বুয়েটের আনন্দ উপভোগ করো। আমি তোমাদের জন্যে দোয়া করি!
তোমরা ভাল থাকো, সুন্দর থাকো। সুখে-আনন্দে থাকো।
মিজানুর রহমান পলাশ
ইইই-০৭
নজরুল ইসলাম হল
Facebook/logical.palash
(লেখাটা ফেসবুকেও নোট হিসেবে দেয়া হয়েছে!)
নজরুল হল! আহা!
যে সব বড় ভাইদের নাম বললে আদতে আমার তারা ছোটভাই! :love:
আমি এই লেখাটা পড়ে মুগ্ধ! বিশাল পরিমাণ মুগ্ধ! এই লেখাটা শুধু নতুন ব্যাচ না, সবার পড়া উচিত!
ভাইয়ার নাম ‘লাজুক’ ভাইয়া 🙂 ।
হয়েছে না? :thinking:
বুয়েট আইডি কার্ডের মতো পাওয়ারফুল আইডি কার্ড মনে হয় এই বয়সে পাওয়া যায় না। সবাই প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করে বুয়েটের ছাত্রকে। আর, তাদের ভালোবাসার কথা তো ছেড়েই দিলাম।
বুয়েট জীবনটাকে নতুন শিক্ষার্থীরা আপন করে নিক, এই কামনাই করি। তবে ভুল পথে না নিশ্চয়ই…… 🙂
এতদিন কোথায় ছিলা?!! আমরা ইবুক বের করতে চাইছিলাম পিচ্চিদের জন্য যেন ওরা ঠিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন চালাতে পারে।
চমৎকার লেখা।
ফেইসবুকিং নিয়ে একটা প্যারা করলে কেমন হতো?
আর টিউশনির একটা বিকল্প তৈরি করতে পারলে খুব ভালো হত!
চমৎকার লেখা!
আগামী দিনের গাইডলাইন হিসেবে কাজ করবে।
খুব খুব ভালো লাগলো।
আর কয়েকটা দিন আগে হলে ই-বুকটার জন্য এতো কষ্টই করতে হতো না। 🙁
ফেসবুকে একবার বলেছি, আবার বলি, অসাধারণ লেখা ভাইয়া। :happy:
এই মুহূর্তে ক্লাস শুরু হওয়া আর পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন নিয়ে আমাদের ১১ ব্যাচের ছেলে মেয়েদের এবং একই সাথে তাদের অভিভাবক দের চিন্তার অন্ত নেই। :thinking:
এই সময়ে এইরকম একটা লেখা খুব দরকার ছিল। এমনিতেই সবাই হতাশ হয়ে পড়ছে। কয়েকজন তো এমন ও বলছে যে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিক্যালে পরীক্ষা দেবে।যদিও কেউ ই সত্যিকার অর্থে দেবে বলে মনে হয় না। কিন্তু তাও শুনতে কিছুটা খারাপ ই লাগে। এই লেখাটা পড়ে সবাই যেন একবার নিজেদেরকে চার্জ করে নিল। এই চার্জ ক্লাস শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত থাকবে তো বটেই আমার মনে হয় পুরো বুয়েট লাইফেই থাকবে। :yahooo:
তাই আবারও, পুরো বুয়েট-১১ ব্যাচের পক্ষ থেকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। :clappinghands: :happy:
ভালো হয়েছে …………… :happy:
ভালোই লিখেছ।
একটা বস টাইপ লেখা হইছে! :huzur:
শুধু ১১ ব্যাচ? আমার মনে হয় সব ব্যাচ, এমন কি বুয়েটের না হলেও এই পোস্টটা মানুষের কাজে আসবে।
হতাশ বুয়েটিয়ানদের মনে আশার সঞ্চার করতেও এই পোস্ট সাহায্য করবে বলে আমার ধারণা। 😀
চমৎকার লেখা । 😀
খুব ভালো গাইডলাইন । :clappinghands:
বুয়েটে সেকেন্ড ইয়ারে উঠে গেলাম, এখনও একটা রাতও হলে থাকা হল না!! নিজেরে নিয়া ব্যাফুক হতাশা :crying:
ফেসবুকে এক ভাইয়া এই নোটটা শেয়ার করেছেন নেগেটিভ সেন্সে, উনার ব্যক্তিগত মতামত– এখানে অপ্রয়োজনীয় দম্ভ চলে এসেছে।
আমার কাছে কিন্তু মোটেই তা মনে হয়নি!
আমার মনে হয়, নিজের সম্মান ধরে রাখা যেমন অত্যাবশ্যকীয়, ঠিক তেমনি বাড়াবাড়ি অহংকার যেন হয়ে না যায় সেটাও দেখা দরকার। আসলে পুরোটাই নিজের কাছে। বাড়াবাড়ি করা তো রুচিশীল মানুষের কাজ না, এটা তো বলে দেয়ার কিছু নেই। এই নোটটা আমাদের ভার্সিটি লাইফ সম্পর্কে দারুণ সুন্দর করে বলছে, এটা আমাদের ভাল সেন্সেই উৎসাহিত করছে।
ধন্যবাদ! 😀
সুন্দর লিখা! শুধু ‘১১ ব্যাচ না, লেখাটা সবারই পড়া উচিত।
বুয়েটকে অনেক অনেক মিস করব 🙁
র্যাগিং নিয়ে আলাদা পয়েন্ট দেওয়া উচিত ছিল… :p
মাত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে তো !!
:babymonkey: