শিক্ষায় গুণগতমান এবং রাজনৈতিক অস্থিরতামুক্ত ক্যাম্পাসের জন্য সুপরিচিত বুয়েট তার সাম্প্রতিক অস্থিতিশীল অবস্থার ধারাবাহিকতা বজায় রেখে আবারো অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যতকে। সুদীর্ঘ পি,এল এবং টার্ম ফাইনাল পরবর্তী দীর্ঘ বন্ধের পর সকল ছাত্রছাত্রী যখন নবোদ্যমে ক্লাস শুরুর প্রতীক্ষায় অধীর আগ্রহে দিন গুনছে, তখন বুয়েটের প্রশাসন ও শিক্ষকদের মধ্যে মঞ্চায়িত হয়ে চলেছে অপরাজনীতির এক ন্যাক্কারজনক অধ্যায়। আর তাতে জিম্মি করা হয়েছে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাজীবনকেই।
কিন্তু কেন এই আন্দোলন? শিক্ষকদের দাবি কিংবা অভিযোগগুলো কী কী এবং সেগুলো কতটুকু যৌক্তিক? কতটুকু যৌক্তিক শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের বিরাট অংশের মতামতকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে ভিসি ও প্রো-ভিসি’র এই পদ আঁকড়ে পড়ে থাকা? শিক্ষার্থীদের ক্ষতি ব্যাতীত আর কোনো সমাধান কি ছিলো না? এই আলোচনা উপরোক্ত প্রশ্নগুলোরই যুক্তি ও বাস্তবসঙ্গত উত্তর খোঁজার প্রয়াসে।
গত ৪/৪/১২ তারিখে ‘উপ-উপাচার্য ও উপাচার্য নিয়োগের পর বুয়েটের সার্বিক পরিস্থিতি’ শিরোনাম ১৭টি(পরবর্তীতে ১৬টি) বিষয়ে শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রচারিত হয়। আলোচনাকে নাতিদীর্ঘ করতে এখানে প্রধান কয়েকটি বিষয় নিয়েই আলোচনা করছি।
শিক্ষকদের দাবীর অন্যতম একটি হচ্ছে কামাল আহম্মদ নামে একজন আওয়ামীপন্থীকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে ভূতাপেক্ষ নিয়োগদান। আর প্রশাসন বলছে, ‘কামাল আহম্মদ বিগত সরকারের সময় বারবার পদোন্নতির আবেদন করে বঞ্চিত হয়েছিলেন। তাই তাকে ভূতাপেক্ষে পদোন্নতি দিয়ে বঞ্চনা লাঘবের চেষ্টা করা হয়েছে। ভূতাপেক্ষ নিয়োগ অতীতেও হয়েছে, এতে নিয়মভঙ্গ হয় নি’। এখানেই প্রশ্ন আসে, বর্তমান প্রশাসনের কাজ কি আওয়ামী লীগের বঞ্চিত নেতাদের খেদমত করা?
অন্যদিকে শিক্ষক সমিতির উত্থাপিত প্রমাণাদি দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে, কামাল আহম্মদ যদি ভুতাপেক্ষ পদোন্নতি না পেতেন তাহলেও তিনি ২০১৪ সালে রেজিস্টার হতে পারতেন। কিন্তু লীগার হলেও তিনি বোধহয় আওয়ামী লীগের আবারো ক্ষমতায় আসার ব্যাপারে খুব একটা আশাবাদী নন! যাই হোক, রেজিস্টার এর মত ‘সইমারা’ পদের জন্য আমাদের একাডেমিক কার্যক্রম স্থগিত থাকাকে সমর্থন জানাতে পারছি না।
এখানেই আর একটা তথ্য জানিয়ে যাই, শিক্ষক সমিতির সভাপতি মজিবুর রহমান স্যার নিজেই ডিপার্টমেন্টে ১৭তম হয়েও রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ ও পরবর্তীতে অনেক সিনিয়র শিক্ষককে ডিঙ্গিয়ে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতিপ্রাপ্ত এবং যার ধারাবাহিকতায় বর্তমানে শিক্ষক সমিতির সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত হয়ে আছেন!
শিক্ষকদের আরেকটি অন্যতম অভিযোগ হচ্ছে, অহেতুক উপ-উপাচার্য পদ সৃষ্টি এবং উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য নিয়োগে রাজনৈতিক বিবেচনাকে প্রাধান্য দিয়ে জৈষ্ঠতা ভঙ্গ করা। আর এ বিষয়ে প্রশাসন বলছে, “এটি সরকার নিয়োগ করে থাকেন। এই নিয়োগের বিধানে সিনিয়র-জুনিয়র কথা উল্লেখ নেই।” কিন্তু এটি কিভাবে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান দুইজন প্রশাসকের নিয়োগের বিধিমালা হয়। বুয়েটের মতো একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোনোভাবে রাজনৈতিক সরকারগুলোর স্বেচ্ছাচারিতার স্থান হোক, এটা কিছুতেই কাম্য নয়। কিন্তু, এই জিনিসটাই বিগত ২০-৩০বছর ধরে চলে আসছে বুয়েটের উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে।
শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের কাছে আমার দাবি থাকবে, শুধু ভিসি-প্রোভিসির পদত্যাগ নয়; আপনারা জেষ্ঠ্যতার ভিত্তিতে ভিসি-প্রোভিসি নিয়োগে আইন প্রণয়নেরও দাবী তুলুন, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনোদিন কোনো রাজনৈতিক সরকার আমার প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়কে তার খেয়ালখুশির দাস বানাতে না পারে।
শুনেছি, যে যায় লংকায়, সেই হয় রাবণ। আর বুয়েটে ঘটে তার উল্টোটা। রাবণেরা সিংহাসনে বসে মেধাসমৃদ্ধ বুয়েটকে পরিণত করে রাক্ষুসে লংকায়। একজন সনির গুলিবিদ্ধ নিথর শরীরও তাদের এতটুকু টলাতে পারে না। তারা অবলীলায় আশ্রয় দেয় মুকি’দেরকে, অবলীলায় পুলিশ লেলিয়ে দেয় বোনের খুনিদের বিচারের দাবীতে অনশনরত শিক্ষার্থীদের উপর; শুধুমাত্র তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতেই।
উপ-উপাচার্য প্রসঙ্গে আরেকটি কথা, মোঃ হাবিবুর রহমান স্যার নাকি এই পদে আসার আগে পরপর তিনবার শিক্ষক সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। কেন স্যার? কেন আপনারা পরপর তিনবার এই লীগঘেঁষা, অযোগ্য লোকটাকেই ভোট দিয়ে গেলেন? আর কেউই কি ছিল না? তাঁর এই আজকের অবস্থানের জন্য আপনারাও কি দায়ী নন?
শিক্ষকদের অপর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ হচ্ছে রেজাল্ট ইঞ্জিনিয়ারিং, যার প্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষ বলছে, এটা ডিজিটাল ভুল! অন্যদিকে আরেকটি অভিযোগ হচ্ছে, একজন ছাত্রলীগকর্মীর ফেল করা কোর্স উইথড্র করা, যেখানে অন্য একজন সাধারণ ছাত্রের ক্ষেত্রে একই আবেদন গৃহীত হয় নি; যেটিকে উপাচার্য এর বিশেষ ক্ষমতার এখতিয়ারভূত বলে দাবি করেছে বুয়েট প্রশাসন। আর এখানেই আমার আপত্তি। যেখানেই এইধরণের বিশেষ ক্ষমতার উল্লেখ, সেখানেই দেখা যায় স্বেচ্ছাচারিতা। এমনকি এইধরণের সর্বময় ক্ষমতায় রাষ্টপতি ফাঁসির আসামীকেও বেকসুর খালাস করে দিচ্ছে। আর তাই শুধু একটি ঘটনার নয়, সময় এসেছে এইসব স্বেচ্ছাচারী আইনের সমূলে বিলুপ্তির।
*
ছাত্ররাজনীতি বুয়েটের ইতিহাসে নতুন নয়। কালে কালে এর প্রায় সবরকম রূপই মঞ্চায়িত হয়েছে এই ছোট্ট বুয়েট ক্যাম্পাসে। সেই সনি হত্যা পূর্ব মুকি’দের অস্ত্রের রাজনীতি, পরবর্তীতে ফ্রন্ট ও লীগের যুগপৎ সন্ত্রাস বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সুষ্ঠরাজনীতির পরিবেশ ফিরে আসা এবং ২০০৮ নির্বাচনের পরে পুনরায় অস্থিরতার বাতাস বইতে শুরু হওয়া। এই বুয়েট ক্যাম্পাসেই দেখেছি ঘনিষ্ঠ বড়ভাই গৌতমদা’কে রক্তাক্ত হতে, ঈশানের মতো মেধাবী ছেলেকে ভাঙ্গা হাত-পা নিয়ে হাসপাতালের বেডে পরে থাকতে, দেখেছি লিমন নামের এক অকালপক্ক রাজনীতিকের ক্ষমতার বাহাদুরি।
তবু আশার কথা, শাস্তি হয়েছে ঈশানের উপর হামলাকারীদের, গ্রেফতার করা হয়েছে দুর্বিনীত লিমনকেও। এবং একজন আন্দোলন মাঠের একজন হিসেবে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করবো অজস্র প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আন্দোলনকারীদের প্রতি সমর্থন জানানো লীগেরই কয়েকজনের প্রতি। এরা হয়তো সংখ্যায় কম, অনেকেই হয়তো সরাসরি পাশে এসে দাঁড়াতে পারে নি কিংবা এরা হয়তো ব্যাচগত কারণেই পাশে দাঁড়িয়েছিলো, তবু এদের কারণেই ঠেকিয়ে রাখা গিয়েছিলো সুজিত-মিঠুন এর সহযোগীদেরকে। আশা করি এরাও নষ্ট হয়ে যাবে না। কারণ অপ্রিয় হলেও সত্য যে, ছাত্রদের রাজনৈতিকত সচেতনতা দরকার। কেননা, ভালোরা যদি রাজনীতিবিমুখ হয়, তাহলে প্রতিনিয়ত এই অসৎ রাজনীতিকে ভরা অকথ্য গালাগালির সংসদই দেখে যেতে হবে, যেটা কখনোই কাম্য হতে পারে না। আর তাই, নিজে না করতে পারলেও যারা ছাত্ররাজনীতির এই কালোস্রোতের মাঝে নীতি ও আদর্শের হাল ধরে আছে তাদের প্রতি ধন্যবাদ জানাতে এতটুকু কার্পণ্য নেই।
*
অনেকেই বলে থাকেন বুয়েটেতো লাল, নীল, সাদা দল নেই। তাহলে শিক্ষকদের আবার রাজনৈতিক স্বার্থ কি? হ্যাঁ, বুয়েটে কোনো রঙ নেই, কিন্তু শিক্ষকদেরও দল আছে। এখানে যেমন লীগার আছে, তেমনি আছে দল, আছে জামাতপন্থী।
সম্প্রতি, ফেসবুক ও ব্লগ মারফত জানা যায় যে, হাফিজুর রহমান রানা নামে ’০৪ ব্যাচ থেকে শিক্ষক হওয়া মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্টের একজন লেকচারারকে তারই হলের গেস্টরুমে ডেকে এনে হুমকি দিয়েছে ‘শ’ ও ‘র’ আদ্যাক্ষরের দুই ছাত্রলীগকর্মী। শুনেতো অবাক। সিনিয়র শিক্ষকেরা যেখানে আন্দোলনের নেতৃত্বে, সেখানে এত জুনিয়র একজন শিক্ষক কী এমন করলো যে, তাঁকে হলে এসে হুমকি দিয়ে যেতে হবে?
বিস্তারিত খবর নিয়ে জানতে পারি, ঘটনার সূত্রপাত মূলত একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে। সেই স্টাটাসে রানা স্যার লিখেছিলেন, “হায়েনা ওই হায়েনা তুই দেশকে খেয়েছিস, এখন বুয়েট কে খাবি…পারবি না !!!! আমরা বুয়েটের শিক্ষকরা ও সাধারন ছাত্র-ছাত্রীরা হচ্ছি শিকারী…। প্রথমে তোর মাথাতে গুলি করবো, তারপর তোর পেটে…। তারপর মাথা কেটে বুয়েট এর গেটের সামনে টানিয়ে রাখব…যাতে পরে আর কোনো হায়েনার আক্রমণে বুয়েট আক্রান্ত না…… 😛 😛 ” ছাত্রলীগ এই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশটটি হলে হলে প্রচার করেছে এবং দাবি করেছে যে এই স্ট্যাটাসটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’কে উদ্দেশ্য করেই দেওয়া। যদিও এই দাবির সত্যতা প্রশ্ন সাপেক্ষ, তবু বিস্মিত হই যখন দেখি যে, রানা স্যার একসময় বুয়েট ছাত্রদলের আহসানউল্লা হল শাখার সহ-সভাপতি ছিলেন এবং বর্তমানে শিক্ষক সমিতির আপ্যায়ন সম্পাদক পদে নিয়োজিত আছেন!!! এত একজন জুনিয়র একজন শিক্ষকের শিক্ষক সমিতির পদে যাওয়া চমকিত হবার মতোই বৈ কি!
কিন্তু তবুও, একজন শিক্ষককে তার হলে গিয়ে হুমকি দেওয়া কোনোভাবেই সমর্থন যোগ্য নয়। আর তাই, শিক্ষকদের নিরাপত্তা বিধানে এ ঘটনার যথাযথ অনুসন্ধান আবশ্যক বলেই মনে করি।
*
বর্তমান শিক্ষক আন্দোলনের জন্য ক্লাস শুরু না হওয়ায় বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখে অনেকেই বলেছেন যে, যখন ছাত্ররা একের পর এক পরীক্ষা পিছাও তখন এই চিন্তা থাকে না? এখন শিক্ষকরা আন্দোলন করছে দেখেই একেবারে ক্লাস করার জন্য অধীর হয়ে গেলে?
শুনতে অবাক লাগলেও সত্য যে বুয়েটের পরীক্ষা সাধারণ ছাত্ররা পিছায় না। প্রকৃতপক্ষে, বুয়েটের পরীক্ষা পেছাতে খুব বেশি মানুষের দরকারও পড়ে না। বড়জোর দশজন ২য় কিংবা ৩য়বর্ষের ছাত্রের অংশগ্রহণই এখানে যথেষ্ঠ। এদের ডাকে মোস্ট জুনিয়র ব্যাচ তো আসবেই। আর এই দশ ছাত্ররা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো প্রভাবশালী শিক্ষকের ঘনিষ্ঠ এবং তাদের আহবানেই মাঠে নামে। একদিকে এদেরকে দিয়ে মিছিল করিয়ে এবং অন্যদিকে শিক্ষকদের মধ্যে নিজের বাগ্মিতাকে কাজে লাগিয়ে পরীক্ষা পেছানোর আদেশ বের করেন প্রাইভেট ভার্সিটি ও কন্সালটেন্সি-প্রাণ এই শিক্ষকেরাই। আর দোষ দেন ছাত্রদের টিউশন-প্রবণতার, খামখেয়ালীর। আর তাই দেখবেন, বুয়েটের ক্লাসরুমগুলো শিক্ষক-ছাত্রছাত্রীশূন্য পড়ে থাকলেও যথারীতি সরগরমই আছে BRTC আর বুয়েট কর্তৃক দেয়া শিক্ষকদের ব্যক্তিগত রূমগুলো।
*
অনেক কথা বললাম। সবকথা হয়তো সবার ভালো নাও লাগতে পারে। তবু একজন বুয়েটিয়ান হিসেবে নিজের কাছে দায়মুক্তির অন্য কোনো উপায় আপাতত আমার হাতে নেই। হয়তো আমি প্রতিদিন প্রতিটা ক্লাস করতে পারি না। হয়তো আমার রেজাল্ট খুব একটা ভালো নয়, হয়তো আমাকে বিদেশ গিয়ে ৪বছরের কোর্স ৬বছরে শেষ করার জন্য কারো টিজিং এর শিকার হতে হবে না; কিন্তু তবুও আমি আর দশজন বুয়েটিয়ানের মতোই চাই যে, বুয়েটের শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত থাকুক, ভালো থাকুক বুয়েটের পরিবেশ, অটুট থাকুক বুয়েটের সুনাম।
শিক্ষকদের প্রায় বেশীরভাগ দাবীর প্রতি আমিও সমর্থন জানাই। আমিও চাই অবসান ঘটুক দূর্নীতি ও অস্বচ্ছতার; নিশ্চিত হোক সুস্থ, সুষ্ঠ ও স্বচ্ছ ব্যবস্থা। কিন্তু সেটার জন্য যেন আমাদের শিক্ষাজীবন ক্ষতিগ্রস্থ না হয়; যেন দীর্ঘায়িত না হয় আমার শ্রমজীবী বাবার অপেক্ষা- তাঁর সন্তানের চাকরীর জন্যে, একটু স্বাচ্ছন্দে থাকার জন্যে।
আর আন্দোলনের বিকল্প উপায় খুঁজতে খুব বেশী দূরে যাবারও দরকার আছে বলে মনে করি না। কুয়েটের শিক্ষকেরাও আন্দোলন করছেন এবং সেটা ছাত্রছাত্রীদের ক্যারিয়ারকে বাধাগ্রস্থ না করেই। তারা একদিকে একডেমিক কার্যক্রমকে অব্যাহত রাখছেন এবং অন্যদিকে প্রতিদিন একঘন্টা কর্মবিরতির মধ্য দিয়ে চলমান রয়েছে তাঁদের আন্দোলনও।
*
পরিশেষে শেষ করছি, ভিসি ও প্রো-ভিসি’র প্রতি একটি অনুরোধ দিয়ে। ঈশানের উপর হামলার প্রতিবাদে মাঠে নেমেছিলো পুরো বুয়েট। সেখানে না ছিলো কারো ব্যক্তিগত নেতৃত্ব, না ছিলো ভিসি-প্রোভিসি’র প্রতি কোনো ব্যক্তিগত ক্ষোভ। যা কিছু করা হয়েছে, আন্দোলনের স্বার্থেই। তাই ওই ইস্যুতে কয়েকজন ছাত্রকে বিচ্ছিন্নভাবে দোষীসাব্যস্ত করে এবং তাদের রেজাল্টশীট আটকে তাদের কর্মজীবনকে বাধাগ্রস্থ না করার আন্তরিক অনুরোধ জানাই।
– অন্যরকম
একটাই প্রার্থনা, বুয়েট যেন সেই চিরচেনা রূপে ফিরে আসে, আর কিচ্ছু চাই না……
🙁
অন্যস্বরের পোস্টগুলো অনিয়মিত ব্লগাররা দিয়ে থাকেন। এই পোস্টটি যিনি দিয়েছেন তিনি নিজেকে একজন বুয়েটিয়ান দাবী করেছেন।
পুরো পোস্টটি পড়ে এর মূলকথাটুকু উদ্ধার করতে পারলাম না। কেবল ক্লাস করতে অতি-আগ্রহী কিছু পাশ কাটানো ছাত্রের আর্তি বলেই মনে হলো। তবে শতকরা ৯৯জন বুয়েট ছাত্রের আর্তি যে এর বিপরীত, তা যে কেউ বুঝতে পারবে, সার্বিক পরিস্থিতি বিচার করে।
বুয়েটের পরিস্থিতি বোঝার জন্য সাধারণ একজন ছাত্রকে বেদমভাবে মেরে হাসপাতালে পাঠানোর ঘটনা বলাই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু, যখন দেখি, সেটার বিরুদ্ধে ভিসির অফিসের সামনে অবস্থান-আন্দোলনের মত শান্তিপূর্ণ আন্দোলন যারা করেছে, তাদের ১৬জনের রেজাল্ট আটকে দেয়া হয়েছে।
এটার পরও এই ঘটনাকে কেবল “না করার আন্তরিক অনুরোধ জানাই” বলে, সে সব ছাত্রের সমস্ত কষ্টকে এক কথায় মূল্যহীন করে দেয়া হয়েছে। আবার সাথে সাথে হিরো দেখানো হয়েছে, কিছু রাজনৈতিক ছাত্রকে যাদের ধনুক ভাংগা প্রাণপণ প্রচেষ্টায় “ঠেকিয়ে রাখা গিয়েছিলো সুজিত-মিঠুন এর সহযোগীদেরকে”।
এটাকে বুয়েটিয়ানদের সেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের প্রতি অপমান ছুঁড়ে দেয়া হয়েছে বলে মনে করছি।
১৬জনের রেজাল্ট আটকে দেবার মাধ্যমেই বুঝে নেওয়া উচিত, তখনকার আংশিক সফলতা ছিল নিছক লোকদেখানো কিংবা ঠেকায় পড়ে। এবং সেসব রাজনৈতিক ছাত্র এতে অংশ নিয়ে তথাকথিত ‘হিরো’ হয়ে গিয়েছেন, তারা লেলিয়ে দেওয়া গুপ্তচর ছাড়া আর কিছুই নয়।
একদিকে ছাত্রদের অধিকার আদায়ের পক্ষে যারা কাজ করেছে, রাজনৈতিক আঘাতের ভয় সত্ত্বেও, তাদেরকে এখন শুলে চড়ানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আর অন্যদিকে, কেবল রাজনীতি করে বলে, একজন ছাত্র রেজাল্ট পরিবর্তনের মত সুবিধা পাচ্ছে। এটা কি মগের মুল্লুক?
কানাঘুষা শোনা যায়, নতুন ছাত্রদেরকে গণরুমে থাকতে দেয়া হচ্ছে না। এবং, তাদেরকে ক্ষমতাশীন রাজনীতির সাথে যুক্ত হতে প্রলোভন দেয়া হচ্ছে। (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত করে)
এত কিছুর পরও, চরম আ্শাবাদী একটা পোস্ট এটা। “কামালউদ্দীনের” ব্যপারে সহ আরও বিভিন্ন কথায় বোঝা যাচ্ছে যে, পোস্টের লেখক বুয়েট প্রশাসনের বেশ ভেতরকার খবরও জানেন। শুধু জানেন না, বোঝেন, বুয়েট প্রশাসনকে খুব ঠেকায় পড়ে “আওয়ামী লীগের বঞ্চিত নেতাদের খেদমত” করতে ই এত বাজে কাজগুলো করতে হচ্ছে।
এবং, খুব সম্ভবত, বুয়েটের সাধারণ(!) ছাত্রদেরকেও বুয়েটের দেয়ালে দেয়ালে ছড়ানো প্রপাগান্ডা পোস্টার দিতে হচ্ছে একই কারণে।
এই পোস্টটাকে কি,পরোক্ষভাবে সেই একই উদ্দেশ্যের একটা পোস্ট বলা যায় না?
একটু সংশোধন আনেন। মজিবুর রহমান স্যার তাঁর ব্যাচের ৭ম ছিলেন।
https://docs.google.com/file/d/0Bw9L8u1UNM8LcE1PVFV4M2VHdGs/edit?pli=1
সময় এসেছে এইসব স্বেচ্ছাচারী আইনের সমূলে বিলুপ্তির।
সেটা কীভাবে হবে। এই একটাই প্রশ্ন রইল আপনার কাছে।
অত্যন্ত যুক্তি
খুবই ভালো লেখা। কিন্তু কিছু বিষয়ের সাথে একেবারেই একমত পোষণ করতে পারছিনা। রেজিস্ট্রার কখনই ‘সইমারা’ পদ নয়। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি, প্রো-ভিসি এর পর গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোর একটি এই রেজিস্ট্রার। ছাত্রছাত্রী এমনকি শিক্ষকদের কাগজপত্রও রেজিস্ট্রার এই অফিস হয়ে যায় ভিসির অফিসে। দেখুন না, কামাল আহম্মদকে নিয়োগ দিতে প্রশাসন কি পরিমান মরিয়া।
ভিসি, প্রো-ভিসি নিয়োগে এবং বিশেষায়িত ক্ষমতা প্রদানের বিষয়ে নীতিমালা পরিবর্তনের প্রস্তাব অত্যন্ত যুক্তিসংগত। তবে এই মুহুর্তে আন্দোলনের স্বার্থে শিক্ষক সমিতি যে এক দফার আন্দোলনে আছেন তা গুরুত্বপুর্ণ। এ কারনে আন্দোলন অনেক focused থাকবে। এই focus সরানো এই মুহুর্তে ঠিক হবেনা।
একটা বিষয় অনেকেই আমলে নিচ্ছেন না এই আন্দোলন আসলে ৭ই এপ্রিল থেকে হচ্ছেনা, বরং গত বছর দুয়েক ধরেই স্যাররা বিভিন্ন সময় নানা রকম প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছেন, যা তারা সঙ্গত কারনেই ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে যথাসম্ভব গোপন রেখেছেন। এর আগের বারের কর্মবিরতি হয়েছিল ছুটির সময় যে কারনে অনেকেই বিষয়টা জানেন না। স্যারদের ক্লাস বর্জন আবশ্যই অত্যন্ত ক্ষতিকর, কিন্তু এক বারো চিন্তা করেছেন কেন তারা এই ধরনের একটা স্টেপ নিলেন? আমি খুব ঘনিষ্টভাবে এক জন বুয়েট শিক্ষকের সাথে থাকার কারনে দেখেছি ছাত্রছাত্রীদের জন্য তাদের কি পরিমান দায়িত্ববোধ কাজ করে। প্রতিটা সেমিস্টার চলাকালীন সময়ে লেকচার তৈরী থেকে শুরু করে, ক্লাস নেয়া, পরীক্ষা নেয়া, সেশনাল নেয়া, প্রশাসনিক কাজ করে তাদের পরিবার পরিজনদের সময় দেয়াই কঠিন হয়ে পড়ে। আর সেমিস্টার শেষ হলে তো রেজাল্ট হবার আগ পর্যন্ত তাদের প্রচন্ড খাটতে হয়। তারপর যখন কেউ খারাপ করে, তখন তারা বলেন না ‘পড়াশোনা করে নাই’, আফসোস করেন ‘ঠিক মত বোঝাতে পারি নাই মনে হয়’। Consultancy নিয়েও আপনার মধ্যে (অন্য অনেকের মত) একটা ভুল ধারনা আছে। consultancy মূলত BUET করে (as an institution)। বুয়েট নিয়োগ দেয় শিক্ষকদের পরামর্শক হিসাবে। বিনিময়ে তারা বুয়েট থেকে একটা পারিশ্রমিক পান (যার প্রায় ৩০-৫০% বুয়েট কেটে রাখে যেহেতু বুয়েট কাজটি সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় infrastructure provide করে। এই consultancy থেকে বুয়েটের কি পরিমাণ লাভ হয় তা একটু চিন্তা করে দেখেন প্লীজ। এই উপকার তো আপনার প্রয়োজনেই ব্যয় হয়। আমাকে বুয়েটের এক জন স্যার এর উদাহরণ দিন যিনি consultancy করতে গিয়ে ক্লাসে ১০ মিনিট দেরীতে আসেন। consultancy কোন সমস্যাই না। আর BRTC এর বেশীরভাগ কাজ সংশ্লিষ্ট client এর সাথে চুক্তির মাধ্যমে করা। একারনে কাজ বন্ধ রাখতে গেলে আইনী জটিলতায় পড়ার একটা সম্ভাবনা থাকে।
এবার চিন্তা করে দেখেন কেন স্যার এত concern হবার পরেও ক্লাস বর্জনের মত কর্মকান্ডে গেলেন। আমি ছোট্ট একটা উদাহরন দিয়ে বলি। আপনি যথার্থই বলেছেন বুয়েটের পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলন করে গুটিকয়েক ছাত্রছাত্রী। আমি ছাত্র থাকাকালীন বিশ্বকাপ খেলাকে কেন্দ্র করে পরীক্ষা পেছানোর যে আন্দোলন হয় তা দেখেছি, পরীক্ষা দেবার জন্য একটা বিশাল অংশ আন্দোলন করলেও পরীক্ষা পিছিয়ে যায়, ওই প্রশাসনের মদদেই। এই ধরনের practice বন্ধ যদি করতে চান তাহলে শিক্ষক সমিতির বর্তমান আন্দোলনের কোন বিকল্প নেই। স্যাররা কোন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করতে আন্দোলন করছেন না। তাদের আন্দোলন আর অনেক বেশী গুরুত্ববহ। এই আন্দোলনের অন্যতম উদ্দেশ্য আপনার স্বার্থ রক্ষা করা। কিভাবে? JIDPUS এ যেভাবে নিয়োগ হয়েছে তা যদি নিয়মে পরিনত হয় তাহলে আপনি বিভাগের সর্বোচ্চ ফলাফল এর মালিক হলেও শিক্ষক নিয়োগের সময় ধরা খেয়ে যেতে পারেন। আবার সর্বোচ্চ ফলাফল deserve করেও ধরা খেতে পারেন, যদি কারো ফলাফল পরিবর্তন করে A+ দিয়ে দেওয়া হয়। যারা বলছেন বুয়েটের পোলাপাইন তো পরীক্ষা পেছায়, এখন এত concerned কেন? তারা ভুলভাবে ভুল যুক্তি দিচ্ছেন। ক্লাস শুরু করা অবশ্যি গুরুত্বপূর্ন। কিন্তু ভবিষ্যতের কথাও একটু চিন্তা করে দেখেন।
একটি লেখায় পড়েছি “এই ভিসি-প্রোভিসি সারা জীবন বুয়েটে থাকবেন না। তবে যে ধরনের practice তারা তৈরী করেছেন বা করছেন তাতে সবচেয়ে লাভ তো শিক্ষকদেরি হওয়া উচিৎ। তারা পরবর্তীতে চাইলে রাজনৈতিক বা অন্য কোন প্রভাব খাটিয়ে বুয়েটে তাদের আত্মীয় স্বজন বা পছন্দের ব্যক্তিদের টিচার বা কর্মচারী হিসাবে নিয়োগ, পদন্নোতি ইত্যাদি দিতে পারবেন। শুধু তদবিরের অপেক্ষা। তাদের consultancy তেও কোন সমস্যা হবে না। তবুও তারা কেন আন্দোলন করছেন? তাদের স্বার্থ আসলে কোথায়? এই আন্দোলন শুরু হবার পর থেকে অনেক সরব স্যার ক্রমাগত বিভিন্ন রকম হুমকির সম্মুখীন হচ্ছেন। কখনো ফোনে, কখনো সশরীরে। তবুও তারা সরব, কেন? কি দরকার ছিল তাদের এত কষ্ট করার? ভিসি ছাত্রদের রেজাল্ট পরিবর্তন করুক, তারা তো নিয়মিত ক্লাস নিয়ে, consultancy করে, বিভিন্ন ভাবে নিজেদের জন্য সুবিধা নিয়ে খুব আরামে জীবন কাটিয়ে দিতে পারেন। ছাত্রদের কাছে যাদের অবস্থান হওয়া উচিত সম্মান আর শ্রদ্ধার তারা সেই ছাত্র দের কাছেই অপদস্থ হচ্ছেন নিজেদের আবাসেই (হাফিজুর রহমান রানার কাহিনী নিশ্চয়ই কমবেশী সবাই জানি, আরও আছে না জানা অনেক কাহিনী)”। খুবই সত্য কথা। আমার চেনা অনেক স্যার সন্ধ্যার পর বাইরে বের হননা। অনেকে পরিবার পরিজনদের বাড়িতে রেখে এসেছেন, বাচ্চাদের স্কুলে যেতে দিতে ভয় পাচ্ছেন হুমকির কারনে। বুঝুন অবস্থা।
বুয়েট প্রশাসন স্যারদের আন্দোলন (যা আসলে হওয়া উচিৎ সকলের আন্দোলন) প্রতিরোধ করার জন্য একে একটি রাজনৈতিক flavor দেয়ার চেষ্টা করছেন। প্লীজ এই ফাঁদে পা দেবেন না। রানা স্যার যে দলই করুন তিনি যে আন্দোলন করছেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং রাজনৈতিক আবরণের বাইরে। একইভাবে শিক্ষক সমিতিতে অনেক শিক্ষক আছেন যাদের রাজনৈতিক allegiance ভিসি স্যার এর সাথে মিলে যাবে। কিন্তু আন্দোলনে আছেন একটা greater উদ্দেশ্য নিয়ে। প্লীজ এটাকে demoralize করবেননা। কারন এই যাত্রায় যদি বুয়েট রক্ষা না পায় তাহলে আর কখনোই পাবেনা। This is the final stand…..please be with it. যদি দূর্নীতি ও অস্বচ্ছতার আবসান চান, মাঠে আসুন। এটা এখন আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন।
*বুয়েট থেকে সব রকম দূর্নীতি দূর করা হোক।
*প্রশাসনের সব পদে নিয়োগ স্বচ্ছ হোক।
*পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলন দু-একবার না মানলেই পরে আর আন্দোলন হবে না। পরীক্ষা পেছানো বন্ধ হোক।
*বুয়েটের শিক্ষকরা অন্য কোথাও ক্লাস বা কন্সালটেন্সি করার জন্য বুয়েটে পরীক্ষা পেছানো সমর্থন করেন-এটা মানতে পারছি না।
*কারো ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য বুয়েটের ব্যবহার বন্ধ হোক।