পেসমেকার

অফিসে আজকে প্রচন্ড ব্যস্ততা। ডেলিভারী আছে। ঘড়িতে বাজে আটটা ত্রিশ। আমার পুরো টিম এখনো অফিসে। রকি আর আমি ডেলিভারী দিচ্ছি, বাকী পোলাপান পুলরুমে। এই সময় মোবাইল ভাইব্রেট করল, মেসেজ আসছে। নির্ঘাত বাংলালিংকের মেসেজ। ধুর শালা, চরম বিরক্ত হয়ে মোবাইল বের করে দেখি, “আই ওয়ান্না চ্যাট উইথ ইউ, আর ইউ ফ্রি? – সামান্থা।” রক্তের মধ্যে কোথায় যেন একটা অ্যাডভেঞ্চারের নেশা জেগে উঠল। মনে মনে বলি, সা-মা-ন্থা, ওয়াও, নাইস নেইম। রকিকে ডাটাবেজ ব্যাকআপ নিতে বলে পাশের রুমে চলে গেলাম। হুম কি রিপ্লাই দেয়া যায়? লিখলাম, ডেলিভারী নিয়ে বিজি। দুই ঘন্টার মধ্যে কল করব। উত্তেজনা নিয়ে কাজে ব্যাক করি। দুই ঘন্টায় যেই বাগ সলভ করতে পারছিলাম না, সেটা দশমিনিটের মধ্যে ধরে ফেললাম। এর মধ্যে মেসেজ আসছে, “আই এম ওয়েটিং…”। এক ঘন্টার আগে ডেলিভারী পুরো শেষ করে অফিসে থেকে বেরিয়ে সোজা গাড়ীতে। “কালাম, কফি শপের দিকে যাও”।

–    হ্যালো।
–    হাই।
–    হাই, আমি সাকিব। তুমি কি আমাকে জানো?
–    উমমম, নোপ। আই রিড ইউর ব্লগ।
–    ওহ রিয়েলি? থ্যাঙ্কস।
–    ওখানে আপনি লিখেছেন, “এই গল্প ভরা রাতে, কিছু স্বপ্ন মাখা নীল নীল হাতে, বেপরোয়া কিছু উচ্ছ্বাস নিয়ে, অপেক্ষায় … “ আপনি কি এখনো কারো অপেক্ষায় আছেন? সার্চিং সামওয়ান স্পেশাল?

হঠাত করে কথা খুঁজে পাইনা। সুমনার মিষ্টি মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সে নিশ্চয়ই আমার জন্য বসে আছে না খেয়ে। কি বলবো এখন এই মেয়েকে?

–    হ্যালো, ক্যান ইউ হিয়ার মি?
–    ইয়েস ইয়েস।
–    আপনি কি এখনো কাউকে খুঁজছেন?
–    হুমম, সেই অর্থে আসলে এখন আর খুঁজি না। স্বপ্নকন্যারা বাস্তবে আসে না, তারা কল্পনার রাজ্যেই ভাল থাকুক।
–    আই সি। এনিওয়ে, আমি আপনার সাথে দেখা করতে চাই। আপনার সময় হবে?
–    কেন দেখা করতে চান?
–    হিহিহি। আমি আমার ভ্যাম্পায়ারকে খুঁজছি। কে জানে আপনাকে আমার ভালও লেগে যেতে পারে, তখন আপনি হবেন পৃথিবীর সবথেকে সৌভাগ্যবান পুরুষ!
–    হাহাহা, তোমার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে তুমি অনেক ইমম্যাচিউরড। তুমি কি স্টুডেন্ট নাকি জবে ঢুকেছ মাত্র?
–    খিকজ! আমি মেডিকেল ফার্স্ট ইয়ার। আর আপনি?
–    অনলি ফার্স্ট ইয়ার!! তুমি তো অনেক ছোট।
–    কেন আপনি কি খুব বুড়ো?
নিজেকে আর যাই হোক বুড়ো ভাবতে ভাল লাগে না। আমি বয়স কমিয়ে বলে দেই।
–    আমি তোমার থেকে কমপক্ষে দশ বছর বড় হব।
–    আহ, দশ বছর! তবে আমার কোন প্রবলেম নেই, আমি দেখা করতে চাই।
বলে কি এই মেয়ে, এর মাথায় গন্ডগোল আছে নির্ঘাত। দশ বছরে সমস্যা নাই তার। আমার আসল বয়স তো বলিই নাই।
–    ঠিক আছে দেখা হবে। তার আগে তুমি আমাকে ফেইসবুকে অ্যাড করো। আমাকে দেখ।
–    উমম, আমি মনে হয় আপনাকে দেখেছি। আমি আপনার ফেইসবুকে অনেক দিন ধরেই আছি। কথা হয়নি কখনো।
–    ওহ আচ্ছা! ঠিক আছে কথা হবে পরে। আমি এখন বাসায় ফিরছি।
–    ওকে বাই।

মেয়েটি ফোন রেখে দিয়েছে। বাসায় ফিরতে ফিরতে উথাল পাথাল ভাবি। কোথা থেকে এই অবেলায় সে আসল, কেন আসল? মাত্র মেডিকেল ফার্স্ট ইয়ার, মানে বয়স ঊনিশ। আর আমার হল ছত্রিশ। দ্বিগুন বয়সী একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ হয়ে আমি কিসব ভাবছি। আমার ঘরে লক্ষী বউ আছে, দশ বছরের সংসার আমার। ছেলে আমার স্কুলে যেতে শুরু করেছে। আর আমি কিনা …

কলিংবেল দিতেই বউ দরজা খুলে দিল, মনে হয় সে পাশেই দাড়িয়ে ছিল।
–    এত দেরী করলে!
–    ডেডলাইন ছিল একটা।
–    আচ্ছা সোজা ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং এ আসো। ল্যাপটপ এ বসবা না।

বউ কে আলতো জড়িয়ে বলি, এই একটু পাঁচ মিনিট, জরুরী মেইল আসতে পারে। সুমনা মুখ বাঁকিয়ে চলে গেল, তোমার মেইল চেক করা আমার জানা আছে। বসবা তো এখন ফেইসবুকে নাহয় ব্লগে। এইগুলো হলো আমার সতীন।

কোন কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ ফেইসবুকে লগিন করি। একটা মেসেজ আছে। ফ্রম মার্জানা চৌধুরী সামান্থা।
“হাই! এটা আমি। সামান্থা।”

আমার কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগে অনেক দিন পর। সোজা তার প্রোফাইলে চলে যাই, কভার পিকে দেয়া আছে টোয়াইলাইটের পোস্টার, আর প্রোফাইল পিকে সাদা এপ্রন পরা একটা দুর্দান্ত মেয়ে। দুর্ধর্ষ সুন্দরী, সামনা সামনি একে দেখলে হার্টফেল করতে পারি।

সুমনা ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছে, এই তুমি কি আসবা? নাকি আমি না খেয়ে ঘুমাতে চলে যাব? এক মিনিটের মধ্যে আসবা, নাহলে কিন্তু আমি চলে গেলাম।

ডিনার শেষে রিমোট কন্ট্রোল নিয়ে এলোমেলো সার্ফ করতে করতে এমটিভিতে দেখি ক্যাটরিনা, মুগ্ধ নয়নে তাকে দেখি। কখন ঘুমিয়ে পড়ি জানি না, স্বপ্নে বউ আর ক্যাটরিনা একাকার হয়ে যায়।

পরের এক সপ্তাহ টুকটাক ফেইসবুক চ্যাটিং হল সামান্থার সাথে। জানলাম সে খুব একাকী। মা নেই, বাবা বেশীরভাগ সময় ব্যবসার কাজে বাইরে থাকে। আর কোন ভাই-বোন নেই। ডিএমসিতে ভর্তি হয়েছে মাত্র কিছুদিন, তেমন বন্ধুত্ব হয়নি কারো সাথে। ক্লাসমেট ছেলেদের সে মোটেই পাত্তা দেয় না। ওদেরকে সামান্থার ম্যাচিউরড মনে হয় না, হাবলা আতেল টাইপ লাগে। কিছুদিন হল ব্লগিং শুরু করেছে, সেখানেই সে দৈবভাবে আমাকে খুঁজে পেয়েছে।
উইকেন্ড আসল। আমার যেদিন উইকেন্ড সেদিন সুমনার উইকেন্ড না। সুমনা ক্লাস নিতে চলে যায়। তাই ছুটির দিনগুলো আমার বেশীরভাগ ঘুমিয়ে কাটে। রবিবার বিকেলে সামান্থা খুব জিদ করল, দেখা করতেই হবে, নো ওয়ে, না দেখা করলে সে রাত বারটায় গিয়ে একা পার্কে বসে থাকবে, পাগলামীমূলক কথাবার্তা আরো বলতেই থাকে। বুকে অনেক সাহস সঞ্চার করে বউকে ফোন দিলাম।

–    সুমনা আমি একটু বাইরে যাব।
–    কোথায় যাবা?
–    এই একটু আশুলিয়ার দিকে।
–    ওয়াও আমিও যাব।
–    না মানে, শুধু ফ্রেন্ডসদের আড্ডা।
–    কেন ওদের বউরা আসবে না?
–    না।
–    ঠিক আছে।

সুমনা ফোন রেখে দিয়েছে। বউকে কষ্ট দিয়ে কেমন যেন অপরাধবোধ গ্রাস করে। ঝিম মেরে বসে থাকি কিছুক্ষণ। সামান্থা আবার টেক্সট করেছে, “আমি রেডী হচ্ছি। বেশী সাজবো না, তাহলে আপনার মাথা খারাপ টারাপ হয়ে যেতে পারে, হিহিহি।”

আমি সুমনাকে ভালবাসি। ভালবেসেই আমরা বিয়ে করেছি, সুমনা ভার্সিটির এক বছরের জুনিয়র ছিল। সুমনা অসুন্দর এই কথা তার নিন্দুকেরাও বলতে পারবে না। কিন্তু অ্যাডভেঞ্চারের ভুত মাথায় চেপে বসেছে। আরে একদিন একটা মেয়ের সাথে দেখা করলে কি হবে! খারাপ কিছু তো করতে যাচ্ছি না। আবার সামান্থা টেক্সট করেছে, “আমি বের হব এখনি। আপনি কোথায়?” নাহ, নিজেকে কন্ট্রোলে রাখা গেল না। কালামকে ছুটি দিয়ে নিজে গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

ধানমন্ডির কাছাকাছি পৌছে মেসেজ পেলাম, “আমি কেএফসিতে একটা কর্ণারের টেবিলে, পিংক ড্রেস।” কেমন যেন একটা টেনশন ভিতরে ভিতরে কাজ করছে। কেএফসিতে ঢুকলাম।

সামান্থার সামনা সামনি বসে আছি বেশ কিছুক্ষণ হল। সে আমার হাত দুটো ধরে বলছে, তুমি কি নার্ভাস?
সামান্থা এই প্রথম আমাকে তুমি তুমি করে বলছে, তার মধ্যে বিন্দুমাত্র জড়তা নেই। আমার সত্যিই অনেক নার্ভাস লাগছে। এত সুন্দর মেয়ে সরাসরি কখনো দেখিনি। ছবিতে যেমন দেখেছি তার থেকে বেশী ধ্বংসাত্মক। যেই পুরুষ একবার একে দেখবে তার আর অন্য কোন মেয়ের কাছে যেতে ইচ্ছে করবে না।

–    এই আমি একটু বেশী সুন্দরী। কিন্তু এতে নার্ভাস হবার কিছু নেই। এত বয়স তোমার, কিন্তু তুমি বেশী অভিজ্ঞ না মনে হচ্ছে। (সামান্থা হাসতে থাকে, মোহনীয় হাসি)
–    না মানে, আমি বয়সে তোমার থেকে অনেক বড়। তুমি আমাকে এমনটা নিশ্চয়ই আশা করোনি।
–    উমমম, তোমাকে একটু বুড়ো দেখাচ্ছে এটা সত্যি। ভুড়িটা বয়সের থেকে বেশী। চেহারাতেও বয়সের ছাপ পড়েছে। তুমি মনে হয় যত্ন নাও না শরীরের ঠিকমত।
–    না আমি আসলে এমনই।
সামান্থা ভুরু নাচিয়ে বলল, নো প্রোবস। আমি তোমাকে অল্প কিছুদিনের মধ্যে ঠিক করে দেব। তোমাকে বেশী বেশী করে ফ্রুইটস খেতে হবে বুঝেছ। তারপর গাজর আর টমেটো খাবে প্রতিদিন। আর খাবে ডিম। আমি একটা চার্ট করে দেব। ঠিক আছে?

আমি মাথা নাড়ি। সামান্থা আমার মাথার চুল এলোমেলো করে দেয় হাত দিয়ে। সুমনার কথা মনে পড়ে যায়। সুমনা এই কাজটা মাঝে মধ্যেই করে আহ্লাদের সময়। অপরাধবোধ মাথায় জাগ্রত হয়, আমি উশখুশ করতে থাকি।
সামান্থা বলে চলেছে, তুমি একটা জিমে ভর্তি হয়ে যাও। বাড়তি মেদ সব কেটে ফেলতে হবে।
কেটে ফেলতে হবে? বাপরে কি বলে এই মেয়ে!
অনেক রাত অবধি সামান্থাকে পাশে বসিয়ে লং ড্রাইভ করি, মিউজিক চলতে থাকে হাই ভলিউমে। সামান্থার বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করে না, সে বলে আমার সাথে এইভাবে রাত কাটিয়ে দেবে। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে তারপর ওর বাসার গেটে ওকে নামিয়ে দেই, বাড়ীর পথ ধরি।

বাসায় ফিরে দেখি, সুমনা আরাশকে পড়াচ্ছে। আরাশ আমাকে দেখে দৌড়ে কোলে ঝাপিয়ে পড়ে, অন্যসময় আমি যেমন প্রচন্ড খুশী হই ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে, আজ ঠিক সেইরকম প্রচন্ড লজ্জা আর অপরাধী লাগে নিজেকে। সুমনা এগিয়ে আসে, কি কেমন হল তোমার আড্ডাবাজি?
রাত বাড়ে রাতের নিয়মে। আমার চোখে ঘুম আসে না। একবার সুমনার কথা ভাবি, একবার সামান্থার কথা ভাবি। টিভিতে ক্যাটরিনা নাচতে থাকে, আমি চ্যানেল বদলে ডিসকভারি দিয়ে রাখি, পশু পাখি দেখি। পশুরাও আমার থেকে ভাল, আর যাই হোক হিপোক্রেট না।

সামান্থার নেশা কাটানো কঠিন। সকালে রকিকে ডেস্কে ডাকলাম। এই ছেলেটা স্বাস্থ্য সচেতন, জিম করে রেগুলার। ওর সাথে জিম বিষয়ক আলাপ আলোচনা করলাম।

–    কি ব্যাপার, সাকিব ভাইয়া জিম করবেন!
–    হুম ভুড়িটাকে কন্ট্রোলে রাখা দরকার। ওজন বেশী বেড়ে যাচ্ছে।
–    ঠিক ঠিক।
–    জিম করলে বয়সের ছাপটাও পড়বে না তাইনা?
–    তা ঠিক বলেছেন।

রকি হাসতে হাসতে চলে গেল। কিন্তু আমি সিরিয়াস। বেশ কিছুক্ষণ গুগল করলাম কিভাবে ফিট থাকা যায়। তবে এতকিছুর দরকার ছিল না। দুপুরে দেখি সামান্থা মেইল করেছে, একটা এক্সেল ফাইলে সুন্দর করে চার্ট করে দিয়েছে। আমি তাড়াতাড়ি প্রিন্ট আউট নিলাম দুইকপি। অফিস শেষে জিমে রেজিস্টার্ড হলাম। সবশেষে এক ডজন ফার্মের মুরগীর বাদামী ডিম, আধা কেজি গাজর আর আধা কেজি টমেটো কিনে বাসায় ফিরি।
সুমনা আমাকে দেখে হাসতে হাসতে শেষ। কি ব্যাপার! সম্রাট আকবর আজ নিজ হাতে কি মনে করে বাজার করলেন! আমি আমতা আমতা করি, ইয়ে মানে, এক কলিগ বলল গাজর আর টমেটো খেলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে, রোগবালাই কম হয়। বাসায় আছে কিনা তাই আমি নিয়ে আসলাম।

–    আর ডিম?
–    ও হ্যাঁ, ডিম। জিম করা শুরু করেছি তো। বেশী বেশী এনার্জি দরকার।
সুমনা এবার হাসতে হাসতে সোফায় বসে পড়ল। এত হাসির কি আছে আমি বুঝলাম না। হাসতেই হাসতেই সে বলল, তুমি হঠাত জিম শুরু করলে যে! প্রেমে পড়েছ নাকি?
আমি লাজুক হাসি দিয়ে বলি, ধুর কি যে বলো। তুমি এখনো কত সুন্দর আছ, আর আমার ভুড়ি বেড়ে যাচ্ছে, বয়সের ছাপ পড়ে যাচ্ছে। তোমার সাথে মানাতে হবে না?

ইসসস, ঢং – সুমনা তাচ্ছিল্যের সাথে বলে, তারপর এগিয়ে এসে আমার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলে, তুমি এখনো অনেক হ্যান্ডসাম আছ, যে কোন তরুণী প্রেমে পড়ে যাবে। এখন জিমটিম করলে আমাকে আরো সতর্ক হতে হবে মনে হচ্ছে। রহস্যময় হাসি দিয়ে সুমনা চলে যায়। বউ আমার কনফিডেন্স বাড়িয়ে দিয়েছে।
গভীর রাতে ফোন আসে, সামান্থার ফোন। উফ, এত রাতে তোমার ফোন আসছে কেন? সুমনার ঘুম ভেঙ্গে গেছে। সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ফোন বন্ধ করে দাও, জান!

কানাডার অনশোর টিম থেকে ফোন করেছে, আজকে একটা ক্লায়েন্ট ডেলিভারী ছিল তো, মনে হয় কোন ঝামেলা হয়েছে।
উফ, তোমার এই ডেডলাইন আর ডেলিভারী আমাকে মেরে ফেলবে।
আমি আস্তে করে সুমনার হাত সরিয়ে উঠে পড়ি, দরজা চাপিয়ে দিয়ে একদম ড্রয়িং রুমে এসে তারপর কলব্যাক করি।

–    হ্যালো সাকিব! কি কর!
–    সামান্থা এত রাতে কি করবো? ঘুমাচ্ছিলাম।
–    ওহ সরি। আসলে হয়েছে কি তোমাকে খুব মনে পড়ছিল। তাই ফোন দিয়েছি। রাগ করেছ?
–    হুমম। রাতের ঘুমের মধ্যে ডিস্টার্ব হলে আমার খুব সমস্যা হয়, সকালে অফিস করতে পারি না ঠিকমত।
–    ওহ সরি সরি, আমি আর ফোন দিব না।
–    আচ্ছা, আর ফোন দিও না, আমি রোজ সন্ধ্যায় অফিস শেষে তোমাকে ফোন দিব।
–    ওকে।
–    রাখি?
–    এই শোন শোন।
–    কি?
–    তোমাকে যে চার্টটা দিয়েছি ফলো করা শুরু করেছ তো?
–    হুম পুরোপুরি চার্টটা ফলো করছি। আর আমি জিমে ভর্তি হয়েছি।
–    ওয়াও গুড বয়।
–    থ্যাঙ্কিউ। গুড নাইট।
–    বাই।

ভয়ে ভয়ে বিছানায় আসি, নাহ সুমনা গভীর ঘুমে আছে। বাকী রাত আমার আর ঘুম আসে না। ঠিক করলাম এরপর থেকে রাতে শোবার আগে অবশ্যি ফোন বন্ধ রাখবো, অন্যসময়ও বাসাতে কখনোই সামান্থার কল রিসিভ করবো না, এই রিস্ক নেয়া যাবে না।

আমার জীবনধারা পাল্টে গেছে অনেকটা, কামলা থেকে এক্কেবারে অ্যাডভেঞ্চারিস্ট। প্রথম প্রথম কলিগরা আর সুমনা হাসাহাসি করল। আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে গেল। এক মাসে ওজন কমিয়ে ফেললাম সাত কেজি!
শনি-রবি দুইদিন হয়ে উঠেছে বর্নিল। এই দুইদিন সুযোগ পেলেই সামান্থার সাথে হারিয়ে যাই। আগের মত ভার্চুয়াল লাইফে সময় না কাটিয়ে রিয়েল লাইফে ব্যস্ত হয়ে উঠেছি। ধানমন্ডি-গুলশান-বনানীর যত আইসক্রিম পার্লার আর ডেটিং কর্নার আছে সবগুলোতে ঢু মারতে থাকি। হঠাত করে যেন আমার বয়স কমে গেছে দশ বছর। টিএসসি, বুয়েট এমনকি মাঝে মাঝে জাহাঙ্গীরনগর ভার্সিটিতে চলে যাই। জগত সংসার, আমি কে, আমার দায়িত্ব কি, সব ভুলতে বসেছি।

সামান্থা মেয়েটা যেমন সুন্দর তেমনি পাগল। যেমন মাঝে মধ্যে গাড়ি রেখে তার হাইওয়ে ধরে হাঁটতে ইচ্ছা হয়, ফ্লাইওভারের উপরে চলন্ত গাড়ীর মুখোমুখি হাঁটতে ইচ্ছা হয়, বৃষ্টি দেখলে পাগলামি আরো বাড়ে। এই পিচ্চি মেয়ের দুস্টামি দেখে আমার ভয় হয়, তারপরেও মোহগ্রস্ত হয়ে সাড়া দেই সব কিছুতেই।

বসন্ত উৎসব আর ভ্যালেন্টাইনস ডে চলে আসে। বাসায় আগে থেকেই বলে রেখেছি, নতুন প্রজেক্ট আসছে, অফিসে অনেক চাপ, ছুটি পাব না এমনকি বাসায় ফিরতে রাত হবে। খুব নিষ্ঠুর হয়ে গেছি, কিন্তু আমার হাতে কোন কন্ট্রোল নেই। সুমনা মন খারাপ করে, একটা কথাও বাড়ায় না। বাসায় থাকলে আমি চুপচাপ থাকি। ফ্যামিলি গেট টুগেদার থাকলে আগের মতন হাসি তামাশা করি না, আড়ালে আড়ালে থাকি। আমি বুঝতে পারি, সমস্যা জটিলতার দিকে যাচ্ছে, আর আমাকেই এর সমাধান খুঁজে পেতে হবে।

বসন্তের প্রথম দিন সামান্থা প্রথম শাড়ি পরে আসে আমার সামনে। আমি মুগ্ধ নয়নে রাজকন্যাকে দেখি, অপূর্ব! সামান্থার মোহ কাটানোর শেষ আশাটাও নিভে যায় যখন ভালোবাসার দিনে সে আমার বুকে মাথা রেখে হঠাত কেঁদে দেয়। এই খামখেয়ালী মেয়েটাকে আমি এখনো একটুও বুঝতে পারি না। এমনিতে সে শক্ত মেয়ে, কিন্তু তবু আশ্রয়হীনতায় ভোগে, আমার বুকে তখন আশ্রয় খোঁজে। রাতে এখন আর ফোন দেয়না আমাকে। রাত জেগে খুব পড়াশুনা করে, সামনেই তার পরীক্ষা, সে খুব ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী আর তাই এত পাগলাটে আমি বুঝতে পারি।
আমার কাজকর্ম অনেকটা এলোমেলো হয়ে গেছে, কাজে মন নেই। সারাদিন সুমনা-সামান্থা কে ভাবি, কোন সমাধান খুঁজে পাইনা, সামান্থাকে ছাড়তে ইচ্ছে হয় না। একটা প্রজেক্টের কাজে সিডনী যাবার অফার ছিল, এই দুইজনকে নিয়ে দ্বিধাদ্বন্ধে ভুগে সেখানেও যাই না। আরাশ যখন কাছে আসে অপরাধের তীব্রতা বাড়ে, নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছা হয়।

সামান্থার জন্মদিনে সে আমার কাছে অদ্ভুত আবদার করে। এবার তার বয়স হবে ২০। তাই রাত বারটায় আমাকে ২০ খানা লালগোলাপ নিয়ে তার বাসায় যেতে হবে।

–    সামান্থা, আমি পারবো না।
–    কেন পারবা না?
–    অফিসের কাজে ভীষন ব্যস্ত।
–    চুপ একদম চুপ, রাত বারটায় আবার কিসের অফিস?
–    নাহ মানে, এত রাতে এতগুলো গোলাপ কই পাবো?
–    তার আমি কি জানি! তোমাকে আসতেই হবে, আর গোলাপগুলো তাজা হতে হবে।

ফোন রেখে দিয়েছে। এখন রাত বারটায় আমাকে যেতেই হবে, না হলে সে রক্তারক্তি করে একটা অঘটন করবে, আরেকবার আমি কথা শুনিনি বলে এমনটা করেছে।

বাধ্য প্রেমিকের মত রাত বারটায় বাসার নিচে গিয়ে হর্ন দেই। ব্যালকনি দিয়ে আমাকে দেখে সে দৌড়ে আমাকে নিয়ে যায় বাসার ভিতর, এর আগে শতবার বলা সত্বেও কখনোই যাইনি। আমার ভয় ভয় লাগে, মেয়ে কখন কি করে বসে ঠিক নাই, তার চোখের ভাষায় দুস্টুমি। কোনরকমে কেক কেটে আমি পালাই।

–    প্লিজ, তুমি একটু থাকো। প্লিজ।
–    আজকে না, আরেকদিন, বাসায় একটু ঝামেলা আছে।
–    প্লিজ।

বাসায় ঢুকি পৌনে একটায়। এত রাতে আমি গত পাঁচবছরে মনে হয় ফিরিনি। কয়কবার বেল দেবার পর দরজা খুলল। বাতি নেভানো, তাই সুমনাকে ঠিকমত দেখতে পাইনা। মাথা নিচু করে চলে যাওয়া শুরু করলে সে হাতটা টেনে ধরল। একটু ডাইনিং এ আসবা? হাত ধরে আমাকে ডাইনিং এ নিয়ে যায়। একটা মোমবাতি ধরানোর পর আমি দেখতে পাই কেকের উপরে লেখা – হ্যাপী অ্যানিভার্সারি।

–    জান, আমি ভুলে গেসিলাম, আই এম ভেরী সরি।

আরো অনেককিছু বলতে চাইছিলাম, সুমনা আমার মুখে হাত দিয়ে আটকে দিল, তারপর আমার খুব কাছাকাছি চলে আসল। আমি ওর চোখের দিকে অনেকদিন পরে তাকালাম, সেখানে একরাশ ভালবাসা-মায়া-বেদনা-কষ্ট সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। ইসসস, কতদিন আমার বউটাকে ভালবাসি না। বুকের মাঝখানটায় সত্যি সত্যিই আজরাতে ভীষন কষ্ট অনুভূত হয়। বউকে জড়িয়ে ধরে সিদ্ধান্ত নেই, না এই কষ্ট আমি আর বাড়াবো না, শেষ করে ফেলব সবকিছু।

পরদিন সকালে মোবাইল অন করে দেখি ২০ টা মেসেজ।
“আই উইল কিল ইউ, আই উইল কিল ইউ, আই উইল কিল ইউ …”
অফিসে এসে ঝিম মেরে বসে আছি। কি করব? কিভাবে সামান্থাকে বলব? সামনা সামনি এখন ওকে গিয়ে সত্য কথা বলার সাহস আমার নেই। আমাকে ছাড়া ওর তেমন কোন সমস্যা হবে না, একজন ভাল বয়ফ্রেন্ড কিংবা লাইফ পার্টনার সে অবশ্যই পেয়ে যাবে। সুমনা-আরাশের যেমন আমাকে ছাড়া চলবে না, আমারো ওদের ছাড়া চলবে না। আমি মেসেজ লিখলাম,
“আমি অপরাধী। আমি তোমাকে ভালবেসেছি সত্যি, কিন্তু তোমাকে ভালবাসার অধিকার আমার নেই। আমি ম্যারিড। যদি তুমি পারো ক্ষমা করো আমাকে।”

তারপর? সিমটা খুলে ফ্লাশ করে দেই। আর একটা কাজ বাকী আছে। ফেইসবুকে ঢুকে ডিএকটিভ্যাট করে দিলাম। এই জীবনে আর ঐ মুখো হবনা। আজ আর কোন কাজ করতে পারব না। সিক লিভ নিয়ে বাসায় চলে আসি।
দরজা খুলে সুমনা অবাক – কি ব্যাপার? তুমি এই সময়ে? গুড নিউজ টা তুমি কোনভাবে পেয়ে গিয়েছ নাকি? – রহস্যময় হাসি দেয় সে আমার দিকে। কিছু বুঝতে পারি না।

আরাশ দৌড়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে, আব্বু আমি ফার্স্ট হয়েছি। আমি টের পাই, আমার চোখে পানি চলে এসেছে। চশমার আড়ালে কোনভাবে বউ আর ছেলের কাছে থেকে নিজের লজ্জা ঢাকি।

এরপর কেটে গেছে অনেক গুলো বছর। আমার ছেলে আরাশ সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে আমার কোম্পানির হাল ধরেছে। আমি অনেকটাই অকেজো। বাইপাস সার্জারি করতে হবে, হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। অপারেশন সাকসেসফুল হল। ডাক্তার দেখা করতে এলে তার হাসি দেখে চিনতে পারি, লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নেই আমি। এক ফাঁকে রুমে কাউকে না রেখে আমার হাত ধরে সামান্থা বলল,
“পেসমেকার ভেবনা যেটা রেখেছি তোমার বুকে, ভেব আমার মাথা, যেন আজো আছি মাথা রেখে।”

বেঁচে আছি এখন শুধু মৃত্যুর প্রতীক্ষায় – বুকে ক্ষত স্মৃতি হয়ে বাজে টিক টিক করে।

–আইডিয়া – পেসমেকার (নচিকেতা)–

হাসিব জামান সম্পর্কে

এই গল্প ভরা রাতে, কিছু স্বপ্ন মাখা নীল নীল হাতে, বেপরোয়া কিছু উচ্ছ্বাস নিয়ে, অপেক্ষায় ...
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে গল্প-এ এবং ট্যাগ হয়েছে স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

23 Responses to পেসমেকার

  1. মিজানুর রহমান পলাশ বলেছেনঃ

    বুঝতে পারলাম- ইদানীং মেডিক্যালের আশে পাশে খুব ঘোরা হচ্ছে!
    :love: :love:

  2. নোঙ্গর ছেঁড়া বলেছেনঃ

    লেখার ধরণ সুন্দর। ভালো লাগলো লেখাটা

  3. স্বপ্ন বিলাস বলেছেনঃ

    পেসমেকার গানটা খুব সুন্দর করে ফুটিয়ে এনেছেন গল্পে। পড়তে খুব ভালো লেগেছে……… 🙂

  4. নিশাত রহমান বলেছেনঃ

    অনেক সুন্দর

  5. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    :welcome: ভাইয়া

    বেশ লাগছে গল্পটা। সারা জাকের এর কাছে সমস্যা নামে কিছু চিঠিতে এই রকম উদ্ভট কিছু পড়ছিলাম!! সেই রকম।
    শেষটা বেশি ভালু পাইলাম।

  6. সামিরা বলেছেনঃ

    গানটা অসাধারণ। গল্পটা আমার কাছে গানের মতই অসাধারণ লাগলো কেন জানি!
    স্যালুট!
    :welcome:

  7. মাহি বলেছেনঃ

    গ্রেট গ্রেট !!
    আমার কাছে সাঙ্ঘাতিক ভালো লাগল … 🙂

    একটা কথাঃ আমার কিছু মেডিক্যাল পড়ুয়া বন্ধু আছে। বেশির ভাগই ক্লাস, আইটেম আর কার্ড ফাইনালের চাপে ফেইসবুকেই ঢুকতে পারে না ! সামান্থারে পাইলে জিগ্যেস করতাম এতো সময় পায় কই ???
    :love:

  8. ইঁদুর বলেছেনঃ

    দারুন তবে শেষটায় এসে মনে হল তাড়াহুড়ায় সেরে দিলেন! =)-আর একটু হলে পুরো গানের মজাটা চলে আসত।

  9. sonet বলেছেনঃ

    মেয়েরা পারেনা এমন কোন জিনিস নাই
    আর ছেলেরা পারে এমন কিছুই নাই ।

  10. তিষা বলেছেনঃ

    মজা পাইসি :happy: :happy:

  11. ইমতিয়াজ সিফাত বলেছেনঃ

    বর্ণনা ভঙ্গি আর বলার ধরন ভালো লাগসে

    :happy:

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।