টুপুরের এখন ভীষণ মন খারাপ। আর্দ্র চোখদুটোতে একরাশ দু:খ জমে আছে। কান্না থামাবার চেষ্টা করছে সে, তবু চোখ ভিজে ভিজে আসছে। একটু আগে গানের টিচার আচ্ছা করে বকে গেছে তাকে। বলে গেছে টুপুরকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। সহজ একটা গানের স্থায়ী যে তুলতে পারল না, তার গান শেখার কোন মানে নেই। এই বলে গানের খাতাটা ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন। মা খুব রাগ করেছে।একটু আগে ঠাশ করে এক চড় লাগিয়েছে টুপুরের গালে। বলেছে, পাজি মেয়ে ইচ্ছে করেই তুই গানটা ভুল করছিস, বদমাশ একটা।
টুপুরের চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিল, আমি ইচ্ছা করে করছি না। কিন্তু সে তা না করে জানলার গ্রিলটাতে মুখ ঠেকিয়ে দাড়িয়ে রইল । আজ স্কুলের ক্লাস শেষের পরে রনি আর রোমেল বলেছিল, আজ ওদের ছাদে ক্রিকেট খেলবে । তাই ও যেন গানের টিচার চলে যাওয়া মাত্রই চলে আসে। কিন্তু এখন এই মন খারাপের সময়ে টুপুর কি করে খেলতে যাবে? অন্ধকারে শয্যা নেবার জন্য প্রস্তুত পশ্চিমা সূর্যের কোমল আভা টোল পড়া টুপুরের গালে এসে লাগল। অন্যদিন এই সময়ে সূর্য ওকে পেত উচ্ছল রূপে রনিদের ছাদে। খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও সে খেলতে যায়। ওদের দশতলা বাড়ি ছাঁদটা টুপুরের খুব ভাল লাগে। ছাদে যখন দোলনায় চড়ে সে, তখন মনে হয় তার একটা ডানা থাকলে সে উড়ে বেড়াতে পারত নিজের মনে। কিন্তু আজ সবকিছু পণ্ড হল এই গানের টিচারের জন্য। উদাস হয়ে সে তাকিয়ে রইল রনিদের বাসার দিকে। ওরা টুপুরদের দুটো বাসা পরেই থাকে।
টুপুর, খুব শান্ত ও লক্ষ্মী একটা মেয়ে। ক্লাস ফোরে পড়ে। ইট পাথরের জঙ্গল এই শহরে তারা এসেছে বছর দুই হল। আগে তারা থাকত মফস্বল শহরে। সেখানে স্কুলের পড়ার পাশাপাশি সে ছবি আঁকত। ছবি আঁকায় তার হাত বেশ ভাল ছিল। কিন্তু মা সব সময়েই চাইত তাকে গান শেখাবে। কিন্তু মফস্বলে ভাল গানের টিচারের খোজ না পাওয়ায় এতদিন তাকে গান শিখতে হয়নি। গান শিখতে টুপুরের একটুও ভাল লাগে না। একটা হারমোনিয়ামের প্যাঁ পু মোটেই ভাল লাগে না তার। তার উপর টিচার এসে শুধু আ আ করে রেওয়াজ করায়, এটা গানের থেকেও বিরক্তিকর।
ঢাকায় এসে মা’র হল মস্ত সুবিধা আর টুপুর হারাল স্বাধীনতা। স্কুলের পড়ার পরিমাণ বাড়ার সাথে সাথে নানা প্রকার সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞের বোঝা তিনি চাপাতে লাগলেন মেয়ের উপরে। আগে বিকেল হলেই কলোনির মাঠে সবার সাথে মিলে নানা ধরণের খেলায় পার হত বিকেলটুকু। আর এখন ভোর ছটায় উঠে মাদ্রাসার হুজুরের কাছে আরবি পড়া, এর পরে স্কুলে যাওয়া, স্কুল থেকে ফিরে আবার গানের টিচার অথবা নাচের ক্লাস টুপুরের সময় গুলো দৌড়ে পালায় পাগলা ঘোড়ার মতন। খেলার সময় এখন খুব অল্প। তাও আজ আবার পণ্ড হল। মন খারাপ করে দাড়িয়ে থাকে টুপুর।
এই মেয়ে, জানলার গ্রিল ধরে দাড়িয়ে আছ কেন ? কখন সন্ধ্যে হয়েছে খেয়াল আছে ? যাও পড়তে বস। কাল সকালে আবারো গানের টিচার আসবেন। তাই রাতের মধ্যেই পড়া শেষ করে ফেল।
হাত মুখ ধুয়ে বই খুলে পড়তে বসে টুপুর। টেবিল জুড়ে নানা বিষয়ের বই। কাল শুক্রবার কিন্তু তাও রেহাই নেই, শনিবার দু দুটো ক্লাস টেস্ট। সেগুলোর পড়া রেডি করতে হবে। আজ মোটেই মন বসছে না পড়ায়। বইটা খুলে শুধু চেয়েই রইল সে। খুব মনে পড়ছে এখন ছবি আকার কথা। যখন ওরা পলাশপুর থাকত তখন কি সুন্দর ছবি আঁকত সে। কিন্তু ঢাকায় এসে মা তাকে আর্টের স্কুলে ভর্তি করে দেয়নি। তাই সে এখন আর ছবি আকে না। রাত দশটার দিকে খাবার ডাক পড়ল। চুপচাপ খেয়ে নিল সারা দিনের নানান হ্যাপায় ক্লান্ত ছোট্ট মেয়েটি।
রাতে শোবার আগে আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিল গানের খাতাটাতে। মা খুব সুন্দর করে জেল পেন দিয়ে লিখেছে গানটা। নিচে আবার লিখেও রেখেছে গানের রচনাকাল। কিন্তু গানটা টুপুর একেবারেই বুঝতে পারছে না। কি যে একটা গান, মুখস্থ তো হতে চায় না। আর কত বড়!
‘আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি।
সন্ধ্যাবেলার চামেলি গো, সকালবেলার মল্লিকা
আমায় চেন কি।’
‘চিনি তোমায় চিনি, নবীন পান্থ–
বনে বনে ওড়ে তোমার রঙিন বসনপ্রান্ত।
ফাগুন প্রাতের উতলা গো, চৈত্র রাতের উদাসী
তোমার পথে আমরা ভেসেছি।’
‘ঘরছাড়া এই পাগলটাকে এমন ক’রে কে গো ডাকে
করুণ গুঞ্জরি,
যখন বাজিয়ে বীণা বনের পথে বেড়াই সঞ্চরি।’
‘আমি তোমায় ডাক দিয়েছি ওগো উদাসী,
আমি আমের মঞ্জরী।
তোমায় চোখে দেখার আগে তোমার স্বপন চোখে লাগে,
বেদন জাগে গো–
না চিনিতেই ভালো বেসেছি।’
যখন ফুরিয়ে বেলা চুকিয়ে খেলা তপ্ত ধুলার পথে
যাব ঝরা ফুলের রথে–
তখন সঙ্গ কে লবি’
‘লব আমি মাধবী।’
‘যখন বিদায়-বাঁশির সুরে সুরে শুকনো পাতা যাবে উড়ে
সঙ্গে কে র’বি।’
‘আমি রব, উদাস হব ওগো উদাসী,
আমি তরুণ করবী।’
‘বসন্তের এই ললিত রাগে বিদায়-ব্যথা লুকিয়ে জাগে–
ফাগুন দিনে গো
কাঁদন-ভরা হাসি হেসেছি।’
এত বড় এই গানটিই কেন তাকে শিখতে হবে তা কিছুতেই বুঝতে পারছে না টুপুর। কিন্তু মা গো ধরেই আছে এই গানটাই স্কুলের কম্পিটিশনের জন্য তাকে শিখতে হবে। কোন মানে হয় ? কত সোজা ছিল আমরা সবাই রাজা গানটা। গাইতেও সে পারে বেশ। তা না, শুধু শুধু মা কেন যে এমন করে! ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে টুপুর।
গানের থাতাটা নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। আস্তে আস্তে হাত থেকে খসে পড়ে ওটা। ক্লান্ত মেয়েটির চোখদুটো আচ্ছন্ন হয় গভীর ঘুমে। ঘুমের মাঝেই হারিয়ে যায় স্বপ্নে। শাদা কালো দিনের অথচ রঙ পেন্সিলে আকা ছবির মত খুব রঙিন একটা স্বপ্ন। সে এখন একটা ছাদের উপর দাড়িয়ে। তপ্ত দুপুরের সূর্য আগুন ঝরাচ্ছে চারপাশে। স্বেচ্ছাচারী সূর্যটাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে রয়েছে টুপুর। পারছে না তবু দেখছে, যেন সূর্য সে কখনো দেখেনি, দেখেনি বাড়ির সামনের গাছ গুলোকে, ছোট্ট মেঠো পথ আর দূরের ওই নদীটাকে। টুপুর লক্ষ্য করে নদীতে চলছে নানা রঙের পালতোলা নৌকো। হঠাৎ অবাক হয়ে ভাবে, এই শহুরে বাড়িটার একটু দূরেই নদী এলো কোথা থেকে? আর এই মেঠো পথ তো এখানে থাকার কথা না, এত ছিল সেই পলাশপুরে!
হঠাৎ সে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে। মেঝেটা টাইলস দিয়ে সুন্দর করে বাধানো। ঠিকই তো আছে এটা রনিদের বাড়ির ছাদ কিন্তু ছাদটা আজ বেশ বড় বড় লাগছে। সামনের গাছগাছালি আর নদীটা কোথা থেকে এলো, ভাবতে ভাবতেই তাপ ছড়ানো রোদবালকটা মেঘের আড়ালে লুকোচুরি খেলতে শুরু করল। হাওয়াই মিঠাই এর মত দেখতে বড়ো বড়ো মেঘের টুকরোগুলো আকাশজুড়ে শুরু করল ছায়ার চাষ। খুব মজা করে উপভোগ করছিল টুপুর। হঠাৎ কাঁধে একজন বৃদ্ধ হাত চমকে ওঠে টুপুর। বুড়ো লোকটা খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
টুপুর মনি কি দেখছ অমন করে ? নীল আকাশে মেঘের খেলা ?
টুপুর হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে। অবাক হয়ে বলে, আপনি কে? আপনাকে তো চিনতে পারলাম না। এখানে এলেন কি করে ?
বুড়ো লোকটা হাসলেন। বললেন একেবারেই চিনতে পারছ না ?
বিশাল জোব্বা টাইপের একটা ড্রেস পড়ে আছে লোকটা, ভাবছে টুপুর। অনেকটা আরবি হুজুরের মত, কাল সকালে হুজুর আসবে না ভাবতেই মনটা খুশিতে ভরে উঠল টুপুরের। এই লোকটার প্রচুর দাড়ি আর চুল, গোঁফটাও কেমন ঠোট অব্ধি, ঠিক রবীন্দ্রনাথের মতন। আচ্ছা আপনি কি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কিছুটা ভয় নিয়ে প্রশ্ন করে টুপুর।
এইতো ঠিক ধরেছ মামনি, আমি রবীন্দ্রনাথ।
টুপুরের বিশ্বাস হতে চাইল না। সে আরো অবাক চেহারায় প্রশ্ন করল,
কিন্তু আপনি এখানে কি করে এলেন? আপনি তো সেই কবেই মারা গেছেন। আপনি কি করে এলেন ? টুপুরের পুনঃ: পুনঃ: প্রশ্নে কিছুটা বিব্রত কবিগুরু চুপ করে রইলেন। তার পরে বললেন,
কে কোথায় কিভাবে আসে তা কি জানতে পারে টুপুর? যদি প্রশ্ন করি তুমি কিভাবে এসেছ এই শহর আর গ্রামের যুগলসন্ধিতে তুমি কি বলতে পারবে ? পারবে না। আমিও কিভাবে এসেছি বলতে পারিনা টুপুর। আমার ঠিক জানা নেই কে আমাকে বলেছে এখানে আসতে। নিজের ইচ্ছায় এসেছি কিনা তাও বলতে পারব না।
টুপুর চুপ করে রইল, সে ভাবছে। কি করে সে এখানে এলো, সত্যিই সে বলতে পারে না। রবিঠাকুর আবারো বলে উঠলেন,
আজ সারাটা দিন তুমি মন খারাপ করে ছিলে। ছোট্ট বাচ্চাদের মন খারাপ আমার মোটেই ভাল লাগে না। ছোট শিশুরা পরীর মত। যার এখন গান গাওয়ার সময়, উড়ে বেড়ানোর সময় ডানা মেলে, পাপড়ি মেলে কুড়ি থেকে ফুল ফোটার দৃশ্য দেখা, টুই পাখির গান শোনার সময় যার, তাকে কি মানায় এমন মুখ ফুলিয়ে বসে থাকা?
টুপুরের মনে পড়ে আজকের দিনের কথা। পথভোলা পথিক গানটা তো রবীন্দ্রনাথেরই লেখা। হঠাৎ করে সমস্ত অভিমান গিয়ে পড়ে রবিকবির উপর। সে বলতে শুরু করে দু:খের কথা। গানটি কবি কেন লিখলেন, না লিখলে তাকে মুখস্থ করতে হত না, এত কষ্ট করে সুর তুলতে হত না। মা মারত না, টিচার বকত না। কত ভাল হত। এই পথভোলা পথিকটা কে, মাধবী, চামেলি, কিংবা মল্লিকা ফুল দেখতে কি রকম তা সে জানে না, তাহলে কেমন করে সে অনুভব করবে গানটা এমনতরো হাজারো অনুযোগ জানিয়ে অবশেষে টুপুর বলল,
আপনার জন্যই আমার আজ দিনটা খারাপ গেল, রনিদের সাথে খেলা পণ্ড হয়ে গেল।
সব শুনে রবিবাবু মৃদু হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। এর পরে টুপুরের হাত ধরে বললেন,
গান তো কোন জোর করে শেখাবার জিনিস নয়। আমি জানি না কেন তোমার মা এভাবে জোর করে গান শেখাতে চাইছেন। কিন্তু আমাকে কেউ কখনোই জোর করে কিছু করাতে পারেনি। তুমি বোধহয় জানো আমি বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়া সম্পূর্ণ না করেই চলে এসেছিলাম।
জানি, মাথা নেড়ে বলে ওঠে টুপুর। কিন্তু আমার কি আর গানটা না শিখে উপায় আছে ? মা যেমন রাগারাগি করছে, মনে হচ্ছে গানটা না শিখলে আমাকে মেরেই ফেলবে। আচ্ছা আপনি এত বড় একটা গান লিখলেন কেন বলুন তো ? না লিখলে কত ভাল হত, আমাকে আর গাইতে হত না।
কবি এবারে হাসলেন। বললেন, এই গানটি যদি না লিখতাম, হয়ত আরো অন্য কঠিন একটা গান তোমাকে শিখতে বলত মা, হয়ত আমার অন্য কোন গান আরো কঠিন হতে পারত। তবে আমি গানটি লিখেছিলাম আমার মনের প্রবল আনন্দে, কোন রকম যন্ত্রণা তোমাকে দেবার জন্য নয়। যাই হোক, আমি যখন এসেই পড়েছি তোমার মন ভাল করবার একটা চেষ্টা করবোই। তুমি বন দেখনি, বনে নানান পাখপাখালির গান শোননি, বাতাসের কানাকানি শোননি, গাছের ডালে পাখিদের বিচরণ দেখনি এত বড়ই দু:খের কথা। পথ ভোলা পথিকের খোজ বনে গেলেই মিলবে। তোমাকে আমি নিয়ে যাব, বনে। আমার মনের মাঝে যে বন বাস করে, নিত্য কথা কয় সোঁদা মাটির গন্ধ সুধায় সেই বনে নিয়ে যাব। চিন্তা করো না, বন দেখা হয়ে গেলে তোমায় আবার ফেরত দিয়ে যাব, যাবে আমার সাথে?
টুপুর কিছু না ভেবেই বলে,হা যাব। আমি আজ আপনার সাথে গিয়ে সব দেখব। আমি মাধবীর চঞ্চলতা দেখব, নতুন করবির দোলা দেখব, আমি পথভোলা পথিককে খুঁজব বনের আনাচে কানাচে। চলুন কবি আমরা যাই। বেলা পড়ে আসছে। সন্ধ্যার আগে বাসায় না ফিরলে মা বকবে।
কিচ্ছু হবে না সোনামনি। ভুলে যেও না আমরা এখন আছি অন্য কোথাও, অন্য কোন এক নির্জনতায়। এখানে অত সহজে সময় শেষ হয়ে যাবে না। আমরা না বলা পর্যন্ত সূর্যদেব নিশাদেবীর ঘরে ফিরবেন না বোধহয়, তিনি যে চাইছেন তুমি আমার সাথে যাও। এই বলে রবিঠাকুর টুপুরের হাতে হাত রেখে তাকে নিয়ে চলে এলেন লালমাটির এক ছোট্ট ছিমছাম শহরে। টুপুরের মনে হতে লাগল, এই লাল রঙা মাটির কথা সে শুনেছে গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ ? টুপুর কবিকে প্রশ্ন করে,
আমরা এখন কোথায় ?এটা কি রাঙামাটি যা দেখে আপনি লিখেছিলেন গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ?
না টুপুর মনি, গানটা ঠিক থাকলেও তুমি জায়গাটা চিনতে ভুল করেছ। অবশ্য তুমি এখানকার নাম শোননি হয়তবা। এটা বোলপুর, এখানেই আমি গড়ে তুলেছিলাম শান্তিনিকেতন। তুমি কি শান্তি নিকেতনের নাম শুনেছ টুপুর ?
হা শুনেছি। সেখানে শুধু গান বাজনা আর নাচ হয় শুনেছি। আমাদের দেশে যারা গান, নাচে ভাল তাদের এখানে পাঠানো হয় শুনেছি।
টুপুরের কথা শুনে কবি মুচকি হাসলেন। এর পরে তিনি অনতিদূরে বনের দিকে ইঙ্গিত করে টুপুরকে বললেন, চলো আমরা যাই অরণ্যের গহীনে! দেখি খুঁজে পাওয়া যায় কিনা পথভোলা পথিকের সন্ধান।
বলতে বলতে তারা দুজনেই ঢুকল একটা বনে, বনটা সাজানো বাগানের মত। বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছিল ফাকা ফাকা যথেষ্ট সুন্দর একটা বাগান। কিন্তু একটু ঢুকেই দেখা গেল, সেটা আদতে অনেক ঘন। এতটাই ঘন যে সূর্যের আলো খুব নরম হয়ে লাগছে। অথচ এখানে মধ্যাহ্নের সূর্য আকাশে।
একটু পরেই টুপুর দেখতে পেল করবি গাছ। ফুলগুলো চৈতালি বাতাসে দুলছিল। রক্তরাঙা পঞ্চপত্রের এই ফুল গুলো গাছের শাখায় যেন আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। টুপুর হেটে চলল আরেকটু সামনে। ছোট গাছটায় হলদে রঙের একটা ফুল। কেউ বলে দিলো না কিন্তু টুপুর ঠিক বুঝতে পারল ওটা ছিল মল্লিকা। পাশেই ছিল ছোট ছোট সন্ধ্যা মালতী। একটু পরে রবিঠাকুর টুপুরকে ডাক দিলেন। তিনি হাতে একটি ভাঙা আম গাছের ডাল ধরে দাড়িয়ে আছেন। কাছে যেতেই বললেন
তোমার কি মনে আছে, গানটিতে ঘর ছাড়া পাগল পথিকটাকে কে ডাক দেয়? বলত সে কে ?
টুপুর ভুলে গেছে, কিছুতেই মনে পড়ছে না। চুপ করে থাকতে দেখে কবি বললেন,
এই যে দেখ এই হল আমের মঞ্জরী। এইটাই ডাকছিল পথিককে।
বারে, কি করে ডাকবে এই আমের মুকুল। ওর কি মুখ আছে নাকি বলুন তো। আপনি কি যে লিখেছেন কবি কিছুই বুঝতে পারি না। টুপুর মাথা দুলিয়ে প্রশ্ন করল কবিকে ।
আছে, আছে। এই মুকুলের মুখ না থাকলেও গন্ধ আছে, অনুভব করানোর আছে এক আশ্চর্য ক্ষমতা। তাই তো পথিক তার আকুল ডাকে সাড়া দেয়। যেভাবে সন্ধ্যার চামেলি, প্রভাতের মল্লিকা চিনতে পারে পথিককে সেভাবে পথিক ও শুনতে পায় আম্রমঞ্জরীর এই আকুল ডাক। তুমিও চেষ্টা করো অনুভব করতে পারবে এই উদাস করা ডাক।
রবিবাবু গাইতে ধরলেন গানের অন্তরাটি,
‘ঘরছাড়া এই পাগলটাকে এমন ক’রে কে গো ডাকে
করুণ গুঞ্জরি,
যখন বাজিয়ে বীণা বনের পথে বেড়াই সঞ্চরি।’
‘আমি তোমায় ডাক দিয়েছি ওগো উদাসী,
আমি আমের মঞ্জরী।
টুপুর ও আনমনা হয়ে গেল উদাস দুপুরে এই গহন বনের উদাস করা পরিবেশে। সে গলাতে মেলাতে শুরু করল কবির সাথে। কি অদ্ভুত একটুও ভুল করলো না। কোথাও তাল কাটলো না কিংবা সুর, সময়ক্ষেপণ এদিক ওদিক হল না। কবি পুরোটা গান গাওয়া শেষ করল পরে টুপুর কবিকে প্রশ্ন করে,
আচ্ছা আমের মঞ্জরী কেন পথিককে এত ভালবাসে? কেন তাকে না দেখেই তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন যদি ভেঙে যায়। এই যেমন আকা নিয়ে আমার দেখা স্বপ্ন গুলো, সব ফিকে হয়ে গেছে। টুপুরের কাঁধে হাত রাখলেন কবি। তারপরে সান্ত্বনা দিয়ে বলতে লাগলেন এই পথিক যে আমের মুকুলের জীবনদেবতা। সে আসে বলেই জীবন পায় পরাগ রেণুর গন্ধ গায়ে মেখে সবুজ পাতায় লুকোনো রসালো আমগুলো। তাই জীবনদেবতার স্বপ্ন তারা চোখ ফোটার আগেই দেখতে শুরু করে। হয়ত স্বপ্ন ভাঙে, বেদনা লাগে, অশ্রুও হয়ত আসে কিন্তু বেদনার সুখটাও তো তারা পায়। বেদনা কোথায় নেই বল? সৃষ্টিতে, ধ্বংসে, জন্মে, মৃত্যুতে, নির্বাণে, নরকে সবখানে বেদনা। তাই সুরের খেলায় মত্ত ধরায় সুখের খোজটাই সবাই করছে। ওই যে গানটা শোননি, একবার লিখেছিলাম
কাঁদালে তুমি মোরে
ভালবাসারি ঘায়ে।
বিস্ময়ে আবিষ্ট হয় টুপুর। এর আগে কখনোই চিন্তা করেনি বেদনা আর সুখ পরস্পর হাত ধরে থাকে। ক্ষণিকের বিষাদ আমাদের সর্বক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখে বলেই আমরা সুখের দেখা পাই না কিংবা পেলেও খুব কম সময়ের জন্যেই পাই। টুপুরের খুব গাইতে ইচ্ছে হল পথভোলা পথিকের গানটি। রবীন্দ্রনাথ হাঁটছেন এদিকে সেদিকে। তাকে আবার গাইতে বলতে বেশ লজ্জা লাগছে টুপুরের। হঠাৎ করবির ঝাঁকটা যেন ওর দিকে তাকিয়ে বলল আবার গাও না গানটা। সে গাইতে ধরল আনমনেই।
‘যখন বিদায়-বাঁশির সুরে সুরে শুকনো পাতা যাবে উড়ে
সঙ্গে কে র’বি।’
‘আমি রব, উদাস হব ওগো উদাসী,
আমি তরুণ করবী।’
গাইতে গাইতেই টুপুরের ঘুম ভাঙল। দেখল, রবিঠাকুর আর পাশে নেই। ঘড়িতে দেখল মোটে পাঁচটা চল্লিশ বাজে। এত তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে যাবে সে ভাবতেই পারেনি। আজ মা ছটা বাজার দশমিনিট আগে ডাকতে আসবেন না। শুক্রবার ওকে ডাকা হয় সাতটায়। এখনো একঘণ্টা সময় ওর হাতে আছে। এইসময়টাতে কি করা যায় ? টুপুরের হঠাৎ মনে হল হারমোনিয়াম টা নিয়ে গানটা গাইতে থাকলে মন্দ হয়না। এমনিতেই আটটার দিকে টিচার চলে আসবেন। হাত মুখ ধুয়ে গান নিয়ে বসল সে।
টুপুর হারমোনিয়ামের রিডগুলো মনে রাখতে পারেনা কখনোই। আজ ও পারবে কিনা তা নিয়ে সে সন্দিহান। তবে আজ আর ভীত নয় সে। সে বাজিয়ে গাইতে ধরল। স্থায়ীটা দুবার গাইল সে। মনে হতে লাগল হচ্ছে তো গানটা। খুব বেশি ভুল হচ্ছে না। স্বপ্নের কথা মনে পড়তে লাগল তার, আবার হাসিও পেল। কিন্তু সে বুঝতে পারছে না, গান কি করে হচ্ছে।
হঠাৎ তার মনে এলো, আচ্ছা এই পথভোলা পথিকটা কে, জিজ্ঞেস করা হল না কবিকে। তার আগেই তিনি কোথায় যে গেলেন? একটু পরে মনে হঠাৎ নাড়া দিল এই পথভোলা পথিক খুব চেনা পরিচিত কেউ নয় তো? এই এখনি কি আমার চারপাশে ঘুরছে না ? স্বস্তির পরশ নিয়ে, ছায়া হয়ে তপ্ত রোদে যে সবসময় পাশে থাকে, সেই কি পথভোলা পথিক? হ্যাঁ, এই সেই পথিক। এ পথিক আর কেউ নয়, বায়ু বা বাতাস। ফাগুনের দখিন হাওয়া, চৈত্রের উদাসী পবন, পৌষের হিম বায়ু, বরষার ভেজা বাতাস। এই সেই বাতাস, এই সেই বনবাসী বৃক্ষ তরুদের জীবনদেবতা। কেউ বলে দেয়নি তবুও টুপুর অনুভব করতে পারে সে ঠিক ভাবছে। এ সেই বাতাস, এ সেই পথভোলা পথিক। সে আপনার মাঝে ডুবে গিয়ে, অদ্ভুত ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হয়ে গাইতে থাকে আপনমনে-
আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি।
সন্ধ্যাবেলার চামেলি গো, সকালবেলার মল্লিকা
আমায় চেন কি।’
ওপাশের জানলা থেকে দিনের শুরুর শৈশবের সূর্য কোমল আভা ছড়াতে শুরু করে। গালে এসে লাগে টুপুরের। পথভোলা পথিকের আলতো ছোঁয়ায় দোল খায় টুপুরের কোঁকড়া চুল।
উৎসর্গ : রবীন্দ্রপ্রেমী ব্লগার মাহমুদা সোনিয়াকে।
কবি গল্পটা পড়ে মন্তব্য জানাবো। তোমার প্রোফাইল এর দিকে নজর দিলে ভালো হয়। সরব এ প্রতি পোস্টে প্রোফাইল দেখায় বলে ছোট করাই বাঞ্ছনীয় মনে হয়
সেইটাই দেখছি। ভাবছি কি করা যায়
গল্পটা ভালো লেগেছে। গানটা এতো সুন্দর করে বুঝিয়ে দেয়া গেছে সুন্দর একটা গল্পের সাথে।
এ শহরের বাচ্চাদের এমন ভয়ানক চাপ সহ্য করতে হয়, ভাবতে এতো খারাপ লাগে……
কমেন্টটি খুব ভাল লাগল স্বপ্ন। গানটি আমার খুব প্রিয়।
আর গানটির অর্থ আমি নিজের মত করে বের করেছি বলেই একটা গল্পের আদলে বলতে চাইলাম।
ধন্যবাদ তোমাকে
ভাল লাগলো 🙂
ধন্যবাদ আপনাকে
ভালোই লাগল। গানটার অর্থ বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ … 🙂
কিন্তু টুপুরের জন্য কষ্ট লাগছে এই জন্যে যে, বেচারী তো আর প্রতিবার রবিঠাকুরের কাছ থেকে গান বুঝে নিতে পারবে না…। মায়ের বকুনি তো খেতেই হবে … !
আর টুপুরের আঁকাআঁকি কি বন্ধই রয়ে গেল ??
জানতে ইচ্ছে করছে …
হা হা ভাল বলেছেন।
প্রতিবার রবিঠাকুরের কাছ থেকে গান বুঝে নিতে পারবে না !!
আসলে গল্পটাতে আমি কল্পনাশক্তির প্রকাশটাকে বোঝাতে চেয়েছি। আমাদের দেশে সব কিছুই শিশু বৃদ্ধ সবার উপরেই চাপিয়ে দেয়া হয়, গল্পটার অবস্থান তার বিরুদ্ধেই।
আঁকাআঁকি বন্ধ হয়ে যেতেও পারে নাও পারে, সব প্রশ্নের উত্তর কি আর পাওয়া যায় ?
ভাল থাকবেন কবিতার মত করে
কী সুন্দর ছবির মতো গল্প! আমার ভাগ্নে ভাগ্নিকে পড়তে দিব।
আরও চাই এমন গল্প!
তুমি তো গল্প একটু কম লিখো।
একটু কম না, কত কম লিখি বুঝতে পারবে এই পরিসংখ্যান থেকে
গত সাত বছরে গল্প লিখেছি ৬ টা। হা হা হা
শিশুদের নিয়ে কখনো লিখিনা বলে এই গল্পটাকে কিছুটা শিশু উপযোগী করবার চেষ্টা করেছি। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমার উদ্দেশ্য কিছুটা হলেও সফল
ভাল থাকা হোক
খুব ভালো লাগলো গল্পটা।
ধন্যবাদ নোঙর।
তা আপনার নোঙরটি ছেড়া কেন ভাই ?
ভাল লাগল গল্পটা। সুন্দর!
ধন্যবাদ হাসিব
চমৎকার গল্প 😀
ধন্যবাদ শারমিন
এত্ত সুন্দর একটা গল্প! প্রিয়তে নিলাম। 😀 তবে টুপুরের মত শিশুদের জন্য খুব খারাপ লাগে, এদের নিষ্পাপ আনন্দ পাবার জীবনটা আমরা বিষিয়ে দিচ্ছি। আমার পিচ্চি কাজিনগুলো দেখি ইয়া বড় ভারী ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যায়। স্কুল থেকে ফিরেই হোমটাস্ক, ক্লাস টেস্টের পড়া! বড়দের চেয়ে ওদের ব্যস্ততা একটুও কম নয়! আমরা জোর করে নিজেদের ইচ্ছা চাপিয়ে দিচ্ছি, এরা কোন স্বপ্ন নিয়ে বড় হবে? কেবলই জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা নিয়ে বড় হচ্ছে আজকালকার বাচ্চারা। মা বাবারা যে কেন বুঝতে চায় না! 🙁 এই ট্রেন্ডটা বদলানোর জন্য কিছু একটা করা দরকার। :crying: