ছোটবেলায় একটা রবীন্দ্রসংগীত শুনে চরম চিন্তায় পড়েছিলাম
আকাশে উড়িছে বক পাঁতি
বেদনা আমার তারি সাথী –
আমি ভাবতাম এই ‘পাঁতি’ মানে বোধহয় পাতিকাক। মনে হতো বেশ তো আকাশে উড়ে টুড়ে বেড়াচ্ছে, এর মধ্যে বেদনা আসলো কই থেকে? তারপর নিজেই ভেবে ভেবে গল্প বের করতাম একটা বক আর পাতিকাকের অসম বন্ধুত্বের তীব্র একাকিত্ব নিয়ে। গানটা শুনলেই আমি বেদনার্ত চিত্তে কল্পনা করতাম একটা বক আর একটা কাক পাশাপাশি উড়ে যেতে চাইছে আর বারেবারে এর ওর পাখার বাড়ি খেয়ে ঝুপ ঝুপ করে পড়ে যাচ্ছে। তার ও অনেক অনেক দিন পরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা প্রথম আলো পড়তে পড়তে জানলাম ‘পাঁতি’ অর্থ আসলে ‘ঝাঁক’। মানে একটা বকের ঝাঁকের কথা বলা হয়েছে গানটায়। পাতিকাক ত্রিসীমানাতেও নাই!
আমার ছোটমামার বিয়ে হয়েছে মেলবোর্নে। তখন আমরা স্কুলে পড়তাম। বাংলাদেশের বিয়ে খাওয়ার স্মৃতি ততদিনে অস্পষ্ট হতে হতে বোরহানী আর কাবাবে এসে ঠেকেছে। আমরা ঠিক করলাম একটা সত্যিকারের বাংলাদেশী বিয়ের হইচই করে মেলবোর্ন বাসীকে আনন্দে উত্তাল করে দিতে হবে।
-গান ছাড়া বিয়ে হয় নাকি?
-গান কই পাওয়া যায়?
-বাংলা নাটকে!
– বাংলা নাটক কাহাকে বলে?
-হুমায়ুন আহমেদ যাহা রচনা করেন।
হুমায়ুন আহমেদের যাবতীয় নাটকে একটাই বিয়ের গান ‘লীলাবালি লীলাবালি…’। ঠিক হলো এই গান শেখা হবে। আমার মেঝবোনের হাতের লেখা সবচেয়ে ভালো, সে সবাইকে গান লিখে লিখে দিল। লিরিক লিখেছিল –
লীলাবালি লীলাবালি বড় যুবতী
সইগো কি দিয়া সাজামু তোরে…
মনে আছে আমরা ‘বড় যুবতী’ নিয়ে খুব হেসেছিলাম। মানে কি? মহা মোটকা? তাগড়া বউ? অথচ আসলে শব্দটা ছিল ‘বরজবতী’। এর মানে কি? ভাগ্যবতী?
আমার বাংলাদেশী বন্ধুবান্ধব জুটেছিল ইউনিভার্সিটিতে পড়তে শুরু করার পরে। স্কলারশীপে অনেক ছেলেমেয়ে পড়তে আসতো বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে, ওদের সাথে মিলেমিশে আমরা এর ওর বাসায় গান গাইতাম। একবার ঠিক করলাম সবাই মিলে একটা কনসার্ট করে মেলবোর্নের জনসাধারণকে তাক লাগিয়ে দিব। ধুন্ধুমার রিহার্সেল শুরু হলো। কোরাস গান হবে ‘এক ঝাঁক প্রজাপতি ছিলাম আমরা’। শাকিল ছিল তিস মার খান একদম। তার নানাবিধ অলৌকিক কর্মকান্ডের মধ্যে একটা মনে পড়ছে – সে একবার এক সিটিং এ বত্রিশটা সিদ্ধ ডিম খেয়েছিল। সে যাক, সবাইকে গানের কথা লিখে দেয়া হলো। তবে কার যেন গলা মিলছিল না আর কোন একটা শব্দে ভুল করছিল বারেবারে, কিন্তু কোরাসের কারণে আলাদা করে ভুলটা ধরা যাচ্ছিল না। তখন সবাই আলাদা আলাদা গেয়ে শোনাল। শাকিল অখন্ড মনোযোগে, সর্বশক্তিতে গাইল –
দেয়াল ছিল না চলার পথে
হয়নি পরিচয় বাপের সাথে…
ওর গান শুনে আমরা ধুমসে হা হা হি হি করলাম, ও খালি সবার দিকে অবাক হয়ে তাকায় আর বলে ‘এই তোমরা হাসো কেন?’
আমি জীবনে প্রথম যাঁর প্রেমে পড়ি (মানে একদম সত্যিকারের প্রেম, অন্য কানের পাশ দিয়ে গুল্লি টুল্লি বাদে), তিনি ছিলেন নানান গুনে গুনান্বিত। তাঁর স্বরচিত হামদ ও নাথ তিনি একবার আমাকে সকন্ঠে গেয়ে শুনিয়েছিলেন। কয়েক লাইন এখনো মনে আছে –
লাব্বায়েক লাব্বায়েক
বলে ফেল বারকয়েক
তারপরে ওগো মানুষ তুমি
যাও মক্কা শরীফ চলে
ঝিম মেরে কেন পড়ে আছো
বস দুহাত তুলে!
এর সাথে আবার কাওয়ালী ধাঁচের নাচ ও আছে। শেষ লাইনটা গাওয়ার সময় দুই হাত মাথার উপরে তুলে তালি দিতে হয়।
কিছু গান আছে ভিজুয়ালি হাস্যকর। যদিও রোমান্টিক হওয়ার কথা, যেমন –
স্বর্ণালী বিকেলের সোনা রোদ মেখে ওই
পাহাড়ের চুড়ায়
তুমি বসেছিলে আমি দেখেছি
এই গানটা শুনলে আমি একটা কার্টুন এঁকে ফেলি মনে মনে। সেখানে একটা পাহাড় থাকে চোখা পেন্সিলের মতন, আর তার চুড়ায় খুব বেকায়দায় একটা মেয়ে বসে থাকে। পাহাড়ে চড়েছে নাকি শূলে বোঝা যায় না।
অথবা ওই গানটা শুনেছেন কেউ?
তোমার আকাশ দুটি চোখে
আমি হয়ে গেছি তারা
এই জীবন ছিল নদীর মত গতিহারা…
কি ভুলভাল কথা না? গতিহারা হলে নদী হলো কি করে?
কিশোর কুমারের একটা গান আছে চরম মজার।
ওগো নিরূপমা,করিও ক্ষমা…
তোমাকে আমার ঘরনী করিতে
আমার মনের দোসর করিতে
পারিলাম না, পারিলাম না যে কিছুতেই…
এই রকম ক্ষমা চাইলে তো নিরূপমার পিত্তি জ্বলে যাওয়ার কথা রাগের চোটে।
তারপরে
হয়তো তোমার অনেক কিছুই আছে
নেই দাম তার কোনই আমার কাছে…
এই গান শোনার পরে নিরূপমা কি বলেছিলেন?
তাইলে হালার বিয়াই করুম না!
“এই গানটা শুনলে আমি একটা কার্টুন এঁকে ফেলি মনে মনে। সেখানে একটা পাহাড় থাকে চোখা পেন্সিলের মতন, আর তার চুড়ায় খুব বেকায়দায় একটা মেয়ে বসে থাকে। পাহাড়ে চড়েছে নাকি শূলে বোঝা যায় না।”
মজা পেলাম পড়ে। আপনি তো ভীষণ কল্পনাপ্রবণ! 😛
আপনার লেখার স্টাইল ভাল লেগেছে। 🙂
অনেক আগে পড়েছিলাম এক জায়গায়, গানের কথা ভুল বোঝাকে বলা হয় mondegreen syndrome। 😛 এই নামকরণের পেছনের কাহিনীটাও মজার।
http://en.wikipedia.org/wiki/Mondegreen
সামিরা অনেক ধন্যবাদ লিংকটার জন্য! এখন দেখি সবকিছুর জন্যই একটা করে সিনড্রোম উপস্থিত!
🙄
গানের লিরিক নিয়ে আমার এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতা আছে।
তুমি আমার বায়ান্ন তাসকে ভেবেছিলাম
তুমি আমার বায়ান্নতা
আর বায়ান্নতা মানে হচ্ছে বোহেমিয়ান আচরণ!
এই রকম আরও কত বোকামি!
মডার্ন টাইমস এ চার্লি চ্যাপলিন গানের লিরিক ভুলে যায় বলে আবোল তাবোল বলে নাচতে থাকে শুধু সুর মিলিয়ে সেটাই আমজনতা ব্যাপক পছন্দ করে।
একটা মেয়েকে পাহাড়ের চূড়ায় বেকায়দায় বসাতে পারলেন আপনে?! ছিঃ 😛
হা হা! বায়ান্নতা মানে শিখলাম! আমি যে কত্ত বড় মুর্খ মাঝে মাঝে বুঝি।
মেয়ে বলেই তো অবলীলায় বসাইতে পারলাম।জানেন না, মেয়েদের সবচেয়ে বড় শত্রু নাকি মেয়েরা?
লাব্বায়েক লাব্বায়েক
বলে ফেল বারকয়েক
তারপরে ওগো মানুষ তুমি
যাও মক্কা শরীফ চলে
ঝিম মেরে কেন পড়ে আছো
বস দুহাত তুলে!
হাহাহাহাহা……………… 😛
ইশ সুর টা আপনাকে শোনানো যাচ্ছে না! ওইটার রেকর্ডেড ভার্সান নাই আমার কাছে, সেইটা শুনে আমি মোটামুটি বিছানা থেকে পড়ে গেছিলাম।
আপনার লেখার হাত বেশ ভালো, আর তার সাথে কল্পনাশক্তিও। 🙂
গানের লিরিক দেখার আগ পর্যন্ত সব সময়-ই কিছু শব্দ উল্টোপাল্টা হয়ে যায়। লিরিক দেখে মনে হয় ‘ও আচ্ছা! এইটা!’ 😛
নতুন লেখার অপেক্ষায় থাকলাম।
আপনি পড়েছেন বলে অনেক ধন্যবাদ! আর লিখতে উৎসাহ দেয়ার জন্য আরো বড় ধন্যবাদ! 🙂
ইয়ে মানে… শেষ পর্যন্ত এসে কী লিখবো বুঝে পাচ্ছিনা। শুরুটা একরকম, শেষে নিরুপমাকে নিয়ে কথা। সুর পালটে অন্য দিকে চলে গেছে!!
তবে আপনার লেখাতে মাঝে শব্দের সুন্দর স্রোত বয়ে গেলো… পাঠক হিসেবে পড়ে ভালো লাগলো… লেখা চলুক! 🙂
আমার তো এরকম ই দশা! কি ভাবে শুরু করি তারপরে কই যাই কোন ঠিকঠিকানা নাই। আমার কথাবার্তা সব আমার মতনই অগোছালো। তবুও পড়েছেন যে তাতেই খুশি লাগছে। 🙂
“এই গানটা শুনলে আমি একটা কার্টুন এঁকে ফেলি মনে মনে। সেখানে একটা পাহাড় থাকে চোখা পেন্সিলের মতন, আর তার চুড়ায় খুব বেকায়দায় একটা মেয়ে বসে থাকে। পাহাড়ে চড়েছে নাকি শূলে বোঝা যায় না।”
🙄 🙄