মৃন্ময়ী ঠিক বুঝতে পারছে না ব্যাপারটা কি রকম হবে , ঠাণ্ডা মাথায় কিছুক্ষণ চিন্তা করা দরকার , ব্যাপারটা অনেকটা “ভেতর বলে দূরে থাকুক, বাহির বলে আসুক না” টাইপের অবস্থা । তার খুবই ইচ্ছা করছে কাজটা করতে কিন্তু আবার একই সাথে মনের ভেতর থেকে কোন একজন বলছে “না মৃন্ময়ী, না”
মৃন্ময়ী নামটা শুনলেই কেন যেন চোখের সামনে “অষ্টাদশী” তরুণী চোখের সামনে ভেসে উঠে , ব্যাপারটা এমন যেন কোন বয়স্ক মহিলার নাম “মৃন্ময়ী” হতে পারে না, আমাদের খেয়ালই থাকে না “এই অষ্টাদশী” তরুণী একদিন সময়কে পেছনে ফেলে এগিয়ে যায় , একদিন তার এলোকেশ চুলেও পাক ধরে , তার চামড়ায় ও ভাজ পড়ে , সময়ের সাথে সাথে সে ও একদিন বেড়ে উঠে । মৃন্ময়ীর বয়স এখন ৪০ এর কোঠায় , চাইলে চালশে বলা যায় , কিন্তু সেটা বলার সাধ্য কারও আছে বলে মনে হয় না ।
জরুরী একটা কাজে মৃন্ময়ীর দেশে এসেছেন , তিনি দীর্ঘ দিন দেশের বাহিরে আছেন , যাবার সময় ভেবেছিলেন ফিরে আসবেন ,কিন্তু তা আর সম্ভব হয়ে উঠেনি , একে একে স্বামী, সন্তান ,চাকরি , কত কিছু ,এভাবে ধীরে ধীরে শিকড় গজাতে থাকে , সে শিকড় উপড়ে দেশে আসাটা খুবই অসম্ভব একটা কাজ , আর একজন নারীর জন্য হলে সে ক্ষেত্রে “প্রায়” শব্দটা বাদ চলে যায় ।
“ব্যাপারটা” সম্পর্কে কিছুটা সন্দিহান মৃন্ময়ী, এতদিন পরে পুরনো জিনিস ঘাটতে মনে চাচ্ছে না , কিন্তু তার মনে হচ্ছে এই দেশে আর আসা হচ্ছে না, এই শেষ আসা , তার কিছু বিষয় খুবই জানা প্রয়োজন , কেন প্রয়োজন তা তিনি নিজে ও জানেন না, কিন্তু তার মনে হচ্ছে জানতেই হবে , সবচেয়ে ভাল হত অন্য কারও মাধ্যমে জানতে পারলে , কিন্তু সেটা আর সম্ভব না, গত পনের বছরে এই দেশ থেকে তিনি সযত্নে তার শিকড় উপড়ে ফেলেছেন , ব্যাপারটা যে কতটা কঠিন ছিল সেটা শুধুমাত্র তিনিই জানেন । আর তিনি এসেছেন খুবই হঠাৎ করে আর খুবই সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ।
তিনি চেয়েছিলেন আর কেউ না জানুক তার এই আসার কথা , কিন্তু এখন কেন জানি মনে একজন মানুষ জানবে তার আসার খবর ,আসলে জানাতে হবে । এই দেশে পা দেবার পর থেকেই সব কিছু কেমন যেন উল্টাপাল্টা হতে শুরু করেছে , বাহিরে থাকাকালীন সময়ে যে আবেগটাকে সযত্নে কবর দিয়েছিলেন , তা কেমন যেন বেড়িয়ে আসতে চাইছে , তবে ব্যাপারটা এমন না যেন সেটা বেড়িয়ে আসছে , মেয়েরা খুবই ভাল নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, আর তার ক্ষেত্রে তো সেটা আরও বেশি ।
প্রত্যেক মেয়ের জীবনেই কিছু অধ্যায় থাকে যার খুঁজ সে ছাড়া আর কেউ জানে না, আর একজন মানুষ জানে যে সেই অধ্যায়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত থাকে । পাশাপাশি এক বিছানায় শুয়ে ও যে অধ্যায়ের খুঁজ বেশির ভাগ পুরুষ মানুষই পায় না , নারীরা খুব সহজেই সেই অধ্যায়টাকে তাদের মনের কোন এক জায়গায় লুকিয়ে ফেলতে পারে , কিন্তু সে জায়গাটা জুড়ে একটা শূন্যতা থেকেই যায় । ছেলেদের জীবনে সেরকম শূন্যতা কমই থেকে কারণ তারা খুব কমই শূন্যস্থান রাখতে পারে , যে কোন শূন্যস্থানই তারা অতি দ্রুত পূর্ণ করে ফেলে । শূন্যের কোন স্থান তাদের জীবনে খুব কমই থাকে ।
তার হাতে সময় খুবই কম , এর মধ্যেই কাজটা করতে হবে , “মারুফের” সাথে দেখা করতে হবে , যার সাথে সর্বশেষ দেখা হয়েছিল ১৫ বছর আগে , এই ১৫ বছরে জগতে কত কিছু বদলে গেছে , বুড়িগঙ্গায় কত জল গড়াল , কত কিছু ভাঙল ,আর গড়ল , মারুফ ও হয়তবা বদলে গেছে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে , মারুফের সাথে দেখা করাটা দরকার । কে জানে আর কোনদিন দেখা হয় কিনা , হয়তবা এইটাই শেষ দেখা ।
কিছু ক্ষণ চিন্তা ভাবনা করে মৃন্ময়ী দেখা করার সিদ্ধান্ত নিল , শেষ বারের মত দেখা করার , মৃন্ময়ী বুঝতে পারছেন না তিনি কি ঠিক করছেন কিনা, কিন্তু তারপর ও কেন জানি তার মারুফের সংসারটা দেখতে মন চাচ্ছে, মারুফের ও হয়তবা বাচ্চা হয়েছে , সে বাচ্চাগুলোকে দেখতে ইচ্ছা করছে , নিতান্তই অমূলক ইচ্ছা কিন্তু তারপর ও প্রচণ্ড ইচ্ছে করছে ।
আজ সন্ধ্যায় মৃন্ময়ীর ফ্লাইট ,হাতে সময় খুবই কম,এর মধ্যেই দেখা করতে হবে , ঠিকানা জোগাড় করাটা একটা বিশাল ব্যাপার, মারুফ এখন কোথায় আছে কে জানে , ঠিকানা কিভাবে জোগাড় করা যায় মৃন্ময়ী বুঝতে পারছেন না, অন্যদের সাহায্য নিলে অবশ্য ব্যাপারটা খুব বেশি কঠিন হত না,কিন্তু কেউ জানুক তা তিনি চান না। একা একা আজকে দিনের মধ্যে ঠিকানা জোগাড় করাটা কিভাবে সম্ভব মৃন্ময়ী বুঝতে পারছে না , কিন্তু আজকের মধ্যে জোগাড় না করতে পারলে হয়তবা এই ঠিকানাটা সারা জীবনের জন্য হারিয়ে যাবে , আর কোনদিনই হয়তবা এই ঠিকানাটার খোঁজ করা হবে না, এই ঠিকানাটা ঠিকানার চেয়ে বড় কিছু ।
কিভাবে শুরু করা যায় মৃন্ময়ী কিছুই বুঝতে পারছেন না , মারুফ কোথায় কাজ করে , কিংবা সে রকম কিছু ও যদি জানা থাকত তাহলে ও হয়তবা কিছু করা যেত কিন্তু এখন আর কিছুই করার নেই , মারুফ সম্পর্কে মৃন্ময়ী যা জানেন তা মনে করার চেষ্টা করতে লাগল , কোন কিছু একটা যা দ্বারা অন্তত আর কিছু না হোক অন্য কাউকে না জানিয়ে একটু খোঁজ খবর নেয়া যায় ,কিন্তু কোন কিছুই মনে আসছে না, সময়ের স্রোত সব কিছুর উপরই একটা প্রলেপ দিয়ে দেছে ।
হ্যাঁ, একটা উপায় অবশ্য আছে ,সেটা হচ্ছে মারুফদের জিগাতলার বাসা, যতদূর মনে পড়ে মৃন্ময়ীর ওই বাড়িটা ছেড়ে অন্য জায়গায় যাবার কথা ছিল , এখন আছে কিনা কে জানে , মারুফরা না থাকলে ও যারা থাকে তারা অন্তত কিছু একটা বলতে পারার কথা ।
ঠিকানাটা স্পষ্ট মনে আছে মৃন্ময়ীর , জিগাতলা বাস স্ট্যান্ড থেকে ৩ মিনিট যাবার পর ডান দিকের গলি, গলি ধরে আগাতে থাকলে পর পর তিন বার বাঁক নিতে হবে , তার পর গলি ধরে হাঁটতে থাকলেই হল , রাস্তার শেষ মাথায় ওদের বাড়ি , সাদা রঙের একটা টিনশেড বিল্ডিং , অবশ্য এখন কি আছে কিনা কে জানে!
ওদের বাড়ির সামনে একটা চায়ের দোকান ছিল ,সেটা এখন আর আছে কিনা কে জানে , সে দোকানদারের চেহারার সাথে “হিটলারের” চেহারার ভাল মিল ছিল!! এই দোকানকে ঘিরে কত স্মৃতি , না মৃন্ময়ী কিছুই মনে করতে চাচ্ছে না , যা একবার অতীত হয়েছে তাকে টেনে আনার কোন মানেই হয় না , মৃন্ময়ী বর্তমানে বাস করে ,অতীত নিয়ে ভাবার মত সময় বর্তমানের মানুষের খুব কম সময়ই থাকে ।
মৃন্ময়ী খুব তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিল,আগামী কয়েক ঘণ্টার জন্য একটা মানসিক প্রস্তুতি দরকার , প্রথমত ঠিকানা জোগাড় করতে বিশাল একটা ঝামেলা পোহাতে হবে বলে হচ্ছে , যদিও শেষ পর্যন্ত পারা যাবে কিনা সন্দেহ , আর যদি পাওয়া ও যায় তাহলে করতে হবে আসল কাজটা মারুফের সাথে দেখা করা , ব্যাপারটা কি রকম হবে কে জানে !! মারুফের স্ত্রী ব্যাপারটা কিভাবে নিবে? যদি জিজ্ঞাসা করে সে কে তাহলে কি উত্তর দিবে? মারুফ কিভাবে নিবে ব্যাপারটা ?
এত গুলো প্রশ্নের উত্তর না জানা সত্ত্বেও মৃন্ময়ীর ইচ্ছা করছে দেখা করতে , খুবই অবাধ্য একটা ইচ্ছা ।
জিগাতলা তলায় এসে মৃন্ময়ী অবাক হয়ে গেল সব কিছুই বদলে গেছে! বদল হবে এইটাই স্বাভাবিক কিন্তু এতটা আসা করেনি , এত বেশি রকমের বদলের কারনে মৃন্ময়ীর জানা ঠিকানা পেতে অবস্থা খারাপ হয়ে গেল , গলির মোড়ের সেই চায়ের দোকান আর নেই , সব জায়গায়ই আকাশ চুম্বী দালান , সেই হাতের তালুর মত চেনা এলাকাই এখন সম্পূর্ণ অপরিচিত , কিছুই আর চেনা যায় না, যে জায়গাটায় মারুফের সাথে দেখা হত সে জায়গার আর কোন অস্তিত্বই নেই ।
মৃন্ময়ী সব চেয়ে বেশি অবাক হল মারুফদের বাড়ি দেখে , এত সব বদলের ভিড়ে আজ সেই রকমই আছে , একটু ও বদলে নি , বাড়ির সামনে একটা বাগান ছিল আগে , এখন ও সেই বাগানটা আছে , শুধুমাত্র বাগানটা একটু বড় হয়েছে মাত্র , তবে হ্যাঁ এই একটা বিষয় বদলে গেছে তা হল আগে এই বাড়ি সব সময়ই প্রানচাঞ্চল্যে মুখরিত থাকত , কিন্তু এখন বাহির থেকে দেখলেই বুঝা যায় বাড়িটি মোটামুটি নিস্তব্ধ ।
মৃন্ময়ীর ধারণা হচ্ছে মারুফরা এখন আর এক বাসায় থাকে না । কোথায় থাকে কে জানে!!
গেট পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকল মৃন্ময়ী ,চেনা জানা সেই বাড়ি , বাসার বেল টিপল মৃন্ময়ী , একজন অল্প বয়সী ছেলে দরজা খুলল , দেখেই বুঝাযায় এ বাসায় কাজ করে ,
-কারে চান?
মৃন্ময়ী বুঝতে পারছে না কি বলবে, সে তো মারুফকে চায় কিন্তু সে কথা একে বলে তো আর লাভ নেই ,একে কিভাবে বুঝানো যাই , কি সমস্যায় পড়ল !!
-আমি আসলে এই বাসার মালিকের সাথে কথা বলতে চাচ্ছিলাম,
-স্যার বাসায় নাই ,আপনে পরে আইসেন
-বাসায় কথা বলার মত আর কেউ নেই?
-জে না ,আমি একাই বাসায় আছি ।
মৃন্ময়ী কি করবে কিছু বুঝতে পারছে না , এই বাসার মালিক কখন আসবে কে জানে , তিনি যদি সন্ধ্যা বেলা আসে !! কিংবা আজকে নাই আসে!!
-আচ্ছা, তোমার স্যার আসবেন কখন?
-১ টার দিকে আইব ।
মৃন্ময়ী ঘড়ি দেখল, হাতে সময় আছে ১ ঘণ্টা , এই সময়ের মধ্যে কোন কিছু করা সম্ভব না , কোন কোথাও যাবে তাও সম্ভব না,কারন ভদ্রলোক যদি বাসায় এসে আবার চলে যায়!! তাহলে তো আবার সমস্যা!! কি করা যায় এই ১ ঘণ্টা ? ইশ ভদ্রলোক যদি আজ কোন কারণে আগে চলে আসতেন!!
-আচ্ছা,আমি কি একটু বসতে পারি ?
ছেলেটা কিছুক্ষণ সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বলল
-জে না, আমার স্যার এর নিষেধ আছে
-দেখ,আসলে আমার তোমার স্যার এর সাথে দেখা করাটা খুবই জরুরী ।
ছেলেটা আবার ও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ কি মনে করে গেট খুলে দিল ।
মৃন্ময়ীকে বসার রুমে নিয়ে গেল, মৃন্ময়ীকে বসতে বলে ভিতরে চলে গেল ।
মৃন্ময়ী হঠাৎ বুঝতে পারল , একটা বিরাট বোকামি করা হয়েছে ,এতক্ষণ এই একটা জিনিস সে বুঝতেই পারে নি ,এই বাড়ির বর্তমান মালিক কে? এই বাড়ি কি এখন ও মারুফদের আছে আছে কিনা কে জানে? আর যিনি এ বাড়ির মালিক তিনি কি মারুফকে চিনেন কিনা কে জানে ? বরং না চিনার সম্ভবনাই খুবই বেশি, কিন্তু এ ছাড়া আর কিছুই করার নেই , এখন কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই হবে , ভাগ্য যদি খুব সহায় হয় তাহলে হয়তবা তিনি মারুফকে চিনবেন, আর যদি না চিনেন তাহলে আর কিছুই করার নেই , মৃন্ময়ীকে ফিরে যেতে হবে , হয়তবা চির দিনের জন্য , আর কোনদিনই মারুফের খোঁজ করা হবে না, চির দিনের মত তা চলে যাবে বিস্মৃতির পাতায়, নিউরনের সিনাপ্সিস গুলো অপ্রয়োজনীয় তথ্য মনে করে হয়তবা রা“মারুফ”নামটিকে সরিয়ে ফেলবে ,কিন্তু তারপর ও বুকের মাঝের ওই শূন্যস্থানটা ঠিকই থেকে যাবে ,
কোন কাজ না থাকায় মৃন্ময়ী ঘরের চারপাশ দেখতে লাগল ,ভাল করে একটু চোখ বোলালেই সহজেই বুঝা যায় এই বাড়িতে “গৃহকর্ত্রী” নামক কোন মানুষের অস্তিত নেই , চারপাশ কিছুটা অগোছালো ।
এসব কিছু দেখতে দেখতে মৃন্ময়ীর পুরনো কথা মনে পড়তে লাগল , মনে না চাইলে ও পুরনো কথারা একে একে লাইন ধরে ভিড় করতে থাকে , পুরনো সব স্মৃতি । সময় কিভাবে যে এত দ্রুত চলে গেল, মনে হয় যেন সে দিনের কথা !!
বাসায় এসে মারুফ আহমেদ জানতে পারলেন তার সাথে একজন মহিলা দেখা করতে এসেছেন, তিনি কিছুটা অবাক হলেন , তার কাছে এমনিতে কেউ আসে না , কে এসেছে কিছুই বুঝতে পারলেন না ।
বসার ঘরে ঢুকে মারুফ মোটামুটি চমকে উঠলেন,তিনি ঠিক বুঝতে পারলেন না তিনি যা দেখছেন তা কি সত্যি নাকি? এটা কি করে সম্ভব!!! নাকি তিনি ভুলে অন্য বাসায় ঢুকে গেছেন!! কিছু একটা ভুল হচ্ছে কিন্তু সে ভুলটা যে কি তা তিনি বুঝতে পারছে না, মৃন্ময়ী সোফায় বসে আছে!! কিন্তু এটা কি করে সম্ভব!! নাকি অন্য কেউ বসে আছে ,তাকে মৃন্ময়ীর মত লাগছে!!! কিন্তু দেখতে তো অবিকল সেই একই মানুষ, একই রকম চোখ ,নাক, মুখ! বসার ভঙ্গিটি ও একই রকম , সেই একই ভাবে গালের নিচে হাত দিয়ে বসে আছে । এত বছরে ও একটু খানি বদলে যায় নি, সেই মৃন্ময়ী!!
তিনি কি করবেন বুঝতে পারছেন না , মৃন্ময়ী হঠাৎ করে কোথা থেকে আসল? আজ এত গুলো বছর পর আবার সেই মানুষটিকে তিনি দেখতে পাচ্ছেন এককালে যে মানুষটিকে একদিন না দেখে থাকা যেত না!!! অথচ সেই মানুষটিকেই না দেখে এত বছর কি সুন্দর চলে গেল!! মানুষ আসলেই খুবই রহস্যময়, সে নিজেই ও জানে না ,সে কি পারে ,
মারুফকে দেখেই মৃন্ময়ী ও চমকে উঠল , তিনি ধারনাই করতেই পারেন নি মারুফ ই হবে এই বাড়ির সেই “স্যার” এত সহজে মারুফের দেখা পেয়ে যাবে মৃন্ময়ী ভাবতে ও পারে নি , কি অদ্ভুত! এই সেই মারুফ!!দুজনই কি বলবে বুঝতে পারছিল না, শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা , তাই মৃন্ময়ীই কথা শুরু করল খুব ধীরে ধীরে বলল
-আসলে , আমি দেশে এসেছিলাম একটা জরুরী কাজে , আজ সন্ধ্যায় আমার ফ্লাইট , হয়তবা এটাই আমার শেষ এ দেশে আসা , তাই ভাবলাম যাবার আগে তোমার সাথে দেখা করে যাই ,মনে হচ্ছিল আর কোন দিন হয়তবা দেখা করার সুযোগ হবে না , তোমাকে এই বাসায় পেয়ে যাব ভাবতেই পারিনি , আমি ভেবেছিলাম আরও অনেক খোঁজাখুঁজি করতে হবে ।তো তারপর কেমন আছ?
মারুফ কি বলবে বুঝতে পারছিলেন না, কি বলা যায় ,কত কথা বলার ছিল!! এত দিন ধরে জমে থাকা কথা!!কিন্তু তিনি নিজেকে সামলে খুব শান্ত ভাবে বললেন
– আমি ও আসলে তোমাকে দেখে অবাক হয়েছিলাম , তুমি আগের মতই আছ , বদলে যাও নি ,হম , ভালই বলা যায় , চলে যাচ্ছে । তোমার খবর বল?
-আমি ও ভালই আছি ,
এর পর আর কি বলা যায় মৃন্ময়ী বুঝতে পারছে না ,মৃন্ময়ীর অবস্থা বুঝতে পেরেই হয়তবা মারুফ ই কথা বলল
-তোমার স্বামীর খবর কি?? বাচ্চা কাচ্চা??
মৃন্ময়ী যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল ।
-হম , ভালই আছে , আমার দুইটা বাচ্চা ,একটার বয়স ৯, আর আরেকটার ৬ ,
মৃন্ময়ী বুজতে পারছে না প্রশ্নটা করা ঠিক হবে কিনা , কারণ এখানে আসার পর মৃন্ময়ীর ধারণা হয়েছে মারুফের বউ এ বাসায় থাকে না, তাহলে কি কোন ঝামেলা চলছে?
-তোমার বাচ্চা কাচ্চা??
হাহাহাহাহহাআহ ,উচ্চ স্বরে হেসে উঠল মারুফ,
মৃন্ময়ী কিছু বুঝতে পারছে না, মারুফের এমন করে হাসার কারণ কি??
-আমি তো বিয়েই করিনি ,বাচ্চা আসবে কোথা থেকে!!!!
মৃন্ময়ীর মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে !! মারুফ এ গুলো কি বলছে!!! চারপাশের সব কিছু কেমন জানি লাগতে থাকে , মারুফের কথা কিছুই তার কানে যাচ্ছে না , ও কি বলছে এ গুলো !!
-বিয়ে করনি মানে কি!!! তুমি কি বলছ এ গুলো!!!
-বিয়ে করিনি মানে বুঝতে পারছ না কেন সেটা তো আমি ও বুঝতে পারছি না, এত দিন বাহিরে থাকার ফলে কি বাংলা ভাষা ও ভুলে গেলে নাকি?? হাহাহাহহাহ
-মারুফ, আমি মজার কোন কথা বলছি না , আমি জানতে চাচ্ছি ,বিয়ে করনি মানে কি ? তুমি বিয়ে করনি কেন!!!!
চিৎকার দিয়ে বলে মৃন্ময়ী,
-তুমি এভাবে কথা বলছ কেন?? বিয়ে না করাটা এমন কোন বিষয় না!! পৃথিবীতে বিয়ে না করার ঘটনা এই প্রথম ও না!! বিয়ে করেনি এমন অনেকেই আছে!!!
মৃন্ময়ী কিছুই বুঝতে পারছেন না,মারুফ তাকে প্রচণ্ড ভালবাসত তিনি জানতেন কিন্তু তাই বলে বিয়ে করবে না!! প্রচণ্ড রাগ আর ঘৃণা হচ্ছে, কিন্তু সেটা কার উপর বুঝতে পারছেন না ,তার নিজের উপরই??
-দয়া করে আমার সাথে আমার হেয়ালি করো না, আমি তোমার হেয়ালি শুনতে আগ্রহী না , আমি জানতে চাচ্ছি তুমি বিয়ে করনি কেন?তুমি কি ভেবেছ বিয়ে না করে তুমি নিজেকে মহাপ্রেমিক প্রমাণ করেছ? তোমার কি ধারণা এই কাজটা খুব বিরাট কিছু? যুগের পর যুগ মানুষ তোমার এই কাজের জন্য বাহবা দিবে ? বলবে “আহারে কি মহান প্রেমিক ছিল” , তুমি কি মনে করেছ তোমার নামে মনুমেন্ট গড়া হবে?? তাহলে বলব তুমি বিরাট ভুল করেছ , কেউ এই কাজকে বাহবা দিবে না , বরং সবাই এটাকে বোকামি বলবে , বুঝতে পারছ??
-তোমার কথা কি শেষ!!! হাহহাআহহা
দেখ , আমি বিরাট কিছু হবার জন্য বা কারও বাহবা পাবার জন্য বিয়ে করিনি তুমি এমনটি কেন মনে করছ আমি জানি না , কিন্তু সত্যিকার অর্থে তেমন কিছুই না, আমি কেন বিয়ে করিনি তার কারণ হচ্ছে,
দেখ আমি চাইলে আরেকটা মেয়েকে বিয়ে করতে পারতাম, কিন্তু কথা হচ্ছে এমন তো হইতেই পারত আমি যে মেয়েটাকে বিয়ে করতাম সে তার সমগ্র জীবনের সবটুকু ভালবাসা তার স্বামীকে দেবার জন্য জমিয়ে রেখেছিল , সে মেয়েটি শুধুমাত্র তার স্বামীকেই শুধু ভালবাসবে বলে এক জগত তৈরি করে রেখেছিল । সুতরাং সে মেয়েটি তো চাইবেই তার স্বামী তাকে তার মত করে ভালবাসুক , কিন্তু আমি কি সেটা পারতাম?পারতাম না , কারণ আমি আরেকজনকে ভালবাসি , তাহলে যে টা হত তা হল শুধু একটি মেয়ের স্বপ্ন ভাঙত , একটি মেয়ে শুধুই কষ্ট পেত যার জন্য তার কোনই দোষ নেই ,বরং আমার ভুল সে বহন করত ।
এখন তুমি বল কি দরকার আরেকজন মানুষকে শুধু শুধু কষ্ট দেয়ার? অন্তত সে অধিকারটা তো আমার নেই
-মারুফ, তুমি বোকার কথা বলছ । আমিও তো তোমাকে ভালবাসতাম কিন্তু আমি তো বিয়ে করেছি এখন আমি আমার স্বামীকে ভালবাসি, আমার সন্তান আছে , আমি আমার সন্তানকে ভালবাসি , তোমার কথা গুলো সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ।
-দেখ, সব মানুষ তো আর এক হয় না, তুমি পেড়েছ ,আরও অনেকেই পারে , কিন্তু আমি পারতাম না , সবাই কি আর সব কিছু পারে?
আমি জানি আমি যা করেছি তাকে অনেকেই বোকামি বলবে , অনেকেই অনেক কিছু বলবে কিন্তু কথা হচ্ছে আমি পারতাম না , আর আমার না পারার জন্য অন্য একজন নিরিহ মানুষকে কষ্ট দেবার কোন মানেই হয় না ।
– তুমি তাহলে এমন একজন বিয়ে করতে যে তোমার মত??
-তাতেই লাভ কি হত ,সে হয়তবা পারত কিন্তু আমি তো পারতাম না , কিংবা সে ও পারত না, তা হলে লাভ কি?? শুধু বিয়ে করার জন্য বিয়ে করে কি লাভ ? তাতে হয়তবা বংশ বিস্তার হত কিন্তু আর যাই সংসার হত না । আর সে বংশ বিস্তারের যে সদস্যরা জন্ম নিত, তাদের ও তো কোন দোষ নেই , আমাদের দুই প্রাণীর মাঝে পরে তাদের জীবন পিষ্ট হত , কি দরকার এত গুলো মানুষকে কষ্ট দেবার?? এত গুলো জীবন নষ্ট করার?
আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে আমি তো ভালই আছি , যদি এভাবেই ভাল থাকি তুমিই বল কি দরকার বিয়ের??
-তোমার মত ভাবলে পৃথিবীতে কাউকে আর বিয়ে করতে হত না
-সবাই এভাবে ভাবে না , আমি ভাবি , কি আর করার বল??
– তাই বলে বিয়ে করবে না!!!!
– দেখ, আমার যা মনে হচ্ছে আমার এই অবস্থানের জন্য তুমি নিজেকে দায়ী করছ , কিন্তু ব্যাপারটা সে রকম কিছু না , আমার তোমার কোন রাগ কিংবা ক্ষোভ নেই , আসলে আমাদের কিছু করার ছিল না , তোমার আমার মধ্যে কোন পরিণতি হত না, নিয়তিকে অস্বীকার করার শক্তি আমাদের নেই ।
তুমি যে আজ কেন এলে!! সময়ের পরিক্রমায় তো সব কিছু ঠিকই ছিল , যাই হোক অনেকক্ষণ হয়ে গেল , তোমার যাওয়া উচিত মনে হয় , না হলে ফ্লাইট মিস করবে ।
আর একটা ব্যাপার , তোমাকে খেতে বলিনি বলে আমাকে অভদ্র ভেবে না , আগে অভদ্র ছিলাম এখন না , আসলে এখন আমাকে রান্না করতে হবে তারপর খেতে পারবে ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করার মত সময় নিশ্চয় তোমার হাতে নেই!!! বলেই উচ্চ স্বরে হাসল মারুফ ,হাহাহাহাহাহাহহাহা ,
হম, মৃন্ময়ীকে ফিরতে হবে , ফিরে যেতে হবে বর্তমানের পৃথিবীতে , মারুফ আসলে ঠিকই বলছে আজকে না আসলেই বুঝি ভাল হত ।
মৃন্ময়ী চলে যাচ্ছে , মারুফ তাকিয়ে আছে অপলক চোখে , তার খুব ইচ্ছে করছে মৃন্ময়ীর হাতটা ধরে বলতে “যেওনা”
কাজটা তিনি আগে ও পারেন নি ,এখন ও পারলেন না, শুধু অপলক তাকিয়ে রইলেন । তার চোখের কোন কিছু হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন অণু চিক চিক করছে , তিনি মনে মনে বললেন “ভাল আছি, খুবই ভাল” ।
ভালো লাগছে পড়তে। বেশ বড় গল্প খুব বেশি তাড়াহুড়ো নেই।
বানান এর প্রতি মনোযোগী হওয়া জরুরি।
আর লেখায় দাঁড়ি/কমার অবস্থান কোথায় হবে? কোথায় স্পেস হবে?!
কাজটা তিনি আগে ও পারেন নি ,এখন ও পারলেন না, শুধু অপলক তাকিয়ে রইলেন । তার চোখের কোন কিছু হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন অণু চিক চিক করছে , তিনি মনে মনে বললেন “ভাল আছি, খুবই ভাল” ।
এই যায়গাটায় অনেক পাঠকই ধাক্কা খাবেন মনে হয়! হাইড্রোজেন অক্সিজেন এর মতো কঠিন জিনিস!!
তবে পরীক্ষা নিরীক্ষা অব্যাহত থাকা উচিৎ।
:love: