১ম পর্বের লিংক : http://shorob.com/?p=7235
হিন্দি সিরিয়াল নিয়ে আমার প্রথম লেখাটা একটু বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে গিয়েছে। এবার কিছু চিন্তা-ভাবনার কথা লিখি। গত লেখায় সমর্থন পাবার জন্য পাঠককেও ধরে নিয়েছিলাম পুরুষ হিসেবে। এবার ধরে নিলাম এক জন হিন্দি-সিরিয়াল-প্রিয় নারী লেখাটি পড়ছেন। হিন্দি সিরিয়াল আপনার (পাঠিকার) চিন্তা ভাবনার জগতের যে বিশাল ক্ষতিটা করছে সে সম্পর্কে কিছু বলতে চাই।
নিতান্ত কৌতুহলবশত নারীবাদ নিয়ে কিছু পড়াশোনা করেছিলাম এক সময়। পুরুষরা কীভাবে সমাজ-রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে নারীদের অধীন করে রাখছে এবং নারীরা কীভাবে তাদের অধিকার ফিরে পেতে পারে তার অনেক উপায় জানা হয়ে পিয়েছিল। তো এই নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে চিন্তা করতে করতে এক সময় আবিষ্কার করলাম, নারীদের জন্য হিন্দি সিরিয়াল এক বিশাল পুরুষতান্ত্রিক ফাঁদ। যারা দীর্ঘদিন হিন্দি সিরিয়াল দেখেও এভাবে কখনও চিন্তা করেননি – তাঁদের বলব আবার ভেবে দেখুন।
হিন্দি সিরিয়াল আপনাকে শেখাচ্ছে পরিবারে সুখ-শান্তি বজায় রাখাই আপনার জীবনের একমাত্র লক্ষ, অত্যাচারী স্বামীর মন পাওয়ার জন্য সব কিছু ত্যাগ করাই জীবনের সার্থকতা কিংবা ‘ভাল বউ’ হবার জন্য শ্বাশুরীর সব অত্যাচার সহ্য করতে হবে। পুরো জিনিসটাকে আমার এক ধরণের মগজ ধোলাইয়ের চেষ্টা বলে মনে হয়েছে। নারী অধিকার বা নারী মুক্তির সাথে এই ব্যপারগুলো কেমন জানি যায় না!
একটু উঁচু মাত্রার আলোচনায় চলে গিয়েছি, পাঠিকা লেখকের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন 😛 । যাই হোক, জীবনে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এগুলোর প্রয়োজন হয়ত আছে কিন্তু তাই বলে আপনি এর পেছনে প্রতি দিন যে ৩-৪ ঘণ্টা সময় ব্যয় করছেন – এই সিরিয়াল কি আপনার সময়ের দামটা দিচ্ছে? বছরের ৩৬৫ দিন এই সিরিয়াল দেখতে দেখতে আপনার মনটা কি ঐ বেডরুম কিংবা রান্নাঘরে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে না?
এত গেল ‘ভাল বউ’ দের কথা। ভাল বউরা পরিবারে সুখ-শান্তি বজায় রাখে, সবার মনমতো চলে। হিন্দি সিরিয়ালে ভিলেন হচ্ছে ‘খারাপ বউ’রা। খারাপ বউদের উদ্দেশ্য হচ্ছে অন্যের স্বামী ভাগিয়ে নেওয়া, কিংবা ভাল বউয়ের নামে কলঙ্ক রটিয়ে ঘর থেকে বের করে দিয়ে যৌথ পরিবারে সম্পত্তির দখল নেয়া। কে পরিবারের পুরুষদের মন জয় করে বেশি সম্পদের মালিকানা লাভ করতে পারবে – এই নিয়ে চলে নোংরা পলিটিক্স!! হিন্দি সিরিয়ালে সাধারণত নারীরা সম্পদ উপার্জন করে না, তারা ‘পুরুষ দখলের’ মাধ্যমে সম্পত্তি দখল করে!! ‘পুরুষ দখল’ করার এই আইডিয়াটা কি আধুনিক শিক্ষিত মহিলাদের জন্য অপমানজনক নয়? :thinking: অন্তত আমার তাই মনে হয়।
কোথায় একটা প্রবাদ শুনেছিলাম যে, নারীর বড় শত্রু নাকি আর এক জন নারী!! এই প্রবাদটির স্বার্থক রূপায়ণ দেখা যায় আমাদের হিন্দি সিরিয়ালে! কিন্তু নারীবাদী বুদ্ধিজীবীদের মতে এই প্রবাদ এবং হিন্দি সিরিয়ালে দেখানো হয় এমন আরও অনেক কিছু নারীসমাজকে বিভক্ত ও দুর্বল করে পুরুষের রাজত্ব বজায় রাখারই অপচেষ্টা! 8)
আমি এক হিন্দি-সিরিয়াল-প্রেমিক নারীর সাথে বিতর্কে উপরিউক্ত যুক্তি তুলে ধরলে সে আমাকে বলল, সে নাকি হিন্দি সিরিয়াল থেকে এসব ঋণাত্মক দিকের কোনটাই শিখে নাই। দিনে ৪-৫ ঘণ্টা একজন মানুষ যেই সিরিয়াল নিয়ে পড়ে আছে সেখান থেকে সে কিছুই শিখে নাই – এটা বিশ্বাস করা শুধু মাত্র আর এক হিন্দি সিরিয়াল দর্শকের পক্ষেই সম্ভব 😛 । ব্যক্তিগত আক্রমণের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে আবার কাজের কথায় আসছি। হিন্দি সিরিয়াল থেকে ঐ নারী এবং আরও অনেক নারী শিক্ষা লাভ করছে কিনা এবং কী শিক্ষা লাভ করছে তা জানার জন্য আমরা অন্য দিকে তাকাই।
হিন্দি সিরিয়াল আমাদের পারিবারিক ক্ষেত্রে কেমন ‘কুপ্রভাব’ রাখছে সে সম্পর্কে আগের লেখায় আমার ব্যক্তিগত মত দিয়েছি। এ ব্যপারে কোন গবেষণা হয়েছে কিনা আমার জানা নাই। গবেষণা থেকে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যেত। কিন্তু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে হিন্দি সিরিয়ালের প্রভাব খুবই দৃশ্যমান। ঈদ আসলেই দেখা যায় আমাদের পোশাক বাজার মেহেরজান, বিলকিস (নামগুলো প্রতিকী অর্থে, সঠিক নাম মনে থাকলে বসিয়ে নিন।) ইত্যাদি বিচিত্র নামের ভারতীয় পোশাকে ভরে যায়। দেশে কসমেটিক বাজারে ভারতের একচ্ছত্র আধিপত্য। লাক্স সাবান কিংবা পেপসোডেন্ট সাবানের বিজ্ঞাপন ইন্ডিয়ান চ্যানেলে দিলেই যথেষ্ট, বাংলা চ্যানেলে দেয়ার দরকার নাই। এরকম আরও অনেক ব্যপারে ভারত-নির্ভরতার অন্যতম কারণ হচ্ছে এই হিন্দি সিরিয়াল। সুতরাং দেখা যাচ্ছে শুধু সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নয়, আমাদের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও হিন্দি সিরিয়ালের প্রভাব ব্যপক। এ ক্ষেত্রে অবশ্য আমাদের ক্রিকেট সংস্কৃতি এবং আরও অনেক ব্যপার জড়িত, তাই এককভাবে হিন্দি সিরিয়ালকে দোষ দেয়া ঠিক হচ্ছে না।
কেউ কেউ বলবেন যে আমাদের দেশে এখনও বিনোদনের যথেষ্ট শক্তিশালী মাধ্যম গড়ে উঠে নাই, তাই হিন্দি সিরিয়ালই আমাদের শেষ ভরসা। প্রশ্ন তোলা যায় যে, পারিবারিক ক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তারকারী দেশের বিপুল জনগোষ্ঠী যদি ইন্ডিয়ান চ্যানেলে আসক্ত থাকে তাহলে দেশে বিনোদনমাধ্যমের প্রসার ঘটবে কীভাবে? দর্শকের সমর্থন ছাড়া ভাল অনুষ্ঠান করা সম্ভব? তা সত্ত্বেও আমি টেলিভিশনের সামনে আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, দেশে এখন ভাল মানের এবং সৃজনশীল আইডিয়া নিয়ে বেশ কিছু নাটক হচ্ছে। অবশ্য দর্শকের অভাবের কারণে এসব নাটকের অধিকাংশই প্রচারিত হয় শুধু ঈদের সময়। সারা বছর যদি এসব নাটকের দর্শক থাকে তাহলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, আমাদের দেশের নাটকেরও যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে।
আমি আমার শেষ কথা বলব, আপনি আপনার অবসর সময়ে সৃজনশীল কিছু করুন বা সৃজনশীল কিছুর সাথে যুক্ত থাকুন। আপনার আবেগকে পুঁজি করে যারা নতুন বোতলে একই পুরনো মদ ভরে বারবার চালিয়ে দিচ্ছে – একটু ভিন্ন দিক থেকে তাদের ব্যপারটা চিন্তা করুন। আপনার সামনে এর বোকামির দিকটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। অবসর সময়ে সৃজনশীল কাজ করুন, নতুন নতুন চিন্তা-ভাবনা লালন করুন। আপনার জীবন বদলে যাবে এবং আপনার পরিবারের অনেক সদস্য এক ধরণের অত্যাচার থেকে মুক্তি পাবে। আপনার জন্য শুভকামনা।
:love:
লেখার কথাগুলোর সাথে সহমত প্রকাশ করছি। হিন্দি সিরিয়াল আমাদের ভালো কিছু শেখায় তা আমি কোনদিন বিশ্বাস করি না। আবার, এটা যে আমাদের শিল্পকে বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করছে, সেটা নিয়েও কোন সন্দেহ নেই।
:wallbash:
লেখার সাথে সহমত পোষণ করছি! 🙂
কিন্তু এত কথা হল হিন্দি সিরিয়াল নিয়ে এতদিনে, কাজ কি কিছু হল কিনা ভাবছি। মানে এই মানসিকতাটা কীভাবে পাল্টাতে পারে কে জানে! 🙁
আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক মেয়েকে চিনি যারা হিন্দি সিরিয়াল দেখে না। আমাদের আপু এবং আন্টিরা যখন আরও সচেতন হবেন এবং হিন্দি সিরিয়ালের অন্তর্নিহিত ‘স্টুপিডিটি’টা সনাক্ত করতে পারবেন তখনই পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে পারে
শুধু হিন্দি? কোলকাতার চ্যানেল গুলো যেভাবে দেখে! আমার বাসায় সবার প্লাস কাজের মেয়েদের যেমন নেশা হয়ে গেছে! দেখে আফসোস করা ছাড়া আর কোন উপায় নাই।
Z বাংলা জীবন শেষ করে দিসে… D:
যেকোন বিনোদনের মাধ্যমকেই আমি সমর্থন করব যদি এতে শিক্ষণীয় এবং সৃজনশীল কিছু উপাদান থাকে। আর সেটা যদি আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে। কিন্তু কোলকাতার চ্যানেলগুলো হিন্দি সিরিয়ালের বাংলা সংস্করণ প্রচার করে কেবল :crying:
ইদানিং তো বাংলাদেশের কিছু চ্যানেলও হিন্দি সিরিয়ালের বাংলাদেশী সংস্করণ প্রচার করছে দেখতে পেলাম। চ্যানেল ঘোরাতে গিয়ে একদিন চোখে পড়ল কড়া মেকাপ, হাস্যকর অভিনয়, ননদ-ভাবি, বউ শাশুড়ির ঝগড়া এইসব বননোদ্রেককারি জিনিসের সমাহারে হাজার হাজার পর্বের কিছু জঘন্য সিরিয়াল। [বমি করার ইমো খুঁজে পেলাম না]
*বমনোদ্রেককারি
বাংলা ধারাবাহিক নাটকে এখন প্রধান দুটি ধারা হচ্ছে ভাঁড়ামি করে মানুষ হাসানোর চেষ্টা আর হিন্দি সিরিয়ালের হুবহু অনুকরণ। প্যাকেজ নাটকে এখনও কিছু আশার আলো হয়ত আছে। 🙁
হিন্দি সিরিয়াল নকল করে করে জি বাংলার বাংলা প্রোগ্রাম তো জাতে উঠে গেল-আমরা কি করলাম এইটাই প্রশ্ন। আমাদের দেশের নাটক সিরিয়ালের নামে ভাঁড়ামি আর শর্ট কার্ট প্যাকেজ চিন্তা নকলবাজি বন্ধ করা দরকার-একজন গ্রামের পটভুমিতে নাটক বানাল তো ব্যাস সব্বাই মিলে সেটা কপি কর। একজন শহুরে এপার্টমেন্ট ভিত্তিক নাটক বানাল বেশ আবার সেটাকে কপি কর। এরকম ভাবে চলতে পারেনা-যার টাকা আছে সেই চ্যানেল খুলছে-চ্যানেলে দরকার প্রোগ্রাম। সেই সু্যোগে হাবি জাবি যাচ্ছেতাই বানাও স্পন্সর নাও আর চালিয়ে দাও এই হইল টিভি চ্যানেল গুলার অবস্থা। এই হুজুগ বন্ধ হবার কোন আশা দেখিনা। :/-বেশির ভাগই টিভি দেখা ছেড়ে দিচ্ছে।
আমি নিজেও টিভি দেখি শুধু ঈদের সময় 🙁
কিন্তু এভাবে তো চলতে পারে না। সবাই আশা ছেড়ে দিলে কীভাবে হবে??
শুধু ঈদের সময় কেন আমরা টিভি দেখব? ঈদের সময় হলে সব চ্যানেলে কেন প্রতিযোগিতা শুরু করতে হবে যে কে কয়দিন ব্যাপী ঈদ প্রোগ্রাম দেখাল? দেশে বিশেষায়িত চ্যানেল দরকার-সবার তো খবর দেখাবার দরকার নেই-সবাইকে তো টক শো করতে হবে না-সবাইকে প্রতিদিনের সংবাদ হেডলাইন তো দেখাবার প্রয়োজন পড়েনা। চ্যানেল গুলার মধ্যেও চলে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। কে চাবে কোয়ালিটি যেখানে প্রতিযোগিতা চলে তাদের মধ্যে কোয়ানটিটি নিয়ে? আমি যখন স্কুলে ছিলাম মনে আছে একুশে টিভি নতুন এল-অসাধারন সব প্রোগ্রাম ছিল, মেধাবী নির্মাতারা ছিলেন। তখন টিভি প্রোগ্রাম দেখার আশায় বসে থাকত লোক জন, সেই প্রোগ্রাম নিয়ে স্কুলে আড্ডাবাজি হত আবার পরের পর্বের জন্য অপেক্ষা করতাম। এই জায়গাটা নষ্ট করার দায় কে নিবে? বাচ্চাদের জন্য কোন চ্যানেল নেই-কার্টুন নেটওয়ার্কের কার্টুনি পরিবেশের সাথে আধঘন্টার ডরিমন পারবে কিভাবে? ভাই আমি হতাশ না হয়ে পারি না। চ্যানেলের মাথা যারা তাদের মানুষের বিনোদন দেখার সময় নেই, তারা আছেন ব্যাবসা নিয়ে। এদের কাছ থেকে আমি টিভির সুদিনের কোন আশা আমি দেখিনা।
দুঃখিত ডরিমনের জায়গায় সিসিমপুর বলতে চেয়েছিলাম। টিভি নিয়ে মনে অনেক দুঃখ ভাই-বলতে গেলে একগাদা কথা বলে ফেলি।:(
ধূমপানের সাথে হিন্দি সিরিয়ালের তফাত কী?