‘এ্যা-ই তুমি আমার ব্রাশ ব্যবহার করেছ?’
বাথরুম থেকে গমগমে আওয়াজ এলো। বিপদের বার্তা। আবার মনে হয় সেই ভুলটা ক’রে ফেলেছি।
‘কী… কথা বলছো না যে, ব্রাশ ভেজা, তুমি নিশ্চয়ই আমারটা দিয়ে দাঁত মেজেছো, এই জন্যে চুপ আছো’।
এবার মনে পড়লো। সামলে নিয়ে বললাম, না না তোমার ব্রাশে ভুল ক’রে পেস্ট লাগিয়ে ফেলেছিলাম, বুঝতে পেরে ধুয়ে রেখেছি।
‘দ্যাখো, গল্প বানাবা না। আরেক জনের মাজা ব্রাশ মুখে দিতে ইচ্ছে ক-রে?’ টানা লম্বা স্বরে হতাশা।
গল্প বানানো চাঁদের মতো দূর আমার কাছে। কথাবার্তা চালিয়ে নেবার মতো বলতে পারি। আমার কথার মধ্যে কারও আওয়াজ শুনলে গুলিয়ে ফেলি শব্দ। হাতড়াতে হয় খেই পাবার জন্যে। টুকিটাকি ভুল ক’রে ফেলি প্রতিদিনই। সামান্য ভুল, তবে বেশিরকম। তাই ভয়ে ভয়ে দুরু দুরু বুকে সময় কাটে। এই ভুল বিষয়ক দুর্বল-চিত্ত-কথা আমার স্ত্রী প্রথম রাতেই বুঝে ফেলেছিলো। ও ব’সে ছিলো সেজেগুজে। আমি পা টিপে টিপে এগোলাম। খাটের কাছাকাছি যেতেই ঘোমটা উঠিয়ে বললো, ‘এত টিপ টিপ ক’রে হাঁটছো কেন? বুক ফুলিয়ে হাঁটো, জয়ের আনন্দ নিয়ে এসো আমার কাছে। তোমার হয়েছে জয়, আমার হয়েছে ক্ষয়’।
বলে হাসতে লাগলো শব্দ ক’রে। আমি বিহবল হলাম। বুক ফুলবে কী? শরীর ফুলে উঠলো। পা আটকে গেলো কাঁচা সিমেন্টের মেঝেয় হাঁটার মতো। ও, অর্থাৎ শিরি ( নামটা ব’লে রাখা ভালো) উঠে এসে হাত ধরলো। ঘোমটা একেবারে ফেলে দিয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমার থুতনি ওর হাতের তালু দিয়ে একটু উঠিয়ে বললো, স্বামী মহাশয়, পরম পুরুষ আমার, তোমার পৌরুষ দীপ্ত করো। আমাকে তুলে ধরো। উঠিয়ে ওইখানে, ওই বিছানায় নাও। তোমার ঘর সংসারের প্রথম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হও’।
আমার মস্তিষ্ক শূন্য হলো। কবিতার মতো শিরির মুখ। মহাকাব্য অনর্গল বের হচ্ছে। মনে মনে বললাম, আমাকে রক্ষা করো, হে মধুসূদন!’।
ব্রাশ-কথায় ফেরা যাক। ওর ব্রাশ আর আমারটা দেখতে প্রায় একইরকম। সকালে ঝাঁপসা চোখে ওরটা তুলে নিয়ে দু’একবার দাঁত মেজেছি। তার মাশুল দিতে হয় প্রায় প্রতিদিন। দোষারোপ, মৃদু ভৎর্সনা এসব গাঢ় প্রেমের নমুনা হিসেবে মেনেও নিয়েছি। কত কিছু মনে না নিয়েও মেনে নিই আমরা। এই যেমন ওর কথাবার্তা মনে অন্যরকম লাগলেও রূপ দেখে মনে হয়েছিলো, পেয়েছি অরূপ রতন। ছবি দেখেই হ্যাঁ বলেছিলাম। ও হ্যাঁ বলেনি। আমাকে দেখবে। কথা বলবে নির্জন কোথাও। পার্কে হলে ভালো হয়। আমার ঘটক মামার কাছে খবর দিয়েছে শুক্রবার বিকেলে সংসদ ভবনের পেছনে আসতে হবে। সাথে কাউকে নিয়ে আসতে পারি তবে কথা বলার সময় সে দূরে থাকবে। কান খাড়া ক’রে শোনাও চলবে না। শুনে আমার কাঁপন আর কে দ্যাখে। পৌষ মাসের সকালে রস-মুড়ি খেলেও এত কাঁপাকাঁপি করা লাগে না।
শুক্রবার সকাল থেকে আয়াতুল কুরসী আর কুলহু আল্লাহ প’ড়ে বুকে ফুঁ দিচ্ছি। একটু পর পর মাথা নিচু করছি সাবধানে। কেউ বুঝে ফেললে লজ্জায় পড়তে হবে। বড় আপার চোখ এড়ানো গেলো না। বললো, এই রুস্তম শীতকালে তোরই কী শুধু গরম লাগছে? ঘন ঘন ফুঁ ফুকছিস ক্যান গায়ে? আমি বলে ফেললাম, আমাকে উদ্ধার করো আপু। মেয়ে কী বলেছে জানো?
‘আবার কী বলেছে?’ চোখ উল্টিয়ে ভুরু নাচিয়ে বললো আপু।
‘আমার সাথে একা দেখা করতে চায়, চন্দ্রিমা উদ্যানে। তোমাকে আমার সাথে যেতে হবে’।
আপুর দিকে একটু ঝুঁকলাম।
‘এ-ই দাঁড়া, দাঁড়া, তুই এখনই কদমবুসি করছিস, না পা ধ’রে অনুরোধ করতে যাচ্ছিস?’
‘দুটোই আপু, আমার শরীর রক্তশূন্য হয়ে পড়ছে। আয়নায় দেখেছি চোখের নিচটা ফ্যাকাশে’।
শেলি আপু হো হো ক’রে হাসলো। ওর গমগমে হাসিতে অভ্যস্ত আমরা। ও ঘর থেকে মা ডাকলেন আপুকে। আপু হাত নেড়ে আমাকে আশ্বস্ত ক’রে চলে গেলো।
লেকের ব্রীজের মাঝখানে আমার দাঁড়িয়ে আছি। আপু একমনে বাদাম খাচ্ছে। বিট লবন আঙুলে মাথায় মাখিয়ে চুষছে মাঝে মাঝে। নির্বিকার তাকিয়ে আছে একদিকে। আমার ঘাড়ে কেউ স্প্রিং লাগিয়ে দিয়েছে। হরর্ মূভ্যির ভূতের মতো মাথা বন্ বন্ ক’রে ঘুরছে। হঠাৎ বিদ্যুতের মতো চমকে গেলো আমার চোখ। বাদাম মুখে দিয়ে চাবাতে ভুলে গেলো শেলি আপু। মুখ হা হলো কিছুটা। অস্ফুট স্বরে বললেন, ওয়াও। মনে হলো আমার সাড়ে পাঁচফুট উচ্চতা কমে গিয়ে নেমে এসেছে দেড় ফুটে। ব্রীজের ফাঁকা দিয়ে পড়ে যাবো পানিতে।
‘স্লামালিকুম….’ মধুর আওয়াজ ভেসে এলো। তাকিয়ে দেখি জলি আর সাথে আরেকটা মেয়ে। চেহারায় মিল আছে। জলির চেয়ে বছর আট-দশ বড়ো হবে মনে হলো। শেলি আপু ঠোঁট নেড়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। আমি ডান হাত উঠিয়ে জলির পেছনের মেয়েটার দিকে তাকিয়ে টেনে টেনে বললাম, আ-স-সা-লা-মু আ-লা-ই-কু-ম আ-পু’।
ঝর্ণার ধারার মতো হেসে উঠলো জলি।
‘… ও আমার আম্মু, আপু না’।
বর পছন্দ করবে আমার মা, তারপর আমি, কেননা মা’র তো অভিজ্ঞতা আছে, হি হি’।
আমার বন্ধু সোহানের শ্বাশুড়ির কথা মনে হলো। কলেজে পড়ান। তবুও আমাদের দেখলে ঘোমটা না দিয়ে সামনে আসেন না। আমার বেলায় এ-কি উল্টোপাল্টা! হবু শ্বাশুড়িকে আপু অলরেডি ব’লে ফেলেছি। দেখতেও প্রায় জলির মতই, ও গড, আমার কী হবে!।
‘চলো আমরা ওই দিকে যাই’।
শেলি আপুর হাত ধরলেন হবু শ্বাশুড়ি। আর আমি ধরলাম আপুর হাত। আস্তে ক’রে আপু হাত ছাড়িয়ে দিতে দিতে দৃষ্টি দিয়ে বললেন, এ জগতে সবাই একা। একাই যেতে হবে, ভাই আমার!’
আমি সেদিন কোনো একটা বাক্যও পরিপূর্ণ বলতে পেরেছি ব’লে মনে হয় না। এদিক ওদিক তাকানোর ফাঁকে ফাঁকে দেখেছি জলিকে। শুধুই দেখেছি। চোখের মাহাত্ব্য টের পেলাম এতদিনে। মনে মনে বললাম, হে দৃষ্টিশক্তির মালিক, তোমার এ ঋণ কোনোদিন শোধ দিতে পারবো না’।
লেকের পাশে ছোট্ট বনের ভেতর আমরা বসে আছি। ঘাসের ওপর গাছে হেলান দিয়ে বসেছে জলি। আমি মুখোমুখি হাঁটু ভেঙে সামান্য দূরে। ওর কথার উত্তর দিয়ে মুখ নামিয়ে রাখছি। লেকের পানির দিকে তাকাচ্ছি। আপু আর ভুল-আপু কোথায় তা দেখার চেষ্টা করছি। কারণ, আমার তো আর দেখার, শোনার কিছু নেই। এই পুতুল কবে ঘরে আসবে ভেবে সময় অনন্তকালের মতো দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। মুখ তুলে দেখি জলি তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হলো আবার। চোখ ফেরাতে পারলাম না এবার। কী দারুণ দৃষ্টির মোহ! ওর ভুরুর নীচে শান্ত দুটো চোখ। অর্ধেক হাসিতে আলো হয়ে আছে মুখ। কী অনুপম সুখে ভরো উঠলো বুকটা। আমাকে দেখছে জলি। সাদা পাঞ্জাবী পরে এসেছি। চামড়ার চপ্পল খুলে রাখা ঘাসের ওপর। হাঁটু ভেঙে বসাতে নামাজের আসনে বসার মতো লাগছে। নিবেদিত। নিজের কথা কীভাবে বলি। আয়নায় যা দেখতে পাই তাতে ‘নীল আকাশের নীচে’র রাজ্জাকের মতোই লাগে আমাকে।
‘তুমি এত নার্ভাস হচ্ছো কেনো?’ মিষ্টি ক’রে বললো জলি।
টুক্ ক’রে একটা স্বস্তির শ্বাস বেরিয়ে এলো আমার। কী সহজ ক’রে নিয়েছে জলি।
‘এত বড়ো একটা কম্পানি চালাও তুমি, অফিসেও কী এমন জড়োসড়ো হয়ে থাকো? দু:খিত ‘তুমি’ বলে ফেললাম’।
‘না না না, তুমি বলাতে অসুবিধে নেই’।
আমার যেনো চেষ্টা, ও যাতে ‘আপনি’তে ফিরে না যায়।
অফিসে আমি কীরকম তা ওকে কীভাবে বোঝাই। কোনদিন যদি দ্যাখে বিশ্বাস করতে চাইবে না। রাশভারি বসের ভয়ে তটস্থ থাকে সবাই। সেক্রেটারি মেয়েটা এককথা দুইতিনবার তোতলাতে তোতলাতে বলে। জলির সামনে আমার অবস্থা তার চেয়েও খারাপ।
হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো জলি। আমি এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে উঠতে যাচ্ছিলাম। ইশারায় ব’সে থাকতে বললো। একেবারে কাছে এসে আমার মতো ক’রে বসলো হাঁটু ভেঙে। আমার দুই উরুতে ওর দু’হাতের পাতা আলতো ক’রে ছুঁয়ে থাকলো একটু। এক হাত তুলে থুতনি তুললো আমার। বললো, রুস্তম, তোমার নাম থেকে বীরের ঘ্রাণ আসে। তোমার মামা রেখেছিলেন না নামটা?’ আমি তাকিয়ে থাকলাম। ও বলতে লাগলো, মামা তোমার এমন কোনো দিক নেই যে বলেন নি আমাকে। তুমি তো জানো, মেয়েরা গল্প শুনে কতটা মজে। ওথেলোর বীর-গাথা শুনেই প্রেমে পড়েছিল ডেসডিমোনা। ওর প্রেম ছিলো কালো। আর আমারটা কী সুন্দর! তুমি কী জানো তোমার দিকে একবার তাকালে শ’বার তাকাতে মন চায়, দেখার তৃষ্ণা বাড়ে?।
চোখে ঝাঁপসা দেখছি। শেলি আপু, মা আর ফিরোজা খালা ছাড়া তেমন কারো সাথে কথা হয় না আমার। ছাত্র জীবনের সারাটা সময় ক’জন মেয়ের সাথে কথা বলেছি মনে নেই। অর্থনীতি পড়লেও আপুর কাছ থেকে নিয়ে নিয়ে ইংরেজি সাহিত্যের অনেকগুলো বই প’ড়ে ফেলেছি। জলিও ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স দিয়েছে। টগবগ করছে ওর ভেতর শেকসপিয়ার, ওয়ার্ডসঅ্যরথ, পি বি শেলী, কীটস্, ব্রাউনিং। ওথেলো পড়া ছিলো আমার। মুখস্ত ক’রে ফেলেছিলাম ডেসডিমোনাকে দেখার পর ওথেলোর কথাগুলো:
“ ….. O my soul’s joy!
If after every tempest come such calms,
May the winds blow till they have waken’d death!
…………………………………………….
…………. If it were now to die,
‘Twere now to be most happy; ”
টেনে টেনে আবৃত্তি করলাম। জলির পলক পড়ছে না। দুইমিনিট পর বললো, তুমি বিজনেসের অংক ক’রে শেকসপিয়ার রাখো কীভাবে মাথায়? আমি লজ্জা পাবার মতো হাসলাম। জলি আমার হাত মুঠোয় পুরে নিলো। আমি হাতখানা নরোম ক’রে রাখলাম। মেলার বেলুনের মতো অনুগত খেলনা হয়ে খেলছে আমার হাত ওর হাতে। কী সহজ সাদামাটা ভঙ্গিমা ওর। এই মোমের পুতুল বউ হবে আমার । ঘরে কখনও আলো জ্বালাবো না। আমাদের গ্রামের বাড়ীর বাঁশবাগান থেকে মুঠো মুঠো জোনাকি এনে ভরে রাখবো বয়েমে। স্বচ্ছ কাঁচের আড়াল চুয়ে নীলাভ মিহি আলো খেলা করবে সারা ঘরে।
প্রথম রাতে দু’একটা কথার পর আমি ওর কথায় শুধু সায় দিয়ে যাচ্ছি। দূরে স’রে ব’সে হ্যাঁ হুঁ করছি। অবস্থা দেখে জলি বললো, আমার নাম মনে আছে তো তোমার?’
গা শির্ শির্ করছে। ভেতরে কেঁপে উঠে বললাম, শি-রি, শিরি তোমার নাম’।
‘উ হুঁ, হলো না, আমার নাম চাঁদনি’ মুখ বেঁকিয়ে ঠাট্টার স্বরে বললো।
কপালে হাত রেখে বললাম, ওহো, দ্যাখো তো কেমন সুন্দর নামটা ভুলে গেলাম…’।
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলাম। জলি হাত উঠিয়ে বললো, আচ্ছা শোনো শোনো, তোমার কাজ সহজ ক’রে দিচ্ছি— আমাকে যে নামে ইচ্ছা প্রতিদিন সেই নামে ডাকতে পারো— শুধু তোমার সেক্রেটারীর নাম ছাড়া। আর হ্যাঁ তার নামটাও আমাকে বলবে না কখনও, তাহলে ভুল ক’রে ডেকে ফেলে লজ্জায় পড়বে’।
পাথর নেমে গেলো বুক থেকে। জানতাম এত সুন্দর মেয়ে, আমার অপ্রস্তুত অবস্থা সামলে নেবে। আমি ওকে সেই থেকে শিরি ব’লে ডাকি। ভুল ক’রে আনন্দের ঘোরে যে নাম উচ্চারণ করেছি সেই নাম নিয়েই শুরু করি না কেনো আমাদের নতুন জীবন।
বিয়ের পরও আমি ওকে নিবিড়ভাবে স্পর্শ পর্যন্ত করতে পারিনি। কারণ অন্যকিছু নয়। এমন ফুল শুধু দেখতে মানায়। কামনার ছোঁয়ায় গ’লে যদি যায় ওই মোম! একঘরে একখাটে শুয়েও নিজে থেকে জড়িয়ে ধরিনি ওকে। সকাল বেলা চোখ মেলে দেখেছি শিরি বেঘোরে ঘুমোচ্ছে বুকের ওপর। আমি দু’হাত দু’দিকে ফেলে রেখে চোখ বুঁজে থেকেছি। অল্প ঘুমের পর দেখি বিছানা শূন্য। বাথরুম থেকে হাতমুখ ধুয়ে বেরোলো শিরি। সাদা তোয়ালো দু’হাতে পেঁচিয়ে চিবুকের জল-বিন্দু মুছছে। শরতের আকাশে মেঘ-মেয়ের মতো লাগছে। আমি দু:খিত দৃষ্টিতে তাকালাম ওর দিকে। ডাগর চোখে ইশারা করলো একটু। তাতে অভিযোগ নেই। যেন বলছে, আমি বুঝেছি তোমাকে।
অফিসে যাই-আসি। কাজে কর্মে উদাস দেখে সেক্রেটারী মলি একদিন বললো, স্যার কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’
‘হ্যাঁ নিশ্চয়ই’।
অন্যদিকে তাকিয়ে উত্তর দিই।
‘আপনার কি মন খারাপ? আমি কী কোনোভাবে আপনার উপকারে আসতে পারি?’
স্থির চোখে তাকালাম। কী বলবো ভাবছি। অফিসের কেউ আমাকে ব্যক্তিগত ব্যাপারে প্রশ্ন করার সাহস পায় না। এই মেয়েটা সাহস জুগিয়ে নিয়েছে নিজে থেকে। আমিও অজান্তেই যেন প্রশ্রয় দিয়েছি। শেলি আপুর ছায়া আছে ওর ভেতর। আপু আমাকে হেল্প করতে পারতেন। কিন্তু বাসার কেউ কিছু বুঝতে পারে না। শিরি বুঝতে দেয় না। ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে আপুকে এড়িয়ে চলি। আপু-ও নব-বিবাহিত ছোটো ভাইকে একা থাকতে দেয়। ডাউনিং টেবিলে আড়চোখে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসে। দুলা ভাই মুখ খুলতে চাইলে টেবিলের নিচ দিয়ে পায়ে খোঁচা মারে।
‘খুব বেশি ব্যক্তিগত বা গোপন কিছু হলে বলার দরকার নেই স্যার, আমি এখন যাই?’
‘না না গোপন টোপন কিছু না’।
নিচের ঠোঁট সামান্য কামড়ে রেখে ভাবছি। মলি তাকিয়ে আছে। ওর সাথে কি আলাপ করা যায়? দুইমাস হয়ে গেলো আমাদের বিয়ে হয়েছে। শিরি চেহারায় যেমন সুন্দর, মনেও তেমন। তবে সপ্তাহ দু’য়েক ওর ওই ব্রাশের ব্যাপারটা বুঝি না। আমরা স্বামী-স্ত্রী। এক জনের ব্রাশ আরেক জন ব্যবহার ক’রে ফেললে ক্ষতি কি? কিন্তু এই একটা ব্যাপারে ওর স্বরে কেমন অসন্তোষ ঝরে।
‘ভাইয়া, প্লিজ ব’লে ফেলুন’।
মলি শান্ত নির্ভিক চোখে তাকিয়ে আছে। আমি থুতনিটা একটু নামিয়ে তাকালাম ওর দিকে। ওর ভাবান্তর হলো না। ‘স্যার’-এর জায়গায় ‘ভাইয়া’ কী ইচ্ছে করেই বললো, না-কি ভুল ক’রে, বোঝা যাচ্ছে না। কিছু জিজ্ঞেস করতেও পারছি না। সত্যিই একটা ছোট বোন হলে ভালো হত।
‘বোসো মলি’।
সামনের চেয়ার দেখিয়ে দিলাম। দু’ঠোঁট মুচড়ে একটু হাসলো মনে হয় মলি। মুখের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে নির্দিধায় বসলো।
‘মলি, তুমি তো জানো, আমার বিয়ে হয়েছে প্রায় দুই মাস হলো। স্ত্রীর সাথে স্বাভাবিক হতে পারছি না। মানে, সংকোচ হচ্ছে খুব। কাছে যেতে পারি না’।
‘ভাবীর হাব ভাব কীরকম?’ দপ্ ক’রে জানতে চাইলো মলি।
আমি অপ্রস্তুত হলাম। জোরে শ্বাস নিয়ে মুখ নিচু ক’রে রেখে একটু পরে মাথা তুললাম। মলি তাকিয়ে আছে। সেই স্থির দৃষ্টি। শেলি আপু ভর করেছে ওর ওপর। ছোটবেলার কথা মনে হলো। যে কথা মাকে বলতো চাইতাম না, কাউকেই নয়, অথচ ভেতরে ভেতরে পোড়াতো আমাকে— শেলি আপু বুঝতে পেরে জেরা করতেন এভাবে।
‘ওর মন তো অসম্ভব ভালো। এত সুন্দরী মেয়ের এত ভালো মন, মানিয়েছে খুব। তবে একটা ব্যাপার বুঝতে পারি না মলি’।
আমার গলা স্বাভাবিক হয়ে আসছে।
‘কী ব্যাপার, ভাইয়া’।
মলি জানতে চাইলো।
আবার একটু চমকে তাকালাম। মলি হাসলো। ইচ্ছে করেই ও আমাকে ‘ভাইয়া’ ডাকছে। আমার দু’কান লালচে হয়ে উঠলো। ঠোঁটের হাসি ছড়ালো সারা মুখে। মলি ওর হাতটা আমার হাতের ওপর রাখলো। ওর চোখ ছল ছল করছে। আমার চোখও ঝাঁপসা।
‘ভুল ক’রে ওর ব্রাশ ব্যবহার করলে একটু রেগে মতো যায়, তোর ভাবি’।
মলি এবার আমার মতো চমকে তাকালো। আমি ওর হাসি ফিরিয়ে দিলাম ওর দিকে।
‘ভাইয়া, তুমি একটা ব্যাপারে এত কাঁচা, ধারনা করিনি। সব ব্যাপারে কাঁচ-কাটা হিরে তুমি। আর এখন তোমার চোখে সন্ধ্যা ছাড়া সকাল দেখছি না’।
এক নি:শ্বাসে বললো মলি।
আমি মাছের মতো চোখ গোল ক’রে তাকিয়ে আছি।
‘ব্রাশ ব্যবহার করার আগে দুজনের মুখের ঘ্রাণ এক হয়েছে কোনোদিন, মা-নে চার-ঠৌট মিশেছে কখনও?’
আমি হা ক’রে আছি। চোখ বড়ো বড়ো।
‘চুমু খেয়েছেন ভাবীকে?’।
মলির উঁচু স্বর।
ডেস্কের সামনের আয়নার দিকে তাকালাম। ওখানে কে বসে আছে? চিনতে পারছি না নিজেকে। মলি চিমটি কাটলো। তাকালাম ওর দিকে।
‘এটা ভাবীর কপট রাগ। দুই মুখের মিলন যখন হলো না, তখন এক ব্রাশকে নদীর দুই তীরের ব্রিজ বানিয়ে কী হবে?’ ব’লে হো হো ক’রে হেসে উঠলো মলি। ভাগ্যিস দরোজা বন্ধ ছিলো। আমার রুমটাও একটু দূরে।
অফিস থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ড্রাইভারকে বললাম শাহবাগ চলো। ফুলের দোকানের পাশে থামতে বললাম। রজনীগন্ধ্যা, গোলাপ আর বেলির ঘ্রাণে নেশার মতো লাগছে। সবচেয়ে বড়ো ব্যুকেটা নিলাম। সাথে আলাদা একগোছা রজনীগন্ধ্যা আর লাল গোলাপ।
আমি এলে টের পায় শিরি। অন্যকাউকে দরোজা খুলতে দেয় না। বিয়ের পর বাসায় এসে খোলা দরোজার সামনে অন্যকাউকে দেখিনি। আজ শেলি আপু দরোজা খুললেন। মা দাঁড়ানো পেছনে। মাজায় হাত। হাত থেকে ফুলের তোড়া পড়তে পড়তে রক্ষা হলো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হেসে গলা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম। মা’র এই চেহারা দেখলে স্বর বের হয় না আমার। আজ নির্ভয় মনে হলো। বাহ! কথা বলতে পারছি।
‘কী ব্যাপার, আমাকে স্বাগত জানাতে এত লোক?’।
আমার রসিকতা গায়ে মাখলো না কেউ। শেলি আপু হাত টেনে ধ’রে বললো, জলি ছাদের ঘরে। উপরে যা’।
আমাদের ছাদের অর্ধেক জায়গা খোলা। টবে টবে ফুলগাছ। কাজী পেয়ারাও আছে। পাতার কুটিরের আদলে দুই-কামরার ঘর বানিয়েছেন বাবা। ছোট্ট একটা বারান্দা আছে। বারান্দার সামনে অতি বড়ো একটা টবে ছোট একটা তালগাছ। তালের ডালে বাবুই পাখির বাসা ঝোলানো। বাবার কান্ড! বাবুই পাখিদের দুর্দশায় কতবার যে আফসোস করেন। আমারও খারাপ লাগে। ইচ্ছে করে গ্রামে গিয়ে বাবার মতো তালাশ করি বাবুই পাখির বাসা-ঝোলানো তাল সারি।
উপরে উঠে ফুলের তোড়া হাতে আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছি। খুঁজছি শিরিকে। সন্ধ্যা পেরিয়েছে। তরল অন্ধকার তবু চারদিকে। ক্ষুদে পেয়ারা তলায় একটা ছায়া দাঁড়ানো। কাছে গিয়ে ফুলের তোড়ায় মুখ আড়াল ক’রে দাঁড়ালাম। ছায়াটা ঘুরলো। ফুলের কাজ করা সাদা শাড়ী পরেছে শিরি। খোলা চুল সন্ধ্যার খেজুর গাছের মতো ঝাঁকড়া হয়ে নেমেছে নিচে। গোলাপি লিপস্টিক দিয়েছে ঠোঁটে। অন্যরকম একটা ঘ্রাণ আসছে। ছাদের খোলা দিক থেকে মিহি বাতাস এলো। শিরির চুল ওড়ালো ঝির্ ঝির্ ক’রে। আমার দিকে তাকিয়ে কেমন ক’রে যেন হাসলো ও। হাত থেকে ফুলগুলো নিয়ে বারান্দার দিকে যেতে লাগলো। এক মুহূর্ত ভেবে দ্রুত পায়ে পিছু নিলাম ওর। ঘরে ঢুকলো শিরি।
কী বিস্ময়! সারাটা ঘর সাজানো। ফুলে ফুলে সয়লাব। বিদ্যুতের বাতির বদলে মোমবাতি জ্বলছে চওড়া একটা টেবিলের ওপর। প্রেম-চিহ্ন হয়ে দুলে দুলে হাসছে সারি সারি শিখা।
***************
গল্পগ্রন্থ : একদিন কপোতাক্ষ ও অন্যান্য গল্প
( প্রকাশক : অন্য প্রকাশ )
গল্পটা সুখপাঠ্য ছিলো। তবে হুমায়ূন এর বিশাল প্রভাব ছিলো মনে হচ্ছে।
আর নায়িকার নামে একটু এলোমেলো হোল বলে মনে হলো!
অনেক ধন্যবাদ, বোহেমিয়ান ।
নায়ক নার্ভাস হয়ে নায়িকার নাম গুলিয়ে ফেলেছে… । 😀
ভাল থাকবেন । 🙂
সুপাঠ্য!
আমি অবশ্য তেমন হুমায়ূনের ছাপ পাই নি।
ধন্যবাদ অশেষ, সামিরা ।
ভাল থাকুন । 🙂 🙂
পড়তে ভাল লেগেছে 🙂
ধন্যবাদ, হাসিব জামান ।
শুভেচ্ছা জানবেন । 🙂 🙂
🙂 🙂 🙂