বৈকালী অপেরা

‘ভা..ই.. সব, ভা..ই.. সব…।

যাত্রা পালা, যাত্রা পালা। রাজগঞ্জ হাই স্কুল মাঠে বৈকালী অপেরার আজকের আয়োজন ‘জীবন নদীর তীরে’।
হ্যাঁ ভাই, রঞ্জন দেবনাথ রচিত ‘জীবন নদীর তীরে’ বা ‘কলংকিনী বধূ’ দেখুন আজরাতে। সাথে আকাশ থেকে নেমে আসছে একঝাঁক ডানাকাটা পরীর ঝুমুর ঝুমুর নাচ। দম ফাটানো হাসি নিয়ে আসবেন কৌতুক অভিনেতা মতিয়ার…।
ভা-ই সব, ভা-ই সব…’।

মাইকে কথার আওয়াজ বন্ধ হয়ে গান ভেসে এলো— ‘নি-মা-ই দাঁড়া রে…।
দাঁড়ারে নিমাই দেখিবো… তোরে। ঘরে বঁধূ বিষ্ণু প্রিয়া… জ্বলন্ত অগিনি… ওরে আ-র ক-ত কাল রা-খ-বো বাপধন রে… ওরে দি-য়ে মুখের বা-ণী রে… নিমাই, দাঁ-ড়া-রে…’।

এই গানটা অনেক বার মাইকে বাজতে শুনেছে সালেহা। কথা তো আছেই, সুরের সম্মোহন পাগল ক’রে তোলে ওকে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে, নিমাই সন্যাসব্রত নিয়ে চলে যাচ্ছে লোকান্তরে। ঘুমিয়ে আছে স্ত্রী বিষ্ণুপ্রিয়া। তার চাঁদমুখের চমকানিতে আভাময় হয়ে আছে সারাঘর। মা ডাকছেন পেছন থেকে। দাঁড়া নিমাই, যাস নে।

শীতকালে অপেরা নিয়ে আসে স্কুল কমিটি। সালেহার খুব ইচ্ছে দেখার। রাজগঞ্জ স্কুল থেকে এসএসসি পাশ ক’রে মণিরামপুর মহিলা কলেজে ভর্তি হয়েছে ও। স্কুলে থাকতেও কোনোদিন যাত্রাদলের অভিনয় দেখার সুযোগ হয়নি। আব্বা সন্ধ্যার পর বের হতে দেন না। ছোটভাই রবি ক্লাস সিক্স থেকে যাত্রা দেখে আসছে। এবার টেনে উঠেছে। ওর সাথে যেতে হবে।

বাড়ীর পুকুরঘাটে কাঠের মসৃন তক্তার ওপর কাপড় কাচা থামিয়ে মাইকের গান শুনতে শুনতে ভাবছিলো সালেহা। দুপুর গড়িয়ে গেছে। একটু দেরীতে গোসলে এসেছে আজ। নিজের জামা কাপড় নিজেই পরিষ্কার করে নেয়। মা-বাবা আর ছোটভাইয়ের গুলো-ও নিয়ে আসে মাঝে মাঝে। কাজের মেয়েটা একসাথে এত কাপড় ধুয়ে পারে না। দ্রুত দৌঁড়ের শব্দে পুকুরের পাড়ের দিকে তাকালো সালেহা। একটা বাছুর দৌঁড়ে আসছে। পিছে পিছে রবি। দিন সাতেক হলো হয়েছে বাছুরটা। এখুনি দৌঁড়ঝাপ শুরু করেছে। একেকবার দৌঁড়ে দূরে গিয়ে থমকে ফিরে তাকায়। ওর মা ডাকে হাম্বা হাম্বা ক’রে। বাছুরের পেছনে লেগে থাকে রবি সবসময়। নতুন গাভীর দুধ না খেলে পেট ভরে না ওর।

বাছুরটা ঘুরে আবার বাড়ীর দিকে গেলে রবিও দৌঁড়ালো সেদিকে। কিছুক্ষণ পর হাঁপাতে হাঁপাতে এলো পুকুরঘাটে। শান বাঁধানো ঘাটের ওপর ইট-সিমেন্টের বেঞ্চে বসলো রবি। পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে বসে আছে চুপচাপ। সাবান ঘষে কাপড় দু’হাতে আস্তে আস্তে আছড়ে ফেনা তুলে কাচছে সালেহা। কাপড়ের ভেতর থেকে বাতাস বেরিয়ে ফেনা ছিটকে পড়ছে। বুদবুদ উড়ে উড়ে পড়ছে পানিতে। কাপড় কাচার থপ্ থপ্ আওয়াজ শুনছে রবি। কেমন ছন্দের মতো। থপ্ থপ্ থ-পা থপ্ থপ্। বাতাসে হালকা শীতার্ত ভাব আছে। সালেহা বু ঘামছে তবু। চুল ভিজে লেপ্টে আছে চোয়ালে। রবি মুগ্ধ হয়ে দেখছে বড় বোনকে। কোনো কাজে ক্লান্তি নেই। সবার দিকে কেমন খেয়াল। শব্দটা থামলে সম্বিত এলো রবির। সালেহা তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
‘তুই গোসল করিচিস রবি?’
‘হি করিচি’
‘তালি কী করতি আইচিস পুকুরঘাটে?’
‘দুইরাত হইয়ে গেলো গান আইয়েচে, শুনতি যাতি পারিনি। মা টাকা দেচ্চে না, আব্বা নাকি মানা কইরেচে।‘
‘টাকা আমি দিতি পারি, এটটা শত্তে।
‘কী বু?’
‘আমার নিয়ে যাতি হবে গান শুনতি, পারবি?’
চুপ ক’রে একটু ভাবলো রবি। নিজে তো ওই পাড়ার আবু চাচা’র সাথে লুকিয়ে যেতে পারে। সালেহা বু’কে নেয়া যায় কীভাবে।
‘অত কী ভাবতিচিস, তোর চিন্তা করা লাগবে না। আছিয়া ফুপুও যাবে। তুই শুদু সাতে থাকপি আমাগের’
‘আব্বা যদি বকে?
‘ফুপুর সাতে গেলি আর তেমন কিচু বলতি পারবে না আব্বা। এটটা দিন মাত্র দ্যাকপো’।

পৌষ মাস কেবল পড়েছে। তবুও ঠান্ডা নেই তেমন। সারাদিন রোদ ছিলো প্রখর। বাতাস কম। সন্ধ্যার পর থেকে হাওয়া বইছে। কোথা থেকে যেন শীতও ব’য়ে আনছে সাথে। রাতের খাবার খেয়ে দেয়ে তৈরি হয়ে নিচ্ছে সালেহা আর আছিয়া। আবু চাচাকে খবর দিয়েছে রবি। একটা ভ্যান আনতে বলে দিয়েছে। আছিয়ার বাবা বারিক মেম্বর জরুরি কাজে যশোরে গিয়েছেন। দিন দুয়েক বাড়ী আসতে পারবেন না ব’লে গিয়েছেন। তাই কিছুটা জোরে সোরে যাত্রা দেখতে যাবার প্রস্তুতি চলছে। একটু পর হি হি হো হো ভেসে আসছে ঘরের ভেতর থেকে। সালেহা আর আছিয়া তৈরি হয়ে নিতে আর কত সময় লাগাবে কে জানে। আবু চাচা এসে পড়বেন এক্ষুণি। রবি জোরে চেঁচিয়ে বললো, ও বু, তাড়াতাড়ি আইসো, দশটা বাইজে গেচে দেরিতি গেলি পিছনে বসতি অবেনে। ওই দ্যাকো আবু চাচা আইসে পইড়েচে ভ্যান নিয়ে’।
আবুকে আসতে দেখে সালেহার মা রওশন আরা বললেন, শোন্ আবু, বড় মানুষ শুদু তুই যাচ্চিস উগের সাতে। এটটুও যোনো এদিক সেদিক হয় না’।
‘তুমি কোনো চিন্তা কইরে না ভাবি, সব দায়িত্ব আমার’।

হানুয়ার গ্রাম থেকে রাজগঞ্জ বাজার মাইল খানেক দূর। সালেহাদের বাড়ীর পাশ দিয়ে কাঁচা রাস্তা বড় পুলের কাছে পাকা ইটের রাস্তায় গিয়ে মিশেছে। মাঠের মধ্য দিয়ে আলপথেও রাজগঞ্জে যাওয়া যায়। সেটা বেশ আড়াআড়ি আর দূর কম হয়। তবে এই রাতের বেলা সেই রাস্তা দিয়ে যাওয়া যাবে না।

চাদর মুড়ি দিয়ে ভ্যানের ওপর বসেছে তিন জন। আবু উঁচু নিচু রাস্তায় ভ্যান ঠেলে দিয়ে পেছন দিকটায় বসছে মাঝে মাঝে। কাঁচা পথে ভ্যান চলছে খর্ খর্ ক’রে। জমাট অন্ধকার চারদিকে। নিজের হাতটাও দেখা যায় না চোখের কাছে না আনলে। সামনের দিকে দুপাশে পা ঝুলিয়ে বসেছে সালেহা আর আছিয়া। সিটের নিচের লোহা আর ভ্যানের কাঠ ধ’রে আছে ওরা। আবু বসেছে মাঝখানে। চলতে চলতে ভ্যান দুলে উঠলে টিলে-পাছার পাতিলের মতো টোল খাচ্ছে রবি। একবার বু’র ঘাড় ধরছে তো আরেকবার লুটিয়ে পড়ছে ফুপু’র গায়ের ওপর। অন্ধকারে হঠাৎ একটা চাকা গর্তে পড়লো। বেশ কাত হয়ে গেল ভ্যনটা। সালেহার দিকটা উঁচু রইলো। রবি আর সালেহা ধরাধরি ক’রে সামলে নিলো। আছিয়া সামলাতে পারলো না। আবু আগেই চিৎ হয়ে পড়ে গিয়েছিলো মাটিতে। উপুড় হয়ে পড়লো আছিয়া ওর ওপর। কোত্ ক’রে উঠলো আবু। আছিয়ার মাথা লেগেছে ওর কপালে। আছিয়া উঠে পড়লো। হাত বাড়ালো আবুর দিকে। আবু একহাতের তালু কপালে ঠেকিয়ে শুয়ে আছে তখনও। আছিয়া বললো, খুব বেশি ব্যাতা পাইচাও আবু ভাই?’ দেকি কোন্ জাগায় লাইগেচে?’
আছিয়ার হাত ধ’রে উঠলো আবু। একটু খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললো, এ-ই ভ্যান ছাড়ো।

ভ্যান একটু দূরে। আবু তখনও ভালোভাবে হাঁটতে পারছে না। লজ্জায় বলতেও পারছে না কিছু। চাপা হাসির শব্দ ভেসে আসছে। ভ্যান থেমে আছে। কাছে এলে আছিয়া বললো, ওটো আবু ভাই। ব্যাতা পা নিয়ে আর হাঁটতি হবে না। তুমি অচল হইয়ে রাস্তায় শুইয়ে থাকলি আমাগের গান শুনাবার দায়িত্ব নেবেন কিডা?’।
‘ঠাট্টা করতিচাও আছিয়া, তা করো, আমি কলাম ব্যাতা শিরাম পাইনি।
তুমি গা’র পরে আইসে পড়লি যা এটটু ঘাবড়াই গিইলাম’।
ঠাট্টার স্বরে বললো আবু। আছিয়া আর কথা বললো না।

জানালা দিয়ে টিকেট দেয়া হচ্ছে। নিচের তলায় ক্লাস সিক্সের রুমের দুটৌ জানালার সামনে লম্বা দুটো লাইন সমান্তরাল হয়ে চলে গিয়েছে পানের হাট পর্যন্ত। লোকজনের ঠেলাঠেলিতে লাইন মাঝে মাঝে জোরে বাতাস হলে দড়ির আড়ার মতো দুলছে। ভিড়ের সময় পেছন থেকে কেউ একজন কাতুকুতু দিলো সামনের লোকটাকে। হো হো ক’রে হেসে উঠলো লোকটা। সামলে নিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়াল আবার। এই লম্বা লাইন দেখে রবি বললো, ‘চাচা আজ গান শুনা হবে না। দ্যাকো লাইন কিরাম লাম্বা’।

সালেহা ও আছিয়া শুনে দাঁড়িয়ে রইলো মন খারাপ ক’রে। আবু হেসে বললো, তুরা মনে করিচিস আমি টিকিট কাটার জন্যি এই কুণায় আইচি? আমি আইচি মজা দেকতি। যাত্রা দেকার জন্যি লোকজন কিরাম গুঁতোগুতি করে টিকিট কাটার সুমায়, দেকতি কায়দা লাগে। আমার কাচে সিজেন টিকিট আচে। গেটের লোকের সাতেও খাতির আচে আমার। তুরা চিন্তা করিস নে’।
রবি হাসলো গাল ভ’রে। বললো, তালি একুনি চলো চাচা, সামনের দিকি বসপো’।

গেইটম্যানকে ব’লে রবিকে সালেহাদের সাথে দিয়ে দিলো আবু। নিজে মেয়েদের বসার জায়গার কাছাকাছি বসলো। স্টেজের খুব কাছে বসতে পারলো না ওরা। মাঝামাঝি জায়গায় বসলো। মাইকে উঁচু আওয়াজে গান বাজছে। ঘোষণা হচ্ছে মাঝে মাঝে। আজ কোন্ যাত্রা-পালা মঞ্চস্থ হবে, কে কে অভিনয় করবে, নাচে গানে কেমন মাতাবে ডানা-কাটা পরীরা এইসব ঘোষণা। হেলায় এমন সুযোগ না হারিয়ে জলদি যাত্রা-প্যান্ডেলে ঢুকে পড়ার আহবান আসছে বার বার।
আসরে বাদ্যযন্ত্র আসা শুরু হয়েছে। তবলা, বাঁশি, চাকি, ঢোল ও হারমোনিয়াম। বাদকরা বসেন মঞ্চের দু্‌ইপাশে। তাদের সাথে বসেন নাটকের পরিচালক। বই থাকে তার হাতে। আস্তে আস্তে সংলাপ প’ড়ে যান তিনি। সেই সংলাপ শুনে শুনে অভিনয় ক’রে যান অভিনেতা-অভিনেত্রীরা।প্যান্ডেলের মাঝখানে চমৎকার মঞ্চ। রঙিন কাপড়ের শামিয়ানা। চারকোণার চারটে খুঁটির গায়ে নানা রঙের লাইট বাল্ব লাগানো। কারেন্ট আছে এখনও। ক্যারেন্ট চলে গেলে ডায়নামার ব্যবস্থা আছে।

বাদকদল চলে এসেছে। বাজনার ঝংকারে ঝন্ ঝন্ করছে চারদিক। টু শব্দ করছে না কেউ। হারমোনিয়াম বাজছে নদীর স্রোতের মতো। মেঘের মতো ডেকে উঠছে ঢোলের আওয়াজ। আর তার সাথে বাঁশির সুর। কী এক মোহময় সুরের মধুরতা মিশে যাচ্ছে বাতাসে। স্কুলের পাশ দিয়ে ব’য়ে যাওয়া বাওড়ের জলেও বুঝি সুর উঠছে রিনিঝিনি। ওপাড়ের ঝাঁপা গ্রামের দিক থেকে ভিজে বাতাস এসে ব’য়ে নিয়ে যাচ্ছে নিঝুম রাতের এই আনন্দময়তা দূর দূর গ্রামে।
প্যান্ডেলের টিউব লাইট নিভে গিয়ে রঙিন বাল্বগুলো জ্বলে উঠলো। সাদা শাড়ি প’রে সারি সারি মেয়েরা এসে দাঁড়ালো মঞ্চের চারকোণায়। বাজনা থামলো। মিহি সুরে বাঁশি বাজলো প্রথমে। বিলাপের মতো সুর। টুং টুং চাকির আওয়াজ। তবলচির আঙুল চঞ্চল হয়ে উঠছে তবলায়। জলের তোড়ের মতো সুর ছড়িয়ে দিলো হারমোনিয়াম। সেই সাথে সমবেতভাবে কন্ঠ মেলাল ওই সব সাদা-পরীরা। বৈকালী অপেরার সূচনা সংগীত গাইছে ওরা।

সালেহা অবাক হয়ে দেখছে ওদের। গান শোনার সাথে সাথে চেহারা খুঁটে খুঁটে দেখছে। কে যেন কথা ব’লে উঠলো। রবি কানে কানে ফিস্ ফিস্ ক’রে বলছে, গত বছর প্রতীমা অপেরা আইলো, বু। ওরে সুন্দর গাই গাইলো— ‘প্রতীমার প্রদীপ জ্বালিয়ে হাতে গাহি তার জয়গান’।

চোখ সরু ক’রে তাকালো সালেহা। বললো, বা-রে রবি। কী গান গাইলো তা-ও মনে আছে তোর? আর কী কী মনে আছে তাই বল্। মাইয়েগুলো কী ইগের চাইতি সুন্দরী ছিলো? কারো কী পছন্দ হইলো তোর?’।

ল্জ্জা পেয়ে একটু সরে গেলো রবি। সত্যি ভালো লেগেছিলো প্রতীমা অপেরার একজনকে। বার তের বছরের মেয়ে। মাইকের গানের সাথে গলা মিলিয়ে একক নৃত্য করেছিলো। ছিপছিপে, ফর্সা মেয়েটা। বাতাসের ঢেউয়ের সাথে দুলে দুলে নেচেছিলো। চিকন সরু ঠোঁট নেড়ে গানের কথাভরা সুর ছড়িয়েছিলো সারা পান্ডেলে। সে রাতে আর কারও চেহারা, আর কোনো অভিনয়-দৃশ্য, কোনোকিছু ভালো ক’রে দেখতে পারেনি রবি। হৃদয় ভাঙার শব্দ শুনেছিলো শুধু। মনের ভেতর এমন হাহাকার, এমন অনুভব সম্পূর্ণ নতুন ওর কাছে। মনে হয়েছিলো অভিনয় শিখবে। চলে যাবে ওদের সাথে। ছোটদের অভিনয়ও দেখেছে ও। সেইরকম কোনো দৃশ্যে মানাবে। যাত্রার লোকদের সাথে যোগাযোগ করতে চেয়েছিলো। সাহস হয়নি। স্কুল খোলার পর ব্লাক বোর্ডে স্যারেরা কিছু লিখলে অক্ষরগুলো উঠে এসে সেই সরু-ঠোঁট মেয়েটির মতো ক’রে হাসতো। ক্লাসের মেয়েদের দিকে তাকাতে পারেনি কতদিন। ওর মতো কেউ নেই, কেউ নেই…।

আছিয়া ফুপুর খোঁচায় চমকে উঠলো রবি, ‘এ-ই, নাচ দেকপি না মুখ নিচু কইরে থাকপি?’ একক নাচ হচ্ছে। অদ্ভূত ভঙ্গির নাচ। বড়ো সড়ো এক স্বাস্থ্যবতী মেয়ে নাচছে। অঢেল যৌবন। ঢোলের তাল আর বাঁশির সুরের বাঁকে বাঁকে পাক খেয়ে খেয়ে উঠছে ওর শরীর। মাঝে মাঝে খোলাচুল বিছিয়ে দিচ্ছে কপাল বেয়ে মুখের ওপর। মাথা উঁচু ক’রে পেছনে ফেলে দিচ্ছে সঘন চুলের মেঘ। সূর্যের মতো ভেসে উঠছে অসহ্য এক মায়াবী মুখ। গলার নিচটা খানিকটা খোলা। বেশি রকম। দু’একবার ঝুঁকে এসে পড়লো রবিদের সামনে। সবুজ ব্লাউজ উপচে বেরিয়ে আসতে চাইলো যেন টসটসে দুটো জামরুল। এমন রসালো বুক-ভঙ্গি দ্যাখেনি কোনোদিন রবি। স্কুলের মেয়েরা বড়ো বড়ো ওড়না প’রে আসে। বুক ঢেকে মাথায়-ও পেঁচিয়ে রাখে কাপড়। সব মেয়ে অবশ্য নয়। আসমা ওড়না প’রেও পরে না। গলায় ঝুলিয়ে রাখে দড়ির মতো। বাতাসে ওড়না ওড়ালে কারো কারো বুক চোখে পড়েছে কখনও। চোখে চোখ পড়লে অকারণে ওড়না নাড়াচাড়া করে আসমা। মুখ টিপে কেমন ক’রে যেনো হাসে। ওই হাসি আর অমন অবস্থায় ওকে অনেকক্ষণ দেখতে ইচ্ছে করে রবির। ল্জ্জায় পারে না। ক্লাসের বা বাড়ীর কেউ শুনলে কেলেংকারী হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি স’রে আসে ও।
চোখ ঝলসে যাবার মতো হলো রবির। চোখ ফেরাতে পারলো না তবু। একমনে দেখলো সেই উর্বশী বুকের মোহনীয় উঠানামা। মেয়েটা নাচ সেরে চলে গেল। একক নৃত্য হলো আরও । যাত্রা-পালা শুরু হবে, ‘জীবন নদীর তীরে’।
এখন কিছু সময়ের বিরতি।

দুই ঠোঙায় বাদাম কিনে এনে ওদের দিকে বাড়িয়ে ধরলো আবু। বাদামের ঠোঙা হাতে নিয়ে আছিয়া বললো, একনও যে গরম রইয়েচে আবু ভাই?। ‘হ্যাই, একনও ভাইজদেচে। যাত্রা দেখপি আর কুট্ কুট্ কইরে বাদাম খাবি? হেসে বললো আবু।

আছিয়া বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো আবুর দিকে। কারণে অকারণে আবু ওকে এটা সেটা কিনে এনে দেয়। রবির খোঁজ নেবার নাম ক’রে বাড়ীতে এসে ফালুক ফুলুক করে। সুযোগ বুঝে হাতে গুঁজে দেয় কিছু একটা। একদিন রাতে বাজার থেকে যাবার পথে রবিকে বাড়ী পৌঁছে দিতে এলো। আড়ালে ডেকে হাতে দিলো দলার মতো কিছু। ঘরে গিয়ে খুলে দেখে পদ্মপাতায় মোড়া একগাদা সন্দেশ। কী সুন্দর গন্ধ! মিষ্টি ঘ্রাণে ভরে গিয়েছিলো যেন ঘরটা। এই মানুষটার মনটা মনে হয় এই সন্দেশের মতো। সবুজ পদ্মপাতায় মোড়া। এমন ঘ্রাণময়। কেমন ভীরু ভীরু বুকে আসে। কথা বলে গুনে গুনে। কোনোদিন কী বলতে পারবে— আছিয়া, তুমার আমি ভালবাসি। আছিয়া ভাবলো, নাহ, আমারই কতি হবে একদিন, ওর মুরোদ হবো না’।

যাত্রাপালার প্রত্যেক অংকের মাঝখানে পরিবেশিত হচ্ছে কৌতুক। হেসে গড়িয়ে পড়ছে সবাই। দু:খের দৃশ্যে ফোঁপানির শব্দ আসছে মেয়েদের ওদিক থেকে। ‘বিবেক’ প্রবেশ করলো এরকম এক দৃশ্যের শেষে। বিবেক হলো সেই বাউল যে জীবনের সুখ দু:খকে বা দৃশ্যের আবহকে জীবনের অনিবার্যতা হিসেবে বর্ণনা ক’রে যায় গানে গানে। তাঁর দীর্ঘ আবেগ-মথিত সুর উদাস করে তুললো সবাইকে। কিছুক্ষণ আগেও প্যান্ডেলের ভেতর হাসির ঝর্ণা ছিলো। এখন সুনসান নীরবতা। সালেহা অবাক হয়ে গেলো। এই তো জীবন। কখনও হাসি। কখনও নির্জলা বাস্তবতাবোধ। শীতার্ত রাতের কিছুটা সময় মানুষগুলো কেমন মোহাবিষ্ট হয়ে আছে। ঠান্ডা হাওয়া দুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে প্যান্ডেলের চটের চাল। এই দুলুনি মানুষের সুখ দু:খের মতো। দৃশ্যগুলো আর দেখতে পারছে না সালেহা।
এমন বেদনাঘন এর শেষের দিকটা। সত্যিই তো, জীবন আমাদের নদীর তীরেই। পাড় ভেঙে প’ড়ে যেতে পারি আমরা যে কোনো সময়!

ভোর হওয়ার আগেই যাত্রা ভাঙলো। আবু একটু আগেই উঠে পড়েছিলো। ভ্যানওয়ালাকে বসিয়েছিলো ওর পাশেই। অচেনা বুড়োমতো একটা লোক চাদর মুড়ি দিয়ে যাত্রা দেখছিলো। লাল চাদরটা লেপের মতো পুরু। পেছন দিকে খুলে রাখা তার প্লাস্টিকের কালো নাগরা জুতো। আবু বললো, দাদা গান শেষ, বাড়ী যাবা না?।
বুড়ো ভারী চোখে তাকালো। চশমার কাঁচ আবুর মুখোমুখি উঠিয়ে বুড়্ বুড়্ ক’রে পলক ফেললো। চোখ টেনে তাকিয়ে বললো, আমার জুতোডা কনে রাকলাম, খুঁইজে পাচ্চি নে’।
আবু এদিক ওদিক তাকালো। একদিকে দেখিয়ে বললো, ওই যে, ওই তুমার জুতো। বুড়ো বললো, ইকেনেই তো রাকিলাম, অত দূরি গেলো কিরাম কইরে?’

উঠতে কষ্ট হচ্ছে বুড়োর। চাদরটা এতো ভারী লাগছে কেন? ভেজা ভেজাও মনে হয়। প্যান্ডেলের ভেতর শিশির পড়তে পারে না। চাদর ভিজলো কী কীভাবে! বোঁটকা একটা ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে এলো আবুর। বুড়ো কুঁজো হয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে। জুতোটার দিকে এগোচ্ছে। জুতোর ভেতর একপা ঢোকানোর সাথে সাথে পচ্ ক’রে শব্দ হলো। পিচকিরির মতো পানি উপরে উঠে নাকে মুখে লেগে গেলো। মুখ খোলা ছিলো। একেবারে টাকরায় গিয়ে পড়লে পিঁচকিরিটা। গাল ভরে গেলো। ঢক্ ক’রে গিলে ফেললো বুড়ো। উহ, কেমন নোনতা স্বাদ। গন্ধও অসহ্য। বুঝতে পেরে এক মুহূর্তে রেগে উঠলো। চাদর খুলতে যাচ্ছে। আবু বিপদ বুঝতে পেরে দৌঁড়াতে লাগলো মেয়েদের বসার জায়গার দিকে। একপেশে হয়ে দৌঁড়াচ্ছে আবু। বুড়ে কী করে তাই দেখবে। বুড়ো গর্জে উঠেছে। সিংহের মতো। বৃদ্ধ বয়সের রাগ বড়ো ভয়ংকর ! এতে কোনোকিছুর বা কারও পরোয়া নেই। বেপরোয়া। চাদর রশির মতো দুইহাতে উপরে উঠিয়ে ঘুরোচ্ছে এখন। লোকজন কিছু বুঝে ওঠার আগেই বৃষ্টির মতো সবার গায়ে চোখে মুখে ছিটা লাগছে। মুখে গেলে দু’একজন জিহবা বাড়িয়ে চাখলো। নাক শিটকে ওয়াক্ব ওয়াক্ করতে লাগলো তারা। হো হো ক’রে হেসে উঠলো বুড়ো। বলতে লাগলো, দাঁড়ায় যা, যাত্রা দেকতি আইসে আমার চাদরে মুতা বাইর কইরে দোবো। স্যালো মেশিনের পানির মতো গল গল ক’রে গালি বেরোতে লাগলো বুড়োর মুখ দিয়ে।

মেয়েদের বসার জায়গায় এসে দ্যাখে সালেহারা দাঁড়িয়ে আছে। আড়মোড়া ভাঙছে রবি। সালেহাকে জিজ্ঞেস করলো, কেমন লাগলো যাত্রা-গান?’ সালেহা বললো, ‘বইডা খুব দুখখির চাচা। তবে সব মিলে ভালোই লাইগেচে। সিনিমায় তো শুদু ছবি দেকা যায় আর এতে সরাসরি মানুষ কি কইরে অভিনয় করে তা-ও দেকতি পাওয়া যায়। এইডেই আমার নতুন অভিজ্ঞতা’।

মানুষের ভিড় একটু কমলে ওরা স্কুলের পুব পাশে আসলো । ভ্যান আনা হয়েছে। একেবারে ফর্সা হয়ে উঠেছে চারদিক। একটু পরেই সূর্য উঠবে।

**************

গল্পগ্রন্থ  :   একদিন  কপোতাক্ষ ও অন্যান্য  গল্প

( প্রকাশক : অন্যপ্রকাশ )

রেজা নুর সম্পর্কে

প্রকাশিত বই ৭টি : ১. অপরূপা নীল নির্জনতায় (কবিতা, ২০০১) ২. সন্ধ্যার ঘ্রাণ (উপন্যাস, ২০০৫ ) ৩. আমেরিকার সাম্প্রতিক কবিতা (অনুবাদ, ২০০৫) ৪. আমেরিকার সাম্প্রতিক কবিতা-২ (অনুবাদ, ২০০৯) ৫. বাংলা শেখা সহজ ( ছোটদের বই, ২০০৯ ) ৬. একদিন কপোতাক্ষ ও অন্যান্য গল্প (গল্পগ্রন্থ, ২০১২) ৭. উত্তরাধুনিক তিন কবি (প্রবন্ধ, ২০১২ )
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে গল্প-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

2 Responses to বৈকালী অপেরা

  1. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    ভালো লেগেছে কবি।

    আপনার দেখি ২০০১ থেকেই বই বেরুচ্ছে 🙂

  2. অনাবিল বলেছেনঃ

    অনেক বড় গল্প, পড়তে সময় নিল…………

    ভালো লেগেছে……।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।