মা

মায়ের জন্য নির্দিষ্ট একটিমাত্র দিন হয় না কখনও। যিনি নতুনতর এক সৃষ্টির উৎসমূল, যার ভেতরে স্থিত, বিস্তৃত ও বিকাশ হয়ে ওঠে নিশ্চিত এক সম্ভাবনার অস্তিত্ব, সেই তিনি সৃষ্ট নতুন প্রাণের ভেতর অবিকল লীন হয়ে থাকেন। এক অনিবার্য অবিচ্ছিন্নতার অমোঘ-সূত্র চিরন্তনতা পায়।

সন্তান ভ্রণের আকার থেকে শুরু করে পৃথিবীতে প্রথম চোখমেলা পর্যন্ত, প্রতিনিয়ত মা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র অনুভবের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেন। এই অনুভব তাঁর একান্ত। সন্তান জন্মগ্রহণ, বেড়ে ওঠার পরও এই অনুভব মুছে যায় না।

মা’কে নিয়ে সবারই অন্যরকম আবেগ থেকে থাকে। আমারও আছে। পঞ্চম শ্রেনীর পর গ্রাম ছেড়ে নানাবাড়ির স্কুলে যেতে হলো। মাকে ছেড়ে থাকা সেই শুরু। প্রথম প্রথম দিনরাত পর্যন্ত বুঝতে পারতাম না। সেই মমতাময় কণ্ঠস্বর নেই। সকাল-সন্ধ্যায়-রাতে সেই স্নেহের পরশ নেই। সময়গুলো কেমন ধু ধু মরুর মতো মনে হতে লাগলো। চারদিকে কেবল নতুন নতুন মানুষের ভিড়। আমি প্রতীক্ষায় থাকি মায়ের নিবিড় সান্নিধ্যের জন্য। পরীক্ষা শেষে কিংবা ছুটিতে বাড়িতে গেলে মনে হয়, আমার স্বপ্নের ভেতরও মা-ই শুধু আছেন।

পরবাসে আসবার পর এই স্বপ্নময়তায় আরও বেশিরকম আচ্ছন্ন হয়ে রইলাম। আগে তো দেশে থাকতে প্রতিদিন না হোক, অন্তত কিছু সময়ের ভেতর দেখতে পেতাম। কিন্তু এখন তো তেমন সুযোগ নেই। ভৌগলিক দূরত্ব ভাবলেও গা শিউরে ওঠে। কত পথ, কত নদী কত সমুদ্র পেরিয়ে এই পরবাসে আসা। মাতৃভূমির প্রতিটি স্মৃতি যেন আরও জীবন্ত হয়ে উঠতে লাগলো। যে পথে হেঁটেছি, যে গাছের ছায়ায় বসেছি, যে পথের পাতারা আনমনে উড়ে গিয়েছে মৃদু বাতাসে আমারই সামনে তারা যেন এই দূরদেশের মেঘের সাথে উড়ে উড়ে আসে। এখনই লুটোবে আমারই পায়ের কাছে। সেইসব বন্ধু-স্বজনও যেন নির্জনে শতস্বরে কথা বলে ওঠে। এইরকম সময়ে মা কেমনভাবে উদ্ভাসিত হতে পারেন তা বুঝতে পারা যায়। সেই অবিচ্ছিন্নতার অমোঘ-সুত্র উপলব্ধি করতে লাগলাম তিলে তিলে।

মাকে নিয়ে আসার কথা ভাবছি। মা-বাবা দু’জনই আসবেন। এর মধ্যে বাবা প্রয়াত হলেন। এই সময় পৃথিবীর সমস্ত বেদনা, নিঃসঙ্গতা, অজস্র ব্যথাতুর অবয়বে এসে এসে দেখা দিতে লাগলো। মা আমার কেমন আছেন, কী ক’রে কাটছে তাঁর দিন, সেই ভাবনায়ই সময় যায়। শুধু প্রতীক্ষা ছিল, মা আসবেন। সেই ছেলেবেলার বিচ্ছিন্নতা, এতটা সময়ের শূন্যতা সবই ভরে উঠবে মায়ের পায়ের স্পর্শে।

আজ মা আছেন। তিনি যখন এই দূরদেশের বাড়ির আঙিনায়, আশেপাশে, ঘাসে আলতো পা ফেলেন আমি দেখি, প্রাণভরে দেখি। আমার মায়ের পায়ের নিচে বাংলার ধূলিমাটি, মমতা। সেই মমতার মধু বিছিয়ে বিছিয়ে যাচ্ছে এই পরদেশে, আমাদের দু’দিনের নীড়ে।

 

**************

রেজা নুর সম্পর্কে

প্রকাশিত বই ৭টি : ১. অপরূপা নীল নির্জনতায় (কবিতা, ২০০১) ২. সন্ধ্যার ঘ্রাণ (উপন্যাস, ২০০৫ ) ৩. আমেরিকার সাম্প্রতিক কবিতা (অনুবাদ, ২০০৫) ৪. আমেরিকার সাম্প্রতিক কবিতা-২ (অনুবাদ, ২০০৯) ৫. বাংলা শেখা সহজ ( ছোটদের বই, ২০০৯ ) ৬. একদিন কপোতাক্ষ ও অন্যান্য গল্প (গল্পগ্রন্থ, ২০১২) ৭. উত্তরাধুনিক তিন কবি (প্রবন্ধ, ২০১২ )
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে বিবিধ-এ এবং ট্যাগ হয়েছে স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

2 Responses to মা

  1. কৃষ্ণচূড়া বলেছেনঃ

    শেষেরটুকুতে মন ছুঁয়ে গেল। মা থেকে দূরে থাকলেই মনে হয় মা-এর গুরুত্ব বোঝা যায়।
    “মায়ের জন্য নির্দিষ্ট একটিমাত্র দিন হয় না কখনও”– একমত।

  2. সামিরা বলেছেনঃ

    ভাল লেগেছে। 🙂

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।