“লাস্ট বেঞ্চ কর্নার- বাইরে যা তুই, এই মুহূর্তে বাইরে যা!”
–মুস্তাফিজ স্যারকে স্মরণ করলে আমার প্রথমে মনে পড়ে এই বাক্য, এরপর তার হাসিমাখা স্নেহার্দ্র মুখ, তারপর আর সবকিছু। এইট, নাইন, টেন– টানা তিন বছর ক্লাস পেয়েছিলাম স্যারের। কিন্তু হিসেব কষলে দেখি, তাঁর মোট ক্লাসের প্রায় অর্ধেকটাই আমার কেটেছে ক্লাসের বাইরে করিডোরে দাঁড়িয়ে, কানের লতিতে হাত ঝুলিয়ে!
অসম্ভব মজার মানুষ ছিলেন স্যার। ‘বাংলা বিরচন’ মানেই চরম একঘেয়ে একটা ক্লাস– এমন ধারণাই মনে বদ্ধমূল হয়ে গেছিল ততদিনে। কিন্তু তিনি এসে বুঝিয়ে দিলেন, জগতে এর চেয়ে আনন্দময় ক্লাস আর হয় না। ক্লাসের পুরোটা সময় মাতিয়ে রাখতেন। কড়া কড়া সব নির্দেশও এমনভাবে, এমন অদ্ভুত ভঙ্গিমায় দিতেন যে, হাসতে হাসতে খিল ধরে যেত পেটে।
কথায় কথায় ছড়া কাটার দারুণ একটা ব্যাপার ছিল তাঁর। ক্লাসে কেউ পানাহার করাটা ভীষণ রকম অপছন্দ ছিল। হাতেনাতে কাউকে ধরতে পারলে এমন ভীষণভাবে লজ্জা দিতেন, ইহজনমে ঐ কাজ দ্বিতীয়বার আর করার রুচি থাকতো না তার। আমাদের এক সহপাঠী ছিল, সম্পর্কে কেমনে জানি নাতি হয় স্যারের। দৈবক্রমে এই কাজ করতে গিয়ে একদিন ধরা খেল সে। সদা হাস্যময় মুখখানি জলদগম্ভীর করে তুললেন নানা। ভঙ্গি-টঙ্গি দেখে আমরা রীতিমত ক্লাইম্যাক্স ক্লাইম্যাক্স গন্ধ পাচ্ছি। কিন্ত তিনি হঠাৎ হেসে ফেললেন। তারপর ছড়া কাটলেন,
“নাতি হও আর নানা,
ক্লাস চলাকালীন সময়ে
খানাপিনা মানা!”
কয়েক ক্লাস পরপর একটা শ্রেণী অভীক্ষা হত স্কুলে। সেই অভীক্ষার শুরুতে তিনি আমাদের সতর্কবাণী শোনাতেন,
“যদি বল কথা
চলে যাবে খাতা
পাবে তুমি মনে ব্যথা!”
ছাত্রদের ওপর কখনই খড়গহস্ত হতেন না স্যার। আর এই সুযোগের চূড়ান্ত সদ্ব্যবহার করতাম আমরা– বিশেষত আমি। হাড়-জ্বালাতন করতাম প্রতিটা ক্লাসে। তবু এস.এস.সি-র আগে বিদায় অনুষ্ঠানের দিন একেবারে বুকে টেনে নিলেন। বললেন, “ব্যাটা, বাঁদরামি তো আর কম করলি না জীবনে, এবার একটু সিরিয়াস হ, মন দে পড়ায়।“
সপ্তাহ দুয়েক আর তখন বাকি ছিল পরীক্ষার। গর্তে ঢোকার আগে বিষধর সর্পরাজও সোজা হয়। রাতদিন ধুমিয়ে পড়লাম। কিন্তু দুই বছরের পড়া কি আর দুই সপ্তাহে হয়! রেজাল্ট আমার আশানুরূপ হয় না এস এস সি-র। রেজাল্টের দিন মিষ্টি নিয়ে স্যারদের বাড়ি বাড়ি যায় সাথের সবাই। আমি যাই না লজ্জায়, দুঃখে।
এরপর প্রায় বছরখানেক। হঠাৎ একদিন দেখা হয়ে গেলো তাঁর সাথে, বাজারের মসজিদে। এড়িয়ে যাব ভাবলাম, কিন্তু চোখাচোখি হয়ে গেল। সালাম দিলাম, স্যার জবাব দিলেন। কয়েক মুহূর্ত নীরবতা। এরপর স্যার জানতে চাইলেন, “কোন কলেজে গেছিস?” জবাব দিলাম। কলেজের নাম শুনে স্যার খুশি হলেন। হেসে বললেন, “যোগাযোগ রাখিস। তোদের কাছে তো রেজাল্টটাই সব। কিন্তু আমাদের কাছে না।”
বুকে গিয়ে বিঁধল কথাটা। স্পষ্টই বোঝা গেল, কতটা কষ্ট তিনি পেয়েছেন মনে, এতদিনেও একবার দেখা না করায়। আমার মাথা হেঁট। বলার কিছু পাচ্ছি না আর। ফের কয়েক মুহূর্ত নীরবতা।
“যাই রে, ম্যালা কাজ পড়ে আছে। ভালো থাকিস।“
আমি তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে। বিড়বিড় করে বললাম, “দোয়া করবেন, স্যার।।”
আঙ্গুল চালিয়ে মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে স্যার জবাব দিলেন, “শিক্ষকদের দোয়া কোনদিন বন্ধ হয় না রে বেকুব! দোয়া করি।.”
স্নেহ-মায়া-মমতার এক মহাসমুদ্র বুকে ধারণ করে মুস্তাফিজ স্যারেরা আমাদের দোয়া দিয়ে যান। সেই সমুদ্রের উত্তাল জলরাশি নিত্যদিন রং-বেরঙের আঁকিবুঁকিতে এঁকে যায় আমাদের ললাটলিখন। কিন্তু আমরা? তার খোঁজ আমরা রাখি না। এত সময় কই আমাদের!
স্কুলের স্যাররা এমনই… প্ল্যান করেছি প্রায় ১০ বছর পর স্কুলে যাবো এই মাসে…
লেখা ভালো লেগেছে।
আসলেই, এমনই…!!
:welcome:
ধন্যবাদ হে! 🙂
:welcome:
ধন্যবাদ! 😀
দারুণ একটা কথা বলেছেন
আমাদের এত সময় কোথায়?
অনেক কিছু মনে পড়ল।
স্কুলের স্যার। প্রামারি/ হাই স্কুল…
সরব এ স্বাগতম
হুম্ম… পাঠ ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ!
এই লেখা পড়ে নিজের জীবনের সেরা সময়গুলোর কথা মনে পড়ে গেল। আসলে, এই সত্যিকারের মানুষগুলো, বছরের পর বছর অবলীলায়, একের পর এক ব্যাচের পথ দেখিয়ে দিচ্ছেন ভবিষ্যতের দিকে, নিজেরা ঠাই বসে সেই রংচটা দেয়ালের ক্লাসরুমে।
তাঁদের ঋণ পাহাড়সমান হয়ে যাবার পরও, লজ্জায় যেতে পারি না সামনে।
লেখাটা পড়ে অসম্ভব আবেগী হয়ে পড়লাম।
স্বাগতম।
“এই সত্যিকারের মানুষগুলো, বছরের পর বছর অবলীলায়, একের পর এক ব্যাচের পথ দেখিয়ে দিচ্ছেন ভবিষ্যতের দিকে, নিজেরা ঠাই বসে সেই রংচটা দেয়ালের ক্লাসরুমে। “
হুম্ম… 🙁
পাঠ ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ আপনাকে!
খুব ছুঁয়ে গেলো……………
আমারো খুব মনে পড়ে স্কুল-কলেজের টিচারদের………
লেখা চলুক…………
পাঠ ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ 🙂
“যোগাযোগ রাখিস। তোদের কাছে তো রেজাল্টটাই সব। কিন্তু আমাদের কাছে না।”
কেন জানি এই লাইনটা পড়ে দম বন্ধ হয়ে আসলো! এইরকম কিছু শিক্ষক এখনো আছেন দেখে হয়তো বড়ো হতে পেরেছি কিছুটা নীতিবোধ ভেতরে ধরে রেখে……
:welcome:
আর এমন হাজারো শিক্ষক বেঁচে থাকুন চিরকাল সেই কামনায়…
পাঠ ও এত চমৎকার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ 🙂
এই ধরণের পরিস্থিতিতে আমি স্যারকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। বিশ্বাস করেন, অনেক দিনের আটকে থাকা দমটা অনেক হালকা ভাবে বেড়িয়ে গেলো। বুকটা এতো হালকা লাগছিলো, যেনো স্যার আমার সব লজ্জা অভিমান নিজে শুষে নিয়ে আমায় ভারমুক্ত করে দিলেন।
( আমার এসএসসির রেজাল্ট ও আশানুরুপ হয়নি)
:welcome:
পাঠ ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ, নিশম 🙂
আপনার প্রায় সব লেখাই পড়েছি আমি অন্য ব্লগে, সবগুলোই সুপাঠ্য। সরবে দেখে খুবই ভাল লাগলো।
এই লেখাটাও ভাল লেগেছে। একেবারে মনের কথা বলেছেন। আর স্কুল-কলেজ ছেড়ে আসার পর টীচারদের সাথে যোগাযোগ না রাখার অপরাধবোধ আরো অনেক মানুষের আছে দেখে একটু হলেও সান্ত্বনা পেলাম। এত অকৃতজ্ঞ আমরা – তবে সেটা নিয়ে যে অপরাধী হয়ে থাকি নিজেদের কাছেই, টীচাররা সেটা বুঝে নেন যেন।
:welcome:
টীচারদের নিয়ে আমিও লিখবো ভাবি। লেখা আর হয় না।
সচলের ধূসর জলছবি, ঠিক?
আপনার লেখা পড়েছি, সময়ের অভাবে কমেন্ট করতে পারি না। 🙂
লিখুন লিখুন, লিখে ফেলুন। আর দশজনের বোধটা জাগ্রত করে দিয়ে যদি খানিকটা প্রায়শ্চিত্ত হয় নিজের, বেশ তো!
না তো! আমি এখন শুধু সরবেই লিখি, আর সামহোয়্যারইন ব্লগে একটা পুরনো অ্যাকাউন্ট আছে ‘অনঙ্গ’ নামে, সেখানে অনেক আগে কয়েকটা পোস্ট দিয়ে আর লিখি নি। আর কোন ব্লগে অ্যাকাউন্ট নেই কোন।
ওহ্, মাফ করবেন। এই দুইটা লেখায় গুলিয়ে ফেলেছিলাম আসলেঃ
১> http://shorob.com/?p=6910
২> http://www.sachalayatan.com/dhusor_jolchobi/44387
যাহোক, শিক্ষকদের নিয়ে লিখুন শিগগির, অপেক্ষায় আছি 🙂
সামিরারটা আগে লেখা হয়েছিলো, বিশ্ব বই দিবস উপলক্ষ্যে।
“যোগাযোগ রাখিস। তোদের কাছে তো রেজাল্টটাই সব। কিন্তু আমাদের কাছে না।”
মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো স্কুলের স্যারদের কথা মনে করে………