শহীদ মিনারে নাকি ক’জন শুয়ে আছে।
তো থাক, আমার কি? কত রাস্তার কুকুর-ই তো ওখানে থাকে।
না-ওরা ঠিক রাস্তার কুকুর না তবে-
তবে কি ভিখারি, নেশাখোর নাকি পাগল ছাগল!
না ওরা আসলে সেরকম কেউ না, ওরা একটু অন্যরকম মানুষ।
সাধারণ মানুষ বলবি তো- হ্যাঁ খেটে খাওয়া মানুষ-
দেখো বড্ড আবেগ! – যারা খেটে খায় ওদের কি আমি পালঙ্কে এনে শোয়াবো?
না তা বলছি না, বলছি যে ওরা সাধারণ মানুষের ভিড়ে মিশে থাকে
রাত শেষ হয়ে এলে ওরা আকাশের তারার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে-
তাতে আমার কি করতে হবে? ওরা ক’টা তারা গুনলেন তাই কি দেখতে যাবো? ওরে আমার সং রে!
না বলছিলাম-
ওরা সকাল না হতেই অনেক দিনই মুখে কিছু না দিয়ে ঘর ছাড়ে
হয়ত তিন বা পাঁচ বা সাত কিলোমিটার হাঁপাতে হাঁপাতে
একটা বছর পনের পুরানো সাইকেল টানতে টানতে ঐ টিন ছাউনিটির পাশে কড়ই তলায় পৌঁছায়
তারপর টিনের চালের নিচে ভ্যাপসা গরমে
বাচ্চারা যখন কিচির মিচির করে স্বরে অ, স্বরে আ বলে
তখন ঘাম ভেজা কপালে এক অদ্ভুত দ্যোতনা খেলা করে
ওরা অনাগত ভবিষ্যৎ কে স্বপ্ন দেখায় – তোমাদের একদিন বড় হতে হবে
বলে- মানুষের মত মানুষ হতে হবে
ওরা ছড়া শেখায়
সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি- সারাদিন যেন আমি ভালো হয়ে চলি
খা খা রোদ্দুর টিনের চালে এসে পড়ে
কড়ই তলায় এসে আশ্রয় নেয় একটা নেড়ে কুকুর
শুকানো পুকুরের পাড়ে আধমরা বাবলা গাছ
গনগনে সেই রোদের মাঝখানে
একজন আপাত-বৃদ্ধ কপালের দরদরে ঘাম মুছে
ভাঙা সাইকেলটা নিয়ে আবার ফেরার পথ ধরেন।
আস্তে আস্তে ঢলে পড়া সূর্য—–
সারেং বাড়ির হাটে তখন বেশ হাট মুখো মানুষের ভিড়
মুদি দোকানদার রহিম মিয়াকে পাশ কাটাতেই ও হাঁক ছাড়ে-
“ ও মাস্টার মশাই আমার তিন মাসের বাকি টাকা টা!
খুব তো স্কুলে বাচ্চাদের শেখান ঋণ করা ভালো নয়!!!
একটা শুকনো হাসি হেসে- এই যে আসছি বাপু!
তরকারি বেচা কালু সেখ, ও বলে
‘মাস্টার মশাই! আপ্নে জানা শোনা মানুষ বলে আইজ কিন্তুক দাম
কম রাখবার পারবো নানে”
সেলাই করা থলেটার তলনিতে আলু, মিষ্টি কুমড়োর এক টুকরো
আর ওপরের দিকে হাত পা ছড়ানো পুঁই লতা
যেন থলে ভর্তি বাজার!
আজ যে ঘরে কুটুম আসবার কথা রয়েছে! তাই আর কি!
মুদি দোকানের রহিম মিয়া –‘ মাস্টার মশাই- আর কতদিন আপনারে বাকি দিমু
আমারেও তো চাল, পেঁয়াজ রসুন কিনতে হয় নাকি-
আপনি জানা শোনা মানুষ- আর বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না’
ভারি কাঁচের চশমার ফাঁক গলে ধোঁয়াশা হয়ে যায় শেষ আশা টুকু
ঘরে কুটুম- তাই বুকের সমস্ত ব্যথা দম বন্ধের মত আটকে রেখে
ফ্যাল ফ্যালে নির্লজ্জতায় – ‘বাপু, এইতো আর মাত্র কয়েকটা দিন’
যে কয়েকটা দিন তার এত গুলো বছরেও শেষ হয় নি!
শেষ বিকেলে পথ পেরিয়ে এসে থামে ভাঙা পাঁচিলের বাইরে।
ছিন্ন বস্ত্রে লজ্জা -ঢাকা বধুর মত গৃহ থেকে
একজন মহীয়সী এক চিলতে হাসি মেখে বাজারের থলেটা নেন,
আঁচলে মুছে দেন কপালের ঘাম
কিছুটা পর- রান্নার ঘর থেকে পাণ্ডুর মত ডাক
‘ আজো একটু মাছ আনো নি?’
এটা হয়ত দুজনের ভালবাসা মাখা খুনসুটি!
ঘরের আর মানুষগুলোর কথা-
না থাক ঐ কাঠ কয়লার গল্পগুলো।
জানেন একদিন ওরা কেউ কেউ যৌবনের স্বপ্ননীল মেখে
বুলেট আর রাইফেল সঙ্গী করেছিলো
ওরা জেনেছিল – একদিন আমরাও হাসতে জানব সোনালি দিনের ভোরে—
এখন ওরা
পুলিশের বুটের নিচে পিষ্ট হয়
শেষ প্রার্থিত -এক ফোঁটা পানি দাও বললে
জল কামানের তীব্র ঝাঁঝালো রঙিন গরম পানি
প্রার্থনার জবাব দেয়।
তবু ওরা বলে তোমাদের একদিন বড় হতে হবে
বলে- মানুষের মত মানুষ হতে হবে-
ওরা শুয়ে থাকে শহীদ মিনারে!
তো থাক, আমার কি? কত রাস্তার কুকুর-ই তো রাত বিরাতে ওখানে থাকে।
না-ওরা ঠিক রাস্তার কুকুর না তবে-
সবাই ঘুমিয়ে আছে।
আপনি কিংবা আমি কেউ ঘুমিয়ে নেই
কিছু একটা করার কথা ভাবুন
দেখবেন আসলেই সবাই জেগে আছে
চোখে জল এনে দেয়।
কি বলো বন্ধু-
ক’ ফোঁটা রক্তে এক ফোঁটা চোখের জল হয় জানো ?
উলটো রাজার দেশে…
মহারাজাই কখন না জানি উল্টে যান—
দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যাপীঠের ছাত্রী এখন। কিন্তু এখানে আমি এখনো আমার সেই ছোটবেলার স্কুলের আপা আর স্যারদের মত আন্তরিক আর শেখানর মানসিকতার মানুষ পাইনি। আমি যা শিখেছি তার ভিত্তিটা শুধু তারাই করে দিয়েছিলেন।
ওনাদের কষ্টগুলো দেখলে মনে হয় বেঁচে থাকাটা খুব কঠিন।
কি আশায় তারা যে আগামীকে স্বপ্ন দেখায়—————-
কিছু বলবো না আমি।
আমরা সবাই আসলে জেগেও ঘুমিয়ে …
ভাই বকা মানুষ… অসাধারন লেখা… আমি এটা আবৃত্তি করতে চাই… আপনার নামটা তাই জানা দরকার…
এমন ভাবে লিখলেন। বুকের ভিতরটা কেমন যেন কষ্টে ভেঙে যাচ্ছে……