আশ্রয়

কবরের জায়গা ঠিক করতে গ্রামে এসেছেন আনিস সাহেব।

বয়স হয়েছে। ছেলেমেয়েরা যে যার মতো জায়গা ক’রে নিয়েছে। ভালোই চলছে ওদের জীবন। মেয়েরা বেড়াতে আসে। নাতী-নাতনীরা খেলে কোলে পীঠে। ওদের দপদপানিতে বুড়ো পীঠও ঘোড়ার মতো শক্ত ক’রে রাখেন। ছেলের বউ ঘোরাঘুরি করে আশেপাশে। কখন কোনটা লাগে। একটু পর পর জিজ্ঞেস করে, আব্বা, চা খাবেন? আমের সময় এলে বলে, আব্বা, একটা ফজলি আম কেটে দিই, আপনার ছেলে একটু আগে এনেছে। মৃদু হাসেন আনিস সাহেব। জীবনের প্রান্তের এই দিনগুলো ভালোই মনে হচ্ছে। সবাই গম্ গম্ করছে চারদিকে।গিন্নি ফোড়ন কাটেন, ওই বুইরা, ফোকলা দাঁতে আর কতো হাসবা?

হাসি স্বর পায়। জোরালো হয়। শব্দ ক’রে হাসেন আনিস। ভোরের পাখিরা গানের পর গলা জুড়িয়ে নিচ্ছিল একটু। হাসির দমকে উড়ে গেলো দু’একটা। সরু আলপথে হাঁটতে হাঁটতে একটু হোঁচট খেয়ে সম্বিত ফিরে পেলেন। ফজরের নামাজ প’ড়ে আকবর মৃধার উঠোন পার হয়ে নদীর ধারে পারিবারিক গোরস্তানের কাছাকাছি এসে পড়েছেন। শিশির শুকোয় নি এখনও। রাঙা রোদে সোনার নাকফুলের মতো চিকচিক করছে। চপ্পল ভিজে কাদাটে হয়ে এলো পা। দাঁড়িয়ে পা বেঁকিয়ে ঘাসে মুছলেন। কাদার প্রলেপ লেগে রইলো। ধানক্ষেতের নরোম মাটির ছোটো ছোটে গর্তে পানি জমে আছে। স্বচ্ছ টলটলে পানি। আলের পাশের সরু পানির নালায় ব্যাঙাচির মতো ছোট মাছ সাঁতার কাটছে। আঁজলা ক’রে তুললেন একটা। আঙুলের ফাঁক দিয়ে পড়ে গেলো পানিতে।

রাস্তায় উঠে আসলেন। হাঁটতে হাঁটতে আরেকবার ফিরে তাকালেন মাঠের দিকে। ফুরফুরে বাতাসে হেলে আছে দূরের ওই জমাট সবুজ। সন্ধ্যা নদীর পাড় মিলিয়ে বিস্তৃত হয়ে আছে বিশালতা। ছেলেবেলায় দাদাজির সাথে আসতেন এই মাঠে। শুকনোর সময় সেঁচের পানি দিতে হতো ক্ষেতে। দুপুরের কঠিন রোদেও পানির পরশ পেয়ে কেমন রসগোল্লার মতো রসিয়ে গ’লে গ’লে উঠতো বড় বড় ঢেলা। সেঁচ-কলের রশি টানতে টানতে হেসে গড়িয়ে পড়তেন। দাদা বলতেন, যা-রে আনিস, ওই গাছের ছায়ায় গিয়া ব’।

আর পারলে ক্ষ্যাতে পানি যায় কি-না দেইখা আয়’।

ছায়ায় বসা হয়নি কোনোদিন। ছায়া দেখেছেন। কালো পাটির মতো বিছিয়ে থাকতো জমিনের একটকোণার বড়ো আমগাছটার নিচে। দৌঁড়ে দৌঁড়ে পানির সরু স্রোত দেখতেন শুধু।
‘কবে দ্যাশে আইলেন আনিস চাচা, ঢাকার খবর কী?’ কারও কথার আওয়াজে ভাবনা ভাঙলো। দেখলেন, অল্প বয়সী একটা ছেলে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। চিনতে চেষ্টা করলেন। না চেনার কথা বলতেও লজ্জা লাগছে। বুঝতে পেরে ছেলেটা বললো, ‘আমি রহমত, বাপের নাম রইস উদ্দীন। আপনাগোর বারিতে কাম করতো আমার বাপে…’।

চোখ মুখ উজ্জ্বল ক’রে আনিস বললেন, ও, ও, তুমি রইসের পোলা? তা বাবা চিনতে পারিনি, কিছু মনে কইরো না’। ‘না না মনে করার কী আছে, আপনি ব্যস্ত মানুষ, তা’ছাড়া এতদূর থাইকা তো ঘন ঘন আসা-ও যায় না দ্যাশে’।

বিনীত হয়ে বললো রহমত। আনিস আনমনা হলেন। রহমত সালাম দিয়ে বিপরীত দিকে হেঁটে গেলো। ওর সালামের শেষ শব্দের গুঞ্জন বাজতে লাগলো কানে। সেই গুঞ্জন ছাপিয়ে আনিস শুনতে পেলেন, রইস ডাকছে। বার বার। ‘আ-নি-স… আ-নি-স…, খারায়া খাক, যেই খানে আছোস হেইখানেই খারায়া থাক। আমি আইতাছি। তর কিচুই অইবো না, ভয় পাইস না…’।

রইস তখন যুবক। গরু রাখে। সাত-আট বছরের আনিস স্কুল থেকে এসে লেগে থাকে রইসের পেছনে। স্কুল ছুটির দিনে তো কথাই নেই। তখন এড়া-কাল। ফসল-শূন্য মাঠ। ধান পাটের বদলে ঘাস আর ঘাস। সবাই যে যার গরু বাছুর ছাগল ছেড়ে দিয়েছে। রইস সকালে পান্তাভাত খেয়ে সাত-আটটা গরু নিয়ে মাঠে যাবার জোগাড় করছে। ও দড়ি ছাড়া গরু ছাড়তে চায় না। তেজী ষাড় আর অবাধ্য গুরুগুলোকে বেড়ে আনা মুশকিল। তাই নিজে দড়ির লাগাম ধ’রে রাখতে চায়।

‘আমি তুমার লগে গরু লইয়া যামু মাডে, রইস ভাই’।

রইসের হাত ধ’রে ফেললো আনিস।‘না না না, তুই যাইতে পারবি না, গরুর গুতা খাবি’।

রইস হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বললো। ‘আমি দূরে থাকমু আনে, আমারে লইয়া যাও, না কইরো না’।

আনিস কেঁদে ফেললো। ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, কান্দিছ না, তয় কইলাম যেইখানে বইয়া থাকতে কমু হেইখানেই থাকবি, থাকবি তো?’ বললো রইস। ‘হু হু হু, তুমি যা কইবা তা-ই’ রইস ভাই। দ্রুত মাথা নাড়লো আনিস।
খোলা মাঠে শুধু গরু ছাগলের ছুটোছুটি। লাঠি দিয়ে গরু হাকাচ্ছে রইস। আরেক হাতে আনিসকে ধ’রে আছে। মাঠে এসে গাছের নিচে ওকে বসিয়ে বললো, আমি গরুর খুঁডা পুইতা আসি, তুই বইয়া থাক’।

রইস একটা একটা ক’রে খুঁটো কাঠের হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে পুঁতে দিতে লাগলো শক্ত মাটিতে। আনিস দেখছে, বড়ো বড়ো বাঁশের খুঁটো হুড় হুড় ক’রে দেবে যাচ্ছে মাটির নিচে। রইসের গায়ে কতো বল্। বুদ্ধিও খুব! বড়ো একটা কাঠ দিয়ে কী দারুণ হাতুড়ি বানিয়েছে। স্কুলে না যেতে হলে সব সময় রইসের কাছে কাছে থাকা যেত, কত কিছু শিখতে পারতো আনিস ওর কাছ থেকে। হঠাৎ হড়ে হড়ে দৌঁড়ের শব্দে হুঁশ হলো আনিসের। ফিরে দ্যাখে লড়াই বাঁধিয়েছে দুটো ষাড়। বড়ো বড়ো শিং পেঁচিয়ে বিশাল দুটো মাথা স্থির হয়ে আছে। শিং ছাড়িয়ে কিছুটা পিছিয়ে গেলো ষাড় দুটো। জোরে দৌঁড়ে এসে খটাং ক’রে আঘাত করলো শিঙে শিঙে। ভয়ে জড়োসড়ো হলো আনিস। তাকিয়ে দেখে রইস বেশ দূরে। বাছুরটা দৌঁড় দিয়েছিলো। ওকে ধরে আনতে গিয়েছে। লড়াই দেখে আরও কয়েকটা গরু গুঁতোগুঁতি শুরু করেছে একসাথে। কিছুটা গোলাকার হয়ে আসছে ওদের লড়াইয়ের জায়গা। আনিস ভীতু চোখে তাকিয়ে দেখে রইসকে দেখা যাচ্ছে না। চারদিক শুধু যুদ্ধের দামামা। গর্জন, শিঙের খটাং খটাং আর হুড়োহুড়ি। চিৎকার দিলো আনিস, র-ই-স ভা-ই…।

আনিসের কান্না কানে গেল রইসের। চেঁচিয়ে বললো, আ-নি-স, খারায়া থাক….’।

এখনও কানে বাজতে লাগলো কথাগুলো।
রইস মারা গেছে গত বছর। মৃত্যুর মাসখানেক আগে ঢাকায় এসেছিলো। আসার সময় আনিসকে জড়িয়ে ধ’রে কেঁদেছিলো শিশুর মতো। রাগী হিংস্র গরুর বেষ্টনী পেরিয়ে যেমন ক’রে আনিসকে আগলে ধরেছিলো একদিন ঠিক তেমনি জড়িয়েছিলো হাত দু’টো। রইস না এলে হয়ত পিষে যেতেন জন্তুর যুদ্ধে। মন মোচড় দিয়ে উঠলো আনিসের।

কবরখানার কাছাকাছি এসে পড়েছেন আনিস। চারকোণা সামান্য উঁচু দেয়াল দিয়ে বাঁধানো জায়গাটা। মা-বাবা’র কবর পাশাপাশি। খাটের ফাঁকে প’ড়ে গিয়ে দু’মাসের মেয়ে ডালিয়া মারা গেলে উদভ্রান্তের মতো ঢাকা থেকে এসে মাটির নিচে শুইয়েছিলেন হৃদয়ের টুকরোটাকে। শখের ডালিয়া আর ফুটলো না। ওর মাথার কাছে ডালিয়া ফুলের গাছ লাগিয়ে দিয়েছিলেন। বাড়ীর লোকজনকে বলেছিলেন, ‘এই ফুটগাছটার যত্ন তোরা করিস..। বাবার গলার আওয়াজ শোনা গেল মনে হয়। কেমন দূরাগত শব্দের মতো টেনে টেনে ডাকছেন। ‘আর কতো খেলা করবি বাবা। বই লইয়া আয়, পড়া দেহায়া দি’।

মা বলছেন, ‘ কে-রে আনু, পরা ওইচে…? খায়া যা’।

ঝর ঝর ক’রে কেঁদে ফেললেন আনিস।

আরেকটু এগিয়ে দেয়ালের উপর দিয়ে ভেতরে দৃষ্টি রাখলেন। পাশাপাশি লম্বাটে দুটো গর্ত দেখতে পেলেন। মা-বাবা’র মাথার কাছে দুই কবরের মাঝখানে একটা জবাফুলের গাছ লাগানো। সবুজ পাতার ভেতরে লাল পাপড়ি মেলে ঝুঁকে আছে। ডালিয়ার কবরের পাশের পাতাবাহারগুলো বর্ণিল সজীবতায় দুলছে। দাদা দাদী’র কবরের পাশের কষ্ণচূড়া গাছটা বড়ো হয়েছে উঠেছে বেশ। দাদা মারা যাবার পর গাছটা পুতেছিলেন বাবা। এর তলায় এসে বাবাকে কাঁদতে দেখেছেন ছেলেবেলায়। কৃষ্ণচূড়ার চিকন মিহি পাতা ছুঁয়ে একঝাঁক বাতাসের ঝাপটা এলো। কেমন ভেজা, ঠান্ডা লাগছে। মৃদু ঝুনঝুনির আওয়াজের মতো বাজছে গাছপালার পাতারা। উপরের দিকে তাকালেন আনিস। অচেনা ধরনের দুটো পাখি বসে আছে। লম্বা লেজ। বেশ বড়ো সড়ো। কাঁচা হলুদগোলা রঙ। এমন পাখি তো দেখেন নি কোনদিন! কত চেনা জানা পাখির পেছনে ছুটেছেন ছেলেবেলায়। আজ কী নতুন কেউ এসে জায়গা ক’রে নিলো? পাখি দেখতে দেখতে একটি ঝরা শুকনো পাতার সাথে দৃষ্টি কাটাঘুড়ির সুতোর মতো নিচে নেমে এলো। পায়ের কাছে এসে পড়লো। উবু হয়ে তুললেন পাতাটা। কেমন শুকনো, কড়কড়ে। গাছ পর ক’রে দিয়েছে পাতাটাকে। একদিন সবুজ হয়ে উঠে শোভা বাড়িয়েছিলো গাছটার। আজ ঝরে যাবার সময় হয়েছে তার। চোখ ভিজে এলো আনিসের।

একটা কাঠবিড়ালি গাছ থেকে নেমে কবরের দেয়াল টপকে ফড় ফড় ক’রে দৌঁড়ে গেলো। কবরগুলোর দিকে দৃষ্টি গেল আবার। ভাবলেন, আপাতত স্ত্রী আর নিজের জন্য জায়গাটা বাড়ানো দরকার। পরবর্তী প্রজন্মও যেনো আশপাশেই থাকে সেরকম ভাবনাও করেছেন। ডালিয়ার পর তিনি। তারপর আলেয়া… এইভাবে ভেবেছেন। মেয়েটার পাশেই চিরদিনের ঘুমটা পাড়তে চান।

স্ত্রীর কথা মনে হলো। আসার সময় আলেয়া বলেছিল, ‘তোমার পিছে পিছে যাইতে চাই আমি। সারাজীবন যেরকম তুমার পা’র দাগ দেইখা চলছি। এইখানেও অন্যরকম করমু ক্যান?’ ‘এই খানেও কী ডানদিকে ঘুমাইতে চাও?’ অর্থপূর্ণ হেসে জানতে চেয়েছিলেন। ‘হ হ, ভালো কথা মনে করছো। খোলামেলা দিকটা আমার জন্য রাখবা। ছায়াটা ঠিকমতো য্যান আমার মাটির পরেই পড়ে’।

দুপুর হয়ে আসছে। তবু কেমন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব। সন্ধ্যা নদী ভিজে হাওয়া ছেড়ে দিয়েছে এইদিকে। দূরে তাকালেন আনিস। নিরাভরণ দিগন্ত। শুধুই নীল। দু’এক খন্ড অনিচ্ছুক মেঘ মনে হয় দাঁড়িয়ে পড়ছে নদীর উপরে। উড়ে যাবার আগে আরেকটু দেখে নেয় তাদের জ্ঞাতি-জল। নদীর ঢেউয়ের মতো ঢেউ উঠলো কী রোদেও। বাতাস বেঁকে বেঁকে খেলছে রোদের সাথে। এই পারিপার্শ্বিক চিরদিনের সাথী হবে আমার। এই নীলাভ আকাশ, নদী, বিরল মেঘ, গাছপালা, পাখি, ঘাসের সবুজতা— সবই।

বাড়ীর কাছাকাছি আসতেই দেখলেন লামিয়া দৌঁড়ে আসছে। ছোটবোন কহিনুরের মেয়ে। পাঁচ বছরের এই মেয়েটার দিকে তাকালে ডালিয়ার কথা বেশি ক’রে মনে পড়ে আনিসের। হাত ধ’রে টানতে লাগলো লামিয়া। বললো, ‘কই গিছিলা মামা। সক্কাল থাইকা  খোঁজদে আছি’ ।

হেসে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন আনিস। উঠোনে আসার পর কহিনুরের গলা শোনা গেল, ‘ভাইজান, গোসল কইরা আহেন, ভাত বারতে আছি’।

পরম তৃপ্তিতে দুপুরের খাবার খেলেন আনিস। খাওয়া শেষ হলে কহিনুর বললেন, ভাইজান, বিছনা দিয়া দিছি। একটু গড়াগড়ি দ্যান’।

আনিস বললেন, আমার ঘরের মদ্যেই বিছনাডা কর কহিনুর’। ‘ওই ঘরে তো কেউ থাহে না, ময়লা হইয়া রইছে’, বললেন কহিনুর। ‘আমি একটু বইতে আছি, তুই ঘরডা পরিষ্কার কইরা বিছনা কর’।
আনিস সপরিবারে ঢাকা যাবার পর এই ঘরটা প’ড়ে আছে। কহিনুর ঝাড়টাড় দিয়ে রাখে মাঝে মাঝে। পাশের বাঁশঝাড় থেকে শুকনো বাঁশপাতা এসে বিছিয়ে যায় উঠোনে। চালের ওপর শুয়ে থাকে শুকনো আম-পাতা।

উঠোন ঝাট দিয়ে চকচকে করেছে কহিনুর। একটু দাঁড়ালেন আনিস। আমগাছটা বুড়িয়ে গেছে কিছুটা। প্রগাঢ় কালচে গুঁড়ির উপরে মোটা মোটা ডালপালার বিস্তার। জমাট ছায়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গম্ভীর।

ধীর পায়ে ঘরে ঢুকলেন। আঁশটে গন্ধ নাকে এলো। ঘরের এক কোণায় আগরবাতি থেকে মিহিন ধোঁয়ার সুতো উঠে আসছে। গুমোট কাটানোর জন্য কহিনুরের এই কাণ্ড। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন সেদিকে। চিকন ছাই ঝরে পড়ল ছাই-দানিতে। সোনার নাকফুলের মতো আগুন চুপ হয়ে আছে আগর বাতির দণ্ডের ওপর।

বিছানায় গা এলালেন আনিস। জানালার শিক গলিয়ে তাকালেন বাইরে। বাঁশঝাড়ের ফাঁকা দিয়ে এক টুকরো আকাশ দেখতে পেলেন। সেই নি:সঙ্গ মেঘদুটো ডেকে নিয়ে এসেছে আরও কিছু মেঘ-বন্ধুকে। কী সন্দুর উড়ছে তারা পাখির মতো! ওই খন্ড আকাশ থেকে চাঁদ উঁকি দিয়েছিলো একদিন। এখনও কেমন ছবির মতো হয়ে আছে মনে। আলেয়াকে তুলে এনে এই ঘরেই উঠেছিলেন আনিস। প্রথম রাত। কেমন জড়োসড়ো বসেছিলো আলেয়া। ঘোমটা সরালে স্নিগ্ধ আলোয় ভরে গিয়েছিলো চোখ। দূরের চাঁদও দেখছিলো ওকে। জোসনা ঝুলে থাকা সুতোর মতো বেঁকে ছুয়ে ছিলো জানালা । শিকে বাঁধা ছিলো সুতো। আর চাঁদ-ঘুড়ি উড়ছিলো আলোয় ভেসে ভেসে। দুই চাঁদ দেখে দেখে কখন সেই রাত ভোর হয়ে গিয়েছিলো মনে করতে পারেন না আনিস।

আধোঘুমে স্বপ্নের মতো লাগছে আনিসের। কেমন এক লম্বা সুরে ঘুম-ভরা বোধের গভীর থেকে উঠে আসছে চেতনা। এই সুর কতদিন শোনেন নি। নিথর বাতাসে ঢেউ ওঠা দেখা হয় নি কতদিন! গফুর মুয়াজ্জিনের গলায় এখনও এমন মধু আছে! আজান শেষ হওয়া পর্যন্ত চোখ বুঁজে চুপ হয়ে শুয়ে থাকলেন। কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠলেন তারপর। তাজা হাওয়ায় গা ঝাড়া দিলো বাঁশঝাড়। ঝিন্ ঝিন্জ আওয়াজ হলো একটু। তরল আলোয় চোখ জুড়িয়ে গেল। দরোজা খুলে বাইরে এসে দেখেন কহিনুর দাঁড়িয়ে আছেন। ভাইকে দেখে বললেন, ‘উটছেন ভাইজান, ভাবলাম আজান অইছে, ডাকি আপনেরে, অজুর পানি আইনা দিমু?’ আনিস মাথা নেড়ে বললেন, ‘না না আমি চাপ-কলে যাইতে আছি’।

প্রাত:কাজ সেরে অজু করতে যাচ্ছেন আনিস। কহিনুর কল চাপছেন। ফিনফিনে পানির ধারা থেকে ধোঁয়া উড়ছে। সকালের হিম হিম বাতাসে চাপ-কলের উষ্ণ পানিতে অজু করতে করতে অন্যরকম সজীবতা আর পবিত্রতায় মন ভরে উঠলো। অজু শেষে আনিস বললেন, আমি আইজ রাইতের লঞ্চে ঢাকা যামু কহিনুর। আমার জামা-কাপড় গোছ কইরা রাখ’।

কহিনুর অবাক হলেন ‘আর কইডা দিন থাকেন ভাইজান, কবে আর আসার সময় করতে পারবেন, তার তো ঠিক নাই’। ‘না-রে, আমার অনেক কাজ আছে। ভাইয়ের কন্ঠ অন্যরকম লাগলো কহিনুরের। অচেনা অচেনা লাগলো তাঁর ভেজা মুখ।
বিকেল হয়ে এসেছে। উঠোনে মটর সাইকেল দাঁড়ানো। কহিনুরের স্বামী বশির বললেন, আপনেরে লঞ্চঘাট পর্যন্ত আগায়া দিয়া আসি, মিয়া ভাই’।

আনিস বললেন, না বশির, একটা ভ্যান নিয়া আয়, ভ্যানের পরে বইসা আস্তে ধীরে যামু আনে’।

ফোঁপানির শব্দে ফিরে তাকালেন আনিস। মুখে আঁচল চেপে জোরে কেঁদে উঠলেন কহিনুর। মায়ের হাত ধ’রে আছে লামিয়া। একহাতের পাতা উল্টো ক’রে মেলে দিয়ে চোখের পরে দিয়ে রেখেছে সে। লাল টুকটুকে মুখটা ভিজে একাকার। বোনকে জড়িয়ে ধরলেন আনিস। শক্ত ক’রে আঁকড়ে ভাইকে ধ’রে থাকলেন কহিনুর। মনে হলো আর কখনও ছেড়ে দেবেন না। কোনোরকমে একটু ঝুঁকে লামিয়াকে কোলে তুলে নিলেন আনিস। চোখ মুছে দিলেন। বুকের ভেতরে ফুঁসে ফুঁসে কাঁদতে লাগলো লামিয়া। চোখ মুছতে মুছতে বললেন, এ-রে কোলে নে কহিনুর। আমি এখন যাই’।
ইসলামপুর মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের ছোট মাঠ। সেখানে ভ্যান-রিকশার হাতল ধ’রে দাঁড়ানো ভ্যান ওয়ালা। বাড়ীর ভেতর থেকে এগিয়ে যাচ্ছেন ওইদিকে আনিস। পেছনে ব্যাগ কাঁধে হাঁটছেন বশির। মাঠের এককোণায় কতকগুলো নারকেল গাছ। মুখ বেশ উঁচু করে ওদের ঝাঁকড়া মাথা দেখলেন আনিস। ডাব আর ঝুনো নারকেলে কেমন ফলবতী হয়ে আছে। বাবার সাথে এই গাছগুলো লাগিয়েছিলেন ছোটবেলায়। বদনায় পানি এনে এনে কতবার ভিজেয়েছেন এদের গোড়ার মাটি। স্কুলের দালানে নতুন রঙ করা হয়েছে মনে হয়। বাবার হাতের স্কুল। টিনের বেড়া ছনের চাল আর মাটির মেঝেয় অল্প কিছু বেঞ্চে ক্লাস বসেছিলো। আজ কী সুন্দর শান বাঁধানো বারান্দা! ক্লাসের ফাঁকে বেত হাতে পাঁয়চারি করেন শিক্ষকরা।

ভ্যানের ওপর ব্যাগ রেখে আনিসের দিকে তাকিয়ে আছেন বশির। কেমন স্বপ্ন-ঘোর মানুষের মতো লাগছে তাঁকে। ঘাস, ওই দূরের আকাশ। স্কুল ঘরের ছাদ। মাঠের ওইদিকের গাছপালায় ঘুরে বেড়াচ্ছে তাঁর দৃষ্টি। কখনও স্থির হয়ে তাকিয়ে আছেন কোনোদিকে। মনে হয় আর কোনোদিন দৃষ্টি ফেরাবেন না। চোখের মণি থেকে অদৃশ্য আঁঠা মাখিয়ে রেখে যাচ্ছেন ওইসব প্রিয় পারিপার্শ্বিকে।

আনিসের গ্রাম, ইসলামপুর থেকে শরিকল বাজার দুই মাইল দূর। আগে বাড়ীর পাশের ছোট খালে নৌকা চলতো। এখন চলে না। মাঝে মাঝে বাঁশের মাচা নৌকার মতো ক’রে বেয়ে নিয়ে যায় লোকেরা এ-গ্রাম থেকে ও-গ্রামে। ভ্যানের দুলুনিতে কেঁপে কেঁপে উঠছে সামনের দৃশ্যগুলো। খালের সরু পানির স্রোত ব’য়ে যাচ্ছে। ঝুঁকে থাকা ডালে বসে আছে দু’একটি পাখি। মাছ ধরবে। চারদিক থেকে এই প্রায় সন্ধে হয়ে আসা আলোয় ঘরে ফিরে যাবার প্রস্তুতি তাদের। কেমন যেন ঝিম্ ঝিম্ টু টু টিউ টিউ আওয়াজ ভেসে আসছে। হাতলের নিচের লোহার দন্ড চেপে ক্রিং ক্রিং বেল বাজাচ্ছে ভ্যান ওয়ালা। পাখির ডাক আর বেলের শব্দের মিশ্রণে মুখর হয়ে উঠছে চারদিক। সামনের মাটির পথ, দু’পাশের গাছপালা, বাড়ীঘর সরে সরে যাচ্ছে দৃষ্টি থেকে। সবকিছুই কেমন চলমান চিত্রের মতো লাগছে।

শরিকল বাজারে ব্রীজের নিচে সারি সারি লঞ্চ দাঁড়ানো। একটিতে উঠলেন আনিস। ব্যাগ তুলে দিয়ে মিয়া ভাইয়ের হাত ধরে রইলেন বশির। এমন ভার ভারিক্কি মানুষটা কেঁদে ফেললো ঝর ঝর ক’রে। পাশের লোকজন তাকালো এইদিকে। শব্দ ক’রে কাদতে লাগলেন বশির। স্থির ভেজা চোখে বশিরের কান্না দেখছেন আনিস। চোখের পানি শুকিয়ে কেমন চড়্ চড়্ করছে। চশমা তুলে তালু দিয়ে চোখ চুলকে নিলেন একটু।

হই চই আর চেঁচামেচির ভেতর ভেঁপু বাজলো। একজন যুবকের হাত ধ’রে তির তির ক’রে দৌঁড়ে আসছে পাঁচ ছ’বছরের ছেলে। লঞ্চ ছেড়ে দেবার আগে পৌঁছতে চায় ঘাটে। মনে পড়লো, বাবার হাত ফসকে খালের কাদা-মাটিতে প’ড়ে গিয়েছিলেন একবার ওইরকম বয়সে। কাদায় জবজবে হয়ে গিয়েছিলো হ্যাফ-প্যান্ট। গামছা ভিজিয়ে প্যান্ট মুছেছিলেন বাবা। সারাপথ আর কোল থেকে নামান নি। মা বলেছিলেন, ও আনিসের বাপ, পোলাডার প্যান অহন শুকাইছে, দ্যাও ওরে আমার লগে বইতে দ্যাও’।

মায়ের দিকে শুধু ঠাণ্ডা নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়েছিলেন বাবা। সেই চোখের দৃষ্টি বেয়ে দূরের আকাশ দেখেছিলেন আনিস। কী বিরাট, কী বিশাল, কী অনাবিল সেই আকাশটা ছিলো সেইসময়। আর কোনোদিন দেখতে পান নি তা।
তুমি আজ আবার যদি আমার হাত ধ’রে উঠাতে, বাবা। তোমার কোলের কাপড়ের উষ্ণতায় শুকিয়ে দিতে আমার জীবনের আদ্র দিনগুলো— দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠলেন আনিস। হাত সরালে দেখতে পেলেন সামনে গল গল করছে পানি। লঞ্চের চাকার ঘূর্ণিতে মোচড় খেয়ে উপরে উঠে আসছে স্রোত।

—————————————————————
প্রকাশিত: (সাহিত্য পত্রিকা) নন্দন (৪র্থ সংখ্যা)

গল্পগ্রন্থ : একদিন কপোতাক্ষ ও অন্যান্য গল্প 

(প্রকাশক: অন্যপ্রকাশ )

রেজা নুর সম্পর্কে

প্রকাশিত বই ৭টি : ১. অপরূপা নীল নির্জনতায় (কবিতা, ২০০১) ২. সন্ধ্যার ঘ্রাণ (উপন্যাস, ২০০৫ ) ৩. আমেরিকার সাম্প্রতিক কবিতা (অনুবাদ, ২০০৫) ৪. আমেরিকার সাম্প্রতিক কবিতা-২ (অনুবাদ, ২০০৯) ৫. বাংলা শেখা সহজ ( ছোটদের বই, ২০০৯ ) ৬. একদিন কপোতাক্ষ ও অন্যান্য গল্প (গল্পগ্রন্থ, ২০১২) ৭. উত্তরাধুনিক তিন কবি (প্রবন্ধ, ২০১২ )
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে গল্প-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।