সেই ছেলেবেলা, এই স্মৃতি

ছোটবেলায় আমার পাশের ঘরে একটা জ্বিন থাকতো।

আমার বাসাটা ছিল চৌচালা টিনের ঘর। চারদিকের টিনের রঙ ছিল নীল। ঘরের ভিতর একটা সমুদ্রের মতো খাট ছিল। ছেলেবেলার আমি-র কাছে তার বিশালত্ব সমুদ্রের মতোই ছিল। আমার বাসার পাশেই ছিল একটা গোডাউন ঘর। সে ঘর থেকে রাতের বেলা ভেসে আসতো খুটখাট শব্দ। রাতের বেলা কেন, এমনকি দিনের বেলাও আলাদীনের দৈত্য বোতল বন্দী হয়ে থাকতো সে ঘরে। সেখানে যায় এমন সাহস কার-ই বা আছে।

আমার বাসার পাশেই ছিল একটা বিস্কিটের কারখানা। মাঝে মাঝে সেখান থেকে ভেসে আসতো নতুন বিস্কিটের সুমধুর ঘ্রাণ। ক্রিকেট খেলার সময় মাঝে মাঝে কারখানায় বল ঢুকে গেলে আমরা বল খোঁজার পাশাপাশি বিস্কিট বানানোর যন্ত্রটার জাদুকরী কাণ্ড অবাক হয়ে দেখতাম। আটার দলাগুলোকে কী এক আজব উপায়ে সে বিস্কিট বানিয়ে ফেলছে। কী অদ্ভূত!

ছোটবেলার বাড়িতে তিন ঘর মানুষ ছিল। পুরনো দিনের ঢাকার সাথে যারা পরিচিত, তারা সবাই এই তিন ঘরের ব্যাপারটা বুঝতে পারবে। তিনটা আলাদা বাসা, মাঝখানে বড় একটা উঠান। উঠানের চারপাশ ঘিরে নারকেল গাছ। সে নারকেল গাছ মাঝে মাঝে মানুষের ডাব খাওয়ার নেশায় ন্যাড়া হয়ে যায়। উঠানের ফুল গাছগুলোর সে ঝামেলা নেই। কেউ ফুল ছিড়লে তারা রাগ করে না; বরং, আবার নতুন করে ফুল ফোটায়। বাড়িতে ছেলের আধিক্য কম থাকায় আমি মাঝে মাঝে কুতকুত খেলি।

ক্লাস থ্রি-তে উঠে ভর্তি হয়েছিলাম ধানমণ্ডি গভঃ বয়েজ হাই স্কুলে। লালমাটিয়ার মাঝে দিয়ে সকাল বেলা স্কুলে যাওয়া যেন কোন গুপ্তধন উদ্ধারের মতোই রহস্যময় যাত্রা। সে লালমাটিয়ায় তখনও একলা একলা দোতলা বাড়িরা রাজ্যের গাছের আড়াল থেকে উঁকি দেয়। কাঁঠালের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় গাছের ডাল। দু’চারজন মানুষের দেখা পেলেই মনে হয়, কোথা থেকে এলো ওরা। ওরা কি পথ হারিয়েছে? লালমাটিয়ার নিঝুম রাস্তা তখনো ইটের স্তূপের জঙ্গল নয়, তখনও সে প্রতি সকালে এক রোমাঞ্চকর যাত্রা।

ঘরের জানালার পাশে একটা মেহেদী গাছ ছিল। জানালায় ঝুলে ঝুলে দেয়ালের উপর দিয়ে উঁকি দিয়ে রাস্তার মানুষ দেখা যেত। বিছানায় শুয়ে পড়তাম জন্মদিনে উপহার পাওয়া সুকুমার রায়ের ‘আবোল তাবোল’। কোন এক মজার মানুষ মজার সব শব্দে ভরে দিয়ে গেছেন প্রতিটা পারা, প্রতিটা ছবি। না দেখা জিনিস নিয়ে ভাবনা নাকি স্বপ্ন দেখতে শেখার হাতেখড়ি ছেলেবেলায় যেন এই বইটা-ই করে দিয়েছিল।

আমার ছেলেবেলায় ঢাকায় কোকিল ডাকতো। স্কুল ছুটির পর রিকশা তুফানের মতো উড়িয়ে নিয়ে আসতো বাসার দরজায়। রিকশায় বসে ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও চলে যাওয়া যেত ঢাকার ওই প্রান্তে-নানু বাড়িতে। রিকশা থেকে পড়ে যাওয়ার তো ভয় নেই, আম্মু ধরে আছে না! আব্বুর কাঁধে করে দেয়াল টপকে চলে যাওয়া যায় মাঠে; যেখানে উড়ে বেড়ায় ফড়িং আর ফুটবল খেলে আব্বু। বৃষ্টি হলে পুকুর হয়ে যায় স্কুলের মাঠ। গাছের রাজ্যের মাঝে উঁকি দেয় দোতলা বাড়ির টানা বারান্দা।

আমার ছেলেবেলা-রাজ্যের বিস্ময় চোখে ঘুরে বেড়ায় একটা ছেলে।

[ছেলেবেলার স্মৃতিগুলো মাঝে মাঝেই আমাকে খুব উদাস করে দেয়। সে সময় ঢাকা শহরের ভিতরে প্রাণের একটা অপরূপ ছোঁয়া ছিল। সেই অপূর্ব নগরীতে আমি মাঝে মাঝে কল্পনায় হারিয়ে যাই, বিস্ময় চোখে ঘুরে বেড়াই দুপুরের পথে।
অন্যদের উদাস করে দেয়া ছাড়া এ লেখার কোন উদ্দেশ্য নেই]

স্বপ্ন বিলাস সম্পর্কে

বাস্তবে মানুষ হবার চেষ্টা করে যাচ্ছি। জীবনের নানা পথ ঘুরে ইদানীং মনে হচ্ছে গোলকধাঁধায় হারিয়েছি আমি। পথ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি আর দেখে যাই চারপাশ। ক্লান্ত হয়ে হারাই যখন স্বপ্নে, তখন আমার পৃথিবীর আমার মতো......ছন্নছাড়া, বাঁধনহারা। আর তাই, স্বপ্ন দেখি..........স্বপ্নে বাস করি.....
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে স্মৃতিচারণ, হাবিজাবি-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

15 Responses to সেই ছেলেবেলা, এই স্মৃতি

  1. সামিরা বলেছেনঃ

    মনে হল রূপকথার গল্প পড়লাম।
    হায় ঢাকা! 🙁

    প্যারাগুলির মাঝে স্পেইস দিয়ে দিয়েন ভাইয়া। 😀

  2. রাইয়্যান বলেছেনঃ

    আমিও বয়েজে পড়ছি এক বছর 😀 :love:

    লেখাটা পড়ে একটা কথাই বড় সত্য মনে হচ্ছে, যায় দিন ভাল যায়. . . !! ছোটবেলার ঢাকার সাথে এখনকার ঢাকা মেলানো যায় না। কে জানে, হয়তো আরও ২০ বছর পর সেই প্রজন্মের একজন লিখবে, আহা ২০১২ সালে দেশটা কী সোনালী ছিল গো, আর এখন. . . . . . . . . .

  3. মাশুদুল হক বলেছেনঃ

    আহা, ঢাকা যদি ওরকমই থাকতো 🙁

    আবোল তাবোল এখনও আমি পড়ি, আমার টেবিলে এখনও আছে, এত বয়স হবার পরও মুগ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারিনি 🙂

  4. বিলীন অরণ্য বলেছেনঃ

    বাসার পাশেই ছিল একটা বিস্কিটের কারখানা।

    🙁

  5. অনাবিল বলেছেনঃ

    হারিয়েই গেলাম………… শৈশব………

    আর এখন যান্ত্রিকতা যেন বুঝি সব ভালোলাগা গুলোকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে চোখের সামনেই……… 🙁

  6. শামসীর বলেছেনঃ

    ছোট বেলায় আমি পাউরুটির ঘ্রানটা খুব পছন্দ করতাম। 8)

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।