আস্তাবলে চোখবুজে কালু এক থেকে বিশ পর্যন্ত গুনছিল।
আর গিলু পড়িমড়ি করে খুঁজছিল, কোথায় লুকানো যায়। আস্তাবলটা বিশাল, এ মাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত দেখতে চাইলে চোখ ঘষে খড়ের গাদায় উঠে তাকাতে হয়।
গোনা শেষ হলে কালু চোখ খুলল।
একবার ভালো মত তাকাতেই দেখতে পেল গিলুটা কোথায় লুকিয়ে আছে।
গিলু টা কী বোকা! ভাবা যায়! কালু মনে মনে বলল।
এমন একটা খুটির আড়ালে দাড়িয়েছে যে খুটিটা কেবল ওর শুড়টা ঢেকে রেখেছে।
ভারী বোকা! আবারও কালু মনে মনে বলল।
আবার কেমন ছেলেমানুষ, চট করে ধরে ফেললে মন খারাপ করবে। সারাদিন হয়তো আর কথাই বলবে না।
কালু পুরো আস্তাবল মিছেমিছে দুইবার ঘুরে আসলো। তারপর হঠাৎ করে এসে গিলুর শুড় পেচিয়ে ধরলো।
পেয়েছি!
কিন্তু তাতেও গিলুর খুব মন খারাপ হল। চোখ ছল ছল করে উঠলো।
এমন ছিচকাদুনে হাতি আমি কোনদিন দেখিনি। কালু বিরক্ত হয়ে বলল।
এমন সময় রাজকুমার বিলু এসে হাজির হল আস্তাবলে।
তুই আবার ওকে তাড়াতাড়ি ধরে ফেলেছিস?
তাড়াতাড়ি কই, দুইপাক ঘুরে এসে ধরেছি। কালু বিরক্ত হয়ে বলল।
তারচেয়ে এই লুকোচুরি খেলা বন্ধ কর রোজ রোজ। অন্যকিছু খেলতে পারিস না।
ওই তো! রোজ রোজ খেলতে চায়, আমি কি আর.. কালু অপরাধীর মত গলা করে বলে…এমন ছেলেমানুষ যে কী বলবো!
ছেলেমানুষ? হুম, তাইতো দেখছি। এটার বয়স কত হল রে?
এবার দুইয়ে পড়েছে।
ভাবা যায়, দুই বছরের একটা হাতি আমাদের কে ছাড়িয়ে গেছে, কত বড় হয়েছে দেখেছিস!
হুম, তাতো বটেই।
ওর শিং গজাবে কবে?
কার?
ক্যানো গিলুর।
শুনে কালু একদফা হেসে নেয়।
বিলু বিরক্ত হয়।
হাতির আবার শিং! বিলু হাসতে থাকে।
আমি ঢেড় ঢেড় শিংঅলা হাতি দেখেছি, বিলু এবার রেগেমেগে বলে।
কবে দেখেছিস, নিশ্চয়ই তোর ভারী জামাটা গায়ে দিয়ে যখন ওই বাজে নরম নরম গদিতে ঘুমাচ্ছিলি?
মোটেও না! বিলু এবার ইতস্তত করে, তবে ওদের শিংগুলো বাকীদের মত না মানছি। কেমন যেন নীচের দিকে নামানো।
সেটা শুনে শুধু কালু না, গিলুও কেমন বিচ্ছিরি করে হাসতে থাকে।
তারপরে কোনমতে হাসি থামিয়ে বলে, ওটা দাঁত।
দাঁত?
ওটাকে বলে গজদন্ত। হাতি ঘোড়ার কখনো শিং হয় দেখেছিস?
কে বলল তোকে দাঁত, মুখের বাইরে বেড়িয়ে আছে এমন দাঁত কখনো দেখেছিস, তাছাড়া এত লম্বা। বিশ্বাস হয় না আমার।
বিশ্বাস না করলে নাই। তারচেয়ে চল খেলি।
না না, খেলতে আসি নাই। জল্লাদ সোলেমান চাচার কালকে গর্দান নেয়া হচ্ছে শুনেছিস?
হ্যাঁ, শুনেছি। বিরাট ঝামেলা হয়ে গেল!
কেন?
প্রতি সপ্তাহে উনি আমাদের বাড়িতে একদিন নেমতন্নে আসেন। বাবা দাওয়াত করে নিয়ে আসেন। আর প্রতিবার বলেন, এইবারই শেষ, আর কোনদিন হারামীটাকে দাওয়াত করবো না!
ক্যান?
প্রথম দিন এসে সোলেমান চাচা যে গল্প শুরু করেছিলেন সেটা এখনো শেষ হয় নাই। কয় পর্ব কে জানে! সেটা শোনার লোভেই প্রতিসপ্তাহে বাবা তাকে ধরে নিয়ে আসেন। বাবা বলেন, গল্পটা শেষ হলেই এ বাড়িতে তার আসা বন্ধ। সপ্তায় সপ্তায় এক বাড়তি খরচ!
সকাল থেকে বাবা কারাগারের দরজায় দাড়িয়ে আছে। গল্পের শেষটা সে জানতে চায়। আর সোলেমান চাচাও এমন, তার গর্দান নেয়া হবে শুনে মুখে কুলুপ এটে বসে আছে।
তাহলে তো সমস্যা, তোর বাবা না পাগল হয়ে যায় শেষমেষ।
হু, তাইতো ভাবছি।
কিছুএকটা করা দরকার, কী বলিস? হঠাৎ বিলু বলে।
ক্যান?
না মানে, গল্পের শেষ জানাটা তো জরুরী।
কোনটার? আমাদের যেটা বলতেন?
ধুর, সেটা কি আমি শুনেছি। আমি যেটা শুনেছি সেটার শেষও তো জানতে পারলাম না। বিলু মনমরা হয়ে বলে।
চিন্তার বিষয়!
তারপর রাজকুমার বিলু, কালু আর দাঁতছাড়া গিলু ভাবতে বসলো কী করা যায়। ভাবতে ভাবতে মাথায় একশ একটা বুদ্ধি এল। একটা রেখে বাকী একশটাই গিলু ওর শুর নেড়ে উড়িয়ে দিল।
সেই বুদ্ধিমত কাজ করতে প্রস্তুত হয়ে নিল বিলু, কালু আর গিলু।
*****
পরদিন সকালে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, রাজকারাগারের এক দঙ্গল পাইকপেয়াদা রাতের গভীরে পালিয়েছে, পালিয়েছে একদঙ্গল বন্দী, পালিয়েছে রাজদরবারের দাস-দাসী,কর্মচারী আরেক দঙ্গল। এরা সবাই সোলেমানের গল্প শুনিয়ে। আর তাদের সাথে পালিয়েছে জল্লাদ সোলেমান, জল্লাদগিরির কুড়ালটা ফেলে।
আরও জানা গেল সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না সহিসের ছেলে কালুকে, আর দুইবছরের দাঁতছাড়া গিলুকে আর রাজকুমার বিলুকে।
রাজপুরীতে শোকের মাতম উঠলো। কান্নাকাটি করলো সোলেমানের আরও যত শুনিয়ে ছিল তারা, যারা পালাতে পারে নাই কিংবা ব্যাপারটা মাথায় আসে নাই যাদের।
ওদিকে রানীমা পুত্র বিলুর জন্য সকাল থেকে তারস্বরে চেচাচ্ছে, সেই চেচানিতে রাজা আর মন্ত্রী দুজনারই মাথা ধরে গেল। রাজা ক্ষেপে গিয়ে যাকে সামনে পাচ্ছে তাকেই গর্দান নিয়ে নেয়ার হুকুম দিচ্ছে, কিন্তু জল্লাদ না থাকায় ব্যাপারটা নিয়ে কেউ ভাবছে না।
বিশাল সৈন্যসামন্ত নিয়ে রাজা তখন নিজেই বের হলেন পুত্রের সন্ধানে।
রাজপুরীতে নি:স্তবদ্ধতা নেমে এল। নেমে এল অন্ধকার।
ঠিক এইক্ষণটিরই অপেক্ষা করছিলেন একজন বহুদিন ধরে।
কনকপুরের রাজপুরীতে এসে থামলো এক ঘোড়ার গাড়ি, জেল্লা ভারী, মিশমিশে কালো দুই তাগড়াই ঘোড়া সমেত।
নামল এক থুত্থুরে বুড়ো, হাতে একটা চারপেয়ে লাঠি।
****
এত দেরি করলি ক্যান?
রাজকুমার ছুটতে ছুটতে কালুকে প্রশ্ন করে।
এই…এই গিলুটার জন্যই তো, কোন টাইমটেব্যল নাই। এত গুরুত্বপূর্ন অভিযান, আর কিনা …
আর কি?
পায়ের নখ নাকি বড় হয়ে গেছে সেটা কেটে দিতে বলল।
ও কি আসলেই বলে?
বলেই তো, সবাই ব্যাপারটা ধরতে পারে না এই যা!
আর তুইও দিলি? বুঝাতে পারলি না।
এমন ছিচকাদুনে কি বলবো, না দিয়ে উপায় ছিল না।
বিলুরা যখন কারাগারের কাছে পৌঁছলো তখন সেটা খা খা করছে। পাইক পেয়াদা কয়েদী কেউ নেই।
গেল কই?
ওরা ভিতরে গিয়ে দেখে একজন মাত্র শিকল পড়া বন্দী এখনও আছে।
দাও খুলে দাও, সাত রাজার ধনের খবর দেব!
বন্দী লোভ দেখায়। শেকলের চাবিটা পড়ে আছে খানিক দূরেই, ওরা চাইলেই খুলে দিতে পারে। কিন্তু ওরা ভ্রুক্ষেপ করলো না।
দাও না সোনার ছেলেরা, বেঙ্গমা বেঙ্গমী’র সোনার পালক দেব…
তাতেও কাজ হয় না, ওরা বেড়িয়ে পড়ে।
-এখানে আর কিছু নেই। সবাই পালিয়েছে।
খুলে দে এক্ষুনি, নইলে দুটোকে ধরে এমন আচ্ছামত প্যাদাবো যে সারাজীবন মনে রাখবি, কোটর থেকে চোখ তুলে নেব, মাথার চুল কামিয়ে গোবর লেপে দেব আরো অনেক কিছু করবো যেগুলো খুব ভয়ংকর বলে দিচ্ছি!! পেছন থেকে চ্যাচাতে থাকে বন্দী।
তাই শুনে বিলু আর কালু কাঁপতে কাঁপতে এসে চাবি দিয়ে বন্দীকে শিকল খুলে দিল।
বন্দী ছাড়া পেয়ে ঝটকা মেরে দাঁড়াল,
এখন কেমন? পালি না তো, সাত রাজার ধন আর বেঙ্গমা বেঙ্গমীর পালক, আগের বার খুললে ঠিকই তো বড়লোক হতে পারতি খুব!
-তারচেয়ে বলো সোলেমান চাচা কই গেছে? বিলু বলে উঠে।
হারামীটাকে তো আমারো দরকার। লাস্ট দুই পর্ব এখনো বাকী। পেলে হয় একবার। পেদিয়ে দুইপর্ব আদায় করবো। মনে হয় বনের দিকে গেছে। ওদিকে গিয়ে দেখতে পারিস!
কারাগারের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল এক ঘোড়ার গাড়ি, বাহারী ভারী। কালু এটা জোগাড় করে রেখেছিল আস্তাবল থেকে। পাইক পেয়াদাদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, তাদের সবাইকে মেরে এটাতে চেপেই সোলেমান চাচাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে এই ছিল ওদের ফন্দি। কিন্তু হতাশার ব্যাপার হল, ওরা আসবার আগেই পাইক পেয়াদা সব পালিয়েছে এবং সোলেমানকেও সাথে করে নিয়ে নিয়ে গেছে।
অত:পর আর কী করা, ওরাও বনের দিকে ঘোড়ার গাড়ি সমেত ছুট লাগালো। বন্দীও চলল ওদের সাথে। বন্দীর মনে কী ফন্দি কে জানে, কিন্তু ওকে না নিয়েও বিলুদের উপায় নেই।
একরাশ ধুলো উড়িয়ে মাটির রাস্তা ধরে ঘোড়ার গাড়ি ছুটে চলছে বনের দিকে, আকাশে মস্ত চাঁদ উঠেছে। গাড়ির লাগাম ধরে বন্দী আনন্দে গেয়ে উঠলো-
♪ বহুদিন পর গাইছি আমি গান,
শুনিস তোরা নইলে কাটবো কান,
আজকে ফেলছি বনের বাতাসে দম
ফ্রিদম! ফ্রিদম! ♫
বন্দীর ঘরঘরে গলায় গান শুনে ওরা শিউরে উঠলো। কিন্তু আনন্দ বড় সংক্রামক, ওদেরও হঠাৎ মনে হল এতদিন ওরা বন্দী ছিল, আজ ছাড়া পেয়েছে।
ওরাও তাই খানিক পরে গলা মেলাল-
আজকে ফেলছি বনের বাতাসে দম
ফ্রিদম! ফ্রিদম! ♪
(চলবে)
জল্লাদের সাথে কেন জানি আপনার মিল পাচ্ছি! প্রতিটা পর্বের পর দম বন্ধ করে বসে থাকতে হচ্ছে পরেরটার জন্য!! কি বিপদ! :babymonkey:
হে হে
পড়ার জন্য থ্যাংকু 😀
আরো পড়বো………
খুব ভালো হচ্ছে…… 😀
থ্যাংকু ভাইয়া 🙂
পরের পর্ব চাই । 🙂
ধন্যবাদ আপু, দিব শীঘ্রই 🙂
জল্লাদ এর গল্পের মত! 😀
পরের পর্বও চাই দ্রুত
এমনি যেন চলতে থাকে 😀
অনেক ধন্যবাদ বোহেমিয়ান ভাই 😀
অনেক মজা পাচ্ছি ভাইয়া।পিচ্চিবেলায় সবাইকে গল্প বলার জন্য কত্তো ডিস্টার্ব করতাম। এখন ভাগ্নী গল্প শুনতে চাইলে লিঙ্ক ধরিয়ে দেই 8)
পরের পর্বগুলোর জন্য অপেক্ষায় রইলাম।
থ্যাংকু আপু, লিংক ধরানো ঠিক না, ভাগ্নীরে পাঠ কইরা শুনাইবেন 😀
এক্সাম বইলা পুরাপুরি বসতে পারতেছি না আপু, দেয়া মাত্রই আপনেরে ফেসবুকে নক করবো, আর আপনার ভাগ্নীর জন্য অনেক অনেক শুভকামনা 🙂
পাঠ করে শুনানোর মতো ধৈর্য্য নাই 🙁 অক্ষর চেনার আগপর্যন্ত কিছু রিডিং পড়ে শুনাইসিলাম।
ভাগ্নীকে পড়তে দিয়েছিলাম। গোগ্রাসে গিলেছে দুই পর্বই। :happy:
পড়ার পর তার প্রতিক্রিয়াঃ খুব মজা লাগছিলো, কিন্তু মাত্র দুই পর্ব! 🙁
ধন্যবাদ ভাইয়া 🙂
বলেন কী 🙁 , দাঁড়ান কালকেই বসতেছি, পরীক্ষা হইছে তো কী হইছে
আগেই পড়েছি, অভ্র ছিলো না বলে মন্তব্য করা হয়নি……… পরের পর্বের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায়…………… :happy: :happy:
ধন্যবাদ, পাবেন শীঘ্রই 🙂
পরের পর্ব দ্রুত চাই!!!! 😀
আপনিই কি সোলেমান নাকি? 😀
এই পর্বটা পড়া হয় নাই আগে। একের পরে তিন পড়তে গিয়ে এই জন্যই বুঝতেছিলাম না কিছু। 🙁