তোমরা যারা এবার ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছ…

# সেঁজুতি বিশ্বাস। বাবামায়ের আদরের সন্তান। তাকে নিয়ে অনেক আশা তার বাবামায়ের। ছোটবেলা থেকেই স্কুল-কলেজের ফলাফল ভালো করে আসছে। তাই এই আশাটা আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেছে যেন। ভর্তি পরীক্ষা সামনেই। ভালো একটা জায়গায় পড়ার সুযোগ পাবে সেঁজুতি এমনটাই সবার বিশ্বাস। তাই কোনভাবেই যেন সুযোগ হাত ফসকে বেরিয়ে না যায় তাই সারাক্ষণ সেঁজুতির মা-বাবা তাকে পড়াশুনার উপরে রাখেন। সেঁজুতি পারবে তো এই বাড়তি চাপ সহ্য করে বাবা-মা কে কাঙ্ক্ষিত ফল এনে দিতে?

 

# মারুফ হোসেন। এবার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। স্কুল কলেজের ফলাফল যে আহামরি ভালো তা না। কয়দিন পর ভর্তি পরীক্ষা। বন্ধুদের সাথে পড়াশুনার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করতে গিয়ে সে দেখতে পেলো বন্ধুরা অনেকেই অনেক এগিয়ে গিয়েছে। কিন্তু সে হিসেবে সে নিজে এখনও অনেক পেছনে। হাতে মাসখানেক সময় আছে কিন্তু তারপর ও সে ভরসা পাচ্ছে না। একটা অজানা ভয় কাজ করছে মনের মধ্যে। সে ধরেই নিয়েছে যে সরকারি ভাবে ভালো কোথাও পড়ার সুযোগ সে পাবেনা। আসলেই কি তাই?

 

# অনন্ত চৌধুরী। সেও এবারের ভর্তি পরীক্ষার্থী। বাবা পেশায় ডাক্তার। তিনি চান তার ছেলেও ডাক্তার হোক। কিন্তু অনন্ত চায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান পড়তে। এদিকে বাবার কথাও ফেলতে পারছে না সে। বাবা একেবারে কঠিন ভাবে বলে দিয়েছেন যে অনন্ত কে ডাক্তারই হতে হবে। তাই নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেয় সে। যে বিষয়গুলো এতদিন কেবল দায়সারা করে পড়ে এসেছে সেই বিষয়গুলোই একেবারে ভালো মত করে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পড়তে হচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে বটে কিন্তু বাবার ইচ্ছা। কী হচ্ছে এতে করে?

 

এই প্রশ্নগুলো বর্তমানে ভর্তি পরীক্ষা দেবে এরকম প্রায় সব শিক্ষার্থীর জন্য সত্যি। তাহলে একটু উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি।

 

সেঁজুতির বাবা-মা চান সেঁজুতি যেন কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে। তাই দিন রাত তার উপরে একটা বাড়তি চাপ দিচ্ছেন তারা। হয়ত তারা ধরে নিচ্ছেন যে, এর ফলে সেঁজুতির পড়াশোনার উন্নতি হবে বা তার পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি ভালো হবে। কিন্তু আসলে কি এই বাড়তি চাপ দেয়াটা ঠিক হচ্ছে? মানুষের মস্তিষ্ক যেমন ভাবে তৈরি তাতে করে যত চাপ দেয়া হবে ততই মস্তিস্ক আরও বেশি অস্থির হয়ে উঠবে। আর ভর্তি পরীক্ষার পূর্বের সময়টাতে ছেলে-মেয়েদের মাথায় এমনিতেই চিন্তাটা বেশি থাকে। এসময় আরও বেশি চাপ দেয়া হলে অনেকের জন্যই সেটা হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়। “তোমাকে যেভাবেই হোক পারতেই হবে” এই চিন্তাটা থেকে সরে এসে ‘তুমিও পারবে। চেষ্টা করে যাও’ এরকম করে যদি বোঝান যায় তাহলে হয়ত বিষয়টা আরও একটু কার্যকর হয়।

 

মারুফের ক্ষেত্রে যেটা ঘটেছে সেটা হল আত্মবিশ্বাসের অভাব। এতদিন ধরে সে যেহেতু আহামরি ভালো করতে পারেনি তাই সে ধরে নিয়েছে আসলে সে কোথাও পড়ার সুযোগ পাবেনা। এমনটা হওয়ার পেছনে অনেক সময় কোচিং সেন্টার বা বন্ধুমহল দায়ী থাকে। কোচিং সেন্টার গুলো প্রথমেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা ভাবনা ছড়িয়ে দেয় যে, কোচিং এর পরীক্ষা গুলোতে ভালো না করলে আসল পরীক্ষাতেও ভালো করা যায় না। আর বন্ধুমহলের যারা একটু ভালো করছে তারা এই ধারণা কে সত্য ধরে নিয়ে যারা খারাপ করছে তাদের সাথে অদৃশ্য এক মানসিক প্রতিযোগিতায় লেগে যায়। বিষয়টা একদিকে যেমন কিছুটা পেছনের দিকের ছেলে-মেয়েদের জন্য হতাশার সৃষ্টি করে অন্যদিকে এতে করে যারা ভালো করে তারা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে যায়। এর প্রভাব কোনোদিক দিয়েই ভালো নয়। এমনকি অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস এর কারণে অনেকে দুর্ভাগ্যবশত ভালো করতে না পারলে ভেঙে পড়ে।

 

অনন্তের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরেকটু জটিল। ছেলে-মেয়েদের উপরে একটা নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার কারণেও অনেকেই ঝরে পড়ছে। কার কোন বিষয়ে আগ্রহ সেটা বিবেচনা না করে কেবল নিজেদের যেটা সঠিক মনে হয় সেটা ছেলে-মেয়েদের উপর চাপিয়ে দিলে দেখা যায় সেক্ষেত্রে পড়াশোনাটা আনন্দের না হয়ে দায়বদ্ধতার ব্যাপার হয়ে যায়। এর ফলে ভর্তি পরীক্ষার আগেই অনেকে হতাশ হয়ে পড়ে। সেটা অবশ্যই কারো কাম্য নয়।

 

এই তিনটি ক্ষেত্রের বাইরের যেসব বিষয় আছে সেগুলো মূলত কৌশলগত। কেউ অনেক বেশি পড়েও হয়ত বেশি ভালো করতে পারছে না আবার কেউ তেমন একটা পড়াশোনা না করেও অনেক ভালো করছে। এর পেছনে যে কারণটা মুখ্য সেটা হচ্ছে কে কোন কৌশল প্রয়োগ করছে পড়াশোনার জন্য। মূলত সমস্যা গুলো এরকম হয়ঃ-

  • সবাই বইয়ের বিষয়গুলো ভালো মত পড়ে না। অনেক কিছুই বাদ দিয়ে যায় বা দরকারি মনে করে না। এতে করে যে সমস্যাটা হয় সেটা হল অপূর্ণতা। দেখা যাচ্ছে যে কোন বিষয় পরীক্ষার জন্য হয়ত এতটা জরুরী না কিন্তু সেটা না জানা থাকলে বাকি আরও অনেকগুলো বিষয়ের জ্ঞান অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
  • কেউ যদি মোটামুটি সব বিষয়গুলো পড়েও তারপর ও দেখা যায় যে অনেক কিছু সম্পর্কেই ধারণাটা স্বচ্ছ না। কিছু কথা হয়ত আবছা ভাবে বুঝেছে বা কিছুই বোঝেনি।
  • আরেকটা বড় সমস্যা হচ্ছে সব কিছুকেই ধরাবাঁধা কিছু সূত্রের বা নিয়মের মাঝে নিয়ে আসার প্রবণতা। এতে করে চিন্তার ক্ষেত্রটা সংকুচিত হয়ে যায়। ফলে ভর্তি পরীক্ষায় যখন সেই ক্ষেত্রের বাইরের প্রশ্ন আসে তখন অনেকেই আর উত্তর করতে পারে না।

 

কেবল সমস্যা নিয়ে আলোচনা করলে আসলে অর্থহীন হয়ে যায় সব। আর ভর্তি পরীক্ষার এইসব সমস্যা গুলোর সমাধান বেশি জটিল না। সমাধানগুলোর ধরন এই রকমঃ-

  • প্রথমেই নিজেকে মানসিক ভাবে তৈরি করতে হবে। নিজেকে এই বিশ্বাস দিতে হবে যে তোমার দ্বারা সব কিছুই সম্ভব।
  • কি লক্ষ্য নিয়ে এগুতে চাও সেটা ঠিক করে নিতে হবে। এই অংশটা বেশ জরুরী। কারণ তোমার পরবর্তী পুরো জীবনটা কেমন হবে সেটা নির্ভর করবে এই সিদ্ধান্তের উপর। আর যদি এক্ষেত্রে তোমাকে অনন্তের মত সমস্যায় পড়তে হয় তাহলে বাবা মা কে বোঝানর চেষ্টা কর তুমি যেটা চাও সেটা কেন চাও। ভালো মত বোঝাতে পারলে তারা অবশ্যই বুঝবেন।
  • ভুলে যাও যে ভর্তি পরীক্ষা একটা প্রতিযোগিতা। এটাকে একটা সাধারণ পরীক্ষার মতই চিন্তা কর। তাহলে মানসিক ভাবে কিছুটা বল পাবে।
  • এরপরের কাজগুলো কৌশলগত। নিজের বইগুলোর যেসব বিষয় তুমি বাদ দিয়েছিলে সেগুলো আগে ভালো মত বুঝে নেয়ার চেষ্টা কর। বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা জরুরী।
  • পুরো বই এর সব অধ্যায় গুলো একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা নিয়ে ভাগ করে ফেল কবে কী পড়বে। এক্ষেত্রে বৈচিত্র্য রাখা জরুরী। একদিন কেবল একটা বিষয় পড়তে থাকলে সেটা তুলনামূলক কম স্থায়ী হয়।
  • প্রতিদিনের পড়া নিয়মমতো পড়তে হবে। একটা নির্দিষ্ট রুটিন মেনে চললে সবচাইতে ভালো হয়। আর কোন বিশেষ কারণে যদি কোনদিন কম পড় তাহলে পরের দিন সেটা পুষিয়ে নেয়া ভালো।
  • ধারাবাহিকতা রাখা খুবই জরুরী। প্রথম থেকে কিছুদিন অনেক বেশি পড়ে তারপর হাল ছেড়ে দেয়ার ঘটনা সবচাইতে বেশি ঘটে। তাই চেষ্টা করবে একদম শেষ পর্যন্ত পড়াশোনার ধারাবাহিকতাটা বজায় রাখতে।
  • যে প্রতিষ্ঠানে পড়ার ইচ্ছা সেখানকার বিগত কিছু বছরের প্রশ্ন দেখবে, এতে একটা ধারণা জন্মাবে যে কেমন প্রশ্নে পরীক্ষা দিতে হবে তোমাকে।
  • প্রতিদিনই নিজে নিজে একটা পরীক্ষা দাও। পারলে নিজেই প্রশ্ন করে উত্তর করার চেষ্টা কর। কারণ পরীক্ষা দেয়ার অভ্যাস থাকলে পরবর্তীতে আসল পরীক্ষাতে গিয়ে তোমাদের সুবিধা হবে।

 

ভর্তি পরীক্ষা তোমাদের জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাগুলোর একটি। সবাই এই ধাপটা খুব ভালো ভাবে পার কর। সবার জন্য অনেক অনেক শুভকামনা। আমরা জানি তোমরাই পারবে বিজয়ী হতে। দেখা হবে তোমাদের সাথে সূর্যোদয়ের সময়ে। সবাই ভালো থাকো, সুস্থ থাকো।

তিষা সম্পর্কে

সবসময় ই কাউকে না কাউকে শুরু করতে হয়। আমি শুরু করতে চাই। সবার চেয়ে একটু ভিন্নভাবে চিন্তা করতে পছন্দ করি। পড়ছি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এর পুরকৌশল বিভাগে।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে অনুপ্রেরণা, ইতিবাচক, টিউটোরিয়াল, সচেতনতা-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

5 Responses to তোমরা যারা এবার ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছ…

  1. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    থাম্বস আপ। পিচ্চিদের কাজে লাগুক

  2. সামিরা বলেছেনঃ

    ব্যাপক বড়াপু-বড়াপু ভাব! 😀
    ভাল লাগছে। যাদের জন্য লেখা তাদেরও ভাল লাগবে আশা করি। 🙂

  3. মোহাইমিনুল বলেছেনঃ

    http://www.somewhereinblog.net/blog/greatsabuj007/29613728
    এ লেখাটি ছোট ভাই বোনেরা দেখতে পারে
    কাজে লাগবে আশা করি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।