গেরিলা শব্দটির শাব্দিক অর্থ খুঁজে পেতে ফিরে যেতে হয় নেপোলিয়নের সময়ে। ফ্রান্সের ‘ট্রি কল্যারে’ লাগিয়ে বিশ্ব জয়ের মোহে অদম্য গতিতে এগিয়ে অপরাজেয় নেপোলিয়ন বাহিনী। কিন্তু পেনিনসুল্যার যুদ্ধে হঠাত থমকে দাঁড়াতে হয় তার সেই বিখ্যাত বাহিনীকে। হঠাত ভিন্নধর্মী এক রণকৌশলে বিপর্যস্ত নেপোলিয়ন বাহিনী। হালকা অস্ত্রে সজ্জিত স্প্যানিশ বাহিনীর কাছে একে একে পরাভূত হতে থাকে নেপোলিয়নের ভারী অস্ত্রে সজ্জিত এক একটি ফরমেশান। পরেরটুকু শুধুই ইতিহাস। দীর্ঘ স্থায়ী এই যুদ্ধ হয়ে দাঁড়ায় নেপোলিয়নের পতনের কারণ এবং স্প্যানিশ শব্দ ‘গেরিলা’ বা ‘ছোট যুদ্ধ’ হয়ে পড়ে অপশক্তির বিরুদ্ধে মুক্তিকামী মানুষের সশস্ত্র প্রতিরোধের একমাত্র কণ্ঠস্বর।
“দিন তোমাদের, রাত আমাদের
রৌদ্র তোমাদের, বৃষ্টি আমাদের
শহর তোমাদের, গ্রাম আমাদের।”
– গেরিলাদের কার্যপরিধি এভাবেই ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন চীনের বিপ্লবী নেতা মাও সে তুং। আমরা জানি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পৃথিবীর সংঘটিত অন্যতম একটি সফল গণযুদ্ধ। এই সফল সংগ্রামের মূল ক্রীয়ানক ছিল আমাদের গেরিলা যোদ্ধারা যারা উঠে এসেছিল সমাজের প্রান্তবর্তীত অবস্থান থেকে। মূলত মে-জুন-জুলাই এই তিন মাসে প্রশিক্ষণের পর দেশে প্রবেশ করে হাজারো প্রশিক্ষিত গেরিলা যাদের মূল লক্ষ্য ছিল হিট-এন্ড-রান পদ্ধতিতে পাকিস্তান বাহিনীকে নিয়মিত আক্রমণের মাধ্যমে বিপর্যস্ত রাখা। প্রাথমিক অবস্থায় প্রতি দশ জনের একটি দলকে দেওয়া হত মাত্র তিনটি স্টেনগান (ক্লোজ কোয়ার্টার ব্যাটেলের জন্য যা সবচেয়ে কার্যকরী), একটি বা দু’টি এসএলআর এবং নিরাপত্তার স্বার্থে সবাইকে দু’টি করে গ্রেনেড। যদিও দল এবং স্থানভেদে এই অস্ত্রের পরিবর্তন হতো প্রচুর। যেমন ঢাকায় প্রথম দিকে আসা দলটির সাথে ছিল না কোন হালকা মেশিনগান বা দুই ইঞ্চি মর্টার, কিন্তু সীমান্তবর্তী সব দলে এগুলো স্ট্যান্ডার্ড ইস্যু ছিল।
দেশে ফিরেই এই গেরিলারা পাকিস্তানী বাহিনীর মত সুপ্রশিক্ষিত বাহিনীর উপর একের পর আক্রমণে তাদের মনোবল ভেঙ্গে ফেলে পুরোপুরিই। পাকিস্তানী ব্রিগেডিয়ার জেড.এ.খান লিখেছেন, “জুন-জুলাই এর পর থেকে কোন পাকিস্তানী অফিসার খোদ ঢাকা শহরেই দিনে বের হতে ভয় পেত এবং বের হলেও সাথে অন্তত চারজন সশস্ত্র প্রহরী রাখতো। আর রাতে ক্যান্টনমেন্টের নিরাপদ আবাস ছেড়ে বের হবার কথা তারা কল্পনা করতেই পারতো না।”
একই তথ্য সমর্থন করে মিত্রবাহিনীর জেনারেল জ্যাকব বলেন,”‘আমি অবশ্যই আপনাকে বলতে চাই যে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ছিল সুপ্রশিক্ষিত, আধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত . . . তাদেরকে পরাজিত করা ছিল খুবই দূরুহ। কিন্তু মুক্তি ফৌজ তাদের ওপর আক্রমণ করে এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিলো যে তারা চলাফেরা করতে ভয় পেত. . . এই পরিস্থিতির কারণেই পাকিস্তান পরাজিত হয়েছিলো।”
এই হিট-এন্ড-রান পদ্ধতি এতটাই কার্যকর ছিল যে প্রতি রাতে ঢাকার বাতাসে বারুদের গন্ধ না পেলে শহরবাসীর যেন নির্ঘুম রাত কাটাতে হতো। পরবর্তীতে নভেম্বরের শেষ দিক থেকে যখন যৌথবাহিনীর অগ্রযাত্রা শুরু
হয় তখন এই গেরিলারা নিজেদের রণকৌশল পালটে তাদের হাইড-আউট থেকে বেরিয়ে আসে সম্মুখ
সমরের যোদ্ধা হিসেবে। যৌথবাহিনীর অগ্রযাত্রার স্পীয়ার-হেড ছিল মূলত তারা। একটি সফল সংগ্রামের সফল যোদ্ধা ছিল আমাদের গেরিলারা। কিন্তু দুঃখজনক হল আমাদের ইতিহাসে জনযোদ্ধা বা গেরিলাদের অবস্থান মূল্যায়ন হয়নি সঠিকভাবে। ‘কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র জনতা একযোগে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন’ – শুধুমাত্র এই লাইনটুকুর মাধ্যমেই তাদের ঠাঁই হয়েছে ইতিহাস বইতে। আজ তাই আমাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ বা গেরিলা বলতেই মনের পর্দায় ভেসে ওঠে একাধিক তারকা খচিত সমর নায়কদের প্রতিচ্ছবি। যথারীতি সেই ৯৯% এবং ১% এর হিসেব এখানেও। বলা হয়, “Truth shall prevail”, অর্থাৎ সত্য উন্মোচিত হবে সর্বদা। আমরা পরিনি হয়তো গবেষণার মাধ্যমেই আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম সেই গণযোদ্ধাদের ইতিহাসে আস্তা কুঁড়ে থেকে তুলে এনে ঠিকই বসাবে দেবতুল্য স্থানে।
‘কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র জনতা একযোগে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন’ – শুধুমাত্র এই লাইনটুকুর মাধ্যমেই তাদের ঠাঁই হয়েছে ইতিহাস বইতে।
একমত। এভাবেই আমাদের মুভিগুলাতেও দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধ যথাযথভাবে আসে নি। আমি মুক্তিযোদ্ধা লেখক কর্নেল সাজ্জাদ আংকলকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আমাদের মুভিগুলা কি মুক্তিযুদ্ধ তুলে আনতে পেরেছে? তিনি বলেন একদমই না!
থাম্বস আপ 😀
ধন্যবাদ। 🙂
আমি অপেক্ষায় থাকি, কখন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকারের ইতিহাস মানুষ জানতে পারবে। সত্যিকারের বীরদের মূল্যায়ন হবে।
অপেক্ষাটা বড় দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে……
হুম। দীর্ঘ হচ্ছে বটে।
কিন্তু বাংলা যত মুভিতে মুক্তিযোদ্দাদের নিয়ে করা হয়েছে সব গুলোতেই কিন্তু গেরিলা দের কেই দেখানো হয়েছে।
ধন্যবাদ। এটি অবশ্য সত্য। কিন্তু আমি বোঝাতে চেয়েছে ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ হয়নি তাদের অবদান সেভাবে। একাত্তরের দিনগুলি, গেরিলা, আগুনের পরশমনি এধরণের বই এবং চলচ্চিত্র থেকে একটি নির্দিষ্ট গ্রুপ অফ পিপলের বীরত্বের কথা জানা যায়, কিন্তু সমগ্র দেশব্যাপী এধরণের যে আরো শতাধিক দল ছিল এবং এই দলগুলো যে পাকিস্তানীদের সদা তটস্থ করে রেখেছিল এই ব্যাপারে জানা যায় না কিছুই।
ইশ! লেখার পর চেক না করায় এই অবস্থা হয় 🙁
*মুক্তিযোদ্ধা
ও আমি বুঝে নিয়েছি। 🙂