বহুদিনের অযত্নে আর রোদ-বৃষ্টিতে ফেটে চৌচির হয়ে থাকা পিচটার বাইশগজে কয়েকবার পায়চারি করে একসময় বসে পড়ে ও। তেজ প্রকাশের জন্য সূর্য যেন বছরের এসময়টাকেই বেছে নিয়েছে। প্রচণ্ড উত্তাপে গা বেয়ে ঘামের ফোয়ারা নেমে যায়। তারই মধ্যে অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে স্ট্যাম্পের গর্ত, গার্ড নেয়ার দাগগুলো দেখে আর কিছু একটা যেন খুঁজে ফেরে; কিন্তু পায় না।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
ছেলেটার নাম রুদ্র। বয়সের হিসেবে যুবকই বলা চলে। ত্রিশ ছুঁইছুঁই যুবক। চেহারায় অভিব্যক্তি বোঝা দায়। বহুদিনে অর্জিত কাঠিন্য যেন ছড়িয়ে আছে সমস্ত মুখাবয়বে। কিন্তু ভারীপাওয়ারের গ্লাসগুলোকে পেরিয়ে যেতে পারলে সেখানে হয়তো একজোড়া স্মৃতিকাতর চোখের দেখাও মিলতো। জনমানবশূন্য পরিত্যক্ত জনপদের মাঝখানে কালের সাক্ষী হয়ে টিকে থাকা স্টেডিয়ামটার শেঁওলাধরা-ভাঙ্গা ভবনগুলো
পেরিয়ে মাঠের মাঝখানে এসে দাঁড়ায় ও। পিচটাকে ভালো করে পরখ শেষে একসময় উঠে দাঁড়ায়। তারপর পুরো মাঠের চারদিকে একনজর চোখ বুলিয়ে ফেরার পথ ধরে। ঘাসে-জঙ্গলে আড়াল হতে বসা রাস্তাটার সূক্ষ্মরেখা ধরে হাঁটতে থাকে আনমনেই।
হাঁটতে হাঁটতে অনেকখানি পথ পেরিয়ে এসে হটাৎ একটা চেনা গন্ধে থমকে দাঁড়ায় ছেলেটা। মাথার উপর নতুন মুকুলে ছেয়ে থাকা ঝাঁকড়ামাথা-আমগাছটার উপস্থিতি টের পায়। আর কিছুটা সামনে গেলেই শিউলীদের বাড়িটা পড়বে। ওদের সেই সাজানো বাড়ি, টিনের ঘর, উঠোনে শিউলীর সযত্নে গড়া ফুলবাগান- আরো কত কি? নাহ, সেসব কি আর এখন আছে?
সেই স্কুলের দিনগুলো। ব্যাটে-বলে স্কুলের ছোট্ট মাঠটাতে চার-ছক্কার বন্যা বইয়ে দেওয়া দিনগুলো। প্রতিটা চার-ছক্কার পরে শিউলীর মুগ্ধচোখের দিকে পলকে তাকিয়ে নেয়া কিংবা সিনিয়র ভাইয়াদেরকে হারিয়ে দিয়ে পুরোমাঠ জুড়ে ভিক্টোরীল্যাপ দেয়া। তারপর সেই যে, সে’বার জেলাশহরের নতুন তৈরি হওয়া এই স্টেডিয়ামটাতে ফ্রি-টিকেটে সাকিব-তামিমদের খেলা দেখা আর সেই সাথে মনের মাঝে ক্রিকেটার
হওয়ার সুপ্তবাসনার জন্ম নেওয়া।
কিন্তু সবকিছুকে এলোমেলো করে দিতেই বুঝিবা মাত্র কিছুদিনের ব্যবধানে সেই ভয়াল সিদ্ধান্তটা আসল। জনগণ, ক্রিকেটার এবং খেলোয়াড়দের সকল আপত্তি ডিঙ্গিয়ে শ্বাপদসংকুল পাকিস্তানে ঠেলে পাঠানো হলো সাকিব-তামিমদের। বলা হলো, ওরা ফিরে আসবে।
না, ওরা ফিরে আসেনি। ওরা কোনোদিনই ফিরবে না।
তারপর সেই নিয়ে কত আন্দোলন হলো, কত সংগ্রাম হলো, সরকার পতন হলো। অকাতরে প্রাণ দিলো, গুম হলো সামরিক-বেসামরিক মানুষেরা। আরো একবার মেধাশূন্য করা হলো জাতিকে। আর এই ফাঁকে ঠিকই বেরিয়ে এলো সেই পুরনো হায়েনারা। কায়েম হলো হায়েনার রাজত্ব।
বাঁচার তাগিদে নিজ দেশ ছেড়ে পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় খুঁজে নিতে চেয়েছে অসহায় মানুষ। কিন্তু বাঁচতে পেরেছে কি? না, তাদের অনেককেই জীবন দিতে হয়েছে কাঁটাতারের ফাঁদে। এভাবেই ক্রমেক্রমে জনশূন্য হয়েছে একেকটা জনপদ। আর এখন শহরগুলোতে নিজেদের রাজত্ব কায়েম করে জাঁকিয়ে বসে আছে হায়েনাদের উত্তরসূরীরা।
এখন এদেশে বিধর্মীদের বসবাস নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মেয়েদেরকে করা হয়েছে বোরকায় বন্দী। আর ‘হারামকাজ’ ঘোষণা দেয়া হয়েছে সকল ধরণের খেলাধূলা, গান-বাজনা, শিল্পকলাকে।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
রাস্তার উপর থেকে প্রজেক্ট এসিস্ট্যান্ট জিমি’র চিৎকারে হুঁশ ফিরে আসে। অন্যমনষ্ক হয়ে ভুলপথে চলে যাচ্ছিল। নিজের অসতর্কতায় বিব্রত হয় ও। দ্রুত পা চালিয়ে গিয়ে হেলিকপ্টারে নিজের সিটে বসে পড়ে। ইতিমধ্যে মিশনের বাকি সদস্যরাও চলে এসেছে। কিছুক্ষণ পরেই উড্ডয়নের ঘোষণা আসে। শেষবারের মতো জানালা দিয়ে বাইরের জনপদ, তার জন্ম জনপদটাকে দেখে নেয় আন্তর্জাতিক মানবতাবাদী সংগঠন
ইউএসডি’এর প্রজেক্ট সুপারভাইজর রুদ্র সারোয়ার। জনমানবহীন বিস্তীর্ণ অঞ্চলটার দিকে তাকিয়ে ক্ষণিকের জন্য নিজেকে ভাগ্যবানই মনে হয় ওর। কেননা, প্রবাসী বাবার সূত্রে তৎক্ষণাৎ বিদেশে চলে আসতে না পারলে তাকেও হয়তো আর দশজনের মতো করুণ পরিণতিই বরণ করতে হতো। কিন্তু পরক্ষণেই বুকের গভীরে কোথা থেকে যেন বিষাদ এসে জায়গা করে নেয়। হয়তো, সেই ভালো হতো। দেশে দেশে শান্তির বার্তা বয়ে
বেড়ানো কর্মকর্তা হয়ে জন্মভূমির এই অরাজকতা তো অন্তত দেখতে হতো না।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
অথচ কতদিন আগের কথাই বা হবে? বড়জোর বছর বিশেক। সময় কত দ্রুতই না সবকিছুকে বদলে দেয়। ব্যাট আর বলের লড়াইয়ে মুখর মাঠ, সমর্থকের হর্ষধ্বনিতে প্রাণবন্ত স্টেডিয়াম আজ মৃত। মৃত তরুণ-রুদ্রদের স্বপ্নগুলোও। ওরা আর কোনোদিন সাকিব হতে চাইবে না, আর কোনোদিন তামিম, মুশফিক, নাসির হয়ে মাঠ কাঁপাতে চাইবে না। ওরা আর কোনোদিন গর্বে বুক ফোলাবে না ক্রিকেটপাগল জাতি হিসেবে।
শুধু ওদের বিরহে পড়ে থাকবে নিঃসঙ্গ বাইশগজ, যতদিন না বেখেয়ালে বেড়ে ওঠা ঘাসে-শেঁওলায় ঢেকে যায় এর শেষ চিহ্নটুকুও……।।
–সুম
এমন দেশের দেখা যেন জীবনে পেতে না হয়, সেই প্রার্থনাই করি……
লিখা চমৎকার, শেষ লাইনটাও…… :dhisya:
আমিও সেই প্রার্থনাই করি।
ধন্যবাদ।
লেখার ধরন বেশ।
ধন্যবাদ, আপনার বেশ লেগেছে জেনে আমারো বেশ লাগলো।
আশা করি এমন যেন কোন দিন না দেখতে হয়।
আপনার আরও লেখা পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।
সুন্দর লেখা।
সামনে আরও কিছু লেখা পড়বার প্রত্যাশী হয়ে থাকলাম। 🙂