ছোট্টবেলার প্রেম আমার কালো মেম

১.
ছোট ছিলাম। বয়স তখন কতই বা হবে? বড়জোর এগার-বারো। অসম্ভব চঞ্চল একটি ছেলে। ভালো ছাত্র ছিলাম বলে টিচার থেকে শুরু করে সবার চোখের মধ্যমণি ছিলাম। স্কুলে অনেকটা দাপট ছিল, ক্লাসে অনেকটা পার্ট (!)ও নিতাম! তুমি ক্লাসে খুব শান্ত-শিষ্ট স্বভাবের একটি মেয়ে ছিলে। সবার সাথে বাক্য বিনিময় হলেও তোমার সাথে একবার মুচকি হাসি ছাড়া আর কিছুরই বিনিময় হয় নি। ‘অতি সাধারণ’ তুমিই কেন যেন ‘অসাধারণ’ হয়ে উঠলে আমার কাছে। আজো ভেবে পাই না, একপ্রকার “নারীবিদ্বেষী” বালকটির মনে কিভাবে কোন জাদুতে ছাপ ফেলেছিলে?

তারপর আমার স্কুলও কয়েকবার বদল হলো। অন্য শহরে পড়তে একদিন চলেও এলাম। মোবাইল যুগের প্রচলন ছিল না, টেলিফোন করাটাই যেখানে অনেকটা বিলাসিতা ছিল তখন। রোমান্টিক তো ছিলাম না কোনো কালেই, চিঠি লেখাটা তো প্রশ্নেই আসে না। হয়তো বা যোগাযোগ রক্ষা করা কিংবা কুশল জানার তাগিদেও একবার ইচ্ছেবোধটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। কিন্তু তোমার সঠিক ঠিকানাটা যে জানতাম না। জানি, শুধু অমুক নামের এক বিশাল এলাকাতে হাজার মানুষের ভিড়ে তুমি আছো, ইট-পাথরের নিষ্প্রাণ কোনো এক দালানটিতে ‘সাধারণ’ তুমি অসাধারণভাবেই প্রাণ সঞ্চার করে উজ্জীবিত রেখেছ। তোমার কোনো ছবিও ছিল না আমার কাছে। ভাবতাম, প্রতিদিন এত আধুনিক উন্নতমানের হরেক ক্যামেরা বের হয়, মনের ছবি তোলার জন্য কি বিজ্ঞানীরা কোনো ক্যামেরা বের করতে পারেন না?

জল অনেক গড়িয়ে গেল। একটা সময় তো আমার মনের দৃশ্যপট থেকে মুছেই যেতে গিয়েছিলে। হঠাৎ  অঞ্জন দত্তের “ম্যারিয়েন” গানটা শুনলাম-
“ছোট্টবেলার প্রেম আমার কালো মেম কোথায় গেলে হারিয়ে
ম্যারিয়েন, ম্যারি ম্যারিয়েন, ম্যারিয়েন মারি।”
ইস! কেন যে গানটা শুনতে গিয়েছিলাম! অঞ্জন দত্ত কি আমার জন্যই গানটা গেয়েছিল? না, আমি তো দেখি বন্ধুদের কাছে ধরা পড়ে যাচ্ছি। আমাকে আরো পাকা অভিনয় করতে হবে।

একদিন ছোট শহরের সেই কিশোরটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে ঢাকা চলে এলো। যানজট, দূষিত বাতাস, কৃত্রিমতা- ঢাকা শহর সম্পর্কে এই ছিল তার প্রথম মন্তব্য। দিনগুলো কোনোমতে কেটে যাচ্ছিল।

২.
মার্ক জুকারবার্গকে কোটি কোটি ধন্যবাদ তোমার সাথে মিলিয়ে দেওয়ার জন্য। কি আশ্চর্য! তুমি কিন্তু একটুও বদলাওনি। সেই ছোটকাল থেকে মনের দৃশ্যপটে তোমার যে ছবি এঁকেছিলাম, তাকেই যেন পেলাম। অনেক কথার পরে জানতে পারলাম, তুমি এখন ঢাকাতেই পড়াশুনা করছ। মুহুর্তেই কেন জানি ঢাকা শহরটা আমার কাছে রঙিন হয়ে উঠলো। ঢাকা শহরটা আসলেই খুব সুন্দর।

৩.
সময়টা খুব সুন্দর কাটছিল। শান্তশিষ্ট স্বল্পভাষী লাজুক ছেলেটি কেন জানি তোমার কাছ থেকেই “বাচাল” উপাধিটা পেল। তুমি ছিলে আশ্চর্য এক শ্রোতা। মনে পড়ে গেল এক ভাইয়ার কথা, “ভালো বক্তা অনেকেই হতে পারে, কিন্তু ভালো শ্রোতা হওয়া বড়ই কঠিন। ” তোমাকে না দেখলে আমি এই কথার প্রমাণ হাতেনাতে পেতাম না। আমাদের ছোট শহরটিতে কিন্তু যানজট ছিল না। আর ফার্মগেইট থেকে মহাখালী যেতেই যখন জ্যামে এক ঘন্টা লেগে যায়, তখন দেশের এবং রাজনীতিবিদদের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতাম। মাঝে মাঝে তুমি আর আমি যখন জ্যামে পড়তাম, তখন মনে হত যানজট জিনিসটা তো খারাপ না!  জটটা আজকে কেন জানি আশ্চর্যজনকভাবে খুব তাড়াতাড়ি খুলে গেল। আচ্ছা, ট্রাফিক আঙ্কেল এত নির্দয় কেন? ভাগ্যিস, আইনস্টাইন আঙ্কেল এখন জন্মগ্রহণ করেন নি। করলে আমিই বুঝিয়ে দিতাম ‘থিওরি অফ রিলেটিভিটি’ এর উদাহরণ কিভাবে দিতে হয়!

সুখ কপালে বেশিদিন সইল না। কাছে পেয়ে আবার হারালাম। আবারও নিজের দোষে। বিদেশের ভালো স্কলারশিপের লোভ সামলাতে না পেরে দেশত্যাগ করলাম।

টিচারের লেকচারে একদম যে মন বসাতে পারি না। কিছু একটা পাগলামি করতে ইচ্ছে করে। মাঝে মাঝে মনে হয়, এই যে পড়াশুনা, সম্মান, প্রতিষ্ঠা এর পিছনে দৌড়ানোটাই কি জীবন? সামান্য কিছুর জন্যে আমি কি সবকিছু বিসর্জন দেব?

৫.
অবশেষে বহু প্রতীক্ষিত ছুটিতে দেশে এলাম। ছুটিটা যেন আলোর বেগে কেটে গেল। ঈদের আগে তোমাকে ছেড়ে চলে আসতে অসম্ভব রকমের মন খারাপ লাগছিল। ভাবি, জীবনের কি নির্মম পরিহাস! যখন সেই ছোট্ট শহরটিতে কাছাকাছি ছিলাম, তখন একজন আরেকজনের হৃদয়ের হদিসই পেলাম না, আর যখন পেলাম, তখন আমরা দুজন কতদূরে!
নিজেকে প্রবোধ দেই। খুব বেশিদিন নয়, আবার সবকিছুই ঠিক হয়ে যাবে। একবার হারিয়ে আবার যখন কাছে পেয়েছি, তোমাকে যে করেই হোক শক্ত করে বেঁধে রাখব।

সারাজীবনের জন্য।

মাসরুর সম্পর্কে

অত্যন্ত সাধাসিধে একজন
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে বিবিধ-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

17 Responses to ছোট্টবেলার প্রেম আমার কালো মেম

  1. তোমাকে যে করেই হোক শক্ত করে বেঁধে রাখব…

    শুভকামনা তার জন্য! আর প্রথম প্রেম বুঝি সবসময়ই অন্যরকম হয়, না? 😐

  2. স্বপ্ন বিলাস বলেছেনঃ

    “খুব বেশিদিন নয়, আবার সবকিছুই ঠিক হয়ে যাবে। একবার হারিয়ে আবার যখন কাছে পেয়েছি, তোমাকে যে করেই হোক শক্ত করে বেঁধে রাখব।

    সারাজীবনের জন্য।”

    অসাধারণ!!! :clappinghands:

    শুভকামনা তোমাদের জন্য 🙂

  3. অরণ্য নীলিন বলেছেনঃ

    বেশ ভালো লাগলো, লেখা চালিয়ে যাও 🙂

  4. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    দুর্দান্ত লেখা! :fire:

    চমৎকার! রোমান্টিক স্বরে দেখি সরব জেগে উঠল!

  5. মাসরুর বলেছেনঃ

    ধন্যবাদ!
    রোমান্টিকতায় আগে থেকেই ভরপুর, খালি চান্সের অভাবটাই ছিল আর কি! 😆

  6. সাদামাটা বলেছেনঃ

    “তোমাকে যে করেই হোক শক্ত করে বেঁধে রাখব।
    সারাজীবনের জন্য।”
    আবেগটা ছুয়ে গেলো 🙂

    অফটপিকঃ “প্রতিদিন এত আধুনিক উন্নতমানের হরেক ক্যামেরা বের হয়, মনের ছবি তোলার জন্য কি বিজ্ঞানীরা কোনো ক্যামেরা বের করতে পারেন না?” — এমন ক্যামেরা আবিষ্কার হলে দুনিয়ায় আসল প্রেমিক-প্রেমিকার সংখ্যা অর্ধেক হয়ে যেত নিশ্চিতভাবে 😉 :p

  7. মাসরুর বলেছেনঃ

    ধৈর্য্য ধরে পড়ার জন্য এবং প্রশংসার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। 🙂

    হাহাহা… যৌক্তিক কথা অবশ্য। তবে এসব ক্যামেরা সবাইকে দেওয়া যাবে না। শর্ত প্রযোজ্য 😉

  8. শিশিরকণা বলেছেনঃ

    রোমান্টিক কথা এবং লিখা দুইটাই আমার খুব ভালো লাগে….এই লিখাটাও অসম্ভব ভালো লাগলো….
    “তোমাকে যে করেই হোক শক্ত করে বেঁধে রাখব।
    সারাজীবনের জন্য।”
    অসাধারণ অসাধারণ …. :beshikhushi:

  9. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    “তোমাকে যে করেই হোক শক্ত করে বেঁধে রাখব।
    সারাজীবনের জন্য।” এমনটাই যেন হয়, শুভকামনা রইলো। 🙂

    (জীবন থেকে নেয়া গল্প বলে মনে হচ্ছে। ভালোই লাগলো মধুর গল্পটা)

  10. ঠোঁটকাটা বলেছেনঃ

    ভাই আমি নতুন ব্লগ লেখার কোন অপশন খুঁজে পাচ্ছি না…………………। সাহায্য করুন।

  11. সামিরা বলেছেনঃ

    সরবে হার্টব্রেকের ইমো আছে আস্ত হার্টের ইমো নাই কেনু কেনু কেনু? :wallbash:

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।