পড়াশুনা নিয়ে কথা বলতে গেলেই লজ্জা লজ্জা করে। কারণ, আমি বিশাল ফাঁকিবাজ ছিলাম কিনা, এই জন্য মনে হয়, কি বলতে কি বলে ফেলাই! এ জন্য, মোটামুটি না বোঝা জিনিস গুলো নিয়ে কাউকে জ্ঞান দিতে যাই না! আজকে হঠাত ভাবলাম, ফিজিক্স সেকেন্ড পেপার বই এ একটা চ্যাপ্টার ছিলো “তড়িতপ্রবাহের চৌম্বক ক্রিয়া”, এই চ্যাপ্টারটা মোটামুটি একা পড়েছিলাম। পুরো বই এ এই চ্যাপ্টারটাই যা পছন্দের ছিলো।
এর আগেও এইচএসসি’র জেনেটিক্স চ্যাপ্টার আর ব্লাড গ্রুপ নিয়ে দু’টি লেখা লিখেছিলাম। মাঝে ভেক্টর নিয়ে লেখার ইচ্ছে থাকলে মেডিকেল নামের গারদখানা অবকাশ দেইনি আমায়! তো, ছোট্টো তবে অনেকে না বুঝেই পার পেয়ে যায় এমন একটা টপিক “হল ভোল্টেজ” নিয়ে লিখতে বসলাম আজকে। দেখি, কদ্দুর কি বলতে পারি! না পারলে, ভাইয়া-আপুদের মাইর তো আছেই!
এখন একটু দেখি, পাঠ্যবই এ হল ক্রিয়া কিংবা HALL EFFECT সম্পর্কে কি লেখা আছে!
হল ক্রিয়াঃ
কোন তড়িতবাহী পরিবাহককে চৌম্বকক্ষেত্রে স্থাপন করলে তড়িৎ প্রবাহ ও চৌম্বকক্ষেত্র উভয়ের সাথে লম্ব বরাবর একটি বিভব পার্থক্যের সৃষ্টি হয়, তথা ভোল্টেজ উতপন্ন হয়, এ ঘটনাকে হল ক্রিয়া বলে।
– ( উচ্চ মাধ্যমিক পদার্থবিজ্ঞান-২য় পত্র। ড. শাহজাহান তপন, মুহম্মদ আজীজ হাসান ও ড. রানা চৌধুরী)
এখন কিছু জিনিস বোঝার চেষ্টা করি। তড়িতপ্রবাহ বলতে আসলে ইলেকট্রনের পরিবহন বোঝায়, এটা সবাই জানো। কিন্তু, বহুদিন ধরে চলে আসা তড়িতপ্রবাহের দিককে অসম্মান না করে পরে বলা হয় যে, আচ্ছা ঠিক আছে, ইলেক্ট্রন যেদিকে যায়, তড়িতপ্রবাহ তার উল্টো দিকেই যায়! কী কাহিনীরে বাবা! পুরোই সাকিব খান আর মিশা সওদাগর!
এখন, মনে করো তোমার ছোটো চাচা তোমাকে পকেটে টাকা না থাকায় জন্মদিনে মুখ কাচুমাচু করে একটা ইয়েত্তো বড় চুম্বক দিয়েছে! সে তো আর জানেনা, তুমি খুশীতে আটখানা! এখন, এই চুম্বকটা তুমি যেখানেই রাখবে, সে তার চারদিকে একটা নির্দিষ্ট এলাকা পর্যন্ত প্রভাব রাখবে। অনেকটা এলাকার মাস্তানদের মতো, তাদের এলাকায় অন্য মাস্তান এলেই হালুয়া টাইট! এখানেও তাই, তার এলাকায় অন্য চুম্বক এলেই যদি মেরুতে মেরুতে মিলে যায়, তাইলে কষিয়ে লাথি মেরে পাঠিয়ে দেয়, আর বিপরীত মেরু (!!) হলে কাছে টেনে আদর সোহাগ করে বৈ কি!
বড় করে দেখতেঃ এখানে ক্লিকাও
তো, কাহিনী অন্য জায়গায়! এই চৌম্বক ক্ষেত্রের মাঝে যদি একটা আধান চুম্বককে নায়িকা ভেবে নায়কের মতো দৌড়ে আসে, তাহলে গতিশীল সেই আধান ও কিন্তু চৌম্বকক্ষেত্র দ্বারা প্রভাবিত হবে! তখন, পজিটিভ চার্জ ছুটে আসলে পজিটিভ প্রান্ত তাকে লাথি দিয়ে পাঠিয়ে দেবে, নেগেটিভ চার্জ (ইলেকট্রন) আসলে ভালোবেসে আপন করে নেবে!
আর সব কিছুর মতো চৌম্বক ক্ষেত্রের ও দিক আছে। প্রতিটা দিকে তার প্রভাব থাকবার কারণে, আমরা যে কোনো নির্দিষ্ট দিকে নির্দিষ্ট পরিমানের চৌম্বক বলটাকে দেখাতে পারি। হয়তো অনেকটা এরকম, বড়ভাইরা ভালো বলতে পারবেন।
বড় করে দেখতেঃ এখানে ক্লিকাও
মুলত ছবিটা এরকম –
এ কারণে যেটা হয় –
ধরো, তুমি তোমার নাক বরাবর ইলেক্ট্রন ছুড়ে দিলে। ডান কিংবা বাম (অর্থাৎ X অক্ষ বরাবর) দিক থেকে চৌম্বক বল এসে ওটাকে দিলো ধাক্কা! এখন কি নাক বরাবর যে ইলেক্ট্রনের যাওয়ার কথা ছিলো, নাক বরাবর যাবে? তুমি দৌড় দেয়ার সময় আমি তোমাকে ধাক্কা দিলে তুমি সোজা দৌড়াতে পারবে না বলেই আমার ধারণা। ইলেকট্রনও পারেনা, তখন কি হয়? তখন ইলেক্ট্রনটা তোমার মাথা কিংবা পা এর দিকে বল অনুভব করবে। এই যে চলার পথে বাধা পেয়ে আরেকদিকে বল অনুভব করছে, এটার নাম লরেঞ্জ বল। এখন দিক পাবো কিভাবে? এতো চিন্তার কিচ্ছু নাই, ফ্লেমিং কাক্কু আছে না!
কোনো এক অদ্ভুত কারণে, ফ্লেমিং কাক্কু অসাধারণ সব জিনিসপত্র দুই হাতের মাঝেই খুঁজে পেতেন! আর এ কারণেই আবিষ্কার হয়েছে ফ্লেমিং কাক্কুর বাম হস্ত কিংবা ডান হস্ত নীতির। এ ক্ষেত্রে আমরা বাম হস্ত নীতি কাজে লাগাবো।
এই ছবিটা একটু ভালো করে দেখো –
বড় করে দেখতেঃ এখানে ক্লিকাও
তোমার বাম হাতে যদি পাঁচটা আঙ্গুল থাকে (!!), তাহলে একেবারে মাঝের আঙ্গুলটাতে ধরো তড়িতপ্রবাহিত হচ্ছে! এরপর তর্জনীতে ধরো চৌম্বক বল ঢুকিয়ে দিলাম। এবার বুড়ো আঙ্গুল আর তর্জনী ও মধ্যমা গুলো যদি একে অপরের সাথে ছবির মতো ৯০ ডিগ্রী কোন করে ধরো, তাহলে তোমার বূড়ো আঙ্গুল যেদিকে মুখ করবে এটাই হবে লরেঞ্জ বল, অর্থাৎ ইলেক্ট্রন যেদিকে ধাক্কা অনুভব করেছিলো। একেবারে সহজ না? আমি এটা পড়বার সময় আঙ্গুলে দাগ দিয়ে এঁকে নিতাম, মজাই লাগতো!
এবার বোধ হয় আমরা হল ক্রিয়া সম্পর্কে পড়া শুরু করতে পারি। তাহলে এতোক্ষন কি করলাম? এতোক্ষন টিভিতে বিজ্ঞাপন দেখেছি, চলো এবার অনুষ্ঠান দেখি!
ধরো, তুমি একটা স্টীলের স্কেল কিনে এনেছো, যেটার পুরুত্ব একটু বেশী। এখন তুমি এর মধ্যে তড়িতপ্রবাহ চালানো শুরু করে দিলে। এখন যেহেতু আমার মতো তোমারও খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, তুমি করলে কি, ঠিক ৯০ ডিগ্রী করে চৌম্বক প্রবাহ পাঠালে, কিভাবে পাঠাবে? চোখ বন্ধ করে ধরে নাও তোমার একটা ম্যাগনেট গান আছে, যেটা দিয়ে যেভাবে খুশী, সেভাবে চৌম্বক প্রবাহ করা যায়! সেই ম্যাগনেট গান দিয়ে তুমি তড়িৎ প্রবাহের সাথে সমকোনে চৌম্বকপ্রবাহ ঘটালে।
এই ছবিটা একটু দেখো, ততোক্ষনে আমি মাথাটা চুলকে নেই একটু!
একটা পাতের ভেতর দিয়ে যখন কারেন্ট আচ্ছে, তার বিপরীত দিকে অবশ্যই ইলেক্ট্রন যাচ্ছে। এখন তুমি দুম করে চৌম্বক বল মেরে দিলে ৯০ ডিগ্রী বরাবর। ফলে লরেঞ্জ বলের ধাক্কায় ইলেক্ট্রন গুলো দিশেহারা হয়ে ফ্লেমিং কাক্কুর হাতের দিকে তাকিয়ে বুড়ো আঙ্গুল বরাবর দৌড় দিবে। নিচের ছবিটা চোখ-মুখ বড় করে তাকিয়ে দেখো তো একটু –
বড় করে দেখতেঃ এখানে ক্লিকাও
দেখো, উপরে আর নিচে বাম হাতের বুড়ো আঙ্গুল যেদিকে যায় সেদিক বরাবর যাওয়ার কারণে উপরে নেগেটিভ চার্জ, আর নিচে পজিটিভ চার্জ জমা হয়েছে।
এক্ষন, এই বেসিক জিনিসটা হয়তো আমাদের জানা আছে, যে উচ্চ বিভব থেকে কারেন্ট নিম্ন বিভবের দিকে যায়। তাহলে ইলেক্ট্রন এর প্রবাহ হবে নিম্ন থেকে উচ্চ বিভবের দিকে, এই ছবিটা দেখো –
তাহলে, হল ক্রিয়ার ছবিটার দিকে আবার তাকাও। দেখো, পজিটিভ চার্জ গুলো নিচের দিকে, আর নেগেটিভ চার্জ গুলো উপরের দিকে জমা হওয়ায় একটা বিভব পার্থক্যের সৃষ্টি হবার কথা (নেগেটিভ চার্জগুলো উপরে জমা হওয়াটাই মুল কারণ), তাইনা? আসলেই হবে। আর, বিভব পার্থক্যের কারণেই কারেন্ট প্রবাহিত হয়, ফলে পাতের নিচে থেকে উপরের দিকে কারেন্ট প্রবাহিত হবে কিংবা বলা যায় উপর থেকে নিচের দিকে ইলেক্ট্রন এগিয়ে আসবে।
এখন একটা জিনিস চিন্তা করো তো! লরেঞ্জ বলের ধাক্কাতে ইলেক্ট্রন গুলো উপরে উঠেছিলো, বিভব পার্থক্যের দরুন নিচে নেমে আসছে। শেষ পর্যন্ত আসলে হবেটা কি?
বোঝাই যাচ্ছে, যেটার পরিমান বেশী হবে, ইলেক্ট্রন সেদিকেই যাবে। নায়িকার এক হাত নায়কের হাতে, আরেকহাত ভিলেনের হাতে। যার শক্তি বেশী, তার দিকেই যাবে নায়িকা। নায়ক (লরেঞ্জ বল) আর ভিলেন (বিভব পার্থক্যের জন্য নিচে ছুটে আসার বল) সমান হলে, নায়িকা (ইলেক্ট্রন) স্থির থাকে, এটা হলো সাম্যাবস্থা।
সংক্ষেপে (!!), এটাই হলো হল ক্রিয়া। ভবিষ্যতে ইচ্ছে আছে, টর্ক নিয়ে লেখার। আগে দেখি, কি পরিমান পিটুনি অপেক্ষা করছে আমার জন্য!
(পুর্বে ফেবুতে প্রকাশিত। টার্মটা শেষ হোক, লেখার ইচ্ছে আছে আরও। জয় হোক ফিজিক্সের !!! )
ভালা পাইলাম, একটু সময় করে নিয়মিত লিখলে কিন্তুক মানুষজন বই বাদ দিয়ে এখান থেকেই পড়তে আসবে……
দারুণ! 😀
অনেক চমৎকার।
(Y)
দারুণ!
এত সহজবোধ্য ভাবে পড়ালে পিচ্চিরা ভয় পাবে না, পড়তে গিয়ে ঘুমাবে না!
অন্যরকম ধ্রুব অরফে ধ্রুব আরাফাত যেই প্যারালাল টেক্সট এর কথা বলতেছে সেটাতে যুক্ত করা যাইতে পারে
একটা খটকা আছে। উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়া শিক্ষার্থীদেরকে যে হারে পিচ্চি বানানো হচ্ছে, তাতে তারা উচ্চ-মাধ্যমিকভাবে রাগ করার সম্ভাবনা আছে।
:haturi:
হাহা
পড়ে ফেলেছি আগেই। 😀
অলটারনেটিভ লার্নিং। ছাত্রছাত্রীদের দোরগোঁড়ায় ইন্টারনেট পৌছে যাবার সাথে সাথে এভাবে সহজবোধ্য বিজ্ঞান পৌছে যাওয়া জরুরী।
সরবে এ ধরনের একখানা পড়ার কর্ণার থাকা যেতে পারে। যেখানে আমাদের উদীয়মান উচ্চ-মাধ্যমিক শিক্ষার্থী সমাজ গিয়ে কিছুটা পড়াশুনা করতে পারেন। আর আমরা বুড়োরা গিয়ে কিছুটা জ্ঞান ঝেড়ে আসার সুবর্ণ সুযোগ পেতে পারি।
দারূণ!!!
চলুক………
শুধু শুধুই তুই মেডিতে পড়তেছিস।
আচ্ছা যাক, পড়ছিস যখন তখন কী আর করা? কিন্তু মাঝে মাঝে তো এমন সহজ করে গুছিয়ে একটু লিখতে পারিস, পারিস না? 🙁