এক ব্যাগ রক্তঃ আমাদের জীবনের গল্প

আমার ১৮ তম জন্মদিন। আব্বু আমাকে ধরে নিয়ে গেলেন কোয়ান্টামে, জীবনের ১৮ তম জন্মদিন রক্ত দিয়ে স্মরনীয় করে রাখতে, যদিও আমার বিশ্বাস সেই ছোটবেলা থেকে মশাদেরকে নিয়মিত রক্ত দিয়ে আসার ফলে নতুন করে আর কিছু স্মরণীয় করে রাখবার নেই!
যাই হোক, গেলাম লাফাতে লাফাতে! তবে যতই ভাব দেখাই, সুঁচকে ভয় পাইনা এটা বললে মিথ্যে বলা হবে! তবু সাহসে ভর করে গেলাম, যতনা রক্ত দেবার ইচ্ছেয় তার থেকে বেশি বাহাদুরি দেখাবার আশায়! ৮ মিনিট কিংবা আরও কম সময়ে রক্তের ব্যাগটা ভর্তি হয়ে গেলো। বিশাল ধরণের একটা ভাব আসলো, তখনও এফবি আসেনি বলে আর স্ট্যাটাসটা দেয়া হলো না! তবু পরবর্তী একটা মাস সবার সাথে দেখা হলেই…
-রক্ত দিয়েছিস? কি??? দিস নাই!! আয় হায়!! খুব সহজ, দিয়ে দে……
এইসব হাবিজাবি! তিনমাস পর পরই রক্ত দেয়া যায়, তবে আমাদের স্বাস্থ্য আবার বিশাল ধরণের ভালো (!) দেখে আরো ১ মাস সেফটি ধরে ৪ মাস পরপর রক্ত দেবার কথা বলা হয়। কিভাবে কিভাবে জানি ৩ বার দেয়া হতে গেলো! আজীবন রক্তদাতা সম্মাননা পেলাম! জীবনে খুব বেশি স্বীকৃতি পাইনি কাজের। (বদমাইশির জন্য অহরহই পেয়েছি, কিন্তু ওটা তো স্বীকৃতি হয় না! ধোলাই হয়!) কেমন জানি একটা ভালোলাগা এলো, –
“নারে কিছু একটা মনে হয় করেছি…”
খুব আগ্রহ নিয়ে বন্ধু বান্ধবকে বলতাম, “চল যাই, রক্ত দিয়ে আসি! খাওয়াবোনে রক্ত দিলে!” হয়তো সংখ্যাটা খুব অল্প তবু এই এতোগুলো বছর মোট তিনজন অসাধারণ মানুষকে ধরে নিয়ে যেতে পেরেছি এবং বলা বাহুল্য তাদের কাউকেই খাবারের লোভ দেখাতে হয় নি!
কী করে কী করে জানি ১০ বার রক্ত দেওয়া হয়ে গেলো, আরেকটা মাইলফলক! এবার নাকি একটা রূপার মেডেল দিবে! মহা উৎসাহে প্রেসক্লাবের অনুষ্ঠানের দিন গেলাম, আমার মতো আরো অনেক মানুষ, এমনকি কিছু ‘দিনে এনে, দিনে খাওয়া’ মানুষও, কোন টাকার বিনিময়ে না, শুধু মানবতার তাগিদে রক্ত দিয়ে এসেছেন যারা! ছোট্ট একটা মেয়েকে দেখলাম একটা চেয়ারে চুপ করে বসে আছে আলাদাভাবে। ভেবে পাচ্ছিলাম না, এতো পিচ্চি একজনকে এখানে কেন এনেছে? অনুষ্ঠানের একটা পর্যায়ে মেয়েটা স্টেজে এলো,
“আপনারা কেউ আমাকে চিনেন না, কিন্তু আমি আপনাদের সবাইকে চিনি” অবাক হয়ে শুনছিলাম, “এই আপনাদের জন্যই আমি আজো নিঃশ্বাস নিতে পারছি, এখনো মা বলে ডাকতে পারছি, প্রতি দুই মাসে আমার এক ব্যাগ করে রক্ত লাগে, যখন রক্তের দরকার হয় তখন শরীরটা খুব খারাপ হয়ে যায়, আমি নিঃশ্বাস নিতে পারি না, খুব কষ্ট হয়” অডিটোরিয়ামে পিনপতন নিস্তব্ধতা…
“আমার মা আমার গায়ে হাত বুলায়ে দিতো আর বলতো সব ঠিক হয়ে যাবে, আমি ভাবতাম কিছুই ঠিক হবে না, আমার গরীব বাবা এতো টাকা দিয়ে রক্ত কিনবে কি করে?? কিন্তু এই আপনারা আমাকে আবার বাঁচতে দিয়েছেন, আপনাদের কারণে আর এখানকার মানুষের জন্যই আমি ন্যূনতম খরচে প্রয়োজনীয় রক্তটা পাচ্ছি, আপনাদের জন্যই, যেদিন আপনারা রক্ত দেয়া বন্ধ করে দিবেন, সেদিন আর আমি থাকবো না…”
হলভর্তি যেসব মানুষ সেদিন চোখ মুছেছিলো আমি তাদের মধ্যে ছিলাম না, আমি চোখ মুছতে পারিনি, টপটপ করে লোনা জল গড়িয়ে পড়ছিলো চোখ বেয়ে। কী ভয়ঙ্কর কথাগুলো, কী অবলীলায় মেয়েটি বলে গেল! সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেছিলাম, আমার মতো একটা সাধারণ মানুষের সামান্য রক্তের কারণে যদি একটা ফুটফুটে শিশু বেঁচে যায় তবে অন্তত সেটুকু করতে পারার ক্ষমতা যেন আমার থাকে।
প্রতিবার রক্ত দেবার পর রক্তের ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে মনে হয়, জীবনে আর কিছু না হোক, একটা কিছু তো করলাম…

Ryan
(রায়ানের মতো এমন হাজারো শিশু আছে বাংলাদেশে; ব্লাড ক্যান্সারে (লিউকেমিয়া) আক্রান্ত, তবুও খুশির খবর ৭০% ব্লাড ক্যান্সার এখন নিরাময়যোগ্য, শুধু সুযোগটা চাই)

মনের মাঝে অদ্ভুত সব চিন্তা খেলা করে, কল্পনা করতে ভালো লাগে, এই রক্তটুকু কোন এক মায়ের শরীরে বইছে, যে সুস্থ হয়ে উঠে তার শিশুর শরীরে নাক ডুবিয়ে বুক ভরে গন্ধ নিয়ে নতুন করে বেঁচে ওঠার আনন্দটা টের পাবে।
সেই রক্তটুকু বয়ে বেড়াবে কোন এক মুমূর্ষু পিতার শরীরে, যে আবার উঠে দাঁড়াবে তার প্রায় পথে বসে যাওয়া সংসারটা তুলে ধরতে।
বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়, সেই রক্তটুকুর কল্যাণে কোন এক শিশু বহুদিন বাঁচবার স্বপ্ন দেখবে, স্বপ্ন দেখবে কোন এক প্রিয় মানুষের সাথে সমুদ্রে ঢেউয়ে পা ভিজিয়ে দাঁড়াবার।
ভাবতে ভালো লাগে, এই বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের কারো না কারো শরীরে বইছে আমারই রক্ত। আমি তাকে কখনো দেখিনি, সে আমাকে কখনো চিনবে না, হয়তো কোন একদিন ভীড়ের মাঝে আমি তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাবো, কিন্তু কখনো জানবো না, আমরা দু’জন কোন এক অদ্ভুত বন্ধনে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা, তার প্রতিটি কোষে কোষে ছুটে বেড়াচ্ছে অসংখ্য রক্তকণিকা আর নীরবে বলে যাচ্ছেঃ “ভালো থেকো, ভালো থেকো……”
আমি বিশ্বাস করতাম না, কিন্তু এখন জানি, মানুষের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিতে হবে সবাইকে এমন কোন প্রয়োজন নেই, শুধু প্রয়োজন নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে নিজের কর্তব্যটুকু করে যাওয়া, শুধু প্রয়োজন একটুকরো সাহসের। রক্ত দেবার মতো এতো সহজ কিন্তু ভয়ঙ্কর রকমের ভালো কাজ খুব কমই আছে, বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি…
আসুন না, একটা স্বপ্ন দেখি…
“একটি স্বপ্ন, একজন মানুষ, একটা পরিবার, অনেকগুলো জীবনকে বাঁচাবার।”

blood-donation-roses-small-57708

নিস্তব্ধ শৈশব সম্পর্কে

জন্মেছি যখন মানুষ হয়ে, লড়ে যাবো ভালোর হয়ে, এক নতুন ভোরের অপেক্ষায়...
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে ইতিবাচক, উদ্যোগ, চিন্তাভাবনা, সচেতনতা-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

27 Responses to এক ব্যাগ রক্তঃ আমাদের জীবনের গল্প

  1. স্বপ্ন বিলাস বলেছেনঃ

    “একটি স্বপ্ন, একজন মানুষ, একটা পরিবার, অনেকগুলো জীবনকে বাঁচাবার।”

    এখন রক্ত দিয়ে এসেই চিন্তা করতে থাকি,কবে আবার সাড়ে তিনমাস হবে,আবার রক্ত দিবো। রক্ত দিতে চারমাস অপেক্ষা করতে ইচ্ছা করে না। তিনমাস পরে গেলে আবার নেয় না,তাই সাড়ে তিনমাস পর পরই দৌড় দেই। কি যে আনন্দ!!! এক ব্যাগ রক্ত থেকে তিনটা উপাদান আলাদা করে তিনজনকে দেয়া যায়। এক ব্যাগ রক্ত দিলেই মনে হয়,হয়ত তিনটা মানুষের জীবন বাঁচাতে সাহায্য করবে এই এক ব্যাগ রক্ত………মনে হয় কিছু একটা করছি মানুষের জন্য…… 😀 😀

    @শৈশবঃতোকে অনেক ধন্যবাদ আমাকে প্রথম রক্ত দিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য……… :huzur:

  2. মাসরুর বলেছেনঃ

    প্রথমবার রক্ত যখন দিতে গিয়েছিলাম, কিছুটা ভড়কে গিয়েছিলাম। আমার ধমনীগুলো এত স্পষ্টভাবে জালের মত দেখা যাচ্ছিল দেখে নার্সও দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলেন কোথায় সূঁচ ফোটাবেন। 😆
    তবে রক্ত দেওয়ার পরে আমাকে এক শিশুতোষ আনন্দ পেয়ে বসলো। মনে হচ্ছিল, আমার দেওয়া রক্ত হয়তো কোনো মুমূর্ষু মানুষের জীবন বাঁচাবে, সে মানুষটিও একদিন বড় কোনো ভূমিকা রাখবে।

    খুবই ভালো লাগলো পড়ে..:dhisya:

  3. শিশিরকণা বলেছেনঃ

    খুবই ভালো লাগলো পড়ে…. :dhisya:
    শৈশবকে অনেক ধন্যবাদ এরকম একটি লিখা লিখার জন্য …. :clappinghands:

  4. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    আমাকে যে মানুষটি প্রথমবার রক্ত দিতে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো, তাকে কৃতজ্ঞতা। বন্ধু তুই এমন আরো ভালো সব কাজে আরো অনেক অনেক মানুষকে জাগিয়ে তোল, তাদের ঘুম ভাঙিয়ে দে, আমি প্রার্থনা করি। 🙂

    প্রথমবার লেখাটা ফোনে শুনে যেমন চোখ ছাপিয়ে জল এসেছিলো, এখানে আরেকবার পড়ার পর সেই জলটাকে তবু আটকে রাখতে পারলাম না। এই ছোট ছোট স্বপ্ন, কিছু মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা যে খুব কঠিন কোন কাজ নয়, তা আমি নিজে বুঝেছি। আশা করি এই লেখাটা যারা পড়বে তারাও এই সরল সত্যিটা বুঝতে পারবে। 🙂

  5. সামিরা বলেছেনঃ

    লেখাটা ছুঁয়ে গেলো।
    শুধু রক্ত দিতে পারি যাতে সেজন্যই মনে হচ্ছে খাওয়া-দাওয়া করে ওজনটা ঠিক করা দরকার! 🙁

  6. মুবিন বলেছেনঃ

    রক্ত দেবার মতো এতো সহজ কিন্তু ভয়ঙ্কর রকমের ভালো কাজ খুব কমই আছে, বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি…
    আসুন না, একটা স্বপ্ন দেখি…
    “একটি স্বপ্ন, একজন মানুষ, একটা পরিবার, অনেকগুলো জীবনকে বাঁচাবার।”

    এত চমৎকার একটা লেখা উপহার দেবার জন্য লেখককে অসংখ্য ধন্যবাদ।

  7. সাথী বলেছেনঃ

    অনেক অনেক ভাল লেগেছেরে তোর লিখাটা………!! চোখ বেয়ে পানি চলে আসলো… আর মনে হচ্ছে কবে আমি রক্ত দিতে পারব……??!! ইচ্ছে হচ্ছে আমার ওজন যাই আছে তা নিয়েই আমি আজকেই রক্ত দিয়ে আসি ! যথা সম্ভব চেষ্টা করবো খুব তারাতারি ওজনটা বারিয়ে যতো তারাতারি সম্ভব রক্ত দিতে………

  8. অক্ষর বলেছেনঃ

    আমিও ২ বার রক্ত দিয়েছি, :yahooo: আবার দিবো :love:

  9. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    এইটা একটা অসামান্য লেখা! বার বার পড়া যায়!

  10. রাইয়্যান বলেছেনঃ

    আমি ২বার ব্লাড দিসি, নিয়মিত দেয়ার ইচ্ছা আছে ইনশাল্লাহ 🙂

  11. তিষা বলেছেনঃ

    আমি ৫ বার রক্ত দিয়েছি। দেয়ার পর অনেক অনেক ভালো লাগে। কি অসাধারণ অনুভূতি বলে বোঝাতে পারব না! :yahooo:

    অনেক ভালো লাগলো লেখাটা। :love:

  12. ইঁদুর বলেছেনঃ

    সুন্দর লাগল লেখাটা। ৪ বার রক্ত দিয়েছি। শেষবারের পর ৪ মাস বোধহয় পুরতে চলছে।:)

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।